#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam
_________________[৩১]___________________
.
ঘুম ভেঙে গেছে নীরা’র। বার কয়েক সে চোখ বুজে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম এলো না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে ঘরটা। জানালার পর্দা টেনে দেয়ায় চাঁদের আলোর ছিটেফোঁটাও প্রবেশ করতে পারছেনা।
নীরা পাশ ফিরল। তার বাম পাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ওজগে। থেমে থেমে তার শ্বাসপ্রশ্বাস এর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
নীরা হাত বাড়িয়ে বেড টেবিলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে স্ক্রিন অন করে দেখল রাত আড়াইটা বাজে। এখন এভাবে শুয়ে থাকলে ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। নীরা ফোন রেখে বেড থেকে নেমে এলো। একটু হাটাহাটি করলে হয়তো ঘুম আসবে।
ব্যালকনি দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে ওপর তলার হল রুমটা। নীরা রুম থেকে বেরিয়ে বড় ব্যালকনিতে এসে দাড়ালো সে। ফুরফুরে বাতাস বইছে বাইরে! দু’হাত বুকে গুজে সে হাওয়াটা অনুভব করতে লাগল।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আলোকিত ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটে চলা গাড়ির শব্দ কানে আসছে মাঝেমধ্যে। তারপর আবারও নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ।
হটাৎ ডানা ঝাপটানোর মতো ফতফত শব্দে চমকে তাকালো নীরা। তার থেকে হাত কয়েক উঁচুতে একটা অতিকায় বাদুড় উড়ে বেড়াচ্ছে!
সাথেসাথেই নীরা ছিটকে সরে এলো। তার পিঠ ঠেকে গেলো ব্যালকনির গ্লাসে। বাদুড়টা এখনও উড়ে বেড়াচ্ছে ব্যালকনির সামনে।
এটা কি সাধারণ কোনো বাদুড় নাকি নীরা’র দেখা সেই রক্তচোষা!? এক ঝলক সেটার চোখ জোড়া দেখতে পেলো সে। চুনি পাথরের ন্যায় জ্বলন্ত চোখ!
মুহুর্তের জন্য নীরা’র মনে পড়ল, দুই বছর আগে সেই ভয়ানক রাতের দৃশ্য। মিলিয়ানকে নিয়ে সে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলো। পথিমধ্যে সেই কাঠের গুড়ি!
ড্রাইভার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া! তারপর সেই এক ঝাক বাদুড়ের আক্রমণ! সেই রক্তচোষা পিশাচ পিশাচিনীদের কবল থেকে তাকে রক্ষা করেছিলো ওরহান!
ওরহানের কথা মনে পড়তেই নীরা’র মন থেকে সমস্ত ভয় উবে গিয়ে এক ঝলক খুশির রেখা ফুটে উঠল। দুইটা বছর কেটে গেছে।
কিন্তু সে এখনও ভুলতে পারেনি ওরহানকে আর না মিলিয়ানকে। দুইটা বছরের প্রতিটি রাত স্বাক্ষী, সে কি যন্ত্রণা নিয়ে পার করেছে দিন গুলো।
নীরা গ্লাস থেকে সরে রেলিঙের ধারে ছুটে গেল। বাদুড়টা এখনও উড়ে বেড়াচ্ছে। নীরা সেটার দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারলো না। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। অসহ্য যন্ত্রণায় তার ভেতরটা কাতরাচ্ছে।
পরক্ষণেই বাদুড়টা উলটো দিকে উড়ে চলে গেলো! ধুপ করে ব্যালকনির ফ্লোরে বসে পড়ল নীরা। তার চোখে নোনাজল টলমল করছে। চোখ বুজতেই তার চিবুক বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
________________________________
.
