#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ২৯
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
জীবন বড় ক্ষুদ্র।এই ক্ষুদ্র জীবনে কতোকিছু হয়।তবুও মানুষদের টিকে থাকতে হয়।বাঁচার লড়াইয়ে জিততে হয়।আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।
সাদা শুভ্র দেয়াল এপাশ ওপাশ।সাদা ড্রেস পরিহিত নার্স হাতে ট্রে হাতে হেটে চলছে গন্তব্যে।কেউ বাঁচতে আসে আর কেউ মৃত্যু কে আলিঙ্গন করতে।
হাসপাতালের বাতাস এই জন্যই বুঝি ভারী থাকে।মৃত মানুষের শেষ নিঃশ্বাস যে ঘুড়ে বেরায় সেখানে।তীব্র ভারী নিঃশ্বাস।
ওয়েটিং সীট এ পাশাপাশি বসে আছে আজরাহান আর মারশিয়াদ।থমথমে নিস্তব্ধতা।কারো মুখে কোনো কথা নেই।গাঢ় নিঃশ্বাস এর আওয়াজ শুধু বাতাস ভারী করে তুলছে।মাথাটা সোজা করে দেয়ালে হেলান দেয় মারশিয়াদ।আজরাহান এর নিস্প্রভ চোখ ওর পায়ের কাছে নিবদ্ধ।চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোটা অশ্রুজল।মৌনতা কোনো সমাধান নয়।কিছু জানতে হলে তার জন্য প্রশ্ন অবশম্ভাবী।শান্ত গলায় এক শীতলতা নিয়ে আজরাহান বলল–
“কেনো করলি তুই এমন!!বদলা নিলি আমার উপর!!!
মারশিয়াদ গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে।আহত গলায় বলল–
“আমি ভাবতেও পারিনি এমন কিছু হবে।আমি সানায়া কে কখনো ওই নজরে দেখেনি না কখনো আমি ওর সাথে তেমন কোনো আচরণ করেছি যাতে করে ওর মনে হতে পারে আমি…..।”
আজরাহান ক্ষীপ্র গতিতে উঠে মারশিয়াদ এর শার্ট চেপে ধরে।ক্রুর কন্ঠে বলল–
“কী জানিস না তুই!!কোনো মেয়ে তোকে ভালোবাসে আর তুই তা জানিস না!
আজরাহান দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে আবার বলল–
“হাউ ফানি!!!
বদলা নিলি তুই আমার উপর!!প্রহর এর জন্য তুই আমার বোনকে বলি দিলি।”
মারশিয়াদ আজরাহান এর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ক্রোধিত গলায় বলল–
“ছাড় বলছি।কী বলছিস এইসব!!এইসব এর মধ্যে একদম রেড চিলি কে আনবি না।”
আজরাহান ধীরে ধীরে অধর প্রসারিত করতে থাকে।মৃদু হাসির আওয়াজ ধীরে ধীরে তার তীব্রতা বাড়াতে থাকে।স্বল্পসময়ের ব্যবধানে আজরাহান উন্মাদ এর মতো হাসতে থাকে।ওদের চেঁচামেচি তে সেখানে একটা জটলা তৈরি হয়।আজরাহান হাসি থামিয়ে দাম্ভিক গলায় বলল–
“রেড চিলি!রেড চিলি তোর!!
তোর রেড চিলির জন্য তুই আমার বোনের জীবন নিতে চেয়েছিস!!
মারশিয়াদ শান্ত গলায় বলল–
“আমি মানছি যা হয়েছে ঠিক হয়নি।কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কিছুই জানতাম না।সানায়া আমাকে পছন্দ করে এইটা তো আমি ভাবতেও পারিনি।”
আজরাহান আবারো দ্রুত পায়ে এসে মারশিয়াদ এর গলা চেপে ধরে।কর্কশ গলায় বলল–
“রক্তের সম্পর্কের পরে যদি কোনো সম্পর্ক আপন থাকে তা হলো বন্ধুত্ব।বন্ধু হলো জীবনের সেই অমূল্য সম্পদ যা কোটি টাকার বিনিময়েও পাওয়া যায় না।বন্ধু হলো বুকের বা’পাশের সেই অংশ যা আমরা চাইলেও ভাগ করতে পারি।
নিস্তব্ধ রাস্তায় যখন ওই চাঁদও আমাদের পাশে দাড়ানো ছেড়ে দেয় তখন ছায়া হয়ে পাশে দাড়ায় বন্ধু।পাড়ার মোড়ে দাড়িয়ে সিগারেট এ সুখটান দেওয়ার আগে দশবার ভাবতে হয় এই বুঝি বাবা এলো!!
