হারানো সুর পর্ব-৮

0
851

হারানো সুর-৮ম পর্ব
©শাহরিয়ার

দৌঁড়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলাম। বুঝতে পারলাম ওকে খাওয়াতে হবে। তাই দেরী না করে সাবাকে বুকের সাথে লাগিয়ে রুম থেকে বের হলাম। কিচেনে গিয়ে দেখলাম দুধ গরম করা আছে। মাকে ডাক দিয়ে বললাম আমি এখান থেকে দুধ নিবো সাবাকে খাওয়ানোর জন্য। মা বললেন অবশ্যই নিবে। এই দুধ ওর জন্যই গরম করেছি। আমি মেয়ের জন্য ফিডারে দুধ ভরে নিলাম। আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। কার রিজিক কোথায় কিভাবে রেখেছেন একমাত্র তিনিই তা জানেন। কোন না কোন ভাবে, কোন এক উছিলায় তা ঠিকই আপনার কাছে চলে আসবে।

দেখতে দেখতে সাতটা দিন এ বাড়িতে কেটে গেলো। নিজেকে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছি। বাড়িতে তেমন কাজ নেই সারা দিন আমি আর মা গল্প করেই কাটিয়ে দেই। তবে সব চেয়ে মজার ঘটনাটা ঘটিয়েছেন মা। আমার জন্য বই কিনে নিয়ে এসেছেন। বই গুলো আমার হাতে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করেন। রত্না তুইতো নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাস, নিজে কিছু করতে চাস তাই না?

আমি বললাম হ্যাঁ মা চাই।

মা: তাহলে এই বই গুলো ধর এই গুলো পড়তে হবে তোকে। শিক্ষিত হতে হবে। আমি যেহেতু একজন প্রফেসর। আমি তোকে বোর্ডে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিবো। তোকে সব পড়া আমিই পড়াবো। কিন্তু তোর নিজের আগ্রহটা আসল।

আমি মাকে বললাম, আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সব করতে পারি। তারপর বই গুলো হাতে তুলে নিলাম। কাজের শেষে অবসর সময় গুলোতে মা আমাকে পড়া দেখিয়ে দেন। আর আমি পড়া শিখি। এভাবেই দিন গুলো এগিয়ে যাচ্ছে বেশ।

জাহাঙ্গীরকে এখনো আমার প্রচন্ড রকম ভয় লাগে, উনি যে ভাবে তাকায় মনে হয়। আমি কোন বড় অপরাধী থানার তালা ভেঙ্গে পালিয়ে এসেছি। যদিও উনার সাথে আমার খুব একটা দেখা হয়না। সকালে নাস্তার টেবিল আর রাতে খাবার টেবিলে দেখা হয়। আমি নিজেও উনার থেকে কিছুটা দূরে দূরে থাকি। সত্যিই এই পুলিশকে আমি ভীষণ রকম ভয় পাই। যদিও ভয় পাবার কোন কারণ নেই তবুও ভীষণ ভয় পাই।

আমাকে এমন ভয় পেতে দেখে মা হাসে মাঝে মাঝে আমাকে বলে রত্না তুই কি কিছু চুরি করেছিস? ওকে দেখে এতো ভয়ে ভয়ে কেন থাকিস? আমি লজ্জা পেয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলি। মা আপনার ছেলের মনে সব সময় সবার জন্যই সন্দেহ থাকে হোক সেটা বাড়িতে কিংবা ডিউটিতে। দেখেন না বাড়িতে যতক্ষণ থাকে চোখ বড় করে তাকিয়ে তাকিয়ে এদিক সেদিক কি কি যেন খোঁজে। মনে হয় চোর ডাকাত ঘরের ভিতরে এসেও লুকিয়ে আছে। এভাবেই হাসি আর আনন্দে আমার দিন গুলো বেশ কেটে যাচ্ছে।

আজ এ বাড়িতে আমার পনের তম দিন। আজ সকাল থেকেই মা খুব ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার কারণ কি আমি জানি না। বাড়ি ঘর সমস্ত পরিষ্কার করতে শুরু করেছে আমাকে সাথে নিয়ে। বিশাল বাড়ি দু’জন পরিষ্কার করতে করতে সকাল থেকে দুপুর হয়ে গেছে।

