তোকে_ঘিরে ❤
পর্ব_৪৩
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁
আজ পূর্বের মাথা ঠিক নেই। একটু আগে যে বীভৎস ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে তা নিয়ে এখনো বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। পূর্ণতা ওকে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে টানতে টানতে রুমে এনে বেডে বসায় জোরপূর্বকভাবে। উজ্জ্বল ফর্সা গালদুটোতে হাত রেখে বারবার শান্ত হতে চাপ দিচ্ছে পূর্ণতা। পূর্ব যখন চুপ তখন তান্ডবের পূর্বাভাস হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু আগে গ্রাউন্ড ফ্লোরে খুবই বাজে ভাবে পূর্ণতাকে অপমান করেছে পলক ওয়াসিফ। নষ্টা, বেহায়া, চরিত্রহীনা-সহ নানা জঘন্য উপাধি পেয়েছে পূর্বের সামনেই। পূর্বিকা লজ্জায় সকলের সাথে একধারায় তাল মিলিয়ে চোখের দৃষ্টি ফ্লোরে স্থির রেখেছিলো ঠিকই কিন্তু বড়দের সামনে গলা উচিয়ে বলার মতো সাহস ছিলো না ওর। পূর্ব তখন তীর্যক চাহনি দিয়ে এক এক করে সামনে দাড়িয়ে থাকা সবার মুখ দেখতে থাকল। ডানদিক থেকে শুরু করে পরশ ওয়াসিফ এবং তার অর্ধাঙ্গিনী শেফালী , পলক ওয়াসিফ এবং তার ধর্মিনী আফরিন, সায়মা, পূর্বিকা, মিথুন ও জাওয়াদ। শেষের চারজনের চোখের দৃষ্টি শেষ পযর্ন্ত নিচের দিকে থাকলেও বাকি চারজনের দৃষ্টি নোংরা মানসিকতার এহলান দিচ্ছিলো। পূর্বের ছোট চাচী শেফালী হঠাৎ বলে উঠলো,
– একটা কথা না বলে পারলাম না পূর্ব! তোমার জন্য যে মেয়েগুলোর ছবি দেখানো হয়েছিলো তারা অন্তত ক্যারেক্টারলেস ছিলো না। কিন্তু তুমি তো ছবিগুলো দেখতেই চাইতেনা। এখন ঘরে কি বউ আনলে বলোতো? সুখ পাচ্ছো? শান্তি আছে? এরকম মেয়ে আরো ক’জনের সাথে বিছানায় গিয়েছে তা তো তুমি বুঝতেই চাইছো না।
পূর্ণতা পুরোটা সময় একদম নিরব থাকলেও ভেতরে যে কঠিন প্রলয়ে লন্ডভন্ড হচ্ছিলো সেটা দারুন কৌশলে সামলে নিচ্ছিলো সে। যদি একবার ভুল করে চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল ঝরতো! পূর্ব কতটা ভয়ংকর ভাবে সবাইকে সেই অশ্রুর হিসাব বুঝাতো তা অন্ততপক্ষে সবার অনুমানের বাইরে! পূর্ণতা খামোশ থাকলেও ভয় পাচ্ছিলো যদি পূর্ব নিয়ন্ত্রন হারায় তাহলে উপস্থিত বক্তব্যে যারা ধৈ ধৈ করে পূর্ণতার সুশ্রী গুণগান গাচ্ছে তাদের প্রত্যেককে রাস্তায় খাড়া করিয়ে বিশ্রী ভাবে রফাদফা করে দিবে পূর্ব। পেছন থেকে পূর্বের টিশার্ট টেনে পূর্ণতা ওকে চুপ থাকার জন্য ইশারা দিচ্ছিলো, যেনো কোনোভাবেই সে কিছু না করুক! খোদার দোহাই!
