ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-১৭

0
994

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৭
©জারিন তামান্না

৩ দিন হলো সিফাত ট্রেনিং এর জন্য ইউএস চলে গেছে। ১ মাস চলবে ট্রেনিং। তারপর, ফর্মালিটি শেষ করে দেশে ফিরতে সময় লেগে যাবো আরও কয়েকটা দিন।সে আকদ করে রেখে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও পলকের বাবা সেটা নাকচ করেছেন। তিনি চান,সিফাত ট্রেনিংটা শেষ করে ভালোভাবে আগে দেশে ফিরুক তারপর আগের প্ল্যান অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকতা করে তবেই তিনি মেয়ে বিদায় করবেন।

তাছাড়া একমাস পর বিয়ে হওয়ায় বিয়ের প্রস্তুতি আর খরচ নিয়েও বেশ চিন্তায় ছিলেন তিনি। যদিও সিফাতদের পক্ষ থেকে বিয়ে নিয়ে তেমন কোন চাহিদা নেই,অনুষ্ঠানটাও তাদেরই ফার্ম হাউজে হচ্ছে, তবুও সামাজিকতা বলে একটা ব্যাপার থেকে যায়। সিফাতদের মত এত আয়োজন, খায়-খরচা করতে না পারলেও মেয়েকে একেবারেই শূন্যহাতে তো শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারেন না তিনি। কিন্তু এসব চিন্তার পরেও ছেলেপক্ষের কথার উপর কথা বলতে পারেননি। একে তো সব জেনেও তারা যেচে পড়ে এসে মেয়ে নিতে চাইছে,তারপর যদি তার কথায় কিছু মনে করে বিয়েটা নিয়ে কোন আপত্তি করে! তাই একমাসের অল্প সময়েও তিনি বিয়েটা দিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে,এখন বিয়েটা পিছিয়ে যাওয়ায় তিনি বরং কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। হাতে মাস দুই সময় পাওয়া গেল। এবার ধীরেসুস্থে তিনি বিয়ের প্রস্তুতি নিতে পারবেন। তাই বিয়েটা আরও দুই মাস পরে হবে বলে ঠিক করেছে দুই পরিবারের সদস্যরা।

তবুও,এ নিয়ে সিফাতের কিছুটা মন খারাপ রয়ে গেছে। তিয়ানের সাথে দেখা হওয়াকে কেন্দ্র করে পলকের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা অজান্তেই একটা অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল সিফাতের মনে। তারওপর আবার বিয়েটাও পিছিয়ে গেল আরও দুমাস। সে ভেবেছিল অন্তত আকদ করে রেখে যাবে। পলককে নিজের করে তবেই নিশ্চিন্ত মনে পাড়ি দেবে অন্যদেশে। কিন্তু,পলকের বাবা সেটা চায়নি বলে সেও আর কিছু বলেনি এই নিয়ে। ট্রেনিং এ যাওয়ার আগে মাত্র ৭দিন সময় পেয়েছিল সে।যার জন্য অফিসের কাজ গুছিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।বেশ ব্যস্ত সময় গেছে তার সেই দিন গুলোয়। পলকের সাথেও আর যোগাযোগ হয়নি কোন। কিন্তু তাই বলে যাওয়ার আগে পলকের থেকে একবার বিদায় নেবে না,এমন তো আর হয় না! তাই চলে যাওয়ার আগের রাতে অফিস শেষে বাসায় ফিরে কল করলো পলককে।
________________________________

রাত তখন ১২:৭ বাজে। পলক তখনও স্টাডি টেবিলে বসা।১ দিন পর তার ক্লাসের বাচ্চাগুলোর সাপ্তাহিক ক্লাসটেস্ট। প্রশ্নপত্র তৈরী করছিল সে। ঠিক তখনই টেবিল কাপিয়ে ভাইব্রেশন মোডে বেজে উঠলো ফোনটা। হাতের কাছ থেকে খানিকটা দূরেই রাখা ছিল ফোনটা।প্রশ্ন লিখতে লিখতে একনজর তাকালো সে ফোনটার দিকে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখে বেশ অবাক হলো সে। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিল সে। এতরাতে সিফাতের কল করার কথা নয়। “কোন সমস্যা হলো কি?” -কথাটা ভাবতে ভাবতেই রিসিভ করলো কলটা। তারপর স্বভাবসুলভ শান্ত স্বরে সালাম দিল,
_হ্যালো…আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম মৃন্ময়ী। একটা ফোনের ডেটা অন করুন তো। কল দিচ্ছি আমি।-বেশ জলদি জলদি বললো সে কথাগুলো।যেন কোন কিছুর কারণে বড্ড তাড়ায় আছে সে।
_আচ্ছা। -বলেই কল কেটে দিল পলক। তারপর ফোনের ডেটা অন করলো। অপেক্ষায় রইলো সিফাতের কলের। ডেটা অন করার মিনিট দুই পরেই সিফাতের হোয়াটস অ্যাপ নাম্বার থেকে কল এলো পলকের ফোনে। ভিডিও কল করেছে সে।