ওজগে’র ডাকে ঘুম ভাংলো নীরা’র। ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখল, ওজগে স্কুল ড্রেস পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবার নিজের দিকে তাকালো নীরা।
সে বিছানায় শুয়ে আছে! কিন্তু সে তো গত রাতে ব্যালকনিতে! তারপর কিভাবে রুমে এলো মনে পড়ছে না তার। ওজগে চুল বেনি করতে করতে বলল,
—–” আপু! ওঠো, নিচে সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়েট করছে।
নীরা শোয়া ছেড়ে উঠে বলল, ” হুম, উঠছি।
—–” আমার স্কুলের টাইম হয়ে গেছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো।
ওজগে তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নীরা সেদিকে তাকিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। কেমন একটা ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব লাগছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই হয়তো।
নীরা বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকল। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে নামতে দেখল, ওজগে ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেছে।
ডাইনিংয়ে বসে আছে ওজগে’র বাবা-মা, নীরা’র বাবা-মা আর একটা ছেলে বসে আছে। সিড়ির দিকে উলটো পিঠ করে বসে থাকায় ছেলেটাকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই ওজগে’র ভাই!
—–” নীরা! আমার পাশে এসে বসো।
নীরা’কে নামতে দেখে ডাক দিল জান্নাত। ডাইনিং এ বসে থাকা সকলেই এবার নীরা’র দিকে তাকালো। শুধু সেই ছেলেটা বাদে। নীরা এসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। নাজনীন একটা ট্রেতে অমলেট, শসা স্লাইস, মধু, কবুতরের স্যুপ, মেনেমেন আর এক কাপ তুর্কিশ চা নিয়ে এগিয়ে দিল নীরা’র দিকে।
—–” ওরহান, ও হল নীরা। আমার মেয়ে!
নীরা সবে চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছিলো। বাবার কন্ঠে ওরহান নামটা শুনে যেন মাথায় বাজ পড়ল তার। তার সামনে কে বসে আছে! ওরহান!? নাকি ওরহান নামের অন্য কেউ!!?
নীর অনেক চেষ্টা করেও মুখ তুলতে পারলো না। পাথরের ন্যায় স্থির হয়ে গেছে সে। হাত সরছে না। পা ঝিনঝিন করছে। মৃদু কাপছে নীরা’র শরীর।
—–” কেমন আছেন নীরা!?
চোখ বুজে ফেলল নীরা। সেই কন্ঠঃ! চিরচেনা সেই কন্ঠঃ যা শোনার তৃষ্ণায় বছরের পর বছর ধুঁকছে নীরা! আজ সেই কন্ঠঃ শুনে তার এতদিনের জমে থাকা অভিমান যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
—–” নীরা!
ওজগে’র বাবা-র ডাক কানে এলো। সবাই নীরা’র দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে বসে আছে নীরা। কি করবে সে এখন!? মুখ তুলবে!? তুলে যদি দেখে তার ধারণা মিথ্যে!? ওরহান এর বদলে অচেনা কেউ বসে আছে তখন!?
নীরা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে তাকালো। না, সে ভুল শোনেনি! মিথ্যে নয় তার ধারণা! তার সামনে সশরীরে বসে আছে ওরহান! ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে ধরল নীরা। তার নাক লাল হয়ে গেছে। চোখের পাপড়ি কেপে উঠছে বারবার।
—–” স্যরি, রাতে ভালো ঘুম হয়নি তো। তাই একটু মাথাব্যথা করছে।
কথাটা নীরা উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলল। স্বাভাবিক হয়ে এলো সবাই। ব্রেকফাস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার। নীরা খেয়াল করল, ওরহান এক চুমুকে গরম চায়ের সবটুকু খেয়ে নিল। নীরা’র দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না। কিন্তু নীরা যেন তার থেকে চোখই সরাতে পারছেনা।
সবকিছু এলোমেলো লাগছে। ওরহান এখানে!? কিন্তু কিভাবে!? নীরা’র হটাৎ মনে পড়ল সেদিনের কথা, যেদিন সে প্রথম ওরহানকে দেখেছিলো। সী সাইডের সেই কাঠের বাড়িটায়।
—–“এটা আপনার বাচ্চা?
