রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী পর্বঃ২৭

রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
পর্বঃ২৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই আরু।”

আরশি থমকে গেল। বজ্রপাতের মতো ঝাটকা খেল। মাথাটা ধপধপ করছে। চোখ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠেছে। কৌতুহল ভরা চোখে রৌদ্রকে দেখছে।

“আরু!!”

রৌদ্রর ডাকে আরশি সম্বিৎ ফিরে পেল। চোখ ফিরিয়ে নিল রৌদ্রর দিক থেকে। প্রচন্ড অস্থিরতায় চোখ বুজে ফেলল। জোড়াল নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল আরশি। আবারও রৌদ্রর দিকে তাকালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। চোখে মুখে কৌতুহল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। আরশি নরম গলায় বলল-

“কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না ডক্টর।”

রৌদ্র সহজ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“কেন?”

আরশি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। রৌদ্রর দিকে দৃষ্টি রেখেই নম্র কন্ঠে বলল-

“আপনাকে একটা কথা বলি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। হয়তো আমার কথা শোনার পর আমাকে বিয়ে করার চিন্তা আপনি নিজেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিবেন।”

রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-

“হুম বলুন মিস আরু আমি শুনছি।”

আরশি বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে রৌদ্রর হাসিটা দেখল। আরশির কাছে খুবই রহস্যময় লাগছে এই হাসিটা। আরশি মুখের উপর লেপ্টে থাকা ভেজা চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিলো। সামনের ঝাপসা রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কঠিন গলায় বললো-

“আমি কখনো মা হতে পারবো না। আমার এতবড় ব্যর্থতার কথা শুনেও কি এখনো বলবেন আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান!!”

রৌদ্র চুপ করে আছে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরশি রৌদ্রর দিকে তাকালো। তীক্ষ্ণ চোখে রৌদ্রর মুখের ভাব পর্যবেক্ষণ করছে। আরশি আশাহত হলো। আরশির কথার বিনিময়ে রৌদ্রর মুখে তেমন কোনো ভাবভঙ্গীমা খুঁজে পেল না। রৌদ্র স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। রৌদ্রর পুরু ভ্রু খানিকটা কুচকে এলো। কিছুক্ষন নিরব থেকে ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সন্দিহান কন্ঠে বললো-

“প্রথমত, আপনি কখনো মা হতে পারবেন না এটা ভুল কথা। দ্বিতীয়ত, এটা এমন কোনো অজানা কথা নয় যা শুনলে আমি আমার কথা থেকে পিছিয়ে যাবো।”

রৌদ্র এমন কথায় যেন বেশ বড়সড় এক ধাক্কা খেল আরশি। বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। দু কদম এগিয়ে গেল রৌদ্রর কাছে। চোখদুটি বড়বড় করে এলোমেলো মস্তিষ্ক নিয়ে রৌদ্রকে বোঝার চেষ্টা করছে আরশি। উত্তেজিত কন্ঠে বলল-

“অজানা কথা নয় মানে কি?? আপনি কি আমার এই কথা জানতেন??”

রৌদ্র মুচকি হাসলো। এক হাতে মুখের উপর লেগে থাকা বৃষ্টির পানি গুলো মুছে নিল। বৃষ্টির বেগ কমে এখন ঝিরিঝিরি ফোটা পরছে। আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি আর বিকেলের শেষ প্রহরের আগমন সব মিলিয়ে চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

“আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম প্রায় আড়াই বছর আগে। আমাদের হসপিটালেই একটা কেবিনের বাহিরে বসে কান্না করছিলেন। সেদিনই ডক্টর আপনাকে বলেছিলেন আপনার মা হওয়ার চান্স খুব কম। তবে কখনো মা হতে পারবেন না এটা আপনার ভুল ধারণা।”

রৌদ্রর কথায় আরশি যেন আকাশ থেকে পরলো। অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেল আরশি। প্রচন্ড কৌতুহল নিয়েই বলল-

“আপনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন এটা আমাকে বলেননি কেন??”

রৌদ্র ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল-

“আমি আপনাকে চিনতাম না। হসপিটালে প্রথম আপনাকে কান্না করতে দেখে কিছুটা বিস্ময়ের বশেই ডক্টরের কাছে আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তবে ওই ঘটনাটা ওইদিনই শেষ। আপনার চেহারা এমনকি আপনার কথাও আমার মনে ছিল না। বাসে এমন আকষ্মিক ঘটনা ঘটার পরেও আপনাকে চিনতে পারিনি। তবে পা মচকানোর সময় যখন আপনার ফ্রেন্ডের মুখে আশু নামটা শুনেছি তখনই হঠাৎ করে দু’বছর আগেই সেই কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আর এটা তো তেমন কোনো কারণ নয় যে আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য পিছ পা হবো।”

আরশির আশাভঙ্গ হলো। আকাশসম অস্বস্তি ঝেঁকে ধরেছে। অভ্যাসগত ভাবে হাত কচলানো শুরু হয়ে গেছে। এই প্রথম এমন কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছে। বাকি সব ছেলেদের মতো রৌদ্র পিছিয়ে যাচ্ছে না কিন্তু কেন!! রৌদ্র আরশির সামনা-সামনি এসে দাঁড়ালো। আরশির মাথায় আলতো করে হাত রেখে নরম সুরে বলল-

“আপনি মা হতে পারবেন কি না সেটা অনেক পরের কথা। আর এখানে তো আপনার কোনো দোষ নেই। শুধু শুধু কেন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চাইছেন মিস আরু!!”