ভিডিও কল দেখতেই আজ বেশ তটস্থ হয়ে গেল পলক। সেদিনের ওড়নার ঘটনাটায় ঢের শিক্ষা হয়েছে তার। তাই কল রিসিভ করার আগে ওড়নাটা ঠিকঠাক করে জড়িড়ে নিল গা’য়ে। তারপর ধীরেসুস্থে রিসিভ করলো কলটা। কিন্তু, কল রিসিভ করার পর ফোনের ও পাশে আর কাউকে পাওয়া গেল না। ভ্রু কুচকে গেল পলকের। ফোনটা বিছানার দিকে তাক করে রাখা,মুখোমুখিভাবে। বিছানার উপর এক কোণে একটা বড় লাগেজ রাখা।মনে হচ্ছে, লাগেজ গোছানো হচ্ছে।কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।কিন্তু সেখানে সিফাত নেই। একনজর চোখ বুলালো পলক ঘরটায়। বিছানার দিক থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, বেশ ছিমছাম,গোছানো ঘর বলে মনে হলো তার কাছে।

বিছানার কাছ ঘেঁষে একটা সাইড টেবিল রাখা। টেবিলের উপর লম্বা একটা ল্যামসেড। সিফাতের একটা ছবি ফ্রেম করা। পাইলটের ইউনিফর্ম পড়া।চোখে সানগ্লাস আর মাথায় ক্যাপ। পলিশড সুজ।প্লেনের সামনে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কি সুন্দর প্রাণোচ্ছল হাসি। ছবিটা দেখে মনে হলো বেশ আগের। কিছুটা অন্যরকম লাগছে তাকে। ছবিটার সামনেই একটা ওয়ালেট,ঘড়ি আর গাড়ির চাবি রাখা। ব্যাস..এর চাইতে বেশি আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। পলক যখন ঘর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত তখনই এক ঝলকে সিফাত ক্রস করে গেল ক্যামেরাটার সামনে দিয়ে। পলকের ধ্যান ভাংলো এতে। এরপরেই শোনা গেল সিফাতের কথার আওয়াজ।

_Hey…Mrinmoyi. কেমন আছেন আপনি?
কথাটা বলতে বলতেই কোথাও একটা যাচ্ছিল সিফাত।কিন্তু, সিফাত ক্যামেরা ক্রস করে যাওয়ার সময় যতটুকু তাকে দেখা গেছে তাতেই একপ্রকার থতমত খেয়ে গেছে পলক। মেরুন রঙের একটা টি-শার্ট আর আর ছাই রঙা থ্রি-কোয়াটারে একটা প্যান্ট পড়া। পায়ে ঘরে পড়ার স্লিপার। প্যান্টের কারণে হাঁটু থেকে সিফাতের ফর্সা লোমশ পায়ের বেশ অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। যেটা দেখেই পলকের চক্ষুচড়কগাছ! দুই একটা হার্টবিটও মিস করলো সে। লজ্জায় দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল । মনে মনে বললো,
_সমস্যা কি এই মানুষটার! যখন দেখো আমাকে লজ্জায় ফেলার উপক্রম করে। সেদিন ওড়না আর আজ…ভাবতেই লজ্জায় খিঁচে চোখ বুজে এলো তার।একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ধাতস্ত করলো নিজেকে। এরপর সিফাতকে অনুসরণ করে চাইলো বিছানার দিকে।