কিন্তু সাথে একজন বন্ধু থাকলে অনায়াসে তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বাবার সুপুত্র সাজা যায়।ভালোবাসার মানুষকে মুখ ফুটে ভালোবাসি বলার জন্য যখন লাগাতার স্কুল,কলেজ,রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় তখন সে নিঃসঙ্গ বিষাক্ত সময় কাটানোর জন্য বন্ধুর প্রয়োজন হয়।
আমি তোর জন্য আমার রক্তের সম্পর্কের সাথে লড়েছি।আর সেই তুই কি না আমার প্রান এ হাত দিয়েছিস!!আমার বোনকে মৃত্যু মুখে পতিত করেছিস।”
নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে মারশিয়াদ।চোখে জল ভরে আসে।অক্ষিপুট ভিজে উঠে।অস্ফুটভাবে বলল–
“আজরাহান প্লিজ আমার কথা শোন।”
“তোর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।তোকে আমি….।”
দীপ্ত পায়ে সেখানে এসে দাড়ায় ইনশিরাহ।মারশিয়াদ এর গলা থেকে হাত সরায় আজরাহান এর।রুষ্ট আওয়াজ তুলে কন্ঠে।বলল—
“একদম হাত দিবে না ওর গায়ে।কী ভাবো নিজেকে তুমি!!
আজরাহান কঠোর গলায় বলল–
“একদম আমাদের মাঝে আসবে না শিরনি।ওর জন্য আমার বোন….।”
ইনশিরাহ চিৎকার দিয়ে শক্ত গলায় বলল–
“সানায়া যেমন তোমার বোন জান তেমন আমার ভাই।আর আমার ভাইকে আর একটা বাজে কথাও বলবে না তুমি।”
চোখের পল্লব ছড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আজরাহান,আশফিক।আজরাহান ছোট্ট ঢোক গিলে নরম গলায় বলল–
“মারশিয়াদ তোমার ভাই!!!
“হ্যাঁ।”
আজরাহান দুবোর্ধ্য হাসে।ভারী কন্ঠে বলল–
“সে যাই হোক।কে কার ভাই কে কার বোন তাতে আমার কিছু যায় আসে না।তবে আমার বোনের যদি কিছু হয় আমি তোমাদের কাউকে ছাড়বো না।”
ইনশিরাহ শ্বাসরুদ্ধ কর গলায় বলল–
“তোমার বোনকে যেমন ভালোবাসে আমার ভাইকেও আমি তেমন ভালোবাসি।সানায়ার সাথে যা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি।কিন্তু তাতে জান এর কোনো দোষ নেই।তুমি আর একবারও জান এর দিকে আঙ্গুল তুলবে না।”
আজরাহান দীপ্ত হাসে।গম্ভীর গলায় বলল—
“ভাইয়ের জন্য মায়া হচ্ছে!!আর আমার বোন!!ও যে মরতে বসেছে তার কী হবে!!
“সানায়া যা করেছে ওটা স্রেপ ওর বোকামি।জান কখনো ওর সাথে এমন কোনো আচরণ করেনি।””
“ভুল তো আমি করেছি।তোদের মতো কালসাপ কে আমার বাড়িতে আসতে দিয়েছি।”
ঝাঁঝালো গলায় ইনশিরাহ বলল–
“জাস্ট শাট আপ।অকৃতজ্ঞ তো তুমি।স্বার্থ হাসিল শেষ এখন আমার ভাই কে কালসাপ মনে হচ্ছে।কতটুকু জানো তুমি জান সম্পর্কে !!
আমাদের চোখ তো আয়না।যতটুকু বাইরে থেকে দেখি ঠিক ততটুকুর প্রতিফলন ঘটে।জান তোমার জন্য…।”
ইনশিরাহ কে থামাতেই মারশিয়াদ ব্যগ্র গলায় বলল–
“স্টপ দিস শিরা।প্লিজ।”
ইনশিরাহ ভেজা গলায় বলল–
“কেনো চুপ করবো আমি!!
কেনো তুমি নিজেকে ছোট করবে সবার সামনে!!যেখানে তোমার কোনো দোষই নেই।”
ততক্ষনে পুরো হসপিটাল এর লোক জড়ো হয়ে গেছে।আশফিক কোনোমতে আজরাহান কে নিয়ে যায়।কিন্তু ওর ক্রোধ বিন্দুমাত্র কমেনি।
,
,
,
দু ঘন্টা হয়েছে সানায়া কে কেবিনে শিফট করেছে।কেবিন জুড়ে নিস্তব্ধতা।ফিনাইল এর কড়া গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে।দেয়াল জুড়ে শুভ্রতা।কিন্তু সেখানে বসে থাকা তিনজন পুরুষের চোখে অগ্নিলোচন।কোনো শব্দ ছাড়াই বাতাস ভারী হয়ে আসছে তাদের নিঃশ্বাসে।এসির ভনভন আওয়াজ এক ভয়ংকর সুর তুলছে।সাদা রঙের জানালার পর্দাগুলোও যেনো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।কোনু ছন্দপতন নেই তাদের।গুমোট পরিবেশে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি।সানায়া নিশ্চল আর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্যে।
সানায়ার পাশেই চেয়ারে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আশফিক। একটু দুরেই বসে আছে সামান।অতিশয় শান্ত এবং স্থির মনের মানুষটির মনও আজ বিক্ষিপ্ত তার কলিজার ছোট বোনের এহেন কান্ডে।দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে আজরাহান।এক মুহুর্তেও জন্য মনে হয়েছিলো এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেলো!!
