হারানো সুর পর্ব-৫

0
882

হারানো সুর-৫ম পর্ব
©শাহরিয়ার

নামায শেষ করে সাবাকে বুকের সাথে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শরীর খুবই ক্লান্ত থাকায় অল্প সময়ের ভিতর দু’চোখে ঘুম চলে আসলো। এবং এক সময় দু’চোখ গভীর ঘুমে বন্ধ হয়ে এলো।
ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানে। বিছানা থেকে উঠে ওযু করে নামায আদায় করে নিলাম। সাবা তখনো গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। আমি অপেক্ষা করছি রুমনের জন্য। আমি জানি রুমন কিছু ক্ষণের ভিতর চলে আসবে আমার সাথে দেখা করার জন্য।

হ্যাঁ তাই হলো, অল্প সময়ের ভিতর রুমন আমার রুমে চলে আসলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে কিরে ভাই মন খারাপ?

রুমন, বুবু তুমি কি সত্যিই চলে যাবা?

হ্যাঁ চলে যাবোরে ভাই, সকলের ভালোর জন্য যেতে হবে। তুই যেয়ে এগিয়ে দিয়ে আসবি আমাকে।

রুমন, কোথায় যাবা বুবু? কার কাছে যাবা?

আমি জানি নারে কার কাছে যাবো। তবে আমাকে যেতে হবে। তোর ভালোর জন্য, সাবার ভালোর জন্য, আমাকে বেঁচে থাকার জন্য যেতে হবে। আর যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।

রুমন, আমাকে ভুলে যাবে নাতো?

আমি হেসে দিয়ে পাগল কি বলিস তোকে কি করে ভুলবো। তোকে কি কখনো ভুলা সম্ভব? তোর সাথে আমার যোগাযোগ থাকবেই। আমি যেখানেই থাকি না কেন ঠিকই তোর সাথে আমার যোগাযোগ থাকবেই।

রুমন, সত্যিতো বুবু?

হ্যাঁরে সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি। আচ্ছা শোন তোকে কিছু কথা বলি।

রুমন, হ্যাঁ বলো।

তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে এমন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যেন। কেউ তোর দিকে আঙুল তোলে কিছু বলার আগে হাজার বার কল্পনা করে। আমি যেনো সবার সামনে গলা উচু করে বলতে পারি এটা আমার ভাই।

রুমন, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ঠিক আছে বুবু আমি তোর প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আমি নিজেকে ঠিকই একদিন প্রতিষ্ঠিত করে তুলবো ইনশা আল্লাহ।

ঠিক আছে এখন তুই যা আমি রেডি হই। তারপর তোকে ডাক দিবো তুই আমাকে নিয়ে যাবি। রুমন চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রত্না কিছুটা সময় নিরব বসে রইলো। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠছে। রুমন মনে অনেক আঘাত পেয়েছে বুঝতে পেরেও তাকে কোন রকম শান্তনা দিতে না পারাটা কি যে যন্ত্রনার তা কাউকে বুঝানো সম্ভব না। নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে, সাবাকে বিছানা থেকে তুলে বসিয়ে ওর জামা কাপড় চেঞ্জ করে দিয়ে, নিজের শাড়িটাও চেঞ্জ করে নিলাম। কতদিন আয়নাতে নিজের মুখ দেখি না। আয়নাটা চোখের সামনে ধরতে পরিচিত মুখটাও আজ বড্ড অচেনা লাগছে নিজের কাছেই।

ক্ষুদার্ত আর ঠিকমত না ঘুমাতে পারায় মুখটা কেমন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো কালো দাগ হয়ে গেছে। মানুষ দেখলে ভাববে কত দিনের না রোগী। অথচ এই মুখে ছিলো উজ্জলতা, ছিলো মায়া যে কারো চোখে প্রথম নজড় পরলে হারিয়ে যেতে বাধ্য হতো এ চোখের মায়াতে। শাকিল অসংখ্য বার এ চোখে তাকিয়ে বলেছে ভালোবাসি। অসংখ্য বার বলেছে এ চোখের মায়া কাটিয়ে উঠা নাকি এক জনমে সম্ভব নয়। হয়তো তার বলা কথা গুলো মিথ্যা ছিলো, অভিনয় ছিলো। কিন্তু সত্যিই আমার মুখে চোখে মায়া ছিলো, লাবন্য ছিলো তা আমি জানি।

নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না, ব্যাগ খুঁজে কাজলটা বের করে চোখে লাগাতে শুরু করলাম। টিপের পাতাটা খোঁজে তার থেকে কালো টিপটা বের করে কপালের মাঝে বসিয়ে নিলাম। নিজেকে আজ নতুন করে সাজাতে খুব ইচ্ছে করছে। যেমন আকাশে রংধনু সাত রঙে সাজে ঠিক তেমন করে নিজেকে সাজাতে ইচ্ছে করছে। ব্যাগ থেকে খুঁজে লিপস্টিকটা বের করে ঠোঁটের নিচে লাগাতেই পুরনো দিনের কথা মনে পরে গেলো।

বিয়ের পরদিন সকালে গোসল করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজতে ছিলাম, পাশেই খাটে শাকিল ঘুমিয়ে ছিলো। আমি চোখে কাজল, কপালে টিপ, নেয়ার পর ঠোঁটে লিপস্টিক নিয়ে ঘুরতেই চমকে উঠি, শাকিল বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি তা খেয়াল করিনি। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলাম। শাকিল আমার আরও কাছে চলে আসলো, আমি ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। হঠাৎ করেই পিঠের উপর ওর হাতের স্পর্শে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। আমি বসা থেকে এ লাফে যেনো দাঁড়িয়ে গেলাম। ভয়ে চোখ মেলে তাকাতে পারছি না, ঠোঁট দুটো ভীষণ রকম কাঁপছে।

হঠাৎ কানের কাছে ফিঁসফিঁস করে শাকিল বলে উঠলো তোমাকে অপূর্ব লাগছে, গতরাতে মন ভরে দেখতে পাইনি আজ দেখে যেনো জীবনের পরিপূর্ণতা পেলো। আমি চোখ মেলে তাকাতে যাবো ঠিক সেই মুর্হুতে কোমড়ের উপর দিয়ে দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে পাজা কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এসে শুয়িয়ে দিলো। আমি চোখ বন্ধ অবস্থায় বললাম কি করছেন আম্মা চলে আসবে ছাড়েন। শাকিল হেসে উঠলো, ভয়ংকর হাসি এরপর আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওর ঠোঁট দু’টো আমার ঠোঁটের মাঝে নামিয়ে নিয়ে আসলো।

দরজায় টোকা পরলো, আম্মা এসে ডাকছে, শাকিল আমাকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করে যেয়ে দরজা খুলে দিতেই শাশুড়ি এসে ঘরে ঢুকলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম আম্মা এক দৃষ্টিতে শাকিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমিও শাকিলের দিকে তাকাতে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ওর ঠোঁট দু’টো লিপস্টিকের দাগে লাল টকটকে হয়ে রয়েছে। আম্মা ছিঃ বলে রুম থেকে বের হতে হতে বলতে শুরু করলো বউ পাগলা ছেলে আমার। আম্মার এমন কথায় সেদিন সব লজ্জা শরম ভুলে আমি হা হা করে হেসে উঠি। আমার সাথে সাথে শাকিল ও হেঁসে উঠে।

তবে এতো দিনের পুরনো কথায় দু’চোখের পাতা ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি গুলো বড় মধুর হলেও, সে স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষটা যখন বদলে যায়, তখন সে স্মৃতি গুলো আর আনন্দের থাকে না। বেদনায় ভরে উঠে চারিদিক সব কিছু। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে রুমন দরজার সামনে এসে ডাক দিলো। আমি তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে ওকে ভিতরে ডাক দিলাম।

রুমন, আমার দিকে কিছুটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তুমি কাঁদছিলে তাই না?

আমি কই নাতো কাঁদবো কেন আমি?