এবারে ক্যামেরার সামনে স্থিরভাবে দেখা মিললো সিফাতের।বেশ লম্বা চওড়া এই মানুষটা। লাগেজের সামনে দাঁড়ানোর ফলে এখন আর পাগুলো দেখা যাচ্ছে না সেভাবে। যাক, এবার আর অস্বস্তি হবে না মানুষটার দিকে তাকাতে। -ভেবেই মৃদু হাসলো পলক নিজ মনে।তারপর পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালো সে সিফাতের দিকে।ভাজ করা কয়েকটা টি-শার্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাগেজের সামনে। হয়তো লাগেজে ভরার জন্যই এনেছে। তা দেখে পলক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সিফাতের দিকে। মূলত সিফাতের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে।পলকের ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে তার দৃষ্ট অনুসরণ করে সেও তাকালো তার হাতের দিকে। তারপর, একগাল হেসে দিয়ে খানিক উঁচিয়ে পলকে টি-শার্টগুলো দেখিয়ে বললো,
_প্যাকিং চলছে। কাল সকালের ফ্লাইট। অথচ, অফিসের কাজের ব্যস্ততায় প্যাকিংটাই করা হয়নি এখনো। -বলেই টি-শার্টগুলো লাগেজে গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। তারপর,ওগুলো গোছাতে গোছাতেই বললো,
_তোহ..মিস. মৃণ্ময়ী! কেমন আছেন আপনি? দিন কাল কেমন যাচ্ছে আপনার? আর হ্যাঁ,স্যরি…এত রাতে কল করার জন্য।।আসলে হয়েছে কি এতদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। মাস দেড়েকের জন্য যাচ্ছি তো। অফিসের কাজ গুছিয়ে দিয়ে না গেলে বাবার সমস্যা হতো।আর ওখানে গেলে ট্রেনিং এ বিজি হয়ে যাবো। কখন সময় হবে না হবে কন্টাক্ট করার কে জানে। আর,যাওয়ার আগে আপনার সাথে একবার দেখা করে যাবো না সেটা কি করে হয় বলুন! আপনি তো ভুলেও একবার কল করবেন না জানি। আপনার তো মনেই পড়ে না আমাকে। কিন্তু, আমি তো মিস করি আপনাকে। তাই অগ্যতা বাধ্য হয়ে আমাকেই এতরাতে ভিডিও কল করতে হলো।-বলেই খানিক ফিচলে হাসলো সিফাত। তার টি-শার্টগুলো গোছানো শেষ।তারপর আবার এসে ক্যামেরা ক্রস করে চলে গেল কোথাও। একটু পরেই ফিরে এলো হাতে আরও কয়েক সেট শার্ট প্যান্ট নিয়ে। পলক ধারণা করে নিল, ওপাশটায় বোধয় আলমারি।

এতক্ষণ যাবৎ, পলক চুপচাপ দেখে যাচ্ছে সিফাতের কান্ডকারখানা। সিফাত যে অতক্ষণ ধরে এত বকবক করছে সেটার বিপরীতে কোন কিছুই বলেনি সে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো সিফাত বেশ চিন্তিত মুখে লাগেজ থেকে কিছু কাপড় একবার বের করছে আবার ঢুকাচ্ছে। তিন চারবার এমন করার পর পলক জিজ্ঞেস করলো,
_এডজাস্ট হচ্ছে না ওগুলো?
কাপড়গুলো রেখে ফোনের দিকে চাইলো সিফাত। অসহায় মুখ করে ডা’য়ে বা’য়ে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। খানিক বিচলিত ভঙ্গিতে পলক বললো,
_দেখি,দেখান তো আমাকে..
আচমকা পলকের এমন একটা কথা শুনে অবাক হলো সিফাত। মনে মনে কি যেন ভেবে মৃদু হাসলো সে। তারপর এগিয়ে এসে ফোনটা লাগেজের কাছে নিয়ে গেল। লাগেজের ভেতরটা দেখালো পলককে। পলকও চোখ বুলিয়ে নিল লাগেজটায় একবার। তারপর বললো,
_প্যান্টগুলো লম্বা করে নিচের দিকে দিয়ে প্যাক করুন। আর ওগুলোর উপর একসাইডে আপনার শার্ট, আর অন্যসাইডে টি -শার্ট গুলো রাখুন। ইউনিফর্ম গুলো শার্টের সাথে রাখুন। বাকি যতটা জায়গা থাকবে সাইডে ওখানে আপনার টুকিটাকি জিনিসগুলো আরামসে এডজাস্ট হয়ে যাবে। আর আপনার টাওয়ালটা কাপড়ের উপরে বিছিয়ে নিলেই সুন্দর মত এডজাস্ট হয়ে যাবে সবটা।-বলেই নিজের কাজে নিজেই খুশি হয়ে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে হাসলো সে। সিফাত মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে হাসি।এই প্রথম সে পলককে এভাবে হাসতে দেখছে। প্রেয়সীর মুখে এই হাসি রোদ্দুরে বৃষ্টির মতোই শুদ্ধ আর স্নিগ্ধ লাগলো তার। সিফাতকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল পলক। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল সে। তা দেখে সিফাতও তটস্থ হলো। হাল্কা কেশে গলা ঝেড়ে বললো,
_আ..আব… হ্যাঁ। দু মিনিট ওয়েট করুন। আমি প্যাকিংটা শেষ করে নেই। আর বিছানায় রাখা বাকি কাপড়গুলো আলমারিতে তুলেই আসছি। তারপর, আরামসে কথা বলবো আপনার সাথে। বলেই,তার সেই ভুবন ভুলানো হাসিখানা হাসলো পলকের উদ্দেশ্য। পলক মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে হাসি। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
_জ্বী।
পলকের সম্মতি পেয়ে সিফাত গিয়ে ফোনটা আবার আগের জায়গায় রাখলো। যেখান থেকে সিফাতকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। পলক দেখছে সিফাতকে। মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মানুষটা বড্ড গোছালো। নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করে। কি সুন্দর সব কিছু ম্যানেজ করে চলে। আর এই মানুষটাই কি না তার মত সাধারণ একটা মেয়েকে পছন্দ করলো নিজের জন্য। কথাটা ভেবে আপনমনেই হাসলো পলক।তবে,এই হাসি সিফাতকে নিজের জন্য পাওয়ার খুশিতে নাকি তাকে চাওয়ার জন্য সিফাতের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে ছিল কে জানে!
_________________________________