বেডে পা ঝুলিয়ে কাঠিন্য মুখে বসে আছে পূর্ব। দু’হাতের আঙ্গুলগুলো আষ্টেপৃষ্টে বন্দি করে ফ্লোরের দিকে মাথা নুইয়ে চেয়ে আছে। পূর্ণতা এটা ওটা বলে পূর্বের নিরবতা ভঙ্গের চেষ্টা করলেও ফলাফল একেবারেই বৃথা। ধ্যানমগ্নের মতো মৌনমগ্ন হয়ে আছে পূর্ব। একপলকের জন্যেও পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি ফেরায়নি পূর্ব, সেই যে রুমের ফ্লোরে দৃষ্টি আটকেছে, শেষ পযর্ন্ত উদ্ধার ওটুকুই আছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। যত চুপ তত ভয়াবহ হবে ভেবে পূর্বের ঠিক সামনে একদম মুখোমুখি হয়ে ফ্লোরে বসে পরলো পূর্ণতা। পূর্বের হাটুর উপর নিজের থুতনি বসিয়ে ঠোঁট উল্টে ইনোসেন্ট লুকে তাকালো সে। পূর্বের মুঠোবন্দি আঙ্গুলের উপর নিজের নরম হাতদুটো ঘিরে ধরতেই পূর্ণতা চুমু দিলো হাতে। পূর্বের চোখের দিকে তাকাতেই কি যেনো বুঝার ভঙ্গিতে হালকা গলায় বললো,
– মাথাব্যথা করছে? একটু ম্যাসেজ করে দেই? কোলে মাথা রাখবে?
শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু জোরে নিশ্বাস ছাড়ার শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো আওয়াজ করলো না পূর্ব। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ চুলের ফাঁকফোকর দিয়ে ঘামের কণাগুলো দেখা যাচ্ছে। হালকা লালাভ ঠোঁটটা রাগের তপ্ত নিশ্বাসে থরথর করে কাঁপছে। এসির মিডিয়াম পাওয়ারেও ডিপ ব্রাউন টিশার্টটা ঘেমে পিঠের সাথে লেপ্টে আছে ওর। অতিমাত্রায় রাগ করলে স্নায়ুবিক উত্তেজনা এতোটা প্রবল হয় যে শরীর তার নির্দিষ্ট ট্যাম্পারেচার ঠিক রাখার জন্য তৎক্ষণাৎ ঘাম নিঃসরণ করতে সাইরেন দেয়। পূর্বের ক্ষেত্রে ব্যাপাটা বেশ সাংঘাতিক আকারে চলে যেতেই ওর মাথাব্যথা শুরু হয়। মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়, রাতে ঘুমাতে কষ্ট ভোগা লাগে।
– তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পলক চাচা আমাকে নয়, তোমাকে কথা শুনিয়েছে।
ওমনেই পূর্ব তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুড়ে ঠাঁট বজায় রেখে বললো,
– তোমাকে কিছু বলা মানে কি আমাকে বলা না?
– সত্যি ? আচ্ছা, কেউ যদি আমাকে ‘ লাভ ইউ’ বলে প্রোপোজ করে তাহলে কি তোমাকেও বলা হবে?
– ফাজলামির মুডে নেই পূর্ণ! একদম ফাজলামি করবা না!
– নাউযুবিল্লাহ! কে ফাজলামি করছে? আমি? কি সর্বনাশ! এরকম মিথ্যা আপনি বলতে পারলেন কমরেড সাহেব?
– আমি কমিউনিজম করিনা এই কথাটা তোমাকে আগেও ভালোভাবে বুঝিয়েছি পূর্ণ! আরেকবার যদি আমাকে কমরেড ডাকো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা!
– কমরেড দিয়ে কি দুনিয়ায় একটাই মানে বুঝায় নাকি? ডিকশনারি ঘাটেন না আপনি? কমরেড হচ্ছে সহচর, সঙ্গী। তো ওয়াসিফ পূর্ব কি আমার পার্সনাল কমরেড না?
