হারানো সুর পর্ব-২০

0
1268

হারানো সুর-২০তম পর্ব
©শাহরিয়ার

আজ অনেক গুলো বছর পর গ্রামের বাড়ি আসলাম রুমনের বিয়ে উপলক্ষে। দুই বছরের সাবা এখন সাত বছরের হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই রুমন দৌঁড়ে আসলো। পুরো রাস্তায় ফোনের পর ফোন করেছে। সেই ভোর থেকে এসেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাত দিয়ে সাবাকে কোলে নিয়ে,

রুমন: বুবু আসতে কোন কষ্ট হয়নিতো?

না কষ্ট হয়নি, কেমন আছিস তুই?

রুমন: “আলহামদুলিল্লাহ” খুবি ভালো আছি।

রুমন সাথে করে রিক্সা নিয়ে এসেছিলো। রিক্সায় বসে গল্প করতে করতে চলে আসলাম বাড়ির সামনে। রিক্সা থেকে নামতেই রুমন বাবা মা বলে ডাকতে ডাকতে সাবাকে কোলে নিয়ে, বাড়ির ভিতর ঢুকলো। আমি রুমনের পিছু পিছু ভিতরে ঢুকলাম। বাড়িটা আমার কত দিনের চেনা। এ বাড়িতেই কেটেছে শৈশব কিশোরের দিন গুলো।

বাড়ির ভিতর ঢুকতেই চাচা চাচী ছুটে আসলো। বেশ ভালোই বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে দু’জনের মুখেই। চাচা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করলো কেমন আছি। চাচি শাড়ির আচল দিয়ে মুখটা চেপে ধরে কাঁদছে। আমি হাত বাড়িয়ে দু’জনকে ধরে বললাম। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে যেভাবে রেখেছেন খুব ভালো রেখেছেন। তোমরা কেমন আছো? কতদিন পর তোমাদের দেখলাম। টুকটাক কথা বলতে বলতে সেই পুরাতন আমার রুমটাতে ঢুকে পরলাম। ভিতরে ঢুকতেই আর পুরাতন মনে হলো না ঘরটা। নতুন বিছানার চাদর, বালিশের কাভার। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো রুমটা। রুমন সেই আগের মতই আমার ঘরের খেয়াল রাখে।

ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলাম। আজ কত গুলো বছর পর সকলে এক সঙ্গে নাস্তা খেতে বসলাম। চাচী অনেক রকম পিঠা বানিয়েছে আমারা আসবো তাই। পুলি পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, রসে ভিজানো চিতই, ভাপা পিঠা, হরেক রকম নকশী পিঠা দিয়ে পুরো টেবিল সাজানো।

সাবা: চোখ বড় বড় করে এতো পিঠা।

রুমন: হাসতে হাসতে সব আমার মামুনি খাবে।

সাবা: না না আমি এতো খাবো না। আমিতো সব গুলো থেকে একটা একটা করে খাবো।

ওর কথায় সকলে হেসে উঠলাম। নাস্তার পর্ব শেষ করার পর নিজের রুমে চলে আসলাম সাবাকে নিয়ে। রাতে গাড়িতে করে এসেছি তাই ঘুম হয়নি ঘুমানোর দরকার। আসার সময় রুমনকে বললাম বিকেলে তোর শ্বশুড় বাড়ি থেকে লোক আসার আগে আমাদের ডেকে তুলিস।

রুমন: দুপুরে খাবা না