রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
পর্বঃ৪২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন মিস্টার আহান?”
আরশি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে শক্ত গলায় বলল আহানকে। আরশির কথায় আহান আরও শক্ত করে আরশির হাত চেপে ধরলো। আরশির পাশ থেকে কাসফিয়া রাগী কন্ঠে বলল-
“কি হলো আপনি আশুর হাত ধরেছেন কেন? ছাড়ুন ওর হাত।”
আহান অপরাধীর ন্যায় আরশির দিকে তাকালো। নিম্নস্বরে বলল-
” প্রথমেই তোমার হাত ধরার জন্য সরি বলছি আরশি। আসলে আমি দু’দিন ধরে তোমার জন্য ভার্সিটিতে এসে অপেক্ষা করছি। অবশেষে আজ তোমাকে পেলাম কিন্তু তুমি আমাকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছিলে তাই বাধ্য হয়ে হাত ধরেছি।”
আরশি কাঠকাঠ বলল-
“আমার হাত ছাড়ুন আহান।”
আহান আরশির হাত ধরে রাখা অবস্থাতেই অনুনয়ের স্বরে বলল-
“ছাড়বো তবে আমার কথা গুলো আগে শোনো।”
“আমি শুনছি আপনার কথা। আপনার যা বলার আমাকে বলুন।”
রৌদ্র কন্ঠ শুনে আরশি দ্রুত ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালো। রৌদ্রর চোখমুখ শক্ত হয়ে আছে। চোখ গুলোতে রাগের আভাস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চোয়ালা শক্ত করেই একটা মেকি হাসি দিয়ে আরশির দিকে এগিয়ে আসলো। আহানের হাত থেকে ছাড়িয়ে রৌদ্র নিজের মুঠোয় আলতো করে বন্দী করে নেয় আরশির হাত। আহান ভ্রু কুচকে রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করল-
“আপনি কে?”
রৌদ্র হাল্কা হাসলো। আরশির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল-
“আমি কে সেটা না হয় পরে বলবো তবে আপনি যার হাত ধরে রেখেছিলেন সে আমার একমাত্র ভালোবাসার বউ। আর আমি আমার ভালোবাসার বউয়ের হাত অন্য কোনো ছেলেকে ধরার অনুমতি দেইনি। তাই না মিস আরু!”
রৌদ্র শেষের কথাটা আরশির দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল। আহান প্রথমে খানিকটা অবাক হলেও শেষের কথায় ভ্রু কুচকে ফেলে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল-
“আপনি মজা করছেন আমার সাথে?”
রৌদ্র আহানের দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবেই জিজ্ঞেস করল-
“আমার কথা আপনার কাছে মজা মনে হচ্ছে কেন মিস্টার?”
আহান মুচকি হেসে বলল-
“মজা নয়তো কি মনে হবে ভাই? প্রথমে বললেন আরশি আপনার বউ, তারপর আবার মিস আরু বলে ডাকছেন ওকে। এটা মজা নয়তো কি!”
আরশি বিস্মিত হয়ে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্র এখনো তাকে মিস আরু বলে ডাকে! এতক্ষন এটা খেয়াল না করলেও আহানের কথা শুনে আরশির মনে কৌতূহল জেগে উঠলো। সত্যিই তো ডক্টর রোদ এখনো আমাকে মিস আরু বলেই ডাকে। হঠাৎই আরশির বাহুতে কারও স্পর্শ অনুভব করায় আরশি ভাবনা থেকে ফিরে আসলো। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলো রৌদ্র তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে। আরশি রৌদ্র মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রৌদ্রর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি লেগে আছে। রোদের আলোয় রৌদ্রর চোখ জোড়া চিকচিক করছে। সিল্কি চুল গুলো কিছুটা কপালে এসে পরেছে। হাসির ফলে গালের টোলটা দাঁড়িতে ডেকে কালো হয়ে আছে।
“আজ দু’দিন হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ে বলতে পারিবারিক ভাবেই আকদের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। আর মাত্র পনেরো দিন পরে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। আরুকে আমি সেদিন থেকেই মিস বলা বন্ধ করবো যেদিন থেকে আমার দিন শুরু হবে আরুর মুখ দেখে।”
আহান আহত দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকালো। রৌদ্রর এভাবে জড়িয়ে ধরায় আরশি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। রৌদ্র আরশিকে ছেড়ে দিয়ে আহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আহান কাঁপা কাঁপা হাতে রৌদ্র সাথে হ্যান্ডশেক করলো। রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি ডা.রৌদ্র আহনাফ। তবে আরু আমাকে ডক্টর রোদ বলেই ডাকে। আমার কিন্তু আরও কিছু পরিচয় আছে। আমি আরুর একমাত্র হাসবেন্ড, চিঠিপ্রেমিক, পাশের বারান্দা, পাখির মালিক, অসভ্য ডাক্তার। আরেকটা নাম আছে। কি যেন নাম রেখেছিলে আরু! কি হলো বলো..”
আরশি রৌদ্রর পরিচয় দেওয়া দেখে মনে মনে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই মুহূর্তে হাসা উচিত হবে না তাই আরশি নিজের হাসি কন্ট্রোল করার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আরশি কোনো রকম হাসি চেপে রেখে মৃদুস্বরে বলল-
“এ্যাংরি বার্ড।”
আরশি নামটা বলার সাথে সাথে কাসফিয়া হাসিতে ফেটে পরলো। আরশিও হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাসছে। আহান কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল-
“আমি এখন আসছি।”
আহান কথাটা বলে হনহনিয়ে চলে গেল। আহান কখনোই ভাবেনি আরশির এভাবে হুট করেই বিয়ে হয়ে যাবে। আরশি আর কাসফিয়া এখনো হেসে যাচ্ছে। রৌদ্র আরশির হাসি মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আরশির হাতের দিকে তাকালো। পকেট থেকে রুমাল বের করে আরশির হাত মুছতে লাগলো। আরশি আর কাসফিয়া দুজনেই হাসি থামিয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে রৌদ্রর কাজ দেখছে। আরশি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
“কি করছেন আপনি? আমার হাত মুছে দিচ্ছেন কেন?”