—–“আমি ওর খালামনি।
—–“ওহ।
ওরহান হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলেছিলো,” আমি ওরহান উজুন।
নীরা সেদিন খুব অবাক হয়ে বলেছিলো, ” ওরহান উজুন! আপনি কি টার্কিশ!?
ওরহান স্মিত হেসে মাথা দুলিয়েছিলো, যার মানে হ্যাঁ। নীরাও হাত বাড়িয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলেছিলো, ” নীরা হক।
—–” আপনি বাংলাদেশি?
—–” জ্বি। বিএসসি করতে জার্মানি এসেছি। আর আপনি?
—–” একটা জরুরি কাজে এসেছি। সেটা শেষ করে আবার তুর্কি ফিরে যাবো।
__________________________
ওজগে’র বাবা ব্রেকফাস্ট সেরেই ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। জান্নাত আর নাজনীন গেছে বাজার করতে। মুহিদুলকে নিয়ে বাইরে গেছে ওরহান। বাসায় নীরা একা।
ওজগে স্কুল থেকে ফিরবে দেড়টার দিকে। এখন বাজে, সাড়ে ন’টা। কিচেনে বসে মটরশুঁটি ছাড়াচ্ছে নীরা। জান্নাত এক ঝুড়ি মটরশুঁটি বাছতে দিয়ে গেছে তাকে।
মহিলা বেশ কৌশলে নীরা’কে পরীক্ষা করছে। একমাত্র ছেলের বউ বাছাই পরীক্ষা! বাইরে পড়াশোনা করেছে শুনে তার ধারণা, নীরা ঘরের কাজকর্ম কিছুই পারেনা।
তাই সে নিজ দায়িত্বে নীরা’কে কাজ শেখাচ্ছে। নীরা সেসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ পাচ্ছে না। জান্নাত তাকে আরও কি কি কাজ শেখাবে সেসব নিয়ে ভাবার সময় কই তার!
ঘুরে ফিরে শুধু সেদিনের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছে নীরা। সোফিয়ার ফরেনসিক রিপোর্ট এ এসেছিলো, সে নাকি ভয়ংকর কিছু দেখে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। সোফিয়া কি দেখেছিলো সেদিন!? কেউ জানে না!
পুলিশ এসে শুধু তাদের তিনজকেই পেলো। ওরহান যদি বেচেই থাকে, তাহলে ওখান থেকে পালালো কিভাবে!? আর পালিয়ে যাওয়ার পর এতদিন সে নীরা’র সামনে কেন আসেনি!?
গ্লাসে পানি ঢালার শব্দে চমকে উঠল নীরা। কোত্থেকে ওরহান এসে একটা বড় গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে ধপ করে চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। পুরো দৃশ্য দেখে থ হয়ে তাকিয়ে আছে নীরা। হাতে তার আধখোলা মটরশুঁটির খোসা।
—–” বাবা কোথায়?
জিজ্ঞেস করল নীরা। ওরহান কিছুটা এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে রাখা মটরশুঁটি হাতে নিয়ে খেতে খেতে বলল,” আংকেলকে এলাকার এক সেলুনে রেখে এসেছি। মুরুব্বিদের সাথে খোশগল্পে মেতেছে সে।
নীরা আবারও মটরশুঁটি ছিলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জান্নাত বাজার থেকে ফিরে আসার আগেই কাজটা সেরে সে এখান থেকে কেটে পড়বে। নয়তো আবারও কোন কাজে লাগিয়ে দেবে কে জানে।
—–” বেশ ভালই তো কাজ করছো দেখি! হবু শ্বাশুড়ির মন জয় করতে নাকি!?
বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলল নীরা। সে একটু আগেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলো যে সে ভুল দেখছে। কিন্তু এখন আর কোনো সন্দেহ নেই, এটাই ওরহান।
—–” দুইটা বছর কেটে গেছে! প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর সময় ভাবতাম, মাঝরাতে মিলিয়ান আসবে। এসে আমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে, ঠিক আগের মতো।
থেমে গেলো নীরা। ওরহান চেয়ে রইলো নীরা’র দিকে। নীরা’র ঠোঁট কাপছে। চোখ ছলছল করছে তার।
—–” প্রতিদিন সকালে দরজা খুলতে গিয়ে ভাবতাম, দরজা খুলেই আপনাকে দেখতে পাবো! পাইনি! না মিলিয়ানকে, আর না আপনাকে।
নীরা’র চোখে জল টলমল করছে। একটু টোকা দিলেই যেন গড়িয়ে পড়বে নোনাজল। নীরা করুন দৃষ্টিতে ওরহানের দিকে তাকিয়ে বলল, ” কেন আসেননি? কেন বলতে পারেন!?
ওরহান কিছু বলল না। সে থেমে থেমে নিঃশ্বাস ফেলছে। সকালে ডাইনিং এ বসে খাওয়ার সময়ও ঠিক এমনই দেখাচ্ছিলো ওরহানকে। কেমন যেন মলিন হাসি লেগেছিলো মুখে।
—–” আচ্ছা বলতে হবে না! আমি কিচ্ছু জানতে চাই না। এখন জেনেও কিছুই পরিবর্তন হবে না।
নীরা চেয়ার ছেড়ে উঠে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলো। কান্না পাচ্ছে তার। আর কিছুক্ষণ ওরহানের সামনে থাকলে সে সত্যিই কেদে ফেলবে।
কিন্তু সে ওরহানের সামনে কাদবে না। নিজের কষ্ট সে নিজের মধ্যে রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু চার দেয়ালে ঘেরা বদ্ধ ঘরই শুনতে পায় তার আর্তনাদ।
__________________________
নাজনীন আর জান্নাত বাজার করে এনেছে। মাঝ পথ থেকে মুহিদুল বয়ে এনেছে বাজারের ব্যাগ। ওরহান গেছে বোড্রুম এ। ফিরবে রাতে।
নীরা সেই যে ঘরে গেছে এখনও বাইরে বের হয়নি। ওরহানকে হারিয়ে যে কষ্ট সে পাচ্ছিলো, ওরহানকে সামনে দেখে যেনো তার কষ্ট দ্বিগুন বেড়ে গেছে!
নীরা সারাটাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখল। ওরহান বাসায় নেই জেনেও সে বের হল না। তার এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। দেশে ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছে না।
মন চাচ্ছে পালিয়ে যেতে। দূরে কোথাও। যেখানে গেলে কেউ তাকে খুজে পাবে না। এমনকি ওরহানও না! তখন ওরহান বুঝবে, এতগুলো বছর নীরা কি যন্ত্রণা নিয়ে কাটিয়েছে।
দিনের আলো ফুরিয়ে নেমে এলো রাত। কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল ইজমির। ওজগে এক মগ কফি আর এক কাপ চা এনে ব্যালকনিতে এসে দাড়ালো। নীরা রেলিঙের ধারে হেলান দিয়ে রাতের ইজমির দেখছে।
—–” আপু, এই নাও তোমার ব্ল্যাক কফি!
নীরা কফির মগ হাতে নিয়ে হেসে বলল, ” তুমি কিভাবে জানো যে আমার ব্ল্যাক কফি পছন্দ!?
—–” সেটা এখন বলবো না। তবে আমার ভাইয়াও কিন্তু ব্ল্যাক কফি পছন্দ করে!