সিফাতের প্যাকিং শেষ। লাগেজ লক করে সাইড টেবিলের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলো সে। অতঃপর এসে বসলো সোফায়। ফোনের মুখোমুখি। তারপর বললো,
_এই জন্যই বোধয় লোকে বলে একটা বয়সের পর প্রত্যেক ছেলেরই একটা বউ থাকা লাগে। সময় অসময়ে ইন্সট্যান্টলি এইসব টুকটাক হেল্প,সাজেশনের জন্য হলেও লাগে। আজ আমিও প্রমাণ পেলাম সেটার। বলেই সজোরে হাসলো সে।

পলক লজ্জা পেয়ে গেল সিফাতের কথায়। মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসতে লাগলো সে আপন মনেই।সে হাসির কিছুটা ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণেও।

তারপর সিফাতের কথায় মুখ তুলে চাইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।

_ভেবেছিলাম খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে পার্মানেন্টলি নিয়ে আসবো এ ঘরের মালকিন করে। আমার সমস্ত দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দিয়ে রিল্যাক্স করবো এবার কিছুটা। আপনাকে চিরতরে কাছে পাওয়ার লোভেই মাত্র একমাস পরেই বিয়েটা করতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু হায়..কি কপাল আমার! তা আর হতে দিল কই!-বেশ দুঃখ আর আফসোস করেই কথাগুলো বললো সিফাত।

_জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এসব তো সম্পূর্ণ রিযিকের ব্যাপার। এসব নিয়ে মন খারাপ বা আফসোস করতে নেই।-শান্ত কন্ঠে বললো পলক।

_মৃন্ময়ী! ঘোর লাগানো কন্ঠে ডাকলো সিফাত।

এহেন ডাকে শিউরে উঠলো পলক।একটা তীক্ষ ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদন্ড বেয়ে। সহসা কিছু বলতে পারলো না সে। কিন্তু, সিফাত বললো। আর সিফাতের বলা কথাটা মূহুর্তেই স্তব্ধ করে দিল পলককে।
_এত দুর্লভ কেন হচ্ছেন আপনি? এত কেন অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমার আপানাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য! তবে কি শুধু আমি একাই চাইছি আপনাকে নিজের জন্য…আপনি কি চাইছেন না আমার হতে?

