#জঠর
#পর্বঃ২০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ছোটো ছোটো চোখের পক্ষ্মচ্ছায়া( চোখের পল্লব) মেলে তাকিয়ে আছে পিউলী। নিমগ্ন দৃষ্টি তার। তন্দ্রায় বিভোর সুহাস। বিছানার সাথে বুক চেপে রেখেছে। পিউলী তার ছোটো ছোটো বাহুর নরম স্পর্শ আঁকে সুহাসের অনাবৃত প্রশস্ত পিঠে। নড়বড়ে ঘুমের মধ্যে মৃদু কুঞ্চন ওঠে সুহাসের পুরু ভ্রুযুগলে। অতি কষ্টে চোখের পল্লব মেলে ধরে সে। পাশ ফিরে চাইল। পিউলীর ইঁদুর দাঁতে প্রাণবন্ত হাসি। শ্রান্ত মুখে তাকায় সুহাস। চোখভর্তি ক্লান্ত হাসি। নম্র সুরে বলল—
“তুমি এখানে?”
পিউলী হি হি করে হাসে। খুশি খুশি গলায় বলল—
“তুমি এই পঁচা জিনিস কেন খাও আঙ্কল?”
বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটার উপর সিগারেটের ছাঁইয়ের ছড়াছড়ি। কার্পেটের উপর ফিল্টার। সুহাস স্মিত হাসে। তার আড়ষ্ট শরীরকে সচল করে বা’হাতটা পিউলীর গালে স্পর্শ করে বলল—
“তুমি এখানে আর এসো না পিউ।”
“কেন?”
“এই যে আঙ্কল পঁচা জিনিস খাই।”
“তুমি আর খেয়ো না। ”
হেয়ালি হাসে সুহাস। তার উদ্দেশ্যহীন জীবন চলছেই নিকোটিনের ধোঁয়ায়। কলকলিয়ে হেসে ওঠে পিউলী। অকস্মাৎ সেই হাসিতে ভ্রু নাচায় সুহাস। চোখ পিটপিট করে বলল—
“হাসছ কেন পিউ?”
পিউলী মুখে হাত দেয়। তার চিকন দাঁতের হাসিতে প্রফুল্ল হয় সুহাসের অন্তঃকরণ(মন)। সুহাস চোখের চাহনি দৃঢ় করে। পিউলী সন্দিহান গলায় বলল—
“তুমি খালি গায়ে ঘুমাও কেন? তোমার জামা নেই?”
অধর জোড়া মুদিত অবস্থায় চওড়া করে সুহাস। বলল—
“আমার গরম লাগে।”
“ওই যে ফ্যান চলছে!”
সুহাস সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়। গাঢ় গলায় বলল—
“তবুও গরম লাগে।”
পিউলী একগাল হেসে বলল—
“তাহলে পাপাকে বলব তোমার ঘরে এসি লাগিয়ে দিতে। তারপর ঠান্ডা, ঠান্ডা।”
মুক্ত হাসে সুহাস। পিউলীর চোখের তারায় প্রাণাবেগ। সুহাস বিমোহিত হয়।
“তুমি এসি চিনো?”
“হুম। পাপার ঘরে আছে। ঠান্ডা, ঠান্ডা। ”
“তোমার ঘরে নেই?”
“না। আমি বড়ো হলে আমার ঘরে দেবে। তুমি আমার ঘরে যাওনি কেন? চলো, চলো, যাবে আমার ঘরে।”
পিউলী শায়িত সুহাসের হাত ধরে টানতে থাকে। সুহাস আপত্তি করে বলল—
“এখন না পিউ। পরে যাব।”
পিউলীকে চুমু খাওয়ার জন্য মুখ বাড়ায় সুহাস। পিউলী সরে আসে। চট করে বলল—
“না,না। তুমি ব্রাশ করোনি। যাও ব্রাশ করে আসো।”
সুহাস দিলখোলা হাসে। দুই হাতের ভর দিয়ে ওঠে বসে। ওয়াশরুমে যায়। হৃতি এসে সুহাসকে খুঁজতে থাকে। পেল না সে। টিমটিমে চোখে চেয়ে আছে পিউলী। তাকে জিজ্ঞেস করতেই হৃতি অবগত হয় সুহাসের ব্যাপারে। বিদ্যুৎ বেগে এক বুদ্ধি খেলে গেল হৃতির মস্তিষ্কের স্নায়ুতে। সে পিউলীকে কানে কানে কিছু একটা বলতেই উৎফুল্ল হয় পিউলী।
সুহাস ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে পিউলী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সুহাসের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় পিউলী। একটা আঙুল দিয়ে সুহাসের পায়ে বেল বাজানোর মতো করে নক করে। সুহাস হাতের তোয়ালেটা রেখে নিচু হয়ে বসে। পিউলীর দুই হাতের বাজু ধরে স্থবির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চকিতে নিজের অনাগত সন্তানকে দেখতে পেল সুহাস। যাকে সে আর কোনোদিনও দেখতে পাবে না। ছলছল করে ওঠে সুহাসের চোখ। পিউলী আদুরে গলায় বলল—
“আঙ্কল খাবে না? চলো।”
নিজের ধাতস্থ করে সুহাস। অধর বিস্তৃত করে বলল—
“না, পিউ। তুমি যাও।”
“না। সকালে খেতে হয়।”
পিউলী বাঁধা মানলো না। অবাধ্য শিশুকে যেমন মা জোর করে, ঠিক তেমনটাই করল পিউলী।
,
,
,
“পিউ কোথায়?”
