#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam
_________________[৩২]________________
ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। বাসায় সবাই ঘুম। কিন্তু নীরা’র চোখে ঘুম নেই। তার মাথায় ঘুরছে আকাশপাতাল চিন্তা। তার মামির চাচাতো বোনের ছেলে ওরহান!
দুই পরিবারের মধ্যে তাদের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছে। তাদের জানামতে ওরহান আর নীরা কেউই কাউকে চেনেনা, তাই চেনাজানার জন্যই এই বেড়ানোর উদ্দেশ্য।
নীরা’র মা-বাবা তো কিছুই জানেনা। কিন্তু ওরহানের বাবা-মা! তারা কি জানে যে, তাদের ছেলে কে! বা কি!? নাকি তারাও ওরহানের মতই!
হল রুমে কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠল নীরা। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। রুমের দরজা ভেজানো। বাইরে কে আছে দেখা যাচ্ছে না।
এত রাতে হল রুমে কে!? জান্নাত নাকি ওসমান!? ওরহান না তো! নীরা বেড থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ভেজানো দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখল, কেউ নেই!
কিন্তু ব্যালকনির দরজা খোলা! নীরা কি ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হল রুম অন্ধকার। বাইরে থেকে আসা চাঁদের আলোয় মৃদু আলোকিত হয়ে আছে।
নীরা পা টিপে টিপে ব্যালকনিতে উঁকি মেরে দেখল রেলিঙের ধারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরহান। একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল নীরা। ব্যালকনিতে যাবে নাকি রুমে ফিরে যাবে সেই দ্বিধায় পড়ল।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে গেলো রেলিঙের ধারে। ওরহান তাকালো না। সে এক দৃষ্টিতে আকাশে ঝুলে থাকা রূপোলী চাঁদটা দেখতে ব্যস্ত।
—–” ভেবেছিলাম আর কখনও আমাদের দেখা হবে না! কিন্তু নিয়তি! আবারও আমাদের সামনে নিয়ে এলো!
ওরহানের কন্ঠে কেমন যেন একটা আহত সুর অনুভব করল নীরা। যেন সেও এতগুলো বছর এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে সে কেন সামনে আসেনি!? নীরা তো জার্মানিতেই ছিলো! তাহলে!?
—–” আপনার বাবা-মা! ওজগে জানে!?
হাসল ওরহান। তাচ্ছিল্যের হাসি। নীরা দৃষ্টি সরিয়ে আকাশে তাকালো। অগণিত তারা গুলো ঝিকমিক করছে। রূপোলী থালার মতো চাঁদ থেকেই যেন উৎপত্তি তাদের। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আকাশ জুড়ে!
—–” তুমি কখনো জানতে চাওনি, আমি কিভাবে জানলাম যে লিও আর মীরা’র সাথে কি ঘটেছিলো!
সচকিত হয়ে তাকালো নীরা। সত্যিই তো, সে জানতে চাইনি! কিন্তু ওরহান হটাৎ এসব বলছে কেন!? ওরহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—–” গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরপরই বাবা ব্যবসার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলো আমার হাতে।
দেশের মধ্যে সে সামলাতো আর দেশের বাইরেরটা আমি।
ব্যবসায়িক কাজে, সৌদি, দুবাই আর জার্মানিতেই বেশি আসা-যাওয়া করতে হত।
বলতে গেলে বছরের বারো মাসের মধ্যে আটমাসই বাইরে থাকতাম।
জার্মানিতে যে কোম্পানিতে আমরা প্রোডাক্ট সাপ্লাই দেই সেখানেই জব করতো লিও।
আরেক দফা চমকে উঠল নীরা। লিওকে ওরহান আগে থেকেই চিনতো! মানে কি!? নীরা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলো ওরহানের দিকে। ওরহান সেদিকে না তাকিয়েই বলল,
—–” কাজের ক্ষেত্রে পরিচয় হলেও, অল্প সময়েই কিভাবে যেন আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। লিও তখন সদ্য বিয়ে করেছে মাত্র।
বাড়ি কিনেছে রেগেন্সবূর্গে। বন্ধুত্বের খাতিরে জার্মানিতে গেলেই লিও’র বাসায় যেতাম।
সেই থেকে মীরা’র সাথে পরিচয়। আমি জানতাম না, মীরা আমাদের আত্নীয়।
ওরহান এবার নীরা’র দিকে তাকালো। নীরা’কে ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। মুখে কিছু বলছে না কিন্তু তার মনের মধ্যে প্রশ্নের যে ঝড় বইছে সেটা তার চোখেমুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওরহান।
—–” লিও ভীষণ চঞ্চল স্বভাবের ছিলো কিন্তু মীরা ছিলো তার একেবারেই বিপরীত। শান্তশিষ্ট, অল্পভাষী মেয়ে মীরা!