রৌদ্র মাথা থেকে হাত নামিয়ে পকেটে গুজে দিল। আরশি মাথা তুলে তাকালো। বড় একটা শ্বাস নিয়ে শান্ত চোখে রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-

“আমি জেনে শুনে কোনো মানুষের জীবন নষ্ট করতে চাই না। সব পুরুষই চায় তার সন্তান তাকে বাবা বলে ডাকবে। প্রতিটি পরিবারই চায় তাদের ঘর আলোকিত হোক ছোট ছোট বাচ্চার খিলখিল হাসিতে। ঠিক তেমনি আপনারও নিশ্চয়ই ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে বাবা ডাক শোনার!! আপনার বাবা-মাও নিশ্চয়ই চায় আপনার সন্তানের মুখে দাদা-দাদি ডাক শুনতে, তাদের সাথে খেলতে! এমন আরও অনেক স্বপ্নই হয়তো তারা দেখছে আপনা ভবিষ্যত নিয়ে, আপনার সন্তান নিয়ে। আমি কিভাবে জেনে শুনে পুরো পরিবারের স্বপ্ন ভেসে দিতে পারি বলুন তো।”

রৌদ্রর মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটে উঠলো। ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। আঁধার নেমে এসে তার মনে। গম্ভীর গলায় বললো-

“বাচ্চা হবে কি না তার চিন্তা করে আপনি কেন আপনার নিজের জীবনটা নষ্ট করছেন?? একটা বাচ্চার জন্য নিশ্চয়ই আমাদের জীবন থেমে থাকবে না!! আর এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ হাতে। ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা ভেবে এখন কেন সব দূরে ঢেলে দিচ্ছেন। একটা সম্পর্কে ভালোবাসা বেশি ইম্পর্টেন্ট। সম্পর্কে মধ্যে ভালোবাসা থাকলে সন্তান ছাড়াও দুইটা মানুষ একা একা সারাজীবন সুখে শান্তিতে পাড় করে দিতে পারে।”

রৌদ্র কথা আরশির কাছে ভালো লাগলেও তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। আরশি আগের মতোই নির্লিপ্ত ভাবে বলল-

“ভালোবাসার কথা বলছেন!! সুখে শান্তিতে থাকার কথা বলছেন!! কিন্তু কতদিন?? দু বছর?? চার বছর!! বেশি হলে ছয় বছর না হয় সুখে শান্তিতে ভালোবাসা নিয়ে থাকবো। তারপরই শুরু হবে হাহাকার। সন্তানের জন্য হাহাকার। শুরু হবে আফসোস। কেউ বিয়ের এতবছর পরও বাবা ডাক শুনতে না পেরে হতাশ হবে। আবার কেউ কেউ দাদা-দাদি, ফুপি, চাচ্চু ডাক শুনতে না পেরে আফসোস করবে। আশেপাশের মানুষ নানানরকম তিক্ত কথা বলবে। বারবার জানতে চাইবে বাচ্চার কথা। এমন আরও অনেক পরিস্থিতিতেই তখন পরতে হবে। আর আমি চাই না এইসব কিছু আমার সাথে বা অন্য কারও সাথে হোক। নিজের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষ গুলোকেও আমি কষ্ট দিতে পারবো না। সবার কষ্টের ভার বয়ে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না। সেই শক্তি আমার নেই। তাই সারাজীবন একা একা থাকাই আমার কাছে বেটার অপশন বলে মনে হচ্ছে।”

রৌদ্র হতাশ হয়ে পরলো। কিছুটা দূরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি থেমে গেছে কিছুটা সময় আগেই। চারপাশে এখন সতেজতা। স্নিগ্ধ পরিবেশ আর বৃষ্টির পানিতে কালো চিকচিক করা পিচঢালা রাস্তা সব কিছুতেই মুগ্ধতা ছেয়ে আছে। কিন্তু রৌদ্রর মন বিষাদে ভারে উঠেছে। চোখ মেলে গম্ভীরমুখে বলল-

“কাকতালীয় ভাবে আপনার সাথে আমার খুব মিল আছে মিস আরু।”

আরশি কৌতুহলে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্র আবারও আরশির কাছে আসলো। শান্ত গলায় বললো-