মা: হাঁপাতে হাঁপাতে কোমরে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরে বলতে শুরু করেছে আমি আর পারবো না বুড়ি হয়ে গেছি। আগে একাই এ বাড়ি পরিষ্কার করেছি। নিজ হাতে গুছিয়েছি আর এখন একটুতেই হাঁপিয়ে উঠি।

আমি মায়ের পাশে বসে তার হাত চেঁপে ধরে আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আপনি এখন গোসল করবেন। তারপর আমাকে দেখিয়ে দিবেন, কোথায় কি রাখতে হবে, কি কি করতে হবে আমি সব করে নিবো। আপনার এখন রেস্ট নিতে হবে, এই বয়সে এতো কাজতো করা যাবে না।

মা: চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আমি কি আর স্বাদে করি এতো কাজ। ছেলেটাকে কবে থেকে বলছি বিয়ে কর বিয়ে কর শোনে না আমার কথা। শুনলেতো বাড়ির দ্বায়িত্ব তার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আমি আরাম আয়েশ করে জীবনের বাকি দিন গুলো কাটিয়ে দিতে পারতাম। সে কপাল বোধহয় আমার নেই।

কথা গুলো বলতে বলতে মন খারাপ করে মা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও মায়ের কথাই ভাবছি উনার ছেলের বেশ ভালোই বয়স হয়েছে কিন্তু বিয়ে কেন করছে না? আগে কি প্রেম টেম করে ছ্যাকা খাইছে নাকি এখনো কাউকে চুপি চুপি ভালোবাসে যার কারণে বিয়ে করছে না। কোন না কোন একটা কারণ নিশ্চই আছে।

এ সব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই আমার শাকিলের কথা মনে পরে গেলো। আজ পনের দিনে খুব বেশী শাকিলের কথা মনে পরেনি। আমিও চাইনি ওর কথা মনে পরুক। আমি যথা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু ভালোবাসার কথা মনে পড়তেই ওর কথা মনে পরে গেলো।

সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো, আমি শাকিলের জন্য অপেক্ষা করছি, শাকিল আসবে আমাকে কথা দিয়েছে। এদিকে বৃষ্টি বেড়েই চলেছে, আমি একটা টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ওর আসার অপেক্ষায়। হঠাৎ দূর থেকে মাথার উপর কচু গাছের পাতা নিয়ে তাকে আসতে দেখি। তার এমন অবস্থা দেখে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে মনে প্রচন্ড হেসে নিলাম।

শাকিল: কাছে এসে পাশে দাঁড়িয়ে একটা পাতা আমার মাথার উপর ধরে বলতে শুরু করলো তুমিতো ভিজে গেছো।

এতো সময় আমি খেয়ালই করিনি আমি যে ভিজে গেছি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললাম। আর কিছু ছিলো না? এই কচু গাছের পাতা নিয়ে আসতে হলো আপনাকে?

শাকিল: কি করবো যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তখন কি আর জানতাম এমন বৃষ্টি আসবে? তাহলেতো ছাতা নিয়েই বের হতাম। আর তুমি এখানে আসছো বলেইতো এই বৃষ্টির মাঝেও আমি ছুটে এসেছি না হলে কি আসতাম? ঠিকই বাড়িতে ফিরে যেতাম।

আমি শাকিলের দিকে তাকিয়ে বললাম বেশতো এখন চলে যান। আমিতো আপনাকে বেঁধে রাখিনি।

শাকিল: বেঁধে রাখোনি, কিন্তু তোমাকে একা রেখেই বা যাই কি করে? যে আমার জন্য এতোটা পথ হেঁটে এসেছে এই বৃষ্টির মাঝে তাকে রেখে আমি কি করে চলে যাবো? তারচেয়ে বরং না হয় এই কচু গাছের পাতার ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় গল্প করি।

আমি অবাক দৃষ্টিতে শাকিলের দিকে চেয়ে রইলাম অনেকটা সময়। সে আমার মাথার উপর পাতা রেখে দূর আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম বিকেল হয়ে আসছে আমাকে যেতে হবে।

শাকিল: যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু বেঁধে রাখার মত অবস্থাও নাই। কি করতে কি করি তুমি কি বলতে পারো?