মীরা’র প্রসঙ্গ উঠতেই স্মিত হাসল নীরা। তার বোন সত্যিই খুব শান্ত স্বভাবের ছিলো, বড় মেয়ে বলে হয়তো! নীরা ছিলো ভীষণ চঞ্চল।
যেকোনো দোষ করলে সে বকুনির ভয়ে মীরা’র ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিতো। মীরাও ছোট বোনের জন্য নিজে দোষ শিকার করে বকুনি খেতো।
—–” সে’বার ওরা মিশর থেকে ফেরার কয়েক মাস পর জার্মানি গিয়ে দেখি লিও আর আগের মতো নেই। প্রাণবন্ত যুবক যেন অল্প কদিনেই বুড়িয়ে গেছে। চোখমুখ অসম্ভব ফ্যাকাশে দেখাতো।
আমি জিজ্ঞেস করার আগেই লিও নিজেই খুলে বলল সবকিছু। আমি ভেবে পেলাম না কি বলবো।
লিও খ্রিস্টান ধর্মের, তাকে কি পাদ্রীর কাছে নিয়ে যাবো!? গিয়ে কি বলবো!?
শেষে সমাধান করা যেমনতেমন হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। আমি লিওকে বললাম, আমার সাথে তুরস্কে আসতে।
এখানে নিয়ে চেনা জানা কোনো হুজুর দেখিয়ে যদি কোনো উপায় হয়। লিও বলেছিলো আসবে।
আমি ফ্লাইটও বুকিং দিয়েছিলাম।
কিন্তু পরদিনই শুনলাম মীরা নাকি প্রেগন্যান্ট। লিও আর এলো না আমার সাথে।
আমিও আর জোর করলাম না। মীরা’র তখন লিওকে পাশে দরকার। আমি ফিরে এলাম তুরস্কে।
নানান ব্যস্ততায় জার্মানিতে আর যাওয়া হয়নি। এরমধ্যে লিও’র সাথেও যোগাযোগ কমে গেলো।
প্রায় আড়াই বছর পর ব্যবসায়িক কাজে আবার জার্মানি গেলাম।
লিও’র ছেলে হয়েছে শুনেছি আগেই। মিলিয়ানকে দেখার জন্যই গিয়েছিলাম। আর সেই যাওয়াই আমার জীবনে কাল হয়ে দাড়িয়েছিলো।
একটু থামল ওরহান। গলা কাপছে তার। হাত দিয়ে চেপে ধরেছে রেলিঙ! নীরা এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল ওরহানের হাতে। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে এলো ওরহান। নীরা’র দিকে তাকিয়ে দেখল, নীরাও তাকিয়ে আছে তার দিকে। দু’জনের চোখেই অব্যক্ত অনুভূতি!
—–” সেদিন জার্মানিতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। সারাদিন সে কি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি! মীরা কাদতে কাদতে সব বলেছিলো আমায়।
মিলিয়ান তখন অন্য রুমে ঘুমিয়ে। মীরা কাদতে কাদতে আমার হাত ধরে বলেছিলো, আমি যেন কাউকে কিছু না বলি।
মানসিক ভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলো মীরা। মিলিয়ানকে খেতে দিতো না, একটু ছুয়েও দেখতো না সে। মিলিয়ানকে দেখলেই পাগলের মতো আচরণ করতো।
আমি ভেবে পেলাম না কি করবো। লিও’র মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
আবার মীরা’র পাগলামি! ঘরে ছোট্ট বাচ্চা রয়েছে। মীরা’র যদি কিছু হয়ে যায়, বাচ্চাটাকে কে দেখবে!? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, মীরা’কে একটা ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবো।
তারপর তার বাবা-মাকে খবর দেবো। তার যেন এসে মীরা আর মিলিয়ানকে নিয়ে যায়।
ওরহান এবার সরাসরি নীরা’র দিকে তাকিয়ে বলল, ” সে রাতে আমি মীরা’র বাসায় থেকে গেলাম। এক রুমে মীরা, অন্য রুমে আমি আর মিলিয়ান।
এমন ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে শুনেও কিভাবে যেন ঘুম নেমে এলো আমার চোখে।
ঘুমের মধ্যে হটাৎ শুনতে পেলাম ডানা ঝাপটানোর শব্দ! সাথেসাথেই চোখ মেলে তাকালাম আমি। পুরো ঘরটা তখন আবছা আলোছায়ায় মিশে আছে।
স্পষ্ট কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে অনুভব করলাম আমি আর মিলিয়ান ছাড়াও রুমে তৃতীয় কেউ অবস্থান করছে! কিন্তু কে সে!?
