#জঠর
#পর্বঃ২৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নায়েলের সামনেই বসে আছে মাহিম। টেবিলের নিচে থাকা তার পা যুগলে কম্পন শুরু হয়েছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের শিরা বেয়ে দপদপিয়ে চলছে রক্ত প্রবাহ। মস্তিষ্কের স্নায়ুতে লেগেছে দ্বন্ধ। নিজেকে তবুও শান্ত রেখেছে নায়েল। মাহিম সহজ গলায় বলল—
“ব্যাপারটা কী ঠিক হচ্ছে নায়েল?”
নায়েল তিরিক্ষি মেজাজে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—
“আপনি নিহিতার সাথে যা করেছেন তা ঠিক করেছেন?”
মাহিম তাচ্ছল্য চোখে চেয়ে বলল—
“তোমার কী মনে হয়, একজন স্ত্রী ঘরে স্বামী রেখে বাইরে নষ্টামি করে বেড়াবে আর তার স্বামী তা চুপচাপ সহ্য করে যাবে?”
তড়িৎ বেগে ওঠে দাঁড়ায় নায়েল। তার প্রশস্ত আঁখিপক্ষ্ম কম্পিত হচ্ছে। নায়েল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—-
“আরেকটা বাজে কথা বলবেন না আমার বোনের নামে। ওর অস্থিমজ্জাকেও চিনি আমি। ও কী করতে পারে আর না পারে তার সবটা আমি জানি। আমার বোনের দুর্বলতা কোথায় জানেন? ধোঁকা পাওয়ার পরও আপনার কোনো ক্ষতি চাইনি ও। নিজের আর নিজের সন্তানের কথা ভেবে সব মেনে নিয়েছে।”
মাহিম অগম চোখে তাকাল। সংকোচমুক্ত গলায় বলল—
“আই সি! এতটা সতী ছিল তোমার বোন আমার জানাই ছিল না! তুমি তো তার চেয়ে চার কদম এগিয়ে। আমার সন্তানকে আটকে রেখেছ।”
নায়েল অট্টহাস্য বদনে বলল—
“হাসালেন আপনি! বউ দরকার নেই, এখন মেয়ে চাই আপনার। পিউর সাথে আপনার সব সম্পর্ক নিহিতার মৃত্যুর সাথে সমাপ্ত।”
মাহিম মৃদু হাসল। তার হাসিতে সজীবতা। অচক্রী গলায় বলল—
“দেখো নায়েল, তুমি নিজেও বিয়ে করেছ। তোমার স্ত্রীর কী যেন নাম! অর্হিতা, মিসেস অর্হিতা। আজ বাদে কাল তিনিও মা হবেন, তুমি বাবা হবে। যতই তিনি পিউকে ভালোবাসেন না কেন নিজের সন্তানের থেকে তো আর বেশি ভালোবাসবেন না! তো কী দাঁড়াল বলো তো, আজ বাদে কাল আমার মেয়েটাকে সৎ মায়ের চোখের বালি হতে হবে।”
নায়েল টেবিলের উপর ঝুঁকে দম্ভোক্তি করে বলল—
“পিউ আমার মেয়ে। ভুলেও ওকে নিজের মেয়ে বলবেন না। আপনি আসতে পারেন এখন। আর অর্হিতাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। পৃথিবীতে সব নারী এক না হলেও সত্যিকারের মায়েরা হয়। ”
মাহিম বসেই রইল চেয়ারে। অনুদ্বেগ চাহনিতে চেয়ে বলল—
“আমি মিউচুয়াল সেটেলমেন্ট চাই। কেস কোর্টে উঠলে নিহিতার সম্মান বাঁচবে না। আর ওর সাথে আমার ডিভোর্স এপ্রুভ হবে না। কারণ ও তখন প্রেগন্যান্ট ছিল। তোমরা আমাকে ধোঁকায় রেখছ। কথাটা মাথায় রেখো নায়েল।”
নায়েল বাঁকা হাসল। তীর্যক গলায় বলল—
“যে মরে গেছে অন্তত তাকে তো রেহাই দিন। আপনার যা ইচ্ছে করুন। পিউ কোথাও যাবে না। আমি যেতে দেবো না। ছয় বছর, অর্ধ যুগ ওকে আমি আমার এই বুকে রেখেছি। বাবা না হয়েও বাবা হয়েছি। মাস্টার্স পরীক্ষা দিতেও গিয়েও আমার পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল আমার পিউ। আমার শ্বাস ও। আপনি ভাবলেন কী করে আমি ওকে আপনাকে দেবো? আমার নীরবতাকে আমার দুর্বলতা ভাববেন না মাহিম হাওলাদার। জাস্ট আউট নাউ।”
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে নায়েল।”
নায়েল ক্ষুব্ধ হয়ে বলল—
“বাড়াবাড়ি তো হবেই। এখনই আমার কেবিন থেকে বের হোন। নাহলে গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো আমি।”
“নায়েল!”
