জঠর পর্বঃ৭

0
1959

#জঠর
#পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে দুপুর লগ্নে। সেই বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফিরেছে নায়েল। লুবানার অবস্থা দেখে আর কাজে মন বসাতে পারেনি নায়েল। লুবানার বেঁচে থাকা জরুরি। কারণ, সেই ই বলতে পারবে এই অ্যাকসিডেন্ট কে ঘটিয়েছে।

পিউলীর ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষছে নায়েল। পিউলীকে গোসল করিয়ে এনেছে। বিছানায় বসিয়ে তার চুল মুছে দিচ্ছে। পিউলী টুকটুক করে হাসছে। নায়েল শান্ত গলায় প্রশ্ন করে—

“পিউ, সেদিন লুবানা আনটি কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল?”

পিউলী চোখ পিটপিট করে। চোখের উপর পড়ে থাকা অগোছালো চুলগুলো হাতের তালুর সাহায্যে ঘষে সরিয়ে নেয়। আদুরে গলায় বলল—

“আঙ্কলের সাথে।”

নায়েল আগ্রহদীপ্ত হয়ে বলল—

“কোন আঙ্কল? তুমি চেনো তাকে? আর কখনো দেখেছিলে?”

পিউলী চুপ মেরে যায়। তার ছোট্ট মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে আদৌও সে ওই আগন্তুককে আগে কখনো দেখেছে কি না।
লুবানা সেদিন পিউলীকে শপিংমল নিয়ে যায়। আসার পথেই কার অ্যাকসিডেন্ট হয়।

পিউলী মাথা ঝাঁকায়। যার মানে সে মনে করতে পারছে না। হতাশ শ্বাস ফেলল নায়েল। দৈবাৎ কর্কশ স্বরে ফিরে তাকায় সে।

“এই যে মি. টাকার কুমির! শুনতে পাচ্ছেন?”

নায়েল ভ্রু-বিলাস করে। সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল—

“কিছু বলবেন?”

অর্হিতা পিউলীর দিকে তাকায়। একটা জিন্সের হাফ প্যান্ট আর গোলাপী,সাদার মিশেলে ফ্রক পরেছে পিউলী। অর্হিতাকে দেখে অধর ছড়িয়ে হাসে। অর্হিতা চোখ ফেরায়। মেয়েটার হাসি দেখলেই গলে যেতে ইচ্ছে করে!
চোয়াল শক্ত করে অর্হিতা। ঠান্ডা গলায় বলল—

“আমার ওয়াশরুমের ট্যাপ দিয়ে পানি আসছে না। একটু দেখবেন?”

নায়েল ঘুরে তাকায়। টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে পিউলীর চুল আচড়াতে থাকে। নিরুদ্বেগ গলায় বলল—

“কলরবকে বলুন। লোক এনে ঠিক করিয়ে দেবে।”

“কেন? আপনি ঠিক করতে পারেন না?”

অর্হিতার ঠেস মারা কন্ঠে নায়েল অপ্রস্তুত হয়। পিউলীকে বিছানার উপর থেকে কোলে নিয়ে বলল—

“চলুন। দেখছি।”

নায়েলের কক্ষের পাশেই পিউলীর কক্ষ। তার ডানদিকে অর্হিতার। অর্হিতার কক্ষের বারান্দা আর পিউলীর কক্ষের বারান্দা একই।
,
,
,
ট্যাপ খুলে ফেলেছে নায়েল। কিন্তু তার আগে ছাদে গিয়ে পানির লাইন বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। পিউ দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতার বিছানার উপর। উৎসুক নজরে চেয়ে আছে সে। ট্যাপের মুখে ময়লা জমে পানি আসতে বাঁধা দিচ্ছিল। অর্হিতা নায়েলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। নায়েল কী করছে তাই-ই দেখছে মনোযোগ দিয়ে। চকিতে ট্যাপের পাইপ দিয়ে দুর্দমনীয় জলস্রোত শুরু হয়। তা গিয়ে হানা দেয় নায়েলের চোখে। ছিটকে সরে আসে নায়েল। তড়িঘড়ি করে নায়েলকে সামলাতে গিয়ে তার উপর পড়ে যায় অর্হিতা। জলস্রোত সমান্তরালে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ছে। সেখান থেকে তাদের দুজনের শায়িত শরীরে। সেকেন্ডের ব্যবধানে এমন বিব্রতকর ঘটনা সম্মুখীন হবে তারা বুঝতেই পারেনি। অর্হিতার সম্পূর্ণ ভর নায়েলের বক্ষপুটে। বরফের মতো জমে গেছে অর্হিতা। হুটোপুটি করে উঠে দাড়ায়। ভিজে চুপচুপ দুই কপোত-কপোতী একে অন্যের দিকে তাকাতে পারছে না। নায়েলের স্যান্ডো গেঞ্জি ভিজে তার কায়া দৃশ্যমান। অর্হিতার অধর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। অপ্রস্তুত গলায় বলল—

