#জঠর
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
হাসপাতালের সফেদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে সুহাস। এক সপ্তাহ ধরে এই বিছানাই তার সঙ্গী। ফিনাইলের তীক্ষ্ম গন্ধ আর বদ্ধ পরিবেশে থমকে আছে সুহাসের মস্তিষ্ক। তার পায়ের কাছে বসে আছে হৃতি। সফেদ পর্দাটা একপাশে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে অর্হিতা। তার নরম পায়ে কোনোরূপ ছন্দপতন হলো না। সুহাসের নিকটে এসে থামে সে। সুহাস নতজানু হয়ে আছে। অর্হিতা শান্ত গলায় বলল—
“কেমন আছ সুহাস?”
সুহাস তাচ্ছল্য হাসল। কটাক্ষ করে বলল—
“যেমনটা রেখেছেন। পিউ কোথায়?”
অর্হিতা গূঢ় হাসল। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল—
“আজ কোর্টে হিয়ারিং আছে।”
সুহাস নড়ে বসল। ঝকঝকে গলায় হৃতিকে বলল—
“আমার মোবাইল এনেছ?”
হৃতি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। পার্স থেকে বের করে সুহাসের মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। সুহাস মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে একটা চাপা শ্বাস ফেলে বলল—
“লুবানার অ্যাকসিডেন্টে আমার কোনো হাত নেই। নিজের ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ও ঠিকভাবে ড্রাইভ করতে পারেনি। পাপ কাউকে ছাড়ে না। ওর পাপের শাস্তি ও পেয়েছে। আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, জীবন ওকে ধোঁকা দিয়েছে। না হলে ভাবুন, এত বড়ো অ্যাকসিডেন্টে পিউ কী করে বেঁচে গেল!”
অর্হিতা ব্যস্ত গলায় বলল—
“তাহলে মিথ্যে বললে কেন? আর পিউ তোমাকে চিনতে কেন পারেনি?”
সুহাস বেখেয়ালি গলায় বলল—
“ওইটুকুন মস্তিষ্কে কত মনে রাখবে! আমি তখন ক্লিনশেভে ছিলাম না।”
অর্হিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুহাস হাতের মোবাইলটা অর্হিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—
“এইটা নিন। আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে। পিউর কাস্টেডি পেতে এইটা আপনাদের সাহায্য করবে।”
অর্হিতা কপাল কুঞ্চন করে। ভ্রুযুগলে ভাঁজ তোলে। কৌতূহলী চোখে চেয়ে থাকে মোবাইলটার দিকে। একটা মোবাইল কী করে তাদের পক্ষে লড়তে পারে, যেখানে তাদের এত চেষ্টাও কিছু করতে পারছে না! মাহিম তার রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছে। আদালতে উপস্থাপন করেছে, নায়েল ইচ্ছে করে তার সন্তানকে নিজের কাছে রেখেছে যাতে করে সঠিক সময়ে কাজে লাগিয়ে তার সম্পত্তি হাতাতে পারে!
অর্হিতার দিকে তাকিয়ে সাবলীল সুরে বলতে থাকে সুহাস—
“মাহিম হাওলাদার ইচ্ছে করে পরকীয়ার নাটক সাজিয়ে নিহিতাকে সরিয়েছে। তার কনফেশনের ভিডিয়ো রেকর্ড আছে এখানে। মাহিমের ভাই মনিরের নজর ছিল নিহিতার ওপর। ও চেয়েছিল ডিভোর্সের পর নিহিতাকে বিয়ে করবে। কিন্তু নিহিতা কোনোভাবেই রাজি হয়নি। মনির পিউর কথা জানতে পারে। আর ওই-ই লোক দিয়ে নিহিতাকে সরিয়েছে যেন মাহিম ওকে পিউর কারণে ফিরিয়ে নিতে না পারে। ওর অডিয়ো কনফেশন আছে এতে। তবে মনির নেশায় বুঁদ। আদালত সরাসরি গ্রহণ না করলে ভয়েজ টেস্টে বুঝতে পারবে এইটা মনিরের-ই কণ্ঠ। পিউর কোনো ক্ষতি আমি কখনো করতে চাইনি। শুধু চেয়েছি যে যন্ত্রণা আমি পেয়েছি তা নায়েলও অনুধাবন করুক।”
সুহাসের গলা কম্পিত হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। অর্হিতা ভিডিয়ো দেখল আর অডিয়োটাও শুনল। এইবার অর্হিতা নিশ্চিত কেস তারাই জিতবে। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল—
“যাকে কষ্ট দিতে চেয়েছ আদৌ কী তারচেয়ে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট তোমার কম হয়েছে?”