বেশ কিছুটা সময় স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো পলক সিফাতের মুখপানে।সিফাতও তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। তার মুখে হতাশা আর চাপা কষ্টের ছাপ।করুণ ওই মুখখানা দেখলে যে কারোর বুকের ভেরতটায় হু হু করে উঠবে।চোখে অদ্ভুত এক ঘোর। বড্ড শান্ত অথচ ঘোর লাগা সে চোখের দৃষ্টিতে একধ্যানে তাকিয়ে থাকাও দায়। পলকও পারলো ওই যন্ত্রণা মাখা করুণ মুখ আর শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। চকিতেই চোখ নামিয়ে নিল সে। তারপর, শান্ত ধীর স্বরে বললো,

_চাই!তবে,আগে আপনি ভালোভাবে আপনার ট্রেনিং শেষ করে আসুন।এরপরে, আপনি যা চান তাই হবে। অপেক্ষায় থাকবো আমি।-বলেই লাজুক হাসলো পলক।

পলকের বলা কথাগুলো এক পশলা বৃষ্টির মতো মূহুর্তেই সিফাতের সব হতাশা,আফসোস ধুয়ে মুছে দিল।বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো এসে ঝরঝর করে ভিজিয়ে শান্ত করে দিল তার অশান্ত মনের যত কারবার।অদ্ভুত এক সুখানুভূতি এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। এখন বেশ স্বস্তি লাগছে তার। ফুরফুরে লাগছে খুব।প্রত্যুত্তরে এক প্রশান্তির হাসি উপহার দিল সে পলককে।

সিফাতের এই হাসি ছুঁয়ে দিল পলককেও। সিফাতকে শান্ত করতে পেরেছে সে।এখন স্বস্তি পাচ্ছে সে নিজেও।আর এই স্বস্তি হাসি হয়ে ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে।আর চকিতেই তা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত চোখে মুখেও।
________________________________

গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে স্কুলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিয়ান। চোখে কালো সানগ্লাস।হাতে ফোন নিয়ে কিছু একটা ঘাঁটাঘাঁটি করছে সে। একটু পরে স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো বাচ্চারা। এত এত বাচ্চাদের মধ্যে ফাইয়াজের জন্য অপেক্ষা করছে সে। ফাইয়াজ তার ভাইয়ের ছেলে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আজ স্কুলে খেলতে গিয়ে পড়ে গেছিল সে। হাতে হাঁটুতে কিঞ্চিৎ ছিলে গেছে নাকি। তাই বাড়িতে ফোন করা হয়েছিল যেন গার্ডিয়ান এসে নিয়ে যায়। এই অবস্থায় স্কুল বাসে সব বাচ্চাদের সাথে পাঠাতে চায়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ।

তার ভাই আর ভাবী দুজনেই কর্পোরেট অফিসার।মূলত তারা কলিগ ছিল।আর সেখান থেকেই দুজনের পরিচয়।অতঃপর,প্রণয় আর তারপর বিয়ে। দুজনেই ব্যস্তমানুষ। কাজ ছেড়ে আসা অসম্ভব।তাই, অগ্যতা তিয়ানকেই আসতে হয়েছে অফিস ছেড়ে। ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ভীড়টা কিছুটা হাল্কা হয়ে এলো। তারপরেই, ফাইয়াজকে দেখা গেল। একজন মেয়ের হাত ধরে কিছুটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। হাতে আর হাঁটুতে ব্যান্ডেজ করা।মুখটা কাঁদোকাঁদো তার। বেশ ভালোই চোট লেগেছে বোধয় বেচারার।কিছুটা কাছে আসতেই মেয়েটা কে সেটাও অবগত হলো তিয়ান। মেয়েটা আর কেউ নয়..পলক!কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেল সে। অবাক নয়নে চেয়ে আছে পলকের দিকে। আচমকা আবার এখানে পলকের সাথে তার দেখা হয়ে যাবে এটা সে কখনোই ভাবেনি। চোখের সানগ্লাসটা খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। গায়ের ব্লেজারটাও টেনেটুনে খানিকটা ঠিক করে নিল। প্রায় একেবারে কাছাকাছি আসতেই ফাইজায়কে জিজ্ঞেস করলো কার সাথে যাবে সে। ফাইয়াজও আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় তিয়ানকে দেখালো। এতক্ষণ পলকের সমস্ত ধ্যান ফাইয়াজের উপর ছিল। তাই তিয়ান যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা সে খেয়ালই করেনি। কিন্ত,ফাইয়াজকে অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই থমকে গেল পলকও। তিয়ানকে মুখোমুখি আবার দেখতে পাওয়াটা একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার তার জন্যও। যেই মানুষটার থেকে সে দূরে থাকতে চায়,এড়িয়ে যেতে চায়..সেই ঘুরেফিরে তার সামনে চলে আসছে। এতদিন পরে যখন সব ভুলে সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে, জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পা রাখতে চলেছে কিছুদিন বাদেই…ঠিক তখনই কেন অতীতের দাফন করা অধ্যায়টা নতুন করে উন্মোচিত হচ্ছে তার জীবনে? যেই মানুষ, যেই মুখটাকে সে ভুলতে বসেছিল সেই বা কেন সামনে আসছে আবার?- আচকা ওখানে তিয়ানকে দেখে নানান ভাবনায় ডুব দিয়েছিল পলক।আর তখনই হাতে টান পড়লো তার। ঘোর কাটলো ফাইয়াজের কথার আওয়াজে। পলককে থমকে যেতে দেখে হাত ঝাঁকিয়ে ডাকছে তাকে।

