#জঠর
#পর্বঃ১৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
“মামুনি জানো ওই আঙ্কল না পঁচা জিনিস খায়। ছিঃ গন্ধ! ধোঁয়া, ধোঁয়া।”
অর্হিতা ভাবুক নয়নে তাকায়। তার বুঝতে বাকি নেই পিউলী কীসের কথা বলছে। আজকাল হৃতির ঘরে গেলে সিগারেটের উৎকট গন্ধ লাগে! পিউলী নিশ্চয়ই সুহাসকে সিগারেট খেতে দেখেছে।
“জানো মামুনি, তমাল ভাইয়াও খায়। কী পঁচা!”
“এসব বলে না। থাক, আর তুমি পাপাকে বলিয়ো না আঙ্কলের কথা। ঠিক আছে?”
“ওকে মামুনি।”
পিউলীকে কোলে তুলে নেয় অর্হিতা। নিচে এসে ডাইনিং চেয়ারে বসায়।
“তুমি বসো, মামুনি দুধ নিয়ে আসি।”
“হুম, হুম।”
অর্হিতা রান্নাঘরে গেলে পিউলী ডাইনিং চেয়ারে চিবুক লাগিয়ে বসে থাকে। সুহাসকে দেখে সরব হয় পিউলী। চিবুক উঠিয়ে গোল গোল চোখে চেয়ে থাকে। সুহাস একটা চেয়ার টান দিয়ে পিউলীর পাশেই বসে। সকালে খাওয়া হয়নি তার। নায়েলকে দেখলেই মাথার শিরা কম্পিত হয় সুহাসের। তাই তাকে এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে সুহাস।
পিউলী আধো আধো গলায় বলল—
“তুমি হৃতি আনটিকে বিয়ে করেছ?”
ছোট্ট করে হাসে সুহাস। মাথাটা ঝাঁকিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করে বলল—
“হু।”
“তোমার নাম কী?”
“সুহাস। আর তোমার?”
“আমি পিউলী। তুমি দুধ খাবে?”
সুহাস গালভর্তি হেসে বলল—
“না।”
পিউলীর মুখটা চুপসে যায়। দুঃখী দুঃখী গলায় বলল—
“কেন?”
সুহাস হেসে হেসে বলল—
“আমি তো আর তোমার মতো বাবু নই।”
“দুধ খেলে শত্তি হয়। মামুনি বলেছে।”
পিউলীর কথায় প্রসন্ন হাসে সুহাস। মেয়েটা কী মিষ্টি!
“তুমি কিকেট খেলতে পারো?”
“হুম।”
“ইয়েহ! তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।”
পিউলী চেয়ার থেকে নেমে তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এলোমেলো দৌড়াতে থাকে। টেবিলে রাখা বাদামের বাটি থেকে দুটো বাদাম মুখে পুরে নেয় সুহাস। অর্হিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সন্ধানী গলায় বলল—
“পিউ কোথায়?”
মুহূর্তেই সিঁড়ির দিক থেকে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। ছোট্ট পিউলীর ক্রিকেট ব্যাট দ্বন্ধ লাগিয়েছে সিঁড়ির সাথে। সুহাসের কাছে এসে দাঁড়ায় পিউলী। চোখভরা আশা নিয়ে বলল—
“বল নাও।”
সুহাস টেনিস বলটা হাতে নেয়। পিউলী সুহাসের আঙুল আঁকড়ে ধরে। টুকটুক করে বলল—
“চলো, চলো আঙ্কল। আমরা খেলব।”
অর্হিতা বাঁধা দিয়ে বলল—
“পিউ দুধটা খেয়ে যাও সোনা।”
“না। খাবো না এখন। আমি খেলব। চলো আঙ্কল।”
সুহাস মৃদুহাস্য অধরে বলল—
“চলো।”
সুহাসকে টেনে টেনে ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে যায় পিউলী। গাছগাছালির মায়ার ঘেরা শান্ত পরিবেশ। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। পত্র-পল্লবে নিবিড় ছায়ায় রোদ্দুর ঝলসানো তাপ নেই বললেই চলে। পিউলীর খুশি তার চোখে -মুখে উপচে পড়ছে। অতি সাবধানে বল ছুড়ে দেয় সুহাস। পাছে পিউলীর লেগে না যায়!
