জঠর পর্বঃ৮

0
1967

#জঠর
#পর্বঃ৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বিছানায় বসে খুটখুট করছে অর্হিতা। পায়ের আঙুলের ব্যথা বেড়েছে। কনকন করছে। পা গুটিয়ে নিয়ে আঙুলের মাথায় হাত ছোঁয়াল অতি সন্তর্পনে। ব্যথা যেন ক্রমশ তরতরিয়ে উপরে ওঠে আসছে!

ঘড়িতে তখন দশটা। ব্যথায় উলুথুলু নড়াচড়ায় বিছানার হাল বেগতিক। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে নায়েল। স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। তার কোলে পিউলী। চিলতে হাসি পিউলীর ছোট্ট লাল ঠোঁটে। মাকে দেখার উপচে পড়া খুশি। অর্হিতাকে কাতরাতে দেখে ভ্রুতে টান পড়ে নায়েলের। চোখের কোটরে বিস্ময় খেলিয়ে বলল—

“আপনি ঠিক আছেন?”

মুখ ঘুরিয়ে নেয় অর্হিতা। পিউলী মনমরা চোখে বাবার দিকে তাকায়। নায়েল নিরুত্তেজ। পিউলীকে বিছানার উপর দাড় করিয়ে বেডশীট টেনে যতটুকু গোছানো যায় ততটুকুই করল। যারপরনাই অবাক হয় অর্হিতা। এই লোকটা কী অদ্ভুত !

গজে রক্ত ভরে আছে। তাই দেখে অবিচলিত চোখে তাকায় নায়েল। বেডসাইড টেবিলে রাখা ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে পূনরায় ব্যান্ডেজ করে অর্হিতার পায়ে। আগের গজটা ঝুড়িতে ফেলতেই অর্হিতার শক্ত কণ্ঠে সপ্রতিভ হয় নায়েল।

“ভাইয়াকে টাকা কেন দিয়েছেন আপনি?”

নায়েলের নজর বিদ্ধ হয় পিউলীর ছোট্ট গলুমলু মুখে। শুষ্ক চোখে চেয়ে আছে সে। বাবার দিকে ছোড়া প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়।
নায়েল শান্ত গলায় বলল—

“পিউ, দাদুর কাছে যাও। পাপা আসছি।”

“ওকে পাপা। গুড নাইট মামুনি।”

পিউলীর দিকে তাকাল না অর্হিতা। তার শক্ত, কঠিন, স্থির দৃষ্টি নায়েলের দিকে। পিউলী বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে যায়। নায়েল অর্হিতার কাছে এসে দাঁড়ায়। একটু ঝুঁকে বিছানায় হাত রাখে। নায়েলের মুখটা এখন সেন্টিমিটার ভেদে অর্হিতার কাছে। মোলায়েম গলায় বলল—

“আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন।”

“আমি আপনার কাছে সময় চেয়েছি নায়েল।”

“এই সময়টা তো আমার কাছে নেই অর্হিতা। পিউর আপনাকে প্রয়োজন।”

নিজের অজান্তেই অর্হিতার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক অপ্রত্যাশিত কথা।

“আর আপনার?”

নিজের কথায় নিজেই অবাক হয় অর্হিতা। ডাসা ডাসা চোখে নায়েলের দিকে চাইতেই বিগলিত হাসে নায়েল। লোকটার হাসিতে মাধূর্যতা আছে। প্রথমদিন দেখা করতে গিয়েও এভাবেই হেসেছিল লোকটা। অধরের কোণে গহন হাসি। অর্হিতাকে চরম পর্যায়ে অবাক করে দিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—

” তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন।”

নায়েলের উষ্ণ নিঃশ্বাসে বিদ্যুৎ খেলে গেল অর্হিতার শীতল দেহপিঞ্জরে। থামল না নায়েল। পা চালিয়ে দরজার কাছে আসতেই অর্হিতার বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠ —

“আমার জায়গায় আপনি হলে সবটা মেনে নিতে পারতেন?”

