হারানো সুর পর্ব-১৩

0
800

হারানো সুর-১৩তম পর্ব
©শাহরিয়ার

আমি মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে মা আমাকে বলতে শুরু করলো।

মা: ওর নাম ঝর্ণা, আমার একমাত্র ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে। ওর বড় একটা ভাই আছে আর ও ছোট। খুবি জিদ্দি মেয়ে, ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড রকম জিদ ওর। ওরা পুরো পরিবার কুমিল্লা থাকে, হুটহাট করে বেড়াতে চলে আসে। কখনো ঝর্ণা তো কখনো জাহিদ। বছরে দুই বছরে ওর মা বাবা আসে। তাছাড়া আমরাও মাঝে মাঝে কুমিল্লা বেড়াতে যাই। ধরতে গেলো ঝর্ণা আমাদের দুই বোনের এক মেয়ে।

কথা বলতে বলতে ঝর্ণা উপর থেকে বলে উঠলো খালা মনি চা খাবো চা কোথায়। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি করে দিচ্ছি। বলেই সোফা থেকে সাবাকে কোলে তুলে নিয়ে রান্না ঘরের ভিতর ঢুকে পরলাম। চায়ের পানি গরমই ছিলো তাই বানাতে বেশী সময় লাগেনি। অল্প সময়ের ভিতর চা বানিয়ে ডাইনিং এ নিয়ে দেই।

ঝর্ণা: চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে এ কে খালা মনি? আগেতো কখনো দেখিনি নতুন বুয়া রেখেছো নাকি?

মা: আরে না না বুয়া না, আসলে ও সমস্যায় পরে আমাদের এখানে আছে।

ঝর্ণা: বেশ কয়েক বার আমার দিকে তাকিয়ে ঘরে যৌয়ান ছেলে তোমার, এতো অল্প বয়সী মেয়ে বাসাতে বেশী দিন থাকতে দেয়া কিন্তু ঠিক না বুঝলে।

ঝর্ণার করা ইশারা আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি তাই সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না। আমার ধারণা ঠিকই ও শুধু অহংকারী না ওর মনটাও কুৎসিত। মানুষ এতো ছোট মনের হতে পারে আমার জানা ছিলো না।

মা: কি সব উল্টা পাল্টা কথাবার্তা বলিস তুই। রত্না খুবি ভালো একটা মেয়ে। নামাজি নম্র ভদ্র, এখনকার যুগে এতো ভালো মেয়ে চোখে দেখা যায় না বুঝলি।

ঝর্ণা: ভালো হলেই ভালো।

আমি সাবাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। এই মেয়ের কথা শুনতে আমার আর বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে করছে না। নিজের রুমে এসে সাবাকে কোলে নিয়ে পড়তে বসলাম। ইদানিং সাবাও খুব জ্বালাচ্ছে। পড়তে বসলেই বই ও হাত দিয়ে টানাটানি করতে থাকে। যতই বড় হচ্ছে ততই জ্বালাতন করে চলছে। আর কিছুদিন পর ওর তিন বছর পূর্ণ হবে দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর পর কলিং বেল বেজে উঠলো আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলাম স্যার এসেছে। যেহেতু ঝর্ণা আর মা সেখানে আছে তাই আর উঠতে ইচ্ছে করলো না। কিন্তু পরডর আরও দুইবার বার যখন কলিং বেলটা বেজে উঠলো, তখন বুঝতে পারলাম রুমে হয়তো কেউ নেই। তাই দ্রুত সাবাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে দরজা খুলে দিলাম। আসে পাশে তাকিয়ে দেখলাম মা আর ঝর্ণা নেই। তাহলে দু’জন কোথায় গেলো।

জাহাঙ্গীর: কি ব্যাপার দরজা খুলতে আজ এতো দেরী হলো যে?

স্যার পড়তে বসেছিলাম আর মা আর আপনার খালাতো বোন ঝর্ণা ডাইনিং এ বসা ছিলো ভাবলাম উনারা হয়তো আছে তাই আসিনি।

জাহাঙ্গীর: কি ঝর্ণা এসেছে? এই মেয়ে পাগল করে ছাড়বে। আমি আবার অফিসে চলে যাই পারলে।

কেন কেন স্যার কি সমস্যা?