ওরহানের চোখে নোনাজল টলমল করছে। নীরা নির্বাক শ্রোতার মতো তাকিয়ে আছে ওরহানের দিকে। সে বুঝতে পারছে, আজ সে সব জানতে পারবে! তার মনে জমতে থাকা প্রশ্নের পাহাড়ের ধ্বস নামবে আজ!
—–” জানো নীরা! আমিও সেদিন তোমার মতই মিলিয়ানকে বাচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। যার ফলাফল, কেইনের ক্রোধের শিকার হলাম আমি। কেইন যখন তার ইস্পাত-দৃঢ় হাত দিয়ে আমার ঘাড় আর মাথা দু’হাতে দু’দিকে চেপে ধরেছিলো, মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আমার দমটা বেরিয়ে যাবে।
ঠিক তখনই অনুভব করলাম, কেইন তার ধারালো শ্বদন্ত জোড়া গেথে দিয়েছে আমার ঘাড়ের ধমনিতে। সাথেসাথে গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্তের ধারা। কেইন সে রক্ত খেলো না।
আমার শরীর থেকে শেষ রক্তবিন্দু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় ছিলো সে।
প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো একসময়। আমি লুটিয়ে পড়লাম ফ্লোরে।
কেইন চলে গেলো। পরমুহূর্তে কানে এলো মীরা’র চিৎকার!
সে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে এ ঘর ও ঘর ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। আমার চোখ বুজে এলো। জ্ঞান হারালাম।
নীরা’র চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সেই ভয়াল রাতের দৃশ্য! কি ভীষণ যন্ত্রণা হয়েছিলো ওরহানের, তা ভাবতেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছে তার!
—–” পরদিন দুপুরের একটু আগে আমার জ্ঞান ফিরলো। মীরা তখন মোটামুটি স্বাভাবিক। মিলিয়ানের জন্য রান্না করছিলো সে। আমাকে দেখে বলল,
—–” গুড মর্নিং ওরহান! ফ্রেশ হয়ে আসুন, ডাইনিং এ ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি।
—–” মীরার হটাৎ এমন অদ্ভুত আচরণে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। যেন কিছুই হয়নি!
তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম! আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই একটা দুঃস্বপ্নের মতো ঠেকল।
আমি ব্রেকফাস্ট সেরে মীরা’কে বললাম সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যেতে।
কিন্তু সে আমার কথায় কান না দিয়ে মিলিয়ানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
মিলিয়ানকে খাওয়ানো, গোসল দেওয়া, ঘুম পাড়ানো আরও কত কি!
ওরহান আবারও দূরে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে বলল,” মীরা’কে আমি জোর করতে পারিনি। সে মিলিয়ানকে নিয়ে ভীষণ সুখী আছে এমনটাই জাহির করার চেষ্টা করল আমার সামনে।
আমার ব্যাবসায়িক কাজ মিটতে তিন দিন লাগল। সেই তিনটে দিনের প্রতিটি রাত আমার কাছে ছিলো দূর্বিষহ একেকটা রাত!
আমি বুঝতে পারলাম আমার ভেতরে চরম পরিবর্তন ঘটছে। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকতে মন চাইতো অথচ রাত হলেই ঘরে থাকতে পারতাম না।
ক্ষিদে পেতো খুব। কিসের নেশায় যেন মনটা ছোকছোক করতো। আমার ধারণা পরিষ্কার হয়ে গেলো সে রাতে, যে রাতে আমি এক অচেনা পথচারী মেয়েকে নিজের শিকার বানালাম।
শুষে নিলাম তার সবটুকু রক্ত। ছিবড়ে বানিয়ে ফেললাম তার শরীর! নিজের এমন ভয়ানক কান্ডে প্রচন্ড ভয় পেয়ে পালিয়ে এলাম তুরস্কে।
কিন্তু পালাতে পারলাম না নিজের ভেতর থাকা রক্তের নেশায় আসক্ত সত্ত্বার থেকে। নিজের পরিবারের ক্ষতি করার ভয়!