অর্হিতার কথা কর্ণগোচর হতেই দৃঢ় হয় নায়েল। ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে উদাস হেসে বলল—

“হয়তো কখনো জানবেন আপনার বর্তমান জায়গায় আমি আরো আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছি।”

নায়েলের কথার মানে বুঝল না অর্হিতা। ভাবিত নয়নে অনিমেষ চেয়ে রইল সে। অর্হিতার বোধগম্য হলো না, তার চক্ষুদর্পণ থেকে অনেক আগেই লুপ্ত হয়ে গেছে নায়েল।
,
,
,
সবুজাভ কৃত্রিম বাতির মৃদু আলোকচ্ছটায় বসে আছে নায়েল। বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলিয়ে রেখেছে মাথা। তার মুদিত আঁখিযুগলে ভেসে উঠেছে অর্হিতার মিষ্টি মুখচ্ছবি। মেয়েটার শরীরের মিষ্টি গন্ধ তার দেহপিঞ্জরে আলোড়ন তুলেছে।

লুবানার সাথে নায়েলের বিয়েটা হঠাৎ করেই ঠিক করা হয়। নওশাদ সাহেব নিজের বন্ধুর মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে ঠিক করতে বেশি সময় নেননি। নায়েলও সম্মতি দেয়। নিহিতার হঠাৎ বিয়ে, ডিবোর্স, পিউলী এসবকিছুর মাঝে নায়েল নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারেনি কখনো। তাই বিয়েতে অসম্মতি হওয়ার কোনো যুতসই কারণ ছিল না। আর পিউলীর একজন মায়ের খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সহসা সবকিছু উলটাপালটা হয়ে গেল।

কিন্তু অর্হিতার প্রতি কিছু একটা অনুভব করে নায়েল যা লুবানার ক্ষেত্রে হয়নি। তবে এই অনুভূতির কোনো নাম নেই তার কাছে।
আচমকা চকমকে আলোর তীক্ষ্ম ফলা হানা দেয় নায়েলের চোখে। অমিলীত চোখে চাইতেই দেখল নওশাদ সাহেবের গম্ভীর, চিন্তিত আনন। নায়েল সোজা হয়ে বসে। হাতের মোবাইলটা বালিশের উপরে রেখে সতর্ক কণ্ঠে বলল—

“বাবা তুমি?”

নওশাদ সাহেব নৈঃশব্দে শ্বাস ফেললেন। সেই শ্বাসে ছিল তীব্র বিতৃষ্ণা। বিছানার উপর নিরুদ্বেগচিত্তে বসলেন। চোখের চশমাটা ঠিক করে নায়েলের দিকে চাইলেন। পড়ন্ত শ্বাসের সাথে বললেন—

“লুবানার বাবার সাথে দেখা হয়েছিল আজ।”

নায়েল অনুতপ্ত চোখে তাকাল। ভারী গলায় বলল—

“আমি তো চেষ্টা করছি বাবা। লুবানার অবস্থা ভালো না। আমি আমার চেষ্টার ত্রুটি রাখছি না।”

নওশাদ সাহেব দুঃখী গলায় বললেন—

“মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছে।”

নায়েলের বুক চিরে বেরিয়ে এলো হতাশ শ্বাস। সবকিছু এত জলদি ঘটে গেল সে কিছুই করতে পারেনি। নওশাদ সাহেব আচমকা সন্দিগ্ধ গলায় বললেন—

“অর্হিতা মেয়েটা বড্ড কঠিন। আমার মনে হয় ওকে সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিত তোমার।”

নায়েল কিছু সময় নীরব রইল। মৌনতার দ্বার ভেঙে বলল—

“হ্যাঁ। আমি দেখছি বাবা। অর্হিতাকে সবটা জানানোর চেষ্টা করব। কিন্তু…।”

থেমে গেল নায়েল। নওশাদ সাহেব উদগ্রীব চোখে চেয়ে বললেন—-

“কিন্তু কী?”