পূর্ব আর কোনো কথা বললো না। এই মূহুর্তে কোথাকার রাগ কোথায় এসে ঝেড়ে ফেলবে তা সে নিজেও জানেনা। কমিউনিজম করতে যেয়ে কিছু বিপত্তির মুখোমুখি হয়ে দলত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো পূর্ব, সেই স্মৃতি বারবার স্মরন করিয়ে পূর্ণতা যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা মারে সেটা ও নিজেই জানেনা।। পূর্ণতা পূর্বের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবার বলে উঠলো,
– রাগটা একটু কমাও। মাথাব্যথায় তো মাইগ্রেন হয়ে যাবে।
– উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা! আমার মাইগ্রেন নেই।
– চুপ কর! তোমার চোখ লাল দেখেই বুঝতে পারছি তোমার মাথা ফেটে যাচ্ছে।
– আর কিছু বুঝতে পারো না? তোমার অপমান দেখে আমার কতটা শান্তি লাগছে এটুকু তো বোঝা উচিত ছিলো। ছিলো না? বেকুবের মতো টিশার্ট টেনে চুপ থাকতে বলে খুবই পূণ্যের কাজ করেছো এখন কিসের মাখন লাগাচ্ছো? সরে যাও সামনে থেকে!
পূর্ব নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা। রাগের লেভেলগুলো এতো হাইস্পিডে বাড়ছে পূর্ণতাকেই কোনো আঘাত দিয়ে ফেলে কিনা জানা নেই। বেড ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বারান্দায় যেতে যেতেই পূর্ব পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে স্ক্রিনে ডায়াল করলো, তার ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা কল আসতেই দেরি পূর্ব কানে ব্লুটুথ ঢুকিয়ে রিসিভ করতে দেরি করলো না। রসকসহীন আহ্লাদ ছাড়া কন্ঠে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললো,
– ওর মিনিমাম ইনসাল্ট সহ্য করার মতো মেন্টালিটিতে আমি নেই। তোমার ভাইদের বলো লিমিটের মধ্যে থাকতে। আমি যদি আরেকবার এরকম কিছু দেখি তাহলে বাড়ির বাইরে কি কি করতে পারি তার একফোঁটা নমুনা ওদের বুঝিয়ে দিবো।
পূর্ণতা ফ্লোর থেকে আস্তেধীরে উঠলেও ওর দৃষ্টি ও মনোযোগ ছিলো বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা পূর্বের বার্তার দিকে। পূর্ব কি পলাশের সাথে কথা বলছে? পূর্ণতা ধীরে ধীরে একপা করে এগিয়ে বারান্দার দরজার মুখে দাড়ালো। পূর্ব এখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে,
– ওদের সাবধান করো আব্বু! আমি কিন্তু মাথা ঠিক রাখতে পারবো না। ওরা যদি ষড়যন্ত্র করে আমি কিন্তু ষোড়শষন্ত্র করবো! বারবার বলছি ওদেরকে স্ট্রিক্ট বুঝিয়ে দাও নাহলে আমার বুঝানোটা কেমন হবে আল্লাহ্ জানে!
কথাগুলো শুনে পূর্ণতার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। পূর্ব পলাশকে ফোন করে কেনো এসব বলছে? হার্ট এ্যাটাকের রোগীকে এসব কথা বলা মানে নিজ হাতে খুন করে দেওয়া পূর্ব কি এটা জানেনা? এখন কি হবে? কি হতে যাচ্ছে? সব এলোমেলো লাগছে পূর্ণতার! নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে সেদিনের বোকামির জন্য! যদি একবার কাউকে ফুয়াদের ব্যাপারটা বলে যেতো? পূর্ণতা নানা ভাবনায় ছটফট করতেই হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে রিংটোন বাজতে লাগলো। পূর্ণতা একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে এরপর পূর্বের দিকে চেয়ে দেখলো পূর্ব এখনো উত্তেজিত কন্ঠে কথা বলছে। পূর্ণতা দ্রুততার সাথে ফোনটা নিয়ে দেখলো আয়মান কল করেছে। রিসিভ করতেই আয়মান ভূমিকা না করে মূল কথাটা বলে উঠলো,
– শোন ছেড়ি, শায়লা আন্টির মেয়ে আছেনা? ওইটা সুইসাইড করছে। এখন কেয়ার হসপিটালে এডমিট।
– শায়লা আন্টি মানে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো পূর্ণতা!