_মিস. মিস…
_হ্যাঁ,বাবা?
_এইটা আমার চাচ্চু।আমি তার সাথেই যাবো।-তিয়ানকে দেখিয়ে বললো ফাইয়াজ।

ফাইয়াজের কথায় তিয়ান বুঝলো পলক ফাইয়াজের টিচার। তারপরেও শিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো পলককে,
_পলক তুমি…?
_ফাইয়াজের ক্লাস টিচার।-তিয়ানকে দেখেই ভেতর ভেতর বেশ অস্থির লাগছিল পলকের। তবুও,নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে তিয়ানের প্রশ্নের জবাব দিল সে।
_অহ,আচ্ছা। -তিয়ান বললো।
_হুম।
_তো,কেমন আছো তুমি?
_ভালো আছি।আপনি?
আচমকা পলকের মুখে তুমি থেকে আপনি সম্বোধনটা শুনেই কেমন যেন লাগলো তিয়ানের। তারপরেও,ব্যাপারটাকে ছাপিয়ে জবাব দিল পলকের প্রশ্নের।
_Hmm…I’m fine also.তারপরেই, ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
_Hey…fazz.. what’s up, buddy?
_Not good buddy. see…বলেই হাত আর পায়ের ব্যান্ডেজগুলো দেখালো তিয়ানকে। এরপর, পলক বললো,
_আ…ওকে স্কুলের মেডিকেয়ার থেকে প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। কিছুটা ছিলে গেছে জাস্ট। একটু ব্যাথা থাকবে হয় তো দুই একদিন।রেগুলার ওয়েন্টমেন্ট লাগেলেই ঠিক হয়ে যাবে। & Dr. said, nothing to worry. He will be fine soon. বলেই ফাইয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পলক।
_ok..thanks. -মুচকি হেসে বললো তিয়ান।
_Buddy…let’s go.. naa!! I need rest.
_Yeah..sure buddy. Come here.-বলেই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তিয়ান ফাইয়াজকে। ফাইয়াজ কাছে আসিতেই গাড়ির দরজা খুলে দিল সে। গাড়িতে উঠার আগে ফাইয়াজ পিছন ঘুরে হাত নাড়িয়ে পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_Bye, miss.
_Bye, dear. Take care. -বলেই হাত নাড়িয়ে সেও বিদায় জানালো ফাইয়াজকে। তারপরেই ফাইয়াজ গাড়িতে উঠে বসলো। সে গাড়িতে বসতেই দরজা লাগিয়ে দিল তিয়ান। তারপর,পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_ভালো থেকো পলক।আসছি।
তবে প্রত্যুত্তরে পলক কিছু বললো না। চোখ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়ি রইলো ওখানে। পলকের থেকে কোন জবাব না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলো তিয়ান। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
______________________________

একধ্যানে তিয়ানের গাড়িটার চলে যাওয়া দেখলো পলক। মিনিটের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল গাড়িটা।কিন্তু,গাড়িটা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও ওখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সে। মনে চলছে অজস্র স্মৃতির আনাগোনা। অনেক অনেক পুরোনো যন্ত্রণারা ধারালো আলপিনের মত বুকের মাঝে এসে বিঁধছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে দাফন হওয়া অতীতের কবর থেকে।তবে কি আজও স্মৃতিগুলো,যন্ত্রণাগুলো তেমনই সতেজ..জীবত আছে ,ঠিক যেমনভাবে নিজের মাঝে দাফন করে নিয়েছিল সে?-কথাটা ভাবতেই ভেতর ভেতর বিষাক্ত এক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল পলক। বুকচিরে বেরিয়ে এক কালো দীর্ঘশ্বাস।

আজকের দেখা হওয়াটা সেদিনের মতই অপ্রত্যাশিত ছিল,যেদিন বহু বছর পর শপিং মলের সামনে দেখেছিল। আবার ঠিক সেদিনের মতোও, যেদিন বেশ অপ্রত্যাশিত ভাবেই পলকের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তিয়ানের।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here