অকস্মাৎ ব্যাট হাতে দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পিউলী। মাখনের শরীরে আঘাত লেগেছে। থামায় কার সাধ্যি! একটুখানি ব্যাথাতেই পুরো বাড়ির আঙিনা কাঁপিয়ে ফেলল পিউলী। অর্হিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে। তার কান মিথ্যে শুনেনি। অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে দৌড়ে আসে সে। পিউলী তখন সুহাসের ক্রোড়ে।
“কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু নয়। খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে।”
“এই জন্যই আমি বারণ করেছি।”
“বাচ্চা মানুষ! খেলতে গিয়ে একটু পড়বেই। এত চিন্তার কিছু নেই ভাবীজান।”
“দিন ওকে আমার কাছে।”
“একটা বাচ্চাকে সামলানোর ক্ষমতা আছে আমার। চলুন।”
পিউলী সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে। ক্রন্দনরত গলায় তার একটাই আবদার,” পাপাকে ডাকো, পাপাকে ডাকো।” প্রথমে বাঁধ সাধলেও পরে নায়েলকে কল করে অর্হিতা। কারো কথায় কান্না থামছে না পিউলীর। যতক্ষন না নায়েল এসে পিউলীকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।
বাবার কোলে শান্ত হয়ে লেপ্টে আছে পিউলী। কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। চোখ ফুলে টমেটো! ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। নায়েল নম্র স্বরে বলল—
“আপনার খেয়াল রাখা উচিত ছিল অর্হিতা।”
অর্হিতা ফ্যাকাশে গলায় বলল—
“আসলে আমি….।”
“ভাবীজানের কোনো দোষ নেই বড়ো ভাই। আর বাচ্চা মানুষ, একটু আকটু পড়বেই। নাহলে বুঝবে কী করে ব্যাথায় যন্ত্রণা কত হয়!”
শেষের লাইটা কেমন অদ্ভুত শোনালো অর্হিতার কাছে। তাতে রোষ ছিল।
নায়েল তীর্যক গলায় বলল—
“কী বলতে চাও তুমি?”
“তেমন কিছু না। খেলতে গিয়ে পড়েছে। মলম লাগিয়ে দিন ঠিক হয়ে যাবে। এইটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই।”
“জাস্ট শাট আপ। দায়িত্ব নিলে তা পালন করতে হয়। ও তোমার সাথে খেলতে গেছে, সেক্ষেত্রে তোমার ওর খেয়াল রাখা উচিত ছিল।”
নায়েলের জোর গলায় নড়ে ওঠে পিউলী। সুহাস ঝরা হাসে। রসালো গলায় বলল—
“বড়ো ভাই, ব্যাটসম্যান ব্যাট নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে, সেখানে বোলার কী করতে পারে বলুন? সেইটা তো বোলারের জন্য সুযোগ!”
দাঁত কিড়মিড় করে নায়েল। অগত্যা সে চুপ করে রইল। স্বগতোক্তি( মনে মনে বিড়বিড় করা) করে সুহাস,” নিজের সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও একটুখানিতে এত কষ্ট লাগছে তোর! আর তোর কারণে যে আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি তার হিসেব কে দেবে? তোকে যদি আমি পাগলা কুকুরের মতো দৌড় না করিয়েছি, তো আমিও সুহাস নই মনে রাখিস।”
,
,
,
মুখ নিঃসৃত ধোঁয়ায় অবগাহন( গোসল,সিক্ত) করছে সুহাস। বিছানায় আরাম করে বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছে হৃতি। সিগারেটের গন্ধে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। গা গুলিয়ে উঠছে তার। তবুও বইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠাঁয় বসে আছে। সুহাস কোমল গলায় ডেকে উঠে—
“হৃতি, তোমার পরীক্ষা কবে?”