“আপনার মতো আমারও বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই। এই কথাটা এর আগে কাউকে বলিনি। নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিলাম। আর এই কারনেই আজ পর্যন্ত কারও সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সাহস পাইনি। তবে আপনাকে দেখে ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমাকে মেনে নিবেন। যেহেতু আমরা একই মেরুর প্রানি। তাই সাহস নিয়েই আপনকে বিয়ের কথা বলেছি। তবে সমস্যা নেই আমি আপনাকে এখনই জোর করছি না আর কোনো চাপও সৃষ্টি করতে চাইছি না আপনার উপর। আমি চাই আপনি মন থেকেই আমাকে মেনে নিন।”

আরশি প্রচন্ডরকম চমকে উঠলো রৌদ্রর কথায়। আরশির মাথায় যেন বাজ পড়েছে। পুরো মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আজ যেন তার জন্য চমকে ওঠার দিন। একের পর এক ধাক্কা খেয়েই যাচ্ছে। আরশি কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না এখন কি করা উচিত। নিজেকে কোনো মতে সামলিয়ে নিয়ে জড়ালো কন্ঠে বললো-

“আমি বাসায় যাবো।”

আরশি আর দেরি করলো না কথাটা বলে। ধীর পায়ে গাড়িতে গিয়ে বসে পরলো। রৌদ্র এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়। দৃষ্টি তার রুদ্রাণীর দিকে৷ ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি। ভেজা চুল গুলো হাতের আঙুলে ঝাড়া দিয়েই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িতে বসে হঠাৎ করেই ঝুঁকে পেছনের সিট থেকে একটা টাওয়েল নিল। আরশি একদম জানালার সাথে চেপে বসে আছে। রৌদ্র আচমকা আরশির মাথায় টাওয়েল দিয়ে ডেকে দু হাতে মাথা মুছে দিতে লাগলো। রৌদ্রর এমন কাজে আরশি পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে আছে। শ্বাস আটকে আসছে। স্তব্ধ হয়ে আছে আরশি। বিন্দু পরিমাণ নাড়াচাড়া করার মতো শক্তি বা সাহস কিছুই পাচ্ছে না। রৌদ্র আরশির চুল গুলো মুছে দিয়ে টাওয়েলটা আরশির গায়েই জড়িয়ে দিল। রৌদ্র নিজের মতো করে ড্রাইভ করছে। আরশি পুরো রাস্তা একটা টু শব্দও করেনি। মনে হচ্ছে আজ একের পর এক ধাক্কা খেয়ে এখনও নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারেনি। বাসার কাছে এসে গাড়ি থামলো। আরশি চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে যেবে তখনই রৌদ্র ডাক দিল।

“আরু।”

আরশি থমকে গেল। দূর্বল চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্রর আরশির মাথায় হাত দিয়ে শালীন কন্ঠে বলল-

“বাসায় যেয়ে গরম পানি দিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিও। আর জ্বর জ্বর ভাব বা ঠান্ডা লাগলে আমাকে একটা কল দিও। আমি বারান্দা দিয়ে ঔষধ দিয়ে দিব।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে বাসায় চলে গেল। রৌদ্র মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আসছে আরশির যাওয়ার পথে। আনমনেই একটা মুচকি হাসি দিল।

——————————

সারারাত বৃষ্টির পর স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। রোদের ঝলকানিতে চিকচিক করছে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়া গাছের উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাতা গুলো। কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো থেকে টপটপ করে পানি পরছে। সূর্যের কিরণে পানির ফোটা গুলো হিরার মতো ঝলঝল করে পরছে। আরশি একা একা বসে আছে ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। রৌদ্রস্নাত এই সকালের স্নিগ্ধতায় মন ছু্ঁয়ে যাচ্ছে আরশির। কাল সন্ধ্যার ঘটনা গুলোর পর আরশির ঘুম যেন আরশির সাথে লুকোচুরি খেলছে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে অতিষ্ঠ প্রায়। প্রচন্ড বিরক্ত হয়েই সকাল ভোরেই ভার্সিটি এসে পরেছে একা একা। প্রায় একঘন্টা ধরে বসে আছে এই বেঞ্চিতে। মাথার মধ্যে চলছে তুমুল ঘূর্ণিঝড়। রৌদ্রর বলা কথা আর কর্মকাণ্ড গুলো নিয়েই হচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়। আরশি বুঝতে পারছে না কি সে করবে। তবে কাল রাত থেকে একবারও বারান্দায় যায়নি। রৌদ্রর মুখোমুখি হওয়া এখন আরশির জন্য ভয়ংকর লজ্জার ব্যাপার মনে হচ্ছে।

“কিরে তুই না-কি সকাল ভোরেই ভার্সিটিতে চলে এসেছিস!! পাগল নাকি তুই!! একা একা এখানে বসে করছিস!! তোর জন্য আমাদেরও তাড়াতাড়ি আসতে হলো।”

আরশি মাথা তুলে নীলের দিকে তাকালো। মুখে ক্লান্তির ছাপ। হয়তো খুব তাড়াহুড়ো করেই এসেছে। কিছুটা দূরেই নীলা দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে এদিকে।

চলবে…

(ধামাকাটা কেমন লেগেছে জানাবেন। আরও ধামাকার জন্য অপেক্ষা করুন।😏 ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here