নায়েলের করা প্রশ্নে হৃতি রয়ে সয়ে প্রত্যুত্তর করে—
“ও আমার ঘরে।”
“তুমি এখানে তো পিউ তোমার ঘরে কেন?”
“সুহাস আছে।”
চোয়াল শক্ত করে নায়েল। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করতেই পিউলী গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
” এসো আঙ্কল, এসো।”
নায়েলের বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি। সুহাস তরল চোখে চাইল সবার দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সায়েরা। ছেলেটাকে আজ নিজ চোখে খেতে দেখতে পাবে সে!
“হৃতি আনটি ওঠো। এখানে আঙ্কল বসবে।”
হৃতিকে উঠিয়ে সেখানে সুহাসের বসার ব্যবস্থা করে পিউলী। একপাশে নায়েল আরেকপাশে সুহাস বসেছে পিউলীর। হৃতির দৃষ্টিতে চঞ্চলতা। দুই পা দোলাতে থাকে পিউলী। উচ্ছ্বসিত সে। সুহাসের সরল কাঠখোট্টা চাহনি। পিউলী আবদার করে—
“মামুনি, আঙ্কলকে খেতে দাও।”
অর্হিতা হেসে বলল—
“দিচ্ছি পিউ। তুমি তোমার ব্রেড খাও।”
“না, আগে আঙ্কলকে দাও।”
অর্হিতা গরম দুধ নিয়ে পিউলীর পাশে এসে দাঁড়ায়। টেবিলে রাখতে যাবে তৎক্ষণাৎ পিউলী সামনের দিকে হাত বাড়াতেই গরম দুধের গ্লাসে ধাক্কা লেগে অর্হিতার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায় টেবিলে। গলগলিয়ে দুধের গ্লাস খালি হলো। তা টেবিল ক্লথ বেয়ে পড়ল নিচে, যেখানে ছিল পিউলীর পা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিউলীর চেয়ারকে হাত দিয়ে ধাক্কা মারে সুহাস। তাতে পিউলীর চেয়ার খানিকটা পিছিয়ে যায় আর গরম দুধের বেশিরভাগ অংশ পড়ে সুহাসের হাতে। হঠাৎ ঘটা এই ঘটনায় চকিত সবাই। লাফিয়ে ওঠে সকলে। সায়েরা দ্রুত এসে সুহাসের হাত চেপে ধরে। সকলের উৎসুক দৃষ্টি।
“তুই ঠিক আছিস? জ্বলছে তোর হাত? দেখি কোথায় লেগেছে?”
সুহাস সকলের দিকে চোখ বোলাল। রোষিত গলায় বলল—
“হাতটা ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি।”
পিউলী ঝমঝমিয়ে কেঁদে ফেলে। তাকে কোলে নিয়ে নেয় নায়েল। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। বুকের ভেতরের হৃৎপিন্ড লাফিয়ে যাচ্ছে। সুহাস গজগজ করে চলে যায় সেখান থেকে। খাওয়া হলো না তার। দেখা হলো না এক পিপাসার্ত মায়ের নিজের ছেলের খাওয়ার দৃশ্য।
,
,
,
ঘরময় পায়চারী করছে নায়েল। তার তাপিত মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় অচ্ছুত( ছোঁয়া যায় না এমন) ত্রাসেরা আলোড়ন শুরু করেছে। জেঁকে ধরেছে তাকে এক কল্পনাতীত দুর্নিবার প্রলয়। সুহাস আশেপাশে থাকলেই কেন পিউলীর সাথে দুর্ঘটনা ঘটে! নায়েলের মনে হচ্ছে সে অদৃশ্য ঘাতক হয়তো পিউলীর আশেপাশেই আছে। চর্মচক্ষুতে তা দৃশ্যত নয়। বুকে কম্পন হয় নায়েলের। বোনের শেষ চিহ্নকে সে কোনোভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেবে না।
অর্হিতা দাঁড়িয়ে আছে বহুসময়। নিজের মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় বিভোর নায়েলের দৃষ্টিগোচর হলো না সে। অর্হিতা ধীর গলায় ডেকে উঠে—
“নায়েল!”