দাপিয়ে ওঠে মাহিম। তার দীর্ঘ শরীরে কাঁপন শুরু হয়েছে। থরথরে গলায় ফের বলল—
“ওকে, আমি দেখব তুমি কী করতে পারো।”
নায়েলের কেবিন থেকে বিগড়ানো মস্তিষ্কে বের হয় মাহিম। মুক্ত শ্বাস ফেলল নায়েল। শান্ত হয়ে মাথা চেপে ধরে চেয়ারে বসে সে।
,
,
,
শ্রান্ত বিকালের ধূসর আকাশ আবেগে টলমল। একটু পরেই দুপুরের তেজস্বি প্রভাকরের মিইয়ে যাওয়া আলোর পরের বাকি অংশটুকু, যা চেয়ে রয়েছে ম্লান চোখে, পূর্বাকাশে তা প্রলীন হবে। সন্ধ্যারাগে রঞ্জিত হবে কালচে নীলাভ দ্যুলোক। গোধূলির আবির রঙ সরে গিয়ে জায়গা করে নেবে তমসার চাঁদোয়া। অাচানক দিনের রোশনাই তার খেঁই হারিয়ে মিলেমিশে একাকার হবে রাতের জ্যোৎস্নায়।
শহরের নামকরা পাঁচ তারকা আবাসিক হোটেলে পদার্পন হলো সুহাসের। থাই পুশ করে ভেতরে ঢুকেই সুডোল নেত্রযুগলে চারপাশে চোখ বোলালো সে। রিসিপশনিস্ট থেকে নির্ধারিত ঠিকানা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে হোটেলটির তিন তলায় আসে। করিডর দিয়ে হেঁটে তিনশত দশ নাম্বার কক্ষের দরজার সামনে এসে রুখে দেয় পদযুগলের চঞ্চলতা। দরজায় নক করতেই কেউ একজন আসে। সুহাসকে দেখেই সজীবের চকচকে চোখ ঝিলিক মেরে ওঠে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল কক্ষে প্রবিষ্ট হতেই সুহাসের শরীরে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়। ছোটো ছোটো কদমে এগিয়ে যায় সে। জানালার পাশ ঘেঁষে কাউচ। মৃদু আলোতে মাহিমকে দেখতে পায় সুহাস। স্কচের পেগ নিয়ে মত্ত সে। সজীব কৃত্রিম বাতি অন করে। রোশনাইতে ভরে যায় বদ্ধ ঘর। সুহাসকে ইশারায় ডাকল মাহিম। পাশের কাউচে নিরুত্তাপ হয়ে বসল সুহাস। নেশায় বুঁদ মাহিম। তার নিভুনিভু চোখ। সুহাসের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিতেই বিতৃষ্ণ হাসে সে। প্রসন্ন গলায় বলল—
“টাকার জন্য তো আমি কিছু করিনি ভাই।”
মাহিম নেশার্ত গলায় বলল—
“আজকাল স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না। তোমার কী চাই বলো?”