– এতো বিস্তারিত বলতে পারুম না। বুঝলে বুঝ না বুঝলে নাই।
ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে বলতেই টুট টুট করে বাজতে লাগলো কলের ওপাশ থেকে। পূর্ণতা আশ্চর্য হয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে দেখে আয়মান কল কেটে দিয়েছে। শায়লা আন্টির মেয়ে…শায়লা আন্টির মেয়ে এরকম বলতে বলতে রুমে পায়চারী করতেই হঠাৎ থমকে গিয়ে এমন চিৎকার দিলো পূর্ব দৌড়ে রুম এসে পূর্ণতার বাহু ঝাকিয়ে বলতে লাগলো,
– কি হয়েছে? চিৎকার দিলে কেন?
পূর্ণতা লম্বা লম্বা নিশ্বাস টেনে বললো,
– শ…শ..
কিছুই বলতে পারলো না সব কথা জড়িয়ে যাচ্ছে পূর্ণতার। পূর্ব ওকে জলদি টেনে বেডে বসিয়ে ‘কি হয়েছে’ সব খুলে বলতে বললো। পূর্ণতা জোরে জোরে লম্বা শ্বাসকার্য চালাতেই দুম করে পূর্বের গলা জড়িয়ে ধরলো। পূর্ব বারবার বলছে, কি হয়েছে? কিছু বলো? পূর্ণ কি নিয়ে চিৎকার করলে? আমি আছি তো! বলো কি হয়েছে? পূর্ণতা চোখবন্ধ করে লাগাতার ঢোক গিলতেই জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
– শ্রেশ্রেয়া সুইসুইসাইড করেছে…
পূর্ব চকিত ভঙ্গিতে পূর্ণতাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– কিহ্! অসম্ভব! কে বললো তোমাকে? কার কাছ থেকে খবর পেলে তুমি?
– আয়আয়মান…
পূর্ব শুনার সাথেসাথেই নিজ থেকেই আয়মানকে কল করলো। আয়মান যা যা বললো আসলে সবই সত্য। শ্রেয়া সুইসাইড এ্যাটেম্প করেছে এখন কেয়ার হসপিটালে ভর্তি আছে। পূর্ব দ্রুত আলমারি খুলে পোশাক বের করতেই পূর্ণতাকে বললো,
– ফটাফট নিকাবটা করে বোরখা পরো। সময় নষ্ট করো না।
পূর্ণতা চোখ মুছতেই অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
– তুমি যাবে?
– কেন যাবো না? শ্রেয়া আত্মহত্যা করতে চেয়েছে তুমি কানে শোনোনি?
– ও যে তোমার সাথে..
– আমি ওর ভুল মাফ করে দিয়েছি পূর্ণ। প্লিজ রেডি হও…
রাত সম্ভবত বারোটা তেরো। ঢাকা শহরে রাস্তাগুলো জ্যাম থেকে ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। পূর্ব ড্রাইভারকে না নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে হসপিটালে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে অন্ধকার, লাইট অফ রাখা হয়েছে। পূর্ণতা কালো ঢোলা বোরখায় জবুথবু হয়ে শুধু চোখ দুটো বের করে রেখেছে নিকাবের মধ্য দিয়ে। পূর্বের গায়ে কালো শার্ট, কালো গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরা। বাঁহাতে কালো ইলেকট্রনিক ওয়াচ যা লাল আলোতে অন-অফ হয়ে টাইম শো করছে। বর্তমানে একহাতে ড্রাইভিংয়ে হুইল ঘুরিয়ে ড্রাইভ করছে এবং বাঁ হাতে এক্সিলেটর চেপে স্পিড বাড়াচ্ছে। পূর্ব বামে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা সিটে হেলান দিয়ে সিটবেল্ট খামচে চোখ কুচকে রেখেছে। চোখ ফিরিয়ে পূর্ব সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে এক্সিলেটর থেকে হাত সরিয়ে পূর্ণতার হাতটা চেপে ধরলে পূর্ণতা মাথা উঠিয়ে পূর্বের দিকে তাকায়। আড়চোখে পূর্ব সেটা বুঝতে পারলে পূর্ণতার হাতের ভাঁজে হাত মিলিয়ে এক টান মারে নিজের ঠোঁটের দিকে।
– শ্রেয়ার কিচ্ছু হবেনা পূর্ণতা। বি পজেটিভ!