“সসসসরি।”

নায়েল চোখ উঠাল না। তার মাথায় রাগ চেপেছে। পানির লাইন সে বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। তাহলে পানি এলো কোথা থেকে। নির্ঘাত কেউ ছেড়েছে!
নায়েল অনুতপ্তের সুরে বলল—

“সরি। আসলে আমি..।”

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে অর্হিতা। তাকে দেখে জ্যোতিহীন চোখে চাইল পিউলী। ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে জোর গলায় বলে উঠে নায়েল—

“পিউ, কলরব ভাইয়াকে ডেকে আনো। বলো পাপা ডাকছে।”

পিউলী ঝলমলে গলায় বলল—

“ওকে পাপা।”

বিছানা থেকে নেমেই ছুট লাগায় পিউলী। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতা। ভেজা শরীর দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। নায়েলের অবাধ্য চোখ গিয়ে আবদ্ধ হচ্ছে অর্হিতার ভেজা আঁখিপল্লবে। দীর্ঘ পল্লব ভিজে একে অপরকে জড়িয়ে আছে। মুখে জমে আছে পানি। তা চেপে চেপে মুছে নিচ্ছে অর্হিতা। তার ভেজা ওষ্ঠাধর ক্রমশ কম্পিত হচ্ছে। পরিস্থিতির অস্থিরতা কমাতে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকে নায়েল। হুড়োহুড়ি করে কক্ষে প্রবেশ করে কলরব। ওয়াশরুমের ভেতর দিকে উঁকি মারতেই নায়েল তর্জন গর্জন করে বলল—

“পানি ছেড়েছে কে?”

কলরব থতমত খেয়ে বলল—

“হৃতি ম্যাম বলল পানি আসছে না কল দিয়ে তাই ছাদে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি…।”

“লাই যখন বন্ধ তখন তোমার দুর্বল মস্তিষ্কে ঢুকেনি যে কেউ হয়তো বন্ধ করেছে। যাও,এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বন্ধ করে দিয়ে আসো। প্লাম্বারকে খবর দাও। গো ফাস্ট।”

“জি, জি স্যার।”

কলরব মুহূর্ত ব্যয় করল না।
,
,
,
নীলাভ্রের দিকে উদাসচিত্তে চেয়ে আছে অর্হিতা। শুভ্র, সতেজ জলদের লুকোচুরি খেলা। প্রভঞ্জনে মৃদু দোল। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে সে। এক পশলা বৃষ্টি হতেই ঝলমলে নীলাভ্রের বুক চিরে উড়ছে থোকা থোকা জলদ।

চকিতে বাড়ির সামনে কাউকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় অর্হিতা। টানটান চোখে চেয়ে বুঝতে পারল উক্ত ব্যক্তি আর অন্য কেউ নয় তার-ই ভাই অর্নিশ। অর্হিতা কাল বিলম্ব করে না। দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সেখানেই। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে হাঁটু মুড়ে পড়ে যায় অর্হিতা। তার আঙুলের ডগা ফেটে গিয়ে লহুর স্ফীত ধারা বইতে থাকে। অর্হিতার আর্ত চিৎকারে রান্নাঘর থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে কলরব। থমকে যায় সে। নায়েল তার বাবার ঘরেই ছিল। তারাও একে একে জড়ো হয়। ব্যথায় কাতরাতে থাকে অর্হিতা। দরজা দিয়ে হৃতির সাথে প্রবেশ করে পিউলী। অর্হিতাকে দেখেই জল ছলছল আঁখি তার। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে অস্থির। পিউলীর এই অবস্থায় নিজেকে ভুলে যায় অর্হিতা। হৃতি গম্ভীর গলায় বলে উঠে—