বলতে বলতে চায়ে চুমুক দিল ওজগে। নীরা আবারও চুপচাপ হয়ে গেলো। বুঝতে বাকি নেই ওজগে কিভাবে জানে যে, তার ব্ল্যাক কফি পছন্দ। নীরা কিছু একটা ভেবে বলল,
—–” আচ্ছা ওজগে, তোমার ভাইয়া কি আগে জার্মানিতে থাকতো!?
—–” ভাইয়া গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর আব্বুর ব্যবসা দেখাশোনা করতে শুরু করে। তখন থেকে আব্বু দেশের ভেতরে ব্যবসা সামলায় আর ভাইয়া ব্যবসায়িক কাজে দেশের বাইরে থাকে। মাঝে কয়েক বছর জার্মানিতে আসা-যাওয়া করতো। এখন বেশিরভাগ সময়ই তুরস্কে থাকে।
—–” জার্মানি থেকে পার্মানেন্টলি ফিরেছে কবে!?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো ওজগে। সে বুঝতে পারছেনা নীরা হটাৎ এসব জানতে চাচ্ছে কেন!? নীরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে বলল,” না, আসলে আমিও জার্মানিতে পড়াশোনা করেছি তো। তাই আর কি!
—–” হুম আমি জানি।
ওজগে একটু থেমে আবার বলল, “ভাইয়া গত বছর থেকে তুরস্কে সেটেল হয়েছে।
নীরা’র কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। গত বছর! তাহলে তার আগে ওরহান কোথায় ছিলো!? নীরা’র ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ওজগে বলল,” তুমি জানতে চাইছিলে না, আমি কেন বাংলাদেশে যাইনি!?
নীরা এবার ওজগে’র দিকে তাকালো। ল্যাম্পপোস্ট এর হলদেটে আলোয় মেয়েটাকে মোমেরপুতুল মনে হচ্ছে। নীরা জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওজগে’র দিকে। ওজগে স্মিত হেসে বলল,
—–” আমি ছোট থেকেই খুব অসুস্থ ছিলাম। ডক্টর কোনো রোগ খুজে পেতো না। বাবা-মা অনেক ডক্টর দেখিয়েছে। লাভ হয়নি। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত আমি বেডে শুয়ে কাটিয়েছি। আমাকে প্যারালাইসিস রোগীর মতো ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে।
——” তারপর!?
সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল নীরা। ওজগে খালি চায়ের কাপটা পাশে টি-টেবিলের ওপর রেখে নীরা’র পাশে দাঁড়িয়ে বলল,” আমার তখন সাত বছর বয়স। একদিন দুপুরে এক ভিখারি এলো বাড়িতে। মা তাকে খেতে দিল। আমি ওপরতলায় নিজের রুমে ঘুমিয়েছিলাম। ভিখারি আমাকে না দেখেই বলল, এই বাড়িতে একটা ডাইনি আছে!
চমকে উঠল নীরা। ওজগে হেসে বলল, ” ডাইনিটা যে কে!? সেটা সে বলেনি। এলাকার লোক ধরে নিল, আমিই সেই ডাইনি! রাতারাতি পুরো এলাকায় রটে গেলো ব্যাপারটা। শেষে এমন অবস্থা হল যে ভাইয়া আমাকে নিয়ে ইজমির ছেড়ে আংকারা চলে গেলো। আশ্চর্যজনকভাবেই আংকারা যাওয়ার পর আমি সুস্থ হতে লাগলাম। আট বছর বয়সে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলাম। ফিরে এলাম ইজমিরে। ততদিনে এলাকার মানুষজনের কাছে সেই ডাইনি ব্যাপারটা পুরনো হয়ে গেছে। আমাকে সুস্থ ভাবে ফিরতে দেখে সবাই সবকিছু ভুলে গেলেও, ভাইয়া কেন জানি আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিতো না। স্কুলে আসা-যাওয়া করা ছাড়া, এখনও আমার বাইরে বের হওয়া নিষেধ। তাই ভাইয়া এলে আমি বাইরে যাই না।
…………………………..(চলবে)………………………….