লোক জানাজানির ভয় আর তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে আমি আবারও ফিরে গেলাম জার্মানিতে। থাকার জন্য বাড়ি কিনলাম ব্ল্যাক ফরেস্ট এর ধারে। যাতে সহজেই যখন-তখন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারি জংগলের মাঝে।
এভাবে চলতে চলতে একদিন দেখা হল আমার মতই এক সত্ত্বা এলিসিয়া’র সাথে। সে বলেছিলো যে, এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাইলে মিলিয়ানকে হত্যা করতে হবে!
কেইন মুক্তি দেবে আমাকে! আমি রাজী হইনি। একে তো নিজের জীবনের প্রতিই তিক্ততা এসে গেছিলো। আবার একটা নিষ্পাপ প্রাণ নিয়ে সেই অভিশাপ বয়ে বেড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না আমার।
কিন্তু পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আমার পিছু ছাড়লো না।
সিদ্ধান্ত নিলাম মিলিয়ানকে হত্যা করবো। সে তো শয়তানের ছেলে, তাকে হত্যা করলে কোনো পাপ হবে না। সেটাও ছিলো একটা ধোকা!
মিলিয়ানকে হত্যা করার নানান পরিকল্পনা করলাম। মীরা ততদিনে বহুবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। ঠিক করলাম, মিলিয়ানকে মেরে মীরা’কে দোষী বানাবো।
যাতে কেউ সন্দেহ না করে। তাহলে পুলিশ কেসটা তদন্ত না করে, মীরা’কে মানসিক রোগী ভেবে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে দেবে।
একটু থেমে আবার বলল, ” এরমধ্যে তুমি এলে! পরিকল্পনায় ব্যঘাত ঘটল এই ভেবে যে, তুমি এখানে থাকবে কি থাকবে না।
যখন জানলাম তুমি ভার্সিটির ডর্মে উঠেছো, তখন বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম সঠিক সময়ের।
কিন্তু মীরা আমার সব পরিকল্পনা পন্ড করে সুইসাইড করল। ভেবে পেলাম না এবার কি করবো।
এরমধ্যেই খবর পেলাম এখানে কারা যেন রটিয়েছে যে, আমার বোন ডাইনি!
এলাকার লোকজন পারে তো উচ্ছেদ করে ছাড়ে আমার পরিবারকে। সবাই একরকম এড়িয়ে চলতে লাগল আমাদের।
আমি ফিরে এলাম। ওজগে’কে নিয়ে চলে গেলাম আংকারায়। সেখানে এক আত্নীয়ের কাছে ওজগে’কে রেখে ডক্টর দেখালাম।
সাথে নিজের শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলাম ওকে সুস্থ করতে। ধীরে ধীরে ওজগে সুস্থ হতে লাগল দেখে ফিরে গেলাম জার্মানি। এবারের পরিকল্পনায় তোমাকে টার্গেট করা হল। একই পরিকল্পনা, শুধু মীরা’র বদলে তুমি ছিলে!
ভ্রু কোচকালো নীরা। তাকে টার্গেট করেছিলো মানে!? সেও কি তাহলে মিলিয়ানের হত্যা পরিকল্পনার অংশ ছিলো!? ভেবে পেলো না নীরা। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেচিয়ে উঠলো,
—–” মানে! কি বলতে চাচ্ছেন!?
—–” তোমাকে মানসিক রোগী প্রমাণ করতেই, সেদিন মিলিয়ানকে বাইরে নিয়ে গেছিলাম। আর ফিরে এসে বলেছিলাম যে তুমিই আমাকে ডেকে মিলিয়ানকে নিয়ে যেতে বলেছো।
হতবাক হয়ে গেলো নীরা। তারমানে সেদিন সত্যিই সে ওরহানকে কল করেনি! মিলিয়ানকে পাঠায়নি তার সাথে! আর সারলোট! সে দেখেছিলো যে, একই মুহুর্তে নীরা ছিলো দুই জায়গায়!
—–” কটেজ থেকে পালিয়েছিলেন কিভাবে!?
থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল নীরা। ওরহান না তাকিয়েই বলল, ” সেদিন তোমার কষ্ট দেখে আমাকে জানে মারেনি মিলিয়ান। প্রচন্ড আহত হয়ে পড়েছিলাম শুধু। তুমি যখন মিলিয়ানকে হত্যা করলে, সেই সাথেসাথে আমিও কিছুটা ধাতস্থ হয়ে গেছিলাম।
তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে। তোমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তাতে তোমারই ক্ষতি হত। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে খুজে বের করতো তোমাকে, পুরো ঘটনায় তুমি ফেসে যাবে ভেবে তোমাকে সাথে নেইনি।
অপেক্ষা করছিলাম কেউ আসুক, এসে খবর দিক পুলিশকে। কেউ আসেনি! যখন বাইরে পুলিশের গাড়ি দেখলাম, তখনই বেরিয়ে এসেছিলাম কটেজ থেকে!