নায়েল কথা ঘুরাল। বলল—

“কিছু না। অনেক রাত হয়েছে। তুমি শুয়ে পড়ো গিয়ে। না হলে শরীর খারাপ করবে তোমার। ভরসা রাখো আমার ওপর। পিউলীর কোনো ক্ষতি হবে না।”

নওশাদ সাহেব ছেলের কথা মেনে নিলেও স্বস্তি পেলেন না। নীরবে ত্যাগ করলেন নায়েলের কক্ষ। যাওয়ার আগে বাতি নিভিয়ে গেলেন। নায়েল সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কাকে সন্দেহ করবে সে? কে হতে পারে? কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল লুবানা? সকল প্রশ্ন নায়েলের চোখের সামনে ঝিঝিপোকার মতো উড়তে লাগল। নিভুনিভু চোখে সেই আলোর ঝলকানিতে নায়েল দেখতে পেল অর্হিতাকে। হাসি ফুটে উঠল নায়েলের ব্যথাতুর চিন্তিত মনে। ঘুমের সাগরে হাতড়ে ঘুমের দেশেই তলিয়ে গেল সে। সাথে নিল একরাশ আশা।
,
,
,
দুইদিন চলে গেল প্রকৃতির নিয়মেই। অর্হিতার পায়ের ব্যথা অনেকটা কমে এসেছে। প্রকৃতির ধরাবাঁধা নিয়ম অনুযায়ী ক্ষত সেরে যায় তার আপন সময়ে।

খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও ছিল না অর্হিতা। মেয়েটার ভোরে ওঠার অভ্যাস কি না! তাই সকাল সকাল খেয়ে নিয়েছে।

সকালের নাশতায় যখন সকলে মশগুল সিঁড়ি বেয়ে নামছে অর্হিতা। গায়ে হলুদ রঙের থ্রিপিস। কাঁধে ঝোলানো হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বিনা দ্বিধায় হেঁটে যাচ্ছে। বাড়ির আরো কজন লোকের উৎসুক নজর যে তার গতিবিধিতে তাক করা তা অর্হিতা দৃষ্টিগোচর হলো না। নায়েলের রাশভারী কণ্ঠে থমকে যায় অর্হিতা।

“অর্হিতা! কোথায় যাচ্ছেন?”

অর্হিতার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নায়েল। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে সন্ধানী চোখে চেয়ে ফের প্রশ্ন করল—

“কোথায় যাচ্ছেন?”

অর্হিতা ভাবাবেশ ছাড়াই উত্তর করল।

“বাইরে।”

“আপনার তো ক্লাস নেই। পরীক্ষা তো শেষ। রেজাল্ট আসতে দেরি আছে।”

অর্হিতা কণ্ঠে রোষ নিয়ে বলল—

“তো? ভর্তি তো হতে হবে আমাকে তাই না! টিউশনি আছে আমার। গত এক সপ্তাহ এই বিয়ে- টিয়ের কারণে পড়াতে যেতে পারিনি আমি। স্টুডেন্টের মায়েরা লাগাতার কল করছে।”

নায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল—

“তাদেরকে বলুন আপনি আর পড়াবেন না।”

অর্হিতা চোখ ছোটো ছোটো করে তীক্ষ্ম চোখে তাকাল। ঠেস মেরে বলল—

“ভর্তি টাকা কী আপনি দেবেন?”

“দরকার হলে তাই।”

চকিতে অর্হিতার হাত চেপে ধরে নায়েল। তাকে টেনে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে যায়। পিউলী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বাবার অদ্ভুত কান্ড দেখল।

কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই অর্হিতা ধাক্কা মারে নায়েলকে। তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল—

” এমনি তো ভাজা মাছটা উলটে খেতে পারেন না। আর এখন..। গিরগিটি কোথাকার!”

নায়েল বিগলিত হাসে। চাপা গলায় বলল—

“আপনার মাস্টার্সে ভর্তির ব্যবস্থা আমি করব। আপনি তো বাইরে যেতে চেয়েছেন তাই না?”

অর্হিতা একটা চোখ ছোটো করে কেমন রহস্যঘন চাহনিতে দেখল নায়েলকে। ব্যাটার মতলবটা কী!
মুখ খুলল অর্হিতা। রয়ে সয়ে বলল—

“আপনি কেন টাকা দেবেন? আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিয়ে পারব।”

নায়েল ঝরা হাসল। অর্হিতা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নায়েলের হাসিতে রাগ হচ্ছে তার। নায়েল গলায শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে বলল—

“আমার নয়, আপনার টাকা। মোহরানার টাকা তো শোধ করা হয়নি! তাতে শুধু আপনার অধিকার। ওই টাকা দিয়েই না হয় ভর্তি হবেন। আপনার যখন “আপনার টাকায়’ পড়তে ইচ্ছে করছে।”

অর্হিতার মস্তিষ্ক তড়াক করে উঠল। কী বলতে চায় সে। একটা কিছু মাথায় প্রবেশ করতেই তেঁতে উঠে অর্হিতা। বলল—

“কী বলতে চান আপনি?”