জাহাঙ্গীর: তুমি বুঝবে না এই মেয়ে শুধু সমস্যাই না মহা সমস্যা।

স্যারের মুখে এমন কথা শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পেলেও নিজেকে সামলে নিলাম।

জাহাঙ্গীর: এই মেয়ে আস্তো একটা পাগলী।

বলতে বলতে স্যার উপরে উঠতে শুরু করলো। স্যার উঠে যাবার পর আমি সাবাকে নিয়ে আরেক বার রান্না ঘরে চলে গেলাম স্যারের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসার জন্য। চা রেডি হলে নাস্তা সহ ডাইনিং এ রেখে সোজা নিজের রুমে চলে আসলাম। বিছানার উপর খেলনা দিয়ে সাবাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে আবারও বই নিয়ে পড়তে বসলাম।

বেশ ভালোই দিনকাল কাটছে শাকিলের, নতুন বউয়ের সাথে গত বারো দিন শ্বশুড় বাড়িতে থেকে কিছু সময় আগেই বাড়িতে ফিরেছে। এদিকে শাকিলের মা পাশের বাড়িতে যেয়ে বসে গল্প করছে। গত পাঁচটা বছর রত্না কখনো শাশুড়িকে একা রেখে কোথাও যায়নি। যেখানে গিয়েছে সাথে নিয়েই গিয়েছে। তাই কখনো একা একা লাগেনি। কিন্তু এবার যখন শাকিল ওর নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে শশুড় বাড়ির পথে রওনা হলো। একটা বারের জন্যও জানতে চাইলো না মা তুমি কি যাবে? তখনি তার হৃদয়ের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। শাকিল আর তার বউ বের হয়ে যাবার পর রত্না রত্না করে কেঁদে বিছানার বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। জানে রত্না আর ফিরবে না। তার নাতনী কে আর দেখা হবে না। তবুও একলা ঘরে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করে। আর কিছুক্ষণ পর পর আনমনে বলতে থাকে তুই তোর পাপের শাস্তি পাবি শাকিল। তুইও একদিন একা হয়ে যাবি কাউকেই পাবি না আপন তোর দুঃখের দিনে। যেমন আজ আমি একা হয়ে কাঁদছি একদিন তুই ও কাঁদবি।

আরও নানান রকম কথা বলতে বলতে প্রথম দুই তিন দিন কেটে যায় একা একা। কিন্তু আর ভালো লাগছিলো না একা একা জীবন। তাই পরদিন থেকে এর বাড়ি ওর বাড়ি ঘুরে ঘুরে গল্প করে করে দিন পার করতে থাকলো। দিন গুলো এভাবে কেটে গেলেও রাত গুলো বেশ লম্বাই লেগেছে, একলা বাড়িতে ভীষণ একলা লেগেছে। এভাবেই গত বারোটা দিন কাটিয়েছেন উনি।

শাকিল মা মা করে ডাকাডাকির এক পর্যায় মা বাড়িতে আসে। এসে প্রশ্ন করে কি হয়েছে এতো চিৎকার করছিস কেন?

শাকিল: কতদিন তোমাকে দেখি না। বাড়ি খালি রেখে কোথায় চলে গেছিলা।

মা: সেই কৈফিয়ত কি আমার তোকে দিতে হবে?

শাকিল: আমি কি তোমাকে তা বলছি নাকি? তোমাকে দেখতে না পেয়েই ডেকেছি।

মা: বারো দিনতো বেশ ছিলি আমাকে না দেখে। এখন মানুষকে জানাতে হবে না ডাকাডাকি করে এ বাড়িতে তুই এসেছিস। রত্না চলে যাবার সাথে সাথে এ বাড়ির সুখ শান্তি সব চলে গিয়েছে। যা আর কোন দিনও এ বাড়িতে ফিরে আসবে না। কথাটা বলে নিজের ঘরের ভিতর ঢুকে পরলো মা।
মাথা নিচু করে উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাকিল। সব থাকার পরেও যেনো আজ কিছু নেই।

জাহাঙ্গীর ডাইনিং এ বসে চা নাস্তা খাচ্ছে এমন সময় ঝর্ণা এসে তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে।

জাহাঙ্গীর: টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে আহ কি করছিস জামা কাপড় সব নষ্ট হয়ে যাবে চা পরে। তুই কি এখনো ছোট আছিস নাকি যে এমন পাগলামো করিস।

ঝর্ণা: জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে আমিতো এখনো ছোট আছি, এতো তাড়াতাড়ি বড় হতে চাইনা।

জাহাঙ্গীর: আর কয়দিন পরতো চুল সাদা হতে শুরু করবে। বিয়ে করালে এতো দিনে ডজন খানিক বাচ্চা কাচ্চার মা হলেও অবিশ্বাসের কিছু ছিলো না।