সুহাস দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তার ক্রন্দনরত অশ্রুসিক্ত আনন সে কাউকে দেখাতে চায় না। হৃতি শশব্যস্ত হয়ে উঠে আসে। সুহাসের দুই হাতে নিজের হাত ছুঁইয়ে ধরে। অর্হিতা মিষ্টি হাসে। বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
মুখের উপর থেকে সুহাসের হাত সরিয়ে তার বুকের কাছে খামছে ধরে হৃতি। মুখ গুঁজে দেয় তার বুকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সুহাসের টিশার্ট ভিজে যাচ্ছে হৃতির চোখের নোনা জলে। সুহাস কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“এখন কাঁদছিস কেন? আমি তো খারাপ! আমি মরে গেলেই ভালো।”
ভেজা গলায় হেঁচকি তুলে তুলে হৃতি বলল—
“আমি তোমার জীবনে প্রথম নারী নই, এই আপসোস আমার কোনোদিনও যাবে না সুহাস!”
দুই হাতে বুকের পাটাতনে পিষে ধরে হৃতিকে সুহাস। জমাট গলায় বলল—
“আমার পবিত্র ভালোবাসাকে আমি চিনতে পারিনি, এই আক্ষেপ আমার কখনো কমবে না।”
,
,
,
টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে পিউলী। তার খুশিতে জোয়ার এসেছে। টেবিলে রাখা কেকের ক্রিমে আঙুল ঢুকাতেই অর্হিতা চেঁচিয়ে উঠে—-
“পিউসোনা কী করছ! নষ্ট হয়ে যাবে কেক।”
পিউলী অসহায় মুখ করে বলল—
“আমি কেক খাবো।”
“খাবে তো। সুহাস আঙ্কল আসুক।”
“কখন আসবে?”
“এই তো এক্ষুনি।”
পেছন থেকে অকস্মাৎ জবাব ভেসে আসে। চোখের পলকে বাবাকে দেখে পিউলীর খুশি দ্বিগুন হয়ে এলো। নায়েলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল—
“পাপা, আঙ্কল এখন আসবে?”
“এসে পড়েছে। ওই যে দেখো।”
হৃতি আর সুহাসকে ছাদ থেকে বাড়ির গেইটে দেখেই নেমে আসে নায়েল। বাড়ির ভেতরে পদার্পন করে তারা। পিউলী নায়েলের কোল থেকে নেমে অগোছালো পায়ে দৌড়ে সুহাস কাছে যায়। ঝপ করে তার পায়ের দিকটা জড়িয়ে ধরে পিউলী। সুহাস হাঁটু ভেঙে বসে। পিউলীর ঝকঝকে দাঁতের হাসি, চোখের তারায় প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে নিজেকে রুখতে পারল না সে। নিবিড় মায়ায় জড়িয়ে ধরল পিউলীকে। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে থাকে। পিউলীকে নিজের থেকে আলাদা করে এলোপাথাড়ি চুমু খায়। পিউলী মর্মভেদী গলায় বলল—
“তুমি ডাক্তারের কাছে গেছিলে আঙ্কল? তোমায় মাথায় ব্যাথা! ডাক্তার তোমাকে মেরেছে?”
“না, সোনা। কেউ মারেনি আমায়। কেউ না।”
একপাশে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সায়েরার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে ওঠে দাঁড়ায়। পিউলী প্রাণোচ্ছল হাসে। সুহাসের আঙুল চেপে ধরে বলল—
“এসো আঙ্কল, এসো। মামুনির তোমার জন্য কেক বানিয়েছে। খাবে এসো।”
ডাইনিং টেবিলের কাছে টেনে নিয়ে আসে সুহাসকে পিউলী। চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান পাকা করে। ঝলমলে গলায় বলল—-
“মামুনি কেক খাবো।”
অর্হিতা আদুরে গলায় বলল—
“আচ্ছা, আচ্ছা।”
অর্হিতার ঠোঁটের কোণে রাঙা হাসি। কৃতজ্ঞতার সুরে বলল—
“ধন্যবাদ দেবো না তোমাকে। আপন মানুষদের ধন্যবাদ দিতে নেই। তারা হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে। তোমার প্রতিহিংসা যতটা আমাদের পুড়িয়েছে তার চেয়ে অধিক তোমাকে। তাই আজ তুমি আবারও খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। পিউকে নিয়ে নায়েলের যে ভয় তা আর নেই। এখন থেকে পিউ সম্পূর্ণ আমাদের। নিহিতা তার ন্যায়-বিচার পেয়েছে। মাহিম হাওলাদার তার পাপের শাস্তি। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ, মনিরের জেল হয়েছে। সত্যের জয় সর্বত্র, তা আরেকবার প্রমাণিত। আমরা সবাই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ সুহাস।”
সুহাস হাসল না। তার অন্তঃকরণ ব্যাথিত। মোমের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। নায়েল এগিয়ে গিয়ে কোনো কথা ছাড়াই সুহাসকে আলিঙ্গন করে। সুহাস মুক্ত শ্বাস ফেলে। নায়েল ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলল—
“আই এম সরি সুহাস। রাগের বশে তোমার গায়ে হাত তুলে ফেলেছি।”
“না, আপনার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। নিজের সন্তান হারানোর কষ্টে ভুলেই গেছিলাম আমি যা করছি তা ঠিক নয়। সেখানে আপনার কোনো দোষ নেই।”
“আই এম সরি।”
নায়েল তার হাত আলতো করে বুলাতে থাকে সুহাসের পিঠে। পিউলী চট করে চিৎকার করে উঠে—
“আমি কেক খাবো। সুহাস আঙ্কল কেক কাটো।”
পিউলীর এই কেক খাওয়ার তাড়নায় উপস্থিত সকলে সশব্দে হেসে ওঠে।
,
,
,
ব্যাগভর্তি করছে কাপড়। সেই দিকে বিবশ চাহনি হৃতির। আড়ষ্ট গলায় বলল—
“আমরা কী সত্যিই চলে যাব?”