হৃতি সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে—
“আগামী মাসে।”
“এদিকে এসো।”
সুহাসের সামনে এসে বসে হৃতি। তার মুখভর্তি ধোঁয়ার পাক ছুড়ে দেয় হৃতির স্বচ্ছ মুখে। কেঁশে ওঠে হৃতি। অনুরক্তির সুরে বলল—
“এসব কেন খাও তুমি?”
সুহাস লম্বা টান মারে সিগারেটের ফিল্টারে। শূন্যে ধোঁয়া ছুড়ে বলল—
“পৃথিবী ভুলতে।”
হৃতির করুন দৃষ্টি। সিগারেটের বাকি অংশ অ্যাশ ট্রেতে রেখে হৃতির হাত নিজের হাতে নেয় সুহাস। হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—
“নায়েল পিউলীর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয় তাই না?”
হৃতি নির্বিকার গলায় বলল—
“হুম।”
“পিউলীর বাবা কোথায় জানো?”
“না। আমি কখনো তাকে দেখিনি।”
সুহাস রহস্য হাসে। হৃতি সংকীর্ণ গলায় বলল—
“তুমি এমন কেন করছ সুহাস? এসব নেশা কেন ছেড়ে দিচ্ছ না?”
“তোর কথায় ছেড়ে দেবো? কে তুই আমার? যা এখান থেকে।”
টলটল করে ওঠে হৃতির চোখ। হৃতি ভেজা গলায় প্রশ্ন করে—
“কেন এমন করছ তুমি? কী করেছি আমি?”
সুহাস তেড়ে যায়। ক্ষুব্ধ গলায় বলল—
“কী করিস না তোরা? তোরা মেয়েরা সব পারিস। টাকার জন্য নিজের সন্তানকে ফেলে আসতে পারিস, টাকার জন্য নিজের অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলতে পারিস, টাকার জন্য ভালোবাসার মানুষকে রাস্তায় ফেলে আসতে পারিস। টাকাই সব তোদের কাছে সব। মানি ইজ লাইফ, মানি ইজ লাভ। এখন আমার কাছেও তা। কেউ যদি আমাকে দশ লাখ টাকা দিয়ে বলে তোকে দিয়ে দিতে, আমি দিয়ে দেবো। টাকা চাই আমার।”
ঝমঝম করে কেঁদে ফেলে হৃতি। সন্তর্পনে সুহাসের হাত তার নিজের বক্ষস্থলে চেপে ধরে বলল—
“তোমার হৃৎপিন্ডে হাত রেখে বলো, তুমি পারবে টাকার জন্য আমাকে অন্য কারো কাছে দিয়ে দিতে? সহ্য করতে পারবে তোমার সামনে অন্য কেউ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে? ভাবতে পারবে তোমার জায়গায় অন্য কেউ আমাকে ভালোবেসে আদর করছে?”
সুহাসের মেজাজ চওড়া হয়। খটমটিয়ে উঠে বলল—
“একদম ন্যাকামি করবি না আমার সামনে। যা এখান থেকে। যা আমার চোখের সামনে থেকে।”
হৃতির চোখের শ্রাবণে প্লাবিত হচ্ছে তার কপোল(গাল)। সে জানে, সুহাস তাকে ভালোবাসে। একদিন কলেজের সামনে একটা ছেলে হৃতিকে টিজ করেছিল বলে ছেলেটিকে ইচ্ছেমতো রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে ছিল সুহাস। কলেজের প্রায় ডজনখানেক শিক্ষার্থীর সামনে তাকে প্রপোজ করেছে। কিন্তু সেই মানুষটাই হঠাৎ বদলে গেল। কেন?
তার উত্তর হৃতি জানে না।
চলবে,,,