রুমন, তোমার চোখের কাজল গুলো নষ্ট হয়ে গেছে ভালো ভাবে ঠিক করে নাও।

যার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে ভাই তার চোখের কাজল দিয়ে কি হবে। কথাটা বলেই হো হো করে কেঁদে উঠলাম। আমি চাইনি রুমনের সামনে কাঁদতে তবে আজ আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। হয়তো আর কিছু সময় ওর সাথে আছি বলেই এমনটা হয়েছে।

রুমন, হাত বাড়িয়ে চোখ থেকে পানি মুছে দিয়ে কেঁদো না বুবু। নিশ্চই আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।

নিজেকে শান্ত করে রুমনকে বললাম ব্যাগটা তুলে নিতে আমরা বের হয়ে যাবো রেলস্টেশন এর উদ্দেশ্যে। রুমন বললো কিছু খেয়ে তারপর রওনা হওয়ার জন্য। আমি বললাম বেশী সময় নাই এখন না গেলে ট্রেন মিস করবো পরবর্তি ট্রেন দুপুরে আসবে। রুমন আর কথা বাড়ালো না ব্যাগ কাঁদে তুলে নিয়ে সাবাকে আরেক হাতে কোলে তুলে নিলো।

ঘরের ভিতর থেকে বের হতেই চাচা, চাচীর সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমি চাচাকে জড়িয়ে ধরে কিছুটা সময় কান্না করে চোখের পানি ফেলে মন হালকা করে নিলাম। এরপর চাচীকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই দু’টো মানুষকে আমি আর কখনোই দেখতে পাবো না। চাচীর দু’হাত শক্ত করে ধরে বললাম চাচী তোমার ছেলেটাকে আর কিছু সময়ের জন্য আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি, আর একটু মানুষের কথা সহ্য করে নিও।

চাচী আমার কথা শেষ হতেই হাউমাউ করে কান্না করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি এমনটা আশা করিনি। আমার প্রচণ্ড মায়া হচ্ছিলো চাচীর জন্য। আমি চাচীর পিঠে হাত দিয়ে বললাম তুমি কাঁদছো কেন? জবাবে চাচী বললো অনেক অন্যায় করেছি তোর সাথে পারলে ক্ষমা করে দিস। আমি চাচীর দু’হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে বললাম। বাবা মায়ের কোন অন্যায় থাকে সন্তানের কাছে। বরং তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও। অনেক কষ্ট দিয়েছি জ্বালিয়েছি, মানুষের কথা শুনিয়েছি, তার জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

চাচা চাচীর সামনে দাঁড়ানোর মত শক্তি যেন আর পাচ্ছিলাম না। রুমনের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুটা পথ হাঁটার পরেই একটা ভ্যান পেলাম তাতে উঠে বসলাম। ভ্যান এগিয়ে চলতে শুরু করলো ইস্টেশনের দিকে আমি রুমনের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছি। ওর মন খারাপ আমি জানি গল্প করলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে। ইস্টেশনে এসে আমার জন্য টিকেট কেটে নিয়ে আসলো। ট্রেন আসার সাথে সাথেই আমাকে তুলে দিয়ে সিটে বসিয়ে দিলো। আমি ওর চোখের কোনে পানি দেখতে পেলাম। তাই দুষ্টমি করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। ভাই এরপর যখন আমাদের দেখা হবে তখন যেনো তোর সাথে পরীর মত একটা মিষ্টি বউ থাকে। আমার কথা শুনে রুমন হেসে দিলো। এদিকে ট্রেনের হুইশেল বেঁজে উঠলো। আমি রুমনকে নেমে যেতে বললাম রুমন নেমে গেলো ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমার মনের ভিতর শূণ্যতার ক্ষত সৃষ্টি হতে শুরু করলো। আমি ভয়ে ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম। আর মনে মনে বলতে শুরু করলাম।

“আল্লাহ্ কোনো ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের চাইতে বেশী, এমন বোঝা চাপিয়ে দেন না!”
[সূরা বাক্বারা: ২৮৬]

আমিও নিশ্চই সব দুঃখ কষ্টকে দূরে ঠেঁলে ঠিকই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো ইনশা আল্লাহ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here