সুহাস ব্যাগের চেইন লক করে বলল—-
“হুম। আজ-ই।”
হৃতি কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলল—
“কোথায় থাকব আমরা?
“আপাতত কোনো হোটেলে। দুদিনের মধ্যে আমি কোনো বাসা খুঁজে নেবো। এসো আমার সাথে।”
হৃতি দ্বিরূক্তি করল। অজানা উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সুহাসের সাথে। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিউলী। কেঁদে কেটে একাকার। সে কিছুতেই সুহাসকে যেতে দেবে না। সুহাস মানতে নারাজ। তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। পিউলী নায়েলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই নীরব নিস্তব্ধ। নওশাদ সাহেব সুহাসের সামনে এসে দাঁড়ান। একটা অজ্ঞাত সংকোচে লোকটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না সুহাসের। নওশাদ সাহেব ছোট্ট করে বললেন—
“ধন্যবাদ।”
সুহাস ঝট করেই বিস্মিত চোখে তাকাল। তিনি ফের বললেন—-
“আমাকে তৃতীয়বারের মতো বাবার স্বাদ আস্বাদন করানোর জন্য।”
সুহাস কল্পনাতীত অবাক হলো। নওশাদ সাহেব নিজের গরজে বললেন—
“আজ থেকে আমার দুটো ছেলে। তুমি নাহয় আমাকে খালুজান বলেই ডেকো।”
সুহাসের আঁখিপল্লব সিক্ত হয়। নিজের রোদন দমিয়ে রাখে সে।
সায়েরা দুই হাত জোড় করে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। সুহাসের তাকাতে ইচ্ছে হলো না। কেন তাকাবে সে?
যখন মায়ের উমে তার ঘুমানোর কথা ছিল, তখন কোথায় ছিল সে মা? বজ্ররাতে ভয় থেকে বাঁচতে যখন মায়ের বুকে লুকানোর কথা ছিল, তখন কোথায় ছিল সে মা?
তবে আজ কেন স্নেহের রিক্তথালা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সায়েরার কপোল বেয়ে নামছে প্রস্রবণ।অর্হিতা স্বমহিমায় বলল—
“খালামনি যা করেছে তা ভুল ছিল না। নারী বলে যে তাকে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে পড়ে থাকতে হবে তার কোনো মানে নেই। যদি সেদিন ওই পরিবার থেকে খালামনি বেরিয়ে না আসত তাহলে আদৌ তাকে তারা বাঁচতে দিতো? আমাদের সমাজে এমন অনেক নারী আছে যারা স্বামী এবং তার পরিবারের অত্যাচার, বঞ্চনা সহ্য করে পড়ে থাকে। তাদের শেষ পরিণতি হয় আগুনে ঝলসে যাওয়া না হয় স্বামীর হাতে খুন। তোমার মা এখনো বেঁচে আছে সুহাস!
মাতৃত্ব এক সুপ্ত অনুভূতি। তার পরিস্ফুটন ঘটে সন্তানের উপস্থিতিতে। নায়েল আর নিহিতাকে খালামনি জন্ম দেননি। তার জঠরে জন্ম না হওয়া সত্ত্বেও তাদের তিনি মায়ের স্নেহ দিয়েছেন। সেখানে তুমি তার রক্তে জন্ম নিয়েছ। তোমায় কতটা ভালোবাসে তা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।”
সুহাসের শ্বাস ভারী হয়। রাগের চিতায় আগুন ধরিয়ে তার বিসর্জন করে সে। হুমড়ি খেয়ে মায়ের বুকে পড়ে সুহাস।
মা- ছেলের মিলবন্ধনে সকলের নেত্র সিক্ত হয়। অর্হিতা সুডোল গলায় বলল—
“শেষ ভালো যার, সব ভালো তার!”
চলবে,,,