নীরা কাদছে! ওরহান আড়চোখে তাকালো নীরা’র দিকে। কাদতে কাদতে তার নাকে সর্দি লেগে যাচ্ছে। ওরহান হেসে বলল, ” তুমি এত কান্না করো কেন বলো তো! ছিচকাদুনে মেয়ে একটা!
নীরা চোখ পাকিয়ে তাকালো। হাসি থামিয়ে অন্যদিকে তাকালো ওরহান। নীরা হাতের তালু দিয়ে চোখমুখ মুছে বলল,” তখন নাহয় আমার কথা ভেবে সামনে আসেননি। তারপর!? তুরস্কে সেটেল হওয়ার আগে এক বছর কোথায় ছিলেন?
অভিমানের সুরে বলল নীরা। ওরহান কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ” তুরস্কে সেটেল হয়েছি কে বলল? ওজগে!
উত্তর দিলো না নীরা। ওরহান বুঝে নিলো ওজগে’ই বলেছে। ও ছাড়া কে বলবে নীরা’কে!? নীরা বারবার হাত দিয়ে চোখ মুছছে! এত বছর জমে থাকা সব অভিমান যেন অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে সব।
—–” রেগেন্সবুর্গে তোমার বাসাতেই ছিলাম। তুমি দেখোনি আমায়, আমি দেখেছি তোমাকে। সারাদিন সারারাত, তোমার অগোচরে ছিলাম!
মুহুর্তের মধ্যে কান্না থেমে গেলো নীরা’র! ওরহান রেগেন্সবূর্গে ছিলো! তার বাসায়!? সে কি ঠিক শুনেছে!? ভুল শুনলো না তো!?
—–” দিনকে দিন তোমাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। তোমার সামনে থাকলে নিজেকে সামলাতে কষ্ট হত খুব। তাই ফিরে এসেছিলাম। সব ছেড়ে, তোমায় ছেড়ে!
গলা কাপছে ওরহানের। নীরা’কে সে আজ সব বলে দিয়েছে। কিন্তু এর ফলাফল কি হবে!? সে তো নীরা’কে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতেই সরে এসেছিলো নীরা’র জীবন থেকে। তাহলে এখন এসব বলে আবার কেন মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে সে!?
—–” নিজেকে সামলাতে অন্য মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাই তো!?
কপট রাগ মিশ্রিত কণ্ঠেঃ বলল নীরা। ওরহান হতাশ গলায় বলল,” বিয়ের কথা চলছে শুনে অপেক্ষা করছিলাম হবু স্ত্রীর জন্য। গত রাতে তাকে ভয় দেখাতে এসে দেখি ব্যালকনিতে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। পরে নিজেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলাম!
নীরা খেয়াল করল ওরহানের ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটে উঠেছে। তা দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো নীরা’র। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করল না। ওরহান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
—“নীরা আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
ওরহানের ঠোটের কোনায় ক্রুর হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। তাকে এখন আরও মারাত্মক লাগছে দেখতে। নীরা তার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। ওরহানের এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য্য নীরা’কে যেন আরও বেশি আতংকিত করে তুলছে।
—“না। আপনি আবার কোন সময় আমার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খাবেন কে জানে!
—“আমরা আর এখন সেভাবে রক্ত খাই না। ব্লাড ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণের পছন্দের রক্ত কিনে নিয়ে আসি। চলে যায় মাসখানেক।
—“শুনে শান্তি পেলাম।
নীরার কাচুমাচু করা মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বেশ শান্তি পেয়েছে। কিন্তু ওরহান মুহুর্তেই তার শান্তি চুরমার করে বলল,
—“আমার ও-পজেটিভ রক্ত খুব ভালো লাগে। হালকা মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ আছে।
নীরার মুখটা মলিন হয়ে গেছে। ওরহান কি জানে তার ব্লাডগ্রুপ কি! অবশ্য জানতেও পারে। অসম্ভব কিছু নয়। নীরা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—“ওহ!
—“আচ্ছা নীরা, আপনার রক্তের গ্রুপ কি?
—“জানি না। কখনো পরীক্ষা করাইনি।
_________________[চলবে]_______________