সুহাস ক্রুর কণ্ঠে বলল—
“আমি শুধু চাই আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান। আপনারও তো একটা হক আছে তাই না!”
মাহিমের অধরের কোণে চিলতে হাসি দেখা গেল। প্রসন্ন চোখে চেয়ে বলল—
“ওকে তো আমি নিয়ে যাবই।”
সুহাস পৈচাশিক হাসে। দাঁত কেলিয়ে বলল—
“ভাই একটা কথা বলব?”
“অবশ্যই।”
সুহাস হেসে হেসে বলল—
“আসলে মাই কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্ট টু নো, শুনেছি আপনার আর নিহিতার বিয়ে না কি লাভ ম্যারেজ ছিল! তাহলে বিয়ের চার, পাঁচ মাসেই সব লাভ উবে গেল?”
মাহিম অধর চওড়া করে হাসল। স্কচের এক চুমুক গালভর্তি করে গিলে নিয়ে প্রশান্তির চোখে চেয়ে বলল—
“নিহিতাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে আমার। বাট চেষ্টা করেও ওর কাছে যেতে পাচ্ছিলাম না। বিয়ে ছাড়া হাত লাগানো যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছিলাম।”
সুহাস অবাক না হওয়ার ভান করে বলল—-
“ও আচ্ছা। তাহলে পরকীয়ার ব্যাপারটা! ওটা নিশ্চয়ই সাজানো ছিল?”
মাহিম গাঢ় চোখে তাকাল। সুহাস ফিক করে হেসে নিষ্পাপ মুখ করে বলল—
“না, মানে আমার নিষ্পাপ মন জানতে চাচ্ছিল আর কি!”
মাহিম গ্লাসের সবটকু স্কচ গিলে নিয়ে মুক্ত শ্বাস ছেড়ে বলল—
“আমার কাজে বাঁধা হচ্ছিল। তাই সরাতে বাধ্য হয়েছি।”
দাঁত কেলিয়ে খলখল করে হাসল সুহাস। যেন মজার কিছু ঘটেছে। মিনমিনে সুরে বলল—
“ভাই, এখন বলবেন না যে ওকে রাস্তা থেকে সরাতে আপনিই অ্যাকসিডেন্ট করিয়েছেন?”
বাঁকা চোখে তাকাল মাহিম। সদর্পে বলল—
“ডিভোর্সের পর আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি আমি। তাই বলতে পারছি না।”
“তাহলে হয়তো ক্যাজুয়াল অ্যাকসিডেন্ট ছিল। বেচারি!
ভাই না কি বিয়েও করেছেন? এখন কেমন চলছে আপনার সংসার?”
মাহিম স্থির চোখে তাকিয়ে বলল—
“ভালো।”
“ও আচ্ছা। আজ তাহলে আমি আসি। শুভ কামনা।”
নেশায় বুঁদ মাহিম শুধু হাত দিয়ে বিদায় জানালো। মুখে কিছু বলতে পারল না।”
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল সুহাস। আপাতত তাকে আর কিছুই করতে হবে না। সুহাস নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে হেঁটে চলছে। অদূরে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসল। তাকে দেখেই সামনের বেঞ্চিতে বসা ছেলেটি বিগলিত হাসল। উঠে এসে সুহাসের পাশে বসল। ঝরা গলায় বলল—
“কী খবর তোর?”