ঝর্ণা: একদম ভালো হবে না কিন্তু। উল্টা পাল্টা কথা বলবে না। নিজে বিয়ে করো। আমার বিয়ে নিয়ে এতো মরো কেন তুমি? তুমি বিয়ে করে নিতে পারো না আমাকে? তাহলেইতো ডজন খানেক বাচ্চার বাবা হয়ে যেতে পারো তুমি।

জাহাঙ্গীর: ঝর্ণা এমন ভাবে কথা বলবে আশা করেনি। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে তোকে বিয়ে করার মত পাগল আমি এখনো হইনাই। যদি কখনো পাগল হয়ে যাই তখন না হয় তোর মত পাগলিকে বিয়ে করবো।

ঝর্ণা: তা আমাকে বিয়ে করবে কেন? বাড়ির ভিতর যদি মজা মাস্তি করার জন্য সুন্দরি কাজের বুয়া থেকেই থাকে তাহলে কি আর বিয়ে করার প্রয়োজন হয় নাকি?

কখাটা তীরের মত জাহাঙ্গীরের বুকে এসে লাগলো। টেবিলে থাপ্পর মারতেই টেবিলের উপর থেকে কাপটা নিচে পরে ভেঙ্গে গেলো। কাপ পরার শব্দে উপর থেকে মা আর নিচে থেকে রত্না দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে আসলো। জাহাঙ্গীর চিৎকার করে বলতে লাগলো এখুনি তুই আমার সামনে থেকে চলে যা। তুই যে এতোটা ছোট মনের মানুষ হয়ে গেছিস তা আমি কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আগে ভাবতাম ছোট মানুষ তাই এতোটা বেপরোয়া, দুষ্টমি করিস কম বুঝিস। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে তোর বিয়াদপি ততই বেড়ে চলেছে।

মা: কি হয়েছে তোদের? এতো চিৎকার চেঁচামেচি কেন?

ঝর্ণা লজ্জা পেয়ে মুখ চেপে ধরে দ্রুত উপরের দিকে দৌড়ে উঠে গেলো।

আমি যেয়ে টেবিল আর ফ্লোর পরিষ্কার করতে শুরু করলাম।

জাহাঙ্গীর: এই মেয়ে কেন এ বাড়িতে আসে? ছিঃ দিন দিন বড় হচ্ছে আর মন মানুষিকতা ছোট হচ্ছে ওর। কি বলতে কি বলে নিজেই জানে না। নোংড়া হয়ে গিয়েছে একদম ওর মন মানুষিকতা।

মা: ওতো একটু ছেলে মানুষি করেই এটাতো তুই জানিস। তাই একটু মানিয়ে নিতে হয়।

স্যার রেগে গিয়ে মানুষের ছোট খাটো ভুল মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ইচ্ছে করে উল্টা পাল্টা কথা বলা সহ্য করা যায় না। কথাটা বলতে বলতে স্যার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঁড়ি ধরে উপরের দিকে উঠছে আর বলছে কবে যে এদের ঝগড়া থামবে।

আমি কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না। কি থেকে কি হয়েছে স্যার কেন রেগে গেলো। এ মানুষটাকে রাগতে দেখলে আমার ভীষণ ভয় লাগে। আমি টেবিল আর ফ্লোর পরিষ্কার করে নিজের রুমে চলে আসলাম।

রাতে খাবার টেবিলে ঝর্ণা আসলো না, মা কয়েক বার ডাক দিলো তবুও আসলো না। স্যার খাওয়া শেষ করে চলে গেলো। মা খেতে খেতে আমাকে বললো আমি আর ঝর্ণা মা চেয়েছিলাম ঝর্ণা আর জাহাঙ্গীরের বিয়ে দিতে। কিন্তু ওদের তো কখনোই ঝগড়া থামে না কি যে করি কিছুই ভালো লাগছে না।

আমার মনে হয় বিয়ে দিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে দু’জনের সম্পর্ক।

মা: টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে সে চেষ্টাতো আর কম করিনি। কিন্তু জাহাঙ্গীর কে কোন ভাবেই তো রাজী করাতে পারছি না। বিয়ের কথা বললেই বলে আমি এখন বিয়ে করবো না। যদি কখনো মনে হয় বিয়ে করার প্রয়োজন রয়েছে তখন করবো।

মা হেঁটে চলে যাচ্ছে আমি তার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here