#জঠর
#পর্বঃ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
মগ্ন হয়ে উপন্যাস পড়ছে অর্হিতা। ‘চোখের বালি’ কেন যেন তার একটু বেশিই পছন্দ। বারকয়েক পড়েও যেন তৃপ্তি মেলে না। অর্হিতার জীবনেও অনেক চোখের বালি রয়েছে। সেখানে নতুন করে যোগ হলো ওই টাকার কুমির। উপুর হয়ে শুয়ে উপন্যাসে ধ্যান লাগিয়ে রেখেছে অর্হিতা। ছোটো ছোটো পায়ে তার পাশে পিউলী এসে দাঁড়িয়ে আছে তা অর্হিতা টের পায়নি। অর্হিতার খোলা চুলে পিউলীর হাতের স্পর্শেই সপ্রতিভ হয় সে। ক্ষুব্ধ চোখে পিউলী দেখেই বলল—
“তুমি! তুমি এখানে কেন?”
পিউলী গালভর্তি হেসে বলল—
“তোমার জন্য।”
পিউলীর হাতে একটা বক্স দেখতে পায় অর্হিতা। কন্ঠস্বরে নমনীয়তা এনে বলল—
“এইটা কী?”
“সরি গিফ্ট। পাপা তোমাকে সরি বলেছে।”
অর্হিতা তাচ্ছল্য চোখে চেয়ে কটাক্ষ গলায় বলল—
“তো! আমি কী করব?”
পিউলী শিয়র নত করে। অর্হিতার হঠাৎ করে কেন যেন মায়া লাগল। ওঠে বসে সে। দারাজ গলায় জিজ্ঞেস করল—
“তোমার পাপা কোথায়?”
পিউলী মিহি গলায় বলল—
“বাইরে।”
কটমট করে ওঠে অর্হিতা। থাপ্পড় মেরেছে নিজে আর মেয়েকে পাঠিয়েছে সরি বলতে! বেয়াদব লোক! অর্হিতা দৃঢ় গলায় বলল—
“যাও, তোমার পাপাকে ডেকে আনো।”
এক মুহুর্তেই সূর্য রশ্মিবিচছুরণ হলো পিউলীর ছোট্ট অধরে। দৌড়ে গিয়ে নায়েলকে নিয়ে আসে। কক্ষে ঢুকতেই নায়েলের ব্রীড়া দৃষ্টি। মেয়েটার গায়ে হাত তুলে ঠিক করেনি সে। পিউলী ঝলমলে গলায় বলল—
“পাপা এসেছে, মামুনি।”
কেন যেন এখন অর্হিতার মামুনি ডাকটায় রাগ হলো না। সমস্ত রাগ গিয়ে উপচে পড়ল নায়েলের গম্ভীর মুখটার দিকে। পা উঠিয়ে বিছানায় বসে অর্হিতা। উপন্যাসের বইটা হাতে নিয়েই চোখের সামনে ধরে। মেয়েটার ভাবগতি ঠিক ধরতে পারছে না নায়েল। পিউলী শঙ্কিত চোখে চাইল অর্হিতার দিকে। অর্হিতা গলা খাঁকরি দিয়ে বলল—
“সরি বলুন।”
পিউলী টুক করেই বাবার দিকে তাকাল। নায়েল বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল—
“সরি।”
“এভাবে নয়। হাঁটু মুড়ে বসে, তারপর বলবেন।”
পিউলীর বিমূঢ় চাহনি। নায়েলের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে কটকট করে তাকিয়ে থাকে। অসহায় মুখে বলে উঠে পিউলী—
“পাপা!”
নায়েলের বুকের কোণে ব্যবচ্ছেদ ঘটে। সে আর কিছু ভাবল না। চাপা ক্ষোভ নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বলল—
“সরি।”
অর্হিতা চোখের পাতা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট প্রশ্বস্ত করে। শুষ্ক গলায় বলল—
“শুনতে পাইনি। জোরে বলুন।”
ফোঁস করে দম ফেলল নায়েল। পূর্বেকার ন্যায় পিউলীর ভারাক্রান্ত স্বর—
“পাপা, মামুনি শুনতে পায়নি।”
নায়েল নাকের পাটা ফুলিয়ে দম আটকে বলল—
“সরিইই।”
অর্হিতা কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রন করে গাঢ় গলায় বলল—
“কারো ওপর চড়ে বসার সময় তো আপনার গলায় অনেক জোর থাকে। এখন নেই কেন?”