সুহাস দৃঢ়চিত্তে বলল—
“ভালো।”
সুহাসের বন্ধু নায়িম। কুসুমপুরে থাকে। মাহিমের ভাই মনিরের সাথে ভাগ্যক্রমে সখ্যখা ছিল। সুহাস তাকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করে। নায়িমের মাধ্যমে সব খবর টেনে বের করে মনিরের পেট থেকে। আর শিওর হয় মাহিম-ই পিউলীর জন্মদাতা পিতা কি না। নিহিতার সাথে সুসম্পর্ক কখনোই ছিল না মাহিমের। শুধু নিজের আত্মসিদ্ধির জন্য বিয়ে করেছিল নিহিতাকে। তারপর নিহিতার ওপর পরকীয়ার আরোপ লাগিয়ে ডিভোর্স।
সুহাস কণ্ঠে বিষাদ নিয়ে বলল—
“শালা, কামিনা! শুধু নিজের খায়েস পূরণ করার জন্য নিহিতাকে বিয়ে করেছিল।”
নায়িম ঝকঝকে গলায় বলল—
” ওরা এমনই দোস্ত। মানুষের মূল্য নেই ওদের কাছে।”
“ব্যাপারটা হাস্যকর তাই না বল! যে মেয়ের জন্মের খোঁজও রাখেনি তাকে পাওয়ার জন্য এখন উঠে পড়ে লেগেছে।”
নায়িম সংকীর্ণ হেসে বলল—-
“এসব টাকার খেল বুঝলি। বছর কয়েক আগে একটা দুর্ঘটনার স্বীকার হয় মাহিম হাওলাদার। ইন্টারনাল ইঞ্জুরির কারণে বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারায়। তার ভাই মনিরের স্ত্রী মা হবে। উত্তরাধিকারী প্রয়োজন তাদের। সন্তান জন্মদানে অক্ষম মাহিম এখন তটস্থ। তাই এতো আলগা পিরিত।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। নায়িম শ্রান্ত চোখে চেয়ে মোলায়েম গলায় বলল—
“একটা কথা বলি সুহাস। আমার মনে হচ্ছে তুই যা করছিস ঠিক হচ্ছে না দোস্ত। পিউ ওদের কাছে একদম ভালো থাকবে না। মাহিম শুধু নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য পিউকে নেবে। মেয়েটার শৈশব নষ্ট হয়ে যাবে।”
শান্ত সুহাস মুহুর্তেই ফুঁসে উঠে বলল—
“তাতে আমার কী?”
“দেখ সুহাস, এসব করে কী হবে বল? আদৌ কী তুই তোর সন্তানকে ফিরে পাবি? আর কাকে কষ্ট দিতে চাইছিস তুই? যে সন্তান জন্মই নেয়নি তার জন্য তোর এত কষ্ট হচ্ছে, আর পিউর বয়স তো ছয়! ছয় বছরে কতগুলো দিন হয় তুই ভাবতে পারছিস? নিজের জীবনকে দেখ, তুই কী চাস পিউও এমন একটা জীবন লিড করুক? ”
সুহাস কোনো কথা বলল না। তার আঁখিতে ছলছল করছে নোনা জল। নায়িম ফের বলল—
“বিবেকহীন মানুষ পশুর সমতুল্য দোস্ত। তুই পশুর খাতায় নাম লেখাস না। বন্ধু হয়ে তোর কষ্ট লাগবে আমি যা পেরেছি করেছি। এখন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ফের বলছি, বন্ধ কর এই বদলার খেল। পিউকে ওর বাবা -মায়ের কাছে থাকতে দে। না হলে আরেকটা সুহাস তৈরি হয়ে যাবে। নিজের সন্তানের জায়গায় একবার পিউকে আর নিজের জায়গায় নায়েলকে বসিয়ে ভাব। একটা ভ্রুণ আর একটা মাংসের শরীরের অনেক পার্থক্য দোস্ত। তোকে আমি চিনি। আমি আশা করব তুই সঠিক সিদ্ধান্ত নিবি। জানি না আদৌ এই কেস ঘোরানো সম্ভব কি না! কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। তুই মন থেকে চাইলেই পারবি। ভালো থাকিস।”
নায়িমের কথায় ছিন্নভিন্ন হয় সুহাসের অন্তঃকরণ।
চলবে,,,