রৌদ্র আরশির হাত মুছতে মুছতেই গম্ভীর গলায় বলল-
“অন্য লোকের ছোয়া লেগেছে তোমার হাতে তাই মুছে দিচ্ছি। আমি ছাড়া অন্য কোনো ছেলের স্পর্শ তোমার হাতে রাখতে দেই কি করে আরু!”
রৌদ্র কথায় আরশি ড্যাবড্যাব করে নিজের হাতের দিকে একবার আরেকবার রৌদ্রর দিকে তাকালো। প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে কাসফিয়া আর আরশি একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। এই মুহূর্তে রৌদ্রর কাজকর্ম দেখে হাসবে নাকি কান্না করবে তা কিছুই বুঝতে পারছে না আরশি। রৌদ্র আরশির হাত মুছে দিয়ে বলল-
“যাও এখন।”
“কিন্তু আপনি এখানে কেন এসেছিলেন?”
আরশির উৎকন্ঠিত হয়ে রৌদ্রকে প্রশ্ন করল। রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল-
“বাসায় যাবো এখন তাই ভাবলাম নতুন বউকে একবার দেখে যাই।”
আরশি রৌদ্রকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রৌদ্র আবারও শান্ত গলায় বলল-
“ক্লাস শেষে আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। সাবধানে থেকো ভালোবাসার বউ।”
রৌদ্র গাড়ির দিকে যেতে যেতে লাস্ট কথাটা একটু জোরেই বলল। আরশি অপ্রস্তুত হয়ে আসেপাশে তাকালো। কয়েকজন মানুষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি কাসফিয়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরে দ্রুত পায়ে ভার্সিটিতে চলে গেল।
————————
প্রিয় রুদ্রাণী,
আর কত কষ্ট দিবে ভালোবাসার বউ? দশ দিন ধরে কতো করে অনুরোধ করছি শুধুমাত্র একবার ভালোবাসি বলতে কিন্তু তুমি তো তোমার হাসবেন্ডকে একদমই ভালোবাসো না। তাই আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছো। এটা কিন্তু একদমই ঠিক হচ্ছে না আরু।
ইতি
রৌদ্র(অসহায় হাসবেন্ড)
বিছানায় বসে আরশি চিরকুটটা পড়ে একা একাই হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই আরেকটা চিরকুটের ভাজ খুলে পড়তে লাগলো।
প্রিয় রুদ্রাণী,
আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই রেগে আছি আরু। কি এমন হবে একবার ভালোবাসার কথা মুখে বললে! আমি তো অন্য কারও হাসবেন্ড না তোমারই প্রেমিক হাসবেন্ড। এতো কিসের লজ্জা তোমার? ভালোবাসলে সেটা মুখে বললে কি তোমার পাপ হবে না-কি!
[বিঃদ্রঃ আজ বিকেলের মধ্যে ভালোবাসি না বললে সত্যিই তোমার আর রেহাই নেই আমার কাছ থেকে।]
ইতি,
রৌদ্র(এ্যাংরি বার্ড)
আরশি এবার চিরকুট পড়ে জোরে জোরেই হেসে দিলো। গত দশদিন ধরে রৌদ্র এসব পাগলামি দেখে আরশি বড্ড বেশিই মজা পাচ্ছে। প্রতিদিন সকালে আর রাতে এতোগুলো করে চিরকুট লিখে আরশির বারান্দায় ছুড়ে ফেলা রৌদ্রর নিয়মিত কাজ। আর প্রতিটি চিরকুটে একটাই অনুরোধ থাকে সেটা হলো আরশির মুখে ভালোবাসি শোনা। আরশি এখনো রৌদ্রকে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলেনি। তবে এই কয়দিনে রৌদ্রর প্রতি আরশির ভালোবাসা আকাশস্পর্শী হয়ে উঠেছে। রৌদ্রর প্রতি প্রচন্ডভাবে দূর্বল হয়ে পরেছে আরশি। রৌদ্র চিঠিতে প্রেমিক পুরুষ হলেও সরাসরি একজন দায়িত্ববান স্বামী। চিঠিতে পাগলামি করলেও আরশির সাথে দেখা হলে সব সময় স্বাভাবিক ভাবেই থাকে। সকাল বেলা ভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়া, পড়াশোনা আর খাওয়া দাওয়া নিয়ে আরশিকে শাসন করা প্রতিদিন এ-সব খেয়াল করাই রৌদ্রর কাজ।
————————
বিয়ের অনুষ্ঠানের আর মাত্র পাঁচদিন বাকি। বিকেলে আরশিরা সবাই শপিংমলে কেনাকাটা করতে এসেছে। আরশির বিয়ের সব রৌদ্র নিজেই পছন্দ করে কিনেছে। আরশি বার বার আড় চোখে রৌদ্রকে দেখছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। তবে রৌদ্রর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রৌদ্র সব সময়ের মতোই শান্তশিষ্ট, গম্ভীরমুখে সবার সাথে কথা বলছে। সন্ধ্যার দিকে নীল, নির্বান আর বাকি সবাই নিজেদের মতো কেনাকাটা করছে। হঠাৎ করে তাদের মাঝ থেকে কেউ আরশিকে হেচকা টান নিয়ে গেল।
চলবে…
(দুঃখিত। হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️)