আমি হাসতে হাসতে আমি কি করে বলবো বলেন? আপনার মন আপনিই ভালো জানেন।

শাকিল: এক কাজ করি এমনি করে তোমার মাথার উপর গাছের পাতা ধরে তোমাকে বাড়ির কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি?

লোকে দেখলে যে বদনাম হয়ে যাবে। তখন আমি সমাজে মুখ দেখাবো কি করে?

শাকিল: তখন না হয় আমার বুকে মাথা রেখে সমাজের মানুষ গুলোকে দেখিয়ে দিবে ভালোবাসার মানুষ মাঝ রাস্তায় ছেড়ে চলে যায় না। কেউ কেউ ভালোবেসে বুকের মাঝেও আগলে রাখতে জানে।

আমি তার কথায় মুগ্ধ হই, যতই তার কথা শুনতাম ততই তাকে ভালোবেসে ফেলতাম। মানুষটার কথায় যাদু ছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি তার কথা শুনতাম। যেমন কেউ গল্প বললে আমরা মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে তার গল্প শুনি। তেমনি এই মানুষটার কথা আমি শুনতাম।

মা: কিরে তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, গোসল করবি কখন?

মায়ের কথায় বাস্তবতায় ফিরে আসি। মাথাটা নিচু করে একটু পরেই করবো এখন বলো কি করতে হবে আমাকে?

মা: আচ্ছা তুই কি পায়েস রান্না করতে পারিস?

হ্যাঁ পারিতো কেন করতে হবে?

মা: হ্যাঁ করলেতো ভালোই হয় ছেলেটা আমার পায়েস খুব পছন্দ করে।

আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি এখুনি করে দিচ্ছি। তুমি শুধু একটু বলে দিও। যেভাবে ভালো হয় সেভাবে।

মা: আচ্ছা ঠিক আছে তা না হয় করলাম।

আমি মায়ের সহযোগিতায় রান্না শুরু করে দিলাম। আমি নিজেও বহুবার পায়েস রান্না করেছি। তবুও শহরের রান্না আর আমার গ্রামের রান্না যদি আলাদা রকম কিছু থেকে থাকে। তাই বার বার মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করে আমি সব কিছু দিচ্ছিলাম। না রান্নার নিয়ম সব উপকরণ একই, তাই রান্না করতে আমার কোন রকম সমস্যা হলো না। বরং মা বেশ খুশিই হলো আমার রান্না দেখে। পায়েস রান্না শেষ হতেই মা আমাকে প্রশ্ন করলো পোলাউ রান্না করতে পারি কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ পারি।

মা আমাকে দেখিয়ে দিলো কোথায় পোলাউর চাল আছে, আমি চাল নিতেই মা বললেন আজ কিছু মেহমান আসবে। বেশী করে রান্না করার জন্য। আমি চাল নিতে নিতে মাকে প্রশ্ন করলাম আজ কি কোন বিশেষ দিন?

মা: হেসে দিয়ে হ্যাঁ খুবি বিশেষ একটা দিন।

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম কি দিন মা?

মা: হাসতে হাসতে বললো পরেই জানতে পারবি।

এমন সময় পাশের রুম থেকে সাবা কেঁদে উঠলো, মা আমাকে বললো তুই রান্না কর আমি যেয়ে ওকে নিয়ে আসছি। মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে সাবাকে নিয়ে আসতে গেলো। আমি রান্না বসিয়ে দিলাম চুলোয়।

মা সাবাকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলো। আমি মায়ের দিকে কৌতুহলি চোখে চেয়ে রয়েছি।

মা: কিরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই কি রোস্ট রান্না করতে পারিস?

আমি মাথা নেড়ে বললাম না পারি না তবে দেখিয়ে দিলে পারবো।

মা: হাসি দিয়ে আচ্ছা আমি দেখিয়ে দিবো। রোস্ট বানানো খুবই সহজ। এখন তুই ওর জন্য খাবার রেডি কর।

আমি মাথা নেড়ে সাবার জন্য ফিডার রেডি করতে শুরু করলাম। ফিটার রেডি হতেই মায়ের হাতে তুলে দিলাম মা ফিটার আর সাবাকে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি রান্নায় মনোযোগ দিলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here