সেদিন আজরাহান প্রহর এর রুম থেকে বের হয়ে আসার পর ও সানায়া ঘরে যায়।বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলো সানায়া।হাতের রগ কেটে ফেলেছিলো।গলগল করে রক্ত ভেসে যায় সম্পূর্ন ফ্লোর।ক্ষীন শ্বাস চলছিলো সানায়ার।ওকে দেখেই আত্মচিৎকার দেয় প্রহর।করুন দৃষ্টিতে ভেজা অক্ষিপল্লব মেলে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে ছিলো সানায়।সানায়ার হাতের কাছে পড়েছিলো একটা আধ পোড়া ছবি।যা ছিলো মারশিয়াদ এর।
চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে সানায়ার।শান্ত এবং শীতল গলায় আশফিক বলল–
“কেনো করলি বোন এমন!!একবারও ভাবলি না আমাদের কথা!!
স্যালাইন চলছে সানায়ার।নিঃশ্বাস চলছে অতি ক্ষীন।হালকা উঠানামা করছে বুক।
সামান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।ওর রাগ হচ্ছে না অভিমান সে যানে না।কুহেলিকা আর সানোয়ার আহমেদ এর অবস্থাও ভালো না।
সামানের চোখ মুখে একরাশ হতাশা।বিক্ষিপ্ত নয়নে তাকিয়ে আছে সানায়ার দিকে।অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ সামান।যেকোন মুহূর্তে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার অসীম ক্ষমতাপ্রাপ্ত সে।যেনো তার শরীরে উষ্ণ লহুর বদলে শীতল জলধারা প্রবাহিত হয়।
আজরাহান তার বিপরীত।আশফিক এর কথা শেষ হতেই ফুঁসে উঠে আজরাহান।চোখ দুটো অরুনলোচন।যেনো অগ্নিশিখা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
তপ্ত গলায় বলল–
“কেনো ভাববে ও আমাদের কথা!!কে ও আমাদের!!আমরা তো ওর কেউ না।ওই মারশিয়াদ ই ওর সব।”
আশফিক ব্যস্ত হয়ে ধীর গলায় বলল–
“শান্ত হ আজরাহান।এইটা হসপিটাল।”
আজরাহান ফুসলে উঠে বলল—
“এতোই যখন মরায ইচ্ছে আমাকে বলতি।আমি নিজ হাতে মেরে দিতাম তোকে।”
আজরাহান কথা শেষ করেই সানায়ার সামনে এগিয়ে আসতেই সামান উঠে ওকে ধরে আটকায়।ধীর গলায় বলল–
“শান্ত হ আজরাহান।সানায়ার অবস্থা এখন এইসব শোনার নয়।ছেলেমানুষ।ভুল করে ফেলেছে।”
আজরাহান ঝপাৎ করে সামান কে জড়িয়ে ধরে।আর্দ্র গলায় বলল—
“দেখলে ভাইয়া,কতোটা স্বার্থপর ও।একবারও আমাদের কথা ভাবলো না।শুধু নিজের কথা ভাবলো।ওর কিছু হলে আমাদের কী হতো!!
আজরাহান সোজা হয়ে দাড়ায়।নরম আর ধরা গলায় আবার বলল–
“এই দুই হাতে ওকে কোলে নিয়েছি।এই পায়ের উপর রেখে ওকে হাটতে শিখিয়েছি।ওর কান্না সহ্য হতো না বলে কাঁধে নিয়ে সারাঘর দৌড়ে বেড়িয়েছি।আর ও কিনা একটা অজানা মানুষের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে চাইলো।এতোটা স্বার্থপর কী করে হলো ও!!
আজরাহান এর চোখের কোন বেয়ে টুপ টুপ করে অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে সানায়া।হাত নাড়া পড়তেই ক্যানালা বেয়ে রক্ত উঠে যায়।বিচলিত হয়ে উঠে আশফিক।শশব্যস্ত হয়ে বলল–
“কী করছিস তুই!!
কান্না বন্ধ কর।”
কম্পনরত কন্ঠে সানায় বলল–
“আই এম সরি ভাইয়া।আই এম রিয়েলী সরি।”
আজরাহান দৌড়ে এসে হাটু ভাজ করে বসে। সানায়ার হাত ধরে অনুনয় করে বলল–
“আর এমন করিস না বোন।তোর কিছু তোর ভাই বাঁচবে না।তুই যা চাস আমি এনে দিবো।তবুও এমন কাজ আর করিস না।দোহাই লাগে তোর।”
ঝমঝমিয়ে কাঁদতে থাকে সানায়া।
“আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।মৃত্যু কখনো মুক্তি আনে না।”
চলবে,,,