চকিত ধ্যাণ ছুটে নায়েলের। সামনে চোখ তুলে তাকায় সে। অর্হিতাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল—-
“পিউ কোথায়?”
অর্হিতা সহজ গলায় বলল—
“ও হৃতির ঘরে।”
“হৃতির ঘরে কেন?”
“জেদ ধরেছে সুহাসের কাছে যাবে।”
“ও বললেই যেতে দিতে হবে?”
নায়েল ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে দমদম করে পা ফেলে নিচে আসে। অর্হিতা কিছু বলার সুযোগ পেল না।
,
,
,
বিছানায় আসন পেতে বসে আছে সুহাস। তার উরুর উপর বসে আছে পিউলী। গরম দুধ পড়ায় সুহাসের রোমশ হাত লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কুটকুট করে জ্বালা হচ্ছে হাতে। হৃতি বার্নল লাগিয়ে দিয়েছে। ফ্যানের নিচে হাত দিয়ে রেখেছে সুহাস। ছোট্ট লাল ঠোঁট দুটো বলয় করে সুহাসের হাতে মাতৃস্নেহের সাথে ফুঁ দিচ্ছে পিউলী।
“ব্যাথা করছে আঙ্কল?”
সুহাস ঘাড় বাকিয়ে পিউলীর নরম তুলতুলে গালে চুমু বসায়। আলতো গলায় বলল—
“না।”
“তুমি কেঁদো না। ভালো হয়ে যাবে।”
“জানি। সময়ের সাথে ক্ষত শুকিয়ে যায়, শুধু স্মৃতির পাতায় রয়ে যায় তার যন্ত্রণা!”
হৃতি ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাসের কথার অর্থোদ্বারের চেষ্টা করল। কিন্ত পারল না।
নায়েল তটস্থ হয়ে হৃতির কক্ষে ঢোকে। পিউলী চট করে ওঠে দাঁড়ায়। গলা চড়িয়ে বলল—
“পাপা!”
নায়েল অস্থির হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে নেয়। ঘরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে সুশ্রী আনন গম্ভীর করে। কাষ্ঠ গলায় বলল—
“ঘরের একি অবস্থা হৃতি? বাসায় একটা বাচ্চা আছে, সেইটা নিশ্চয়ই তুমি জানো?”
সুহাস গূঢ় হাসে। খেয়ালিপনায় বলল—
“বড়ো ভাই, আপনার মেয়েকে আমি এখানে আসতে বলিনি। আর ঘরটা যেহেতু হৃতির ওকে ওর মতো থাকতে দিন।”
“ঘরটা হৃতির হলেও বাড়িটা আমার।”
সুহাস চাপা হাসে। শ্লেষাত্মক গলায় বলল—
“ব্যাগ গুছা হৃতি। তোর বড়ো লোক নায়েল ভাই…উফ! সরি। ভাই তো ডাকিস না। কে জানে, কী সম্পর্ক তোদের! চল, তোকে নিয়ে না হয় হোটেলেই থাকব।”
নায়েলের থিতিয়ে থাকা রাগ তরতর করে ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেহপিঞ্জরে। রাগ গলার মধ্যে চেপে রেখে বলল—
“পিউ, মামুনির কাছে যাও। ”
পিউলীকে কোল থেকে নামাতেই সে ছুট লাগায়। নায়েল ধীরপায়ে এগিয়ে আসে সুহাসের কাছে। সুহাস বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়।
“কী বললে তুমি ওকে?”
সুহাস বাঁকা হেসে বলল—
“চাইনিজ ভাষায় তো বলিনি। বাংলায় বলেছি। বুঝতে পারেননি বড়ো ভাই? আরেকবার বলব?”
“ওকে তুই কেন বললে?”
“আমার বউ, আমার যা ইচ্ছে বলব। তাতে কার বাঁড়া ভাতে পানি ঢাললাম!”
নায়েল ফুঁসে উঠে বলল—
“মানে কী এসবের? বউ হয় তোমার, কাজের লোক নয়। আর এই বাড়িতে কাজের লোকদেরও তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়। ”
সুহাস ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে কটাক্ষ গলায় বলল—
“টাকার যারায় মানুষ বেচাকেনা করে তাদের মুখে এই কথা মানায় না বড়ো ভাই। নিজের চরকায় তেল দিন। আমারটা আমি বুঝব।
ভাবীজানকে তো টাকা দিয়েই কিনে এনেছেন। টাকায় কি না করে!”
নায়েল রাগে বিহ্বল হয়ে এক চড় বসায় সুহাসের গালে। সুহাস বিক্ষুব্ধ হয়ে নায়েলের কলার চেপে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাথর বনে যায় হৃতি। একে অপরকে শাসানোর এক পর্যায়ে সায়েরা এসে ধাক্কা লাগায় নায়েলকে। দেয়ালে ছিটকে পড়ে নায়েল।
চলবে,,,