“একটু বারাবারি হয়ে যাচ্ছে না মিসেস অর্হিতা নায়েল আনসারী?”
অনুপলেই ধক করে ওঠে অর্হিতা বুকটা। এই মানুষটা তার স্বামী ভুলেই গিয়েছে সে। বই থেকে চোখ সরিয়ে নায়েলের দিকে এক পলক তাকাল। মেয়ের জন্য হাঁটু মুড়ে বসে পর্যন্ত গেল! আজব বাবা! চোখ সরায় অর্হিতা। নায়েল শক্তপোক্ত গলায় বলল—
“সঅঅঅরিইই।”
“ওকে। ডান। উঠুন, আর এখন যেতে পারেন। দ্বিতীয়বার আমার গায়ে হাত তুললে খবর আছে। যান এখন।”
“তুমি ক্ষমা করেছ পাপাকে, মামুনি?”
পিউলীর দিকে পূর্ণ নজরে তাকাল অর্হিতা। মেয়েটার চোখ দুটো ভারি সুন্দর! চেহারাটাও কী মায়াবী! কিন্তু ওকে দেখেই অর্হিতার মস্তিষ্ক আবার বিগড়ে গেল। খিটখিটে গলায় বলল—
“তোমার পাপা সরি বলেছে। আমি শুনেছি। এখন যাও। পরে জানিয়ে দেবো আমি ক্ষমা করব কি না।”
“আচ্ছা। এইটা নাও। তোমার সরি গিফ্ট।”
অর্হিতা আপত্তি করল না। পিউলীর হাত থেকে বক্সটা নিয়ে নেয় অর্হিতা। নায়েল ক্রোড়ে তুলে নিল পিউলীকে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে বিদুর চোখে চেয়ে রইল অর্হিতার দিকে। অর্হিতার মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না।
,
,
,
পিউলীর মুখের সামনে খাবার ধরে রেখেছে নায়েল। বাচ্চা মেয়েটা বাবার ওপর ভীষণ অভিমান করেছে। সেই হেতু সকাল থেকে না খেয়ে আছে পিউলী। নায়েলের আবেগ মিশ্রিত বিদুর কন্ঠ—
“খেয়ে নাও পিউ। পাপা সরি বলেছি তো।”
পিউলী খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কোমল সুরে মৌনতা ভেঙ্গে বলল—
“তুমি প্রমিজ করো আর কখনো মামুনিকে বকা দেবে না, মামুনিকে মারবে না। তুমি মামুনিকে মারলে আমিও আকাশের তারা হয়ে যাব। নিহি মামুনির মতো আর কখনো তোমার কাছে আসব না। তোমাকে পাপাও বলব না। আড়ি।”
নায়েলের চোখ ভরে আসে। আঁখি নিমীলিত হতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
নায়েল বদ্ধশ্বাসের দ্বার খোলে। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে কান ধরে আদুরে গলায় বলল—
“প্রমিজ করছি পাপা। আর কখনো মামুনিকে বকা দেবো না, মারবও না। এখন খেয়ে নাও মাই হার্ট। প্লিজ?”
পিউলী তার মাছের মতো মুখটা হা করতেই নায়েল প্রাণখোলা হাসে।
,
,
,
“তুমি যা করেছ তা একদম ঠিক করোনি নায়েল।”
নায়েল অনুতাপের সুরে বলল—
“আমি চাইনি বাবা। বাধ্য হয়েছি।”
নওশাদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন—
“এইটা জাহিলিয়াত যুগ নয়। টাকার বিনিময়ে মানুষ বেচাকেনা হবে! ”
নায়েল পূর্ণ চোখে তাকাল। নম্র গলায় বলল—
“আমার সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না। অর্হিতা কিছুতেই এই বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিল না। তার উপর ওর ওই নোংরা ভাই একটা আধ বুড়োর সাথে ওর বিয়ে দিতে চাইছিল। লাখ টাকার বিনিময়ে। তাই আমি….।”
নায়েলের কথা মাঝেই বলে উঠলেন নওশাদ সাহেব—
“তো, তুমিও তো তাই করেছ। টাকার বিনিময়ে কিনে এনেছ ওই মেয়েকে।”
নায়েল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। তার বাবা তাকে সামাজিক শিক্ষা ঠিক-ই দিয়েছে। কিন্তু উদ্ভুত অনেক পরিস্থিই মানুষকে বিবেক বিবর্জিত কাজ করতে বাধ্য করে। নায়েল মৃদু গলায় বলল—
“জানি। কিন্তু একবার ভাবো বাবা, যদি ওই লোকটার সাথে অর্হিতার বিয়ে হতো তাহলে কী হতো? মানছি আমি যা করেছি ঠিক করিনি। কিন্তু ওর ভাই, মামা-মামি যা করত তা কী ঠিক হতো?”