বাতাস ঠান্ডা। পরিবেশ শীতল। হঠাৎ রাতের আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ তুলে কিছুক্ষনের মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আকাশ ফুলে ফেঁপে উঠলো মেঘের গর্জনে। বজ্রপাতের বজ্রধ্বনিতে পূর্ণতা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে কানে দুহাত চেপে কাঁপছিলো। পূর্ব গাড়িটা সাইডে পার্ক করে পূর্ণতার দিকে ঝুঁকে ওর সিটবেল্ট খুলে দিতেই বললো,
– ভয় পাচ্ছো? দেখি আমার দিকে তাকাও। পূর্ণ আমার দিকে তাকাও বলছি।
পূর্ণতা খিচিয়ে রাখা চোখ খুলে কান থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই দেখলো ওর সিটবেল্ট খোলা। পূর্ব টান মেরে পূর্ণতাকে কোলের উপর বসিয়ে নিকাবের উপরই কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো। একহাতে আগলে ধরে পূর্ণতাকে বুকে চেপে অন্যহাতে গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। আস্তে করে কানের কাছে অভয় বাণীতে বলে উঠলো,
– পরিবেশটা রোমান্টিক ভেবে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো। বাকিটা আমি সামলে নিচ্ছি। ওকে?
ওয়াটার রিমুভিং সিস্টেম অন করেও ঝুম বৃষ্টির প্রবলে গাড়ির সামনের গ্লাসটা ঝাপসা থাকা থেকে মুক্তি মিলছেনা, বাধ্য হয়েই রিস্ক নিয়ে বেশ স্পিড দিয়েছে পূর্ব।
.
চল্লিশ মিনিট লাগলো হসপিটালে পৌছাতে। গাড়ি থেকে নামতেই পূর্ব সার্জিক্যাল মাস্ক পরে আশেপাশে দেখে নিলো। এরপর একসঙ্গে ভেতরে ঢুকলো দুজন। রিসেপশন থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো শ্রেয়া ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে আছে। সেখানে পৌছতেই দেখতে পেলো আয়মান বাদে সবাই উপস্থিত। পূর্ণতার মা, বাবাসহ আয়মান ও রাজিবের পরিবারও শামিল হয়েছে। শ্রেয়ার মাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তিনজনের মা।। পূর্ণতা দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে পূর্বের হাত ছেড়ে ওদের কাছে দৌড়ে যেতেই খোদেজা ফোলা ফোলা চোখে ভ্রু কুঁচকে সিটে বসা অবস্থাতেই পূর্ণতার দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বললো,
– তোকে হুজুগে বানালো কে? কি পরেছিস এটা? নিকাব পরেছিস দম বন্ধ লাগেনা?
পূর্ণতা উত্তর দিতে কাঁচুমাচু করছিলো। ও মোটেই আশা করেনি এমন দূরূহ সময়ে খোদেজা এরকম প্রশ্ন ছুড়বে। হঠাৎ পেছন থেকে ওর কাধে কেউ হাত রাখতেই বলে উঠলো ,
– আসসালামুয়ালাইকুম, এখানকার পরিস্থিতি কেমন? ডাক্তার কিছু জানিয়েছে?
পূর্বের সালামটা পূর্ণতার বাবা মিষ্টি করে ফিরিয়ে দিয়ে প্রশ্নের উত্তরটাও সুন্দর করে দিয়ে দিলো। একটা বিষয়ে পূর্ণতার বাবা কৌতুহল না চাপতে পেরে বলে উঠলো,
– পূবা বাবা? তুমি মাস্ক পরেছো, তোমার কি এলার্জীর সমস্যা আছে?