“বাইরে একটা লোক এসেছে। নায়েলের সাথে দেখা করতে চায়।”

নায়েল জানে কে এসেছে। তাই সে প্রতিক্রিয়াহীন। নায়েল অর্হিতার দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় প্রশ্ন করে—

“এভাবে ছুটছিলেন কেন? ট্রেন মিস হয়ে যাচ্ছে আপনার?”

অর্হিতা তার ব্যথা ভুলে গেল। টগবগে গলায় বলল—

“ভাইয়া কেন এসেছে আপনার কাছে?”

নিরুত্তর নায়েল। সকলের সামনে এক অদ্ভুত কাজ করে বসল সে। অর্হিতাকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে বলল—

“হৃতি, বাবার ঘর থেকে ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে এসো। পিউলী আমার সাথে এসো। কলরব গিয়ে বাইরে লোকটাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলো। আমি আসছি।”

অর্হিতা বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। আঁতকে ওঠে নায়েলের কলার খাঁমচে ধরেছে সে। নায়েলের সোজা দৃষ্টি। অর্হিতার ঘোর লাগা চাহনি নায়েলের গম্ভীর মুখে।
কক্ষে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া করে বসায় অর্হিতাকে। হৃতি ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসেছে। তাকে চলে যেতে বলে নায়েল। হৃতি একবার কঠিন চোখে তাকায় অর্হিতার দিকে। বিছানায় ওঠে বসে পিউলী। একদম অর্হিতার পায়ের কাছে। নায়েল তুলো দিয়ে প্রথমে রক্ত মুছে নেয়। পিউলী থেমে থেমে ফুঁ দিচ্ছে আর বলছে—

“মামুনি ব্যথা করছে?”

অর্হিতা জবাব দিলো না। সে অনিমেষ চেয়ে রইল নায়েলের দিকে। লোকটার মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই। স্বাভাবিক সে। ব্যান্ডেজ করে ক্ষান্ত হয় নায়েল। আর কোনো কথা না বলে পিউলীকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। অর্হিতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

ড্রয়িংরুমে বসে আছে অর্নিশ। নায়েল পিউলীকে নওশাদ সাহেবের কাছে যেতে বলল। কাউচের একপাশে বসেই প্রশ্ন ছুড়ে—-

“কেন এসেছেন?”

অর্নিশ মৃদু হাসল। মিইয়ে গলায় বলল—

“মানে, আসলে আমার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল।”

নায়েল ক্ষুব্ধ চোখে চাইতেই অর্নিশ অধৈর্য গলায় বলল—-

“আরে রাগ করবেন না। এইগুলো ধার হিসেবে নেবো। শোধ করে দেবো পরে। মাত্র তিনলাখ হলেই চলবে।”

সটান করে উঠে দাঁড়ায় নায়েল। ক্রোধিত গলায় বলল—

“গেট আইউ। আই সে গেট আউট।”

অপমানবোধ করল অর্নিশ। রুষ্ট গলায় বলল—

“দেখুন নায়েল….।”

“আমি আপনাকে যেতে বলেছি। পনেরো লাখ টাকা দিয়েছি আপনাকে। আবার কোন সাহসে এসেছেন? কেমন ভাই আপনি? শুধু অর্হিতা আমার কাছে সময় চেয়েছিল বলে। নাহলে একটা টাকাও পেতেন না আপনি। বের হোন এই বাড়ি থেকে। আর কখনো এখানে আসবেন না। জাস্ট লিভ…।”

ঢোক গিলল অর্নিশ। কন্ঠে চাপা রাগ। চোখ ভরা রোষ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here