নায়েল ধীরগতিতে এগিয়ে আসে অর্হিতার কাছে। তার শ্বাসের কাছে। অর্হিতার পূর্ণ নজর নায়েলের ভরাট পুরুষালী চেহারায়। কম্পিত হয় তার দেহ। পুরুষ অবয়বের এতটা সন্নিকটে সে আসেনি এর আগে। অর্হিতা চোখ সরায়। লজ্জায় কেঁপে ওঠে তার দীর্ঘ আঁখিপল্লব। দুষ্ট চাহনি নায়েলের। কন্ঠে সরসতা। অর্হিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল—

“আপনি যা বুঝেছেন তাই। এক সপ্তাহ তো হয়ে এলো বিয়ের! দহনক্রিয়ার আশেপাশে দাহ্যবস্তু থাকলে আগুন কিন্তু তাকে আপন করে নেবেই। মাইন্ড ইট অর্হিতা।”

“সরুন, এখান থেকে।”

খলখলিয়ে হেসে ওঠে নায়েল। অর্হিতাকে চমকিত করে তার কক্ষের দরজা বাইরে থেকে লক করে দেয় নায়েল। অর্হিতা রাগের প্রকাশ ঘটিয়ে বলল—

“নায়েল! নায়েল! দরজা খুলুন বলছি। ”

“এই দরজা এখন আর খুলবে না। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আমি অফিস থেকে এসে খুলব।”

“ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!”

“ওকে। আই এম রেডি ফর দ্যাট। বাই।”

অর্হিতার মাথায় চড়ে গেল রাগ। লোকটা আসলেই একটা কুমির, গিরগিটি! মেয়ের সামনে তো এমনভাব নেয় যেন ধবধবে তরল দুধ, কিন্তু পেছনে ডালমে কুছ কালা হ্যায়। বজ্জাত লোক!

সিঁড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে আছে পিউলী। তার কৌতূহলী দুই চোখ সিঁড়ি বেয়ে দপদপিয়ে নেমে আসা নায়েলের দিকে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—

“পাপা, তুমি মামুনিকে ঘরে বন্ধি করলে কেন?”

নায়েল এক ঝটকায় মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খায়। আদরমাখা স্বরে বলল—

“মামুনির পা তো এখনো ঠিক হয়নি প্রিন্সেস। তাই মামুনিকে বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না।”

“মামুনি তো রাগ করবে?”

“পাপা তোমাকে জোর করে দুধ ফিনিশ করাই তাই না? পাপার ওপর রাগ করো তুমি?”

পিউলী নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে না বোধক সম্মতি দেয়। স্মিতহাস্য অধরে বলল নায়েল—

“মামুনিও রাগ করবে না।”

ততক্ষণে পিউলীকে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এসেছে নায়েল। গাড়িতে বসাতেই পিউলী দুম করে প্রশ্ন করে বসে—

“পাপা, মামুনি দুপুরে খাবে না?”

ড্রাইভিং সিটে বসে নায়েল। স্বগতোক্তি করে বলল,” নিজের খাওয়ার তাড়া না থাকলেও মায়ের খাওয়া নিয়ে তৎপর সে।” চাপা হাসে নায়েল। সশব্দে বলল—

“ডোন্ট ওয়ারি পিউ। তোমার মামুনির খিদে লাগার আগেই আমরা ফটাফট চলে আসব।”

“প্লেন দিয়ে?”

” ইয়েস। উড়ে উড়ে।”

দন্তপাটি সমান্তরাল করে খলখলিয়ে হেসে ওঠে পিউলী। মেয়ের হাসিতে হৃষ্ট হয় নায়েলের অন্তঃকরণ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here