পূর্ব মাস্কের আড়ালে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
– ফর দ্যা সিকিউরিটি বাবা।
একদিকে সবাই বিষন্ন অবস্থায় কান্নাকাটি করছে অপরদিকে এ দুজনের খোশ আলাপে খোদেজা বেশ বিরক্ত হয়ে রুমালে চোখ মুছে। চুপচাপ পূর্ণতাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কঠিন গলায় বললো,
– তোকে বোরখা না পরিয়ে আট গজের থান পরিয়ে দিলে মানাতো।
পূর্ণতা কিছু চটপটে উত্তর দিবে তার আগেই পূর্ব ওর মুখের কথা ছিনিয়ে একগাল হাসি দিয়ে বললো,
– আম্মাজান, থান পেচিয়ে আমার বউকে মেরে ফেলতে চাইনা। যেই বোরখাটা পরিয়েছি সেটায় যদি আমিও ঢুকতে পারি তো সমস্যাটা কোথায়? ওয়াসিফ পূর্বের নামটা পাবলিক প্লেসে একবার উচ্চারণ করে দেখবেন। রাস্তায় যেই কোলাহলটা হবে অন্তত আপনার মতো গাইনোলজিস্টের মাথায় ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে, কেনো আমি মিসেস পূর্ণতাকে এভাবে এনেছি।
পূর্বের কথায় প্রচণ্ডরূপে ক্রোধিত হলো খোদেজা। চটাস চটাস উত্তর শুনে খোদেজার ইচ্ছে করছিলো পূর্বকে ভয়াবহ কিছু কথা শোনাতে। অসভ্য, অভদ্র, ফাজিল একটা ছেলে পূর্ব, যার বাবা- মা কিছুই শিক্ষা দেয়নি। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড লেখা রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার ঠিক উপরে লাল বাতি জ্বলে আছে। কিছুক্ষণ পর পর কিছু নার্স স্টিলের ট্রে ভর্তি জিনিসপত্র আনা নেওয়া করছে। পূর্ব সেটা লক্ষ করতেই খানিকটা দূরে গিয়ে নার্সকে দাড়া করিয়ে ট্রেতে কি যেনো দেখতে লাগলো। ঘড়িতে সময়টা একবার পরোখ করে দেখতেই হঠাৎ দরজা খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে একটা ডাক্তার বেরুলে সবাই প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় ডাক্তারের মুখের পানে তাকিয়ে নানা প্রশ্নষকরতে থাকে।। ডাক্তার উত্তর এমন স্বরেই দিচ্ছিলো যা পূর্ব কিছুটা দূরে থেকেই শুনতে পারছিলো। পূর্ণতা ঝটপট প্রশ্ন করছিলো,
– পেশেন্টের কি অবস্থা? ওর সিচুয়েশন কেমন? অন্য হসপিটালে শিফট করতে হবে?
– আপনাদের মিথ্যা সিম্প্যাথি দেওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই সত্যটাই বলছি, পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ। চান্স ফিফটি-ফিফটি।
একটা চাপা আর্তনাদে চিৎকার দিয়ে মাথায় হাত রেখে শরীর ছেড়ে শ্রেয়ার মা। খোদেজা তাড়াতাড়ি শ্রেয়ার মাকে ধরে সারিবদ্ধ সিটের একটাতে বসিয়ে কান্না থামাতে বলে। পূর্ণতার এখন অস্থির লাগছে! মাথা ঘুরাচ্ছে। একসঙ্গে সবাই মাথা চাপড়াতে থাকলে পূর্ণতা হতবিহ্বল হয়ে নিকাবের আড়ালে চোখের পানি ফেলতে থাকে। কেনো ও সুইসাইড করলো? ওই মেয়েটা যত খারাপই হোক ওর জন্য অভিশাপ দিতে পারেনা পূর্ণতা। ভেতরটা ফেটে আসছিলো শ্রেয়ার নাজুক অবস্থা শুনে। আয়মানকে প্রচুর কল করছিলো কিন্তু ফোন বন্ধ। পূর্ব আশেপাশে কোথাও নেই। পূর্ণতা পাগলের মতো একবার এদিক আরেকবাল ওদিক করে পায়চারী করছিলো। রাজিবের বাবা আকুতির স্বরে শ্রেয়াকে বাঁচানোর জন্য ডাক্তারকে রিকুয়েস্ট করতে থাকলে হঠাৎ পূর্ব কোত্থেকে উদয় হয়ে ডাক্তারকে ফট করে জিজ্ঞেস করে,
– একচুয়েল প্রবলেমটা কোথায়?