নওশাদ সাহেব সচেতন গলায় বললেন—
“তাহলে তুমি ওকে কেন সত্যিটা বলছ না? ও তোমাকে ঘৃণা করছে।”
“ইচ্ছে করে বলিনি। তাহলে ও ওর পরিবারকে আরও বেশি ঘৃণা করবে। পরিবার ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না বাবা।”
নওশাদ সাহেব বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আকাশে পূর্ণ প্রকাশিত চাঁদের ফিনকি আলো তার চোখে লাগল। তিনি সেই আলোয় নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেলেন! ভারী গলায় বললেন—
“ও তোমাকে ঘৃণা করলে পিউলীকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না।”
নায়েল নত স্বীকার করে বলল—
” আমার প্রতি অর্হিতার ঘৃণা আমাদের দুজনকে আলাদা রাখবে। পিউলী নিজ যোগ্যতায় অর্হিতার মনে জায়গা করে নেবে। পিউলীর যেমন অর্হিতাকে প্রয়োজন, তেমনই অর্হিতার আমাকে প্রয়োজন। ও আমাকে মেয়েকে সেফ রাখবে, আমি ওকে।”
“আর যদি লুবানা ফিরে আসে? তার আগেই যদি তোমার প্রতি অর্হিতার কোনো অনুভূতির তৈরি হয়?”
নায়েল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পরমুহূর্তে মিহি গলায় বলল—
“অর্হিতাকে আমি সব জানিয়ে রাখব। লুবানার ফিরে আসা নিয়ে ডক্টরাও সন্দিগ্ধ! তুমি জানো ওর অবস্থা কতটা ভয়ানক! ভাগ্যক্রমে সেদিন পিউলীর বেশিকিছু হয়নি। আর ওকে বাঁচাতে দেবদূত হয়ে এসেছিল অর্হিতা। ওর প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ। আমি যা করেছি ওর ভালোর জন্যই করেছি।”
“সমাজ বলে কথা আছে নায়েল? কতজনের মুখ আটকাবে তুমি?”
“বিয়েতে কারো সর্বনাশ হয়ে যায় না বাবা! আমি ওর কোনো ক্ষতি করছি না। আমি শুধু আমার মেয়ের সেফটি চাই। যার সাথে অর্হিতার বিয়ে ঠিক করেছে ওই লোক এর আগেও তিনবার বিয়ে করেছে। ব্রোথেলে রেগুলার আসা যাওয়া তার। এই যুগে স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না বাবা। পিউলীর জন্য বডিগার্ড, ন্যানি যাই- ই রাখি না কেন ওরা শুধু ততটুকুই করবে যতটুকু ওদের দায়িত্ব। টাকার কাছে তো আর জীবন বিলিয়ে দেবে না! কিন্তু আমার পিউলীর জন্য একটা ভরসার ছায়া প্রয়োজন। আর অর্হিতা হবে সেই ছায়া।”
নওশাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন—
“মেয়েটা বড্ড কঠিন নায়েল। ওর মনে জায়গা করা সহজবোধ্য কাজ নয়।”
“জানি। যা পাওয়া দুর্লভ, তার তেজ তত বেশি বাবা।অর্হিতাকে পুরো দুই মাস স্টাডি করেছি আমি। যেই মেয়ে ভিক্ষুককে বিশ টাকা দেওয়ার দরুণ পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরে, ভাবো তো আমার মেয়েকে একবার মেয়ে বলে মেনে নিলে ওর জন্য কী করতে পারে? তুমি আমাকে স্বার্থবাদী বলতে পারো বাবা। আমার পিউলীর জন্য আমাকে যা করতে হবে আমি করব। আমি করব বাবা।”
নায়েলের সিক্ত চোখের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইলেন নওশাদ সাহেব। যেন নিজেকে দেখলেন তিনি।
চলবে,,,