– ওর বডি কোনো প্রকার মেডিসিন নিতে চাইছেনা। এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচানো খুবই টাফ! আমরা নিজের সর্বোচ্চটা চেষ্টা করছি কিন্তু….
– মেডিসিন যেহেতু নিতে চাইছেনা এক্ষেত্রে আপনাদের কাজ এখানেই সমাপ্ত!
সবাই পূর্বের কথায় হকচকিয়ে গেলো! ডাক্তার প্রথমে কৌতুহল দৃষ্টিতে কপালে ভাজ ফুটিয়ে হতভম্ভ হলেও শেষে ঝাঁঝালো গলায় বললো,
– হোয়াট ডু ইউ মিন? আপনি পেশেন্টকে নিয়ে কি বলতে চাইছেন? আমরা ডাক্তাররা চুপচাপ বসে আছি কিছুই করছিনা?
– আপনারা পেশেন্টের ক্লাইমেক্স দেখতে বসে থাকলেও আমরা এখানে রিস্ক নিতে পারছিনা!
পূর্বের কথায় ডাক্তারটা প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে চিল্লাহুল্লা শুরু করলে সবাই নিরবতা ভেঙ্গে ডাক্তারকে শান্ত হতে বুঝাতে থাকে, কোনো লাভ হয়না। ডাক্তারকে নিচু করে কথা বলার জন্য নার্সরাও এখন নানাভাবে কথা শোনাচ্ছে সবাইকে। পূর্ণতা বিবশ হয়ে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছিলো, পূর্বের উগ্র ব্যবহারে মারাত্মক জিদ লাগছিলো ওর। মূহুর্ত্তের মধ্যেই ঘটনা তিল থেকে তাল হয়ে এমন বিশ্রী অবস্থা হলো মানুষ রীতিমতো জড়ো হতে শুরু করেছে সেটা দেখার জন্য।। একজন নার্স মেইন অথোরিটির সেকশন থেকে একজন হেডকে ডেকে আনলে তথাকথিত ডাক্তারটা পূর্বকে ইশারা দিয়ে বোঝায়। অথোরিটির লোকটা খুবই রাগান্বিত চেহারায় পূর্বকে বলে উঠেন,
– আপনি এই হসপিটালে তামাশা করতে এসেছেন? ডাক্তারদের সাথে কিরকম বিহেব করতে হয় জানেন না! এগুলো কেমন আচরণ?
পূর্ব সরু চোখে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে শুধু। ডাক্তারটা ওর চুপটি দেখে ভাবে ব্যাটা অথোরিটিকে দেখে মেবি চুপসে গেছে। অথোরিটির লোকটা আরেকদফায় বলে উঠলো,
– আপনি আপনার পেশেন্ট নিয়ে বিদেয় হোন এক্ষুনি! এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন এই হাসপাতাল থেকে! ডাক্তারদের যারা সম্মান করতে জানেনা তাদের এখানে জায়গা নেই!
পূর্বের উপর ইতিমধ্যে পূর্ণতা সহ সবাই ক্ষিপ্ত!পূর্ব কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে পকেটে হাত গুজিয়ে মাথা সোজা করে বললো,
– আমার জানামতে পেশেন্টকে আপনারা না বুঝেই মেডিসিন দিয়েছেন।
– মানে? কি বলতে চাইছেন? আপনি কি ডাক্তার?
– আমিতো ডাক্তার নই। ইভেন মেডিক্যাল স্টুডেন্টও না।
– আপনি বললেন আমরা না বুঝেই মেডিসিন দিয়েছি! তাহলে কেনো বললেন এটা? পেশেন্টের বডি যদি মেডিসিন রিজেক্ট করে এতে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি করার থাকে?
– ফাস্ট এন্ড ফোরমোস্ট, সুইসাইড করেছে কবজির শিরা কেটে! সাততলা উঁচু ছাদ থেকে লাফ দেয়নি! এখানে মেডিসিন আপনারা কি কি দিয়েছেন সেগুলো কি বলবো? আমি যদি একবার আপনাদের চিকিৎসার স্টেপগুলো রিপোর্ট করে জায়গা মতো পাঠিয়ে দেই কি হবে জানেন তো?
শব্দহীন নিরবতা। যেনো কোনো মানুষ নেই এমন স্তব্ধ অবস্থা বিরাজ করছে এখন। পূর্ব আবার বলে উঠলো কিন্তু এবার ইংলিশে একটা ডিসক্রিভশন দিয়ে বললো,
The risks of medicine are the possible unwanted or unexpected effects that might happen to you when you use them. Risks can be minor, like a mild upset stomach, or more serious. If you give the medicine dose high it’ll be horrible for the patient.
আমি কি ঠিক বলেছি? আপনি কি প্যাশেন্টকে ভুলভাল মেডিসিন দেননি? পয়েন্ট টু বি নোটেড, আমি কোনো মেডিকেল স্টুডেন্ট নই! এইসব তথ্য বের করাটা আমার জন্য ক্রিটিক্যাল কিছুই না। এখন আপনাদের উত্তরটা শুনতে চাই,
অথোরিটি মুখ কালো করে লজ্জা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– আসলে আপনি কে? হু আর ইউ?
পূর্ব মুখের মাস্কটা কানের দুপাশ থেকে খুলতেই এতোক্ষন যারা গলাবাজি করছিলো সবাই বিরাট বড় চোখ করে ঘন একটা ঢোক গিললো। সাদা ড্রেস পড়ুয়া নার্সগুলো ভয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলো, ডাক্তারটা অথরিটির সাথে কথা বলার জন্য হাশফাশ করছিলো ঠিকই কিন্তু অথরিটি নিজেই হতবাক দৃষ্টিতে চোখ বড় করে আছে। পূর্ব বাঁ হাতের ইলেকট্রনিক ওয়াচে ডাবল ট্যাপ করতেই লাল আলো জ্বলে টাইম শো করলো ১:১৯। একপলক চোখ বুলিয়ে বাঁ ভ্রুটা উচু করে পূর্ব বললো,
– একটা চব্বিশের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স রেডি করে পেশেন্টকে এল এল হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন! নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবেনা!
আদেশ পালনের জন্য ঝড় বয়ে গেলো যেনো। সবাই আশ্চর্য হলেও খোদেজা সবচেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো পূর্বের কর্মকাণ্ডে। নিজে একজন মেডিকেল ডিপার্টমেন্টের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও নন ডিপার্টমেন্টের একজন পলিটিক্স করা ছেলে কিভাবে এতো বড় ত্রুটি ধরে ফেললো? খোদেজা একদৃষ্টিতে শ্রেয়াকে শেষ চেষ্টায় বাঁচানোর জন্য পূর্বের কাজগুলো দেখছিলো। পূর্ব যদি উদার মনের মানুষ না হতো সম্ভবত পর কারোর জন্য এতোটা উঠে পরে ব্যস্ত হতো না। আচ্ছা পর মানুষকে যে এতোটা প্রাণ দিয়ে করছে আপন মানুষের জন্য সে কতটুকু উদার হবে? মানুষটা যতই বেয়াদব হোক এমন বেয়াদব ঘরে ঘরে জন্মালে ক্ষতি নেই। মনেমনে বলতেই হেসে ফেলে খোদেজা।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
( নোট : পূর্বের মতো বেয়াদবের দরকার নেই😑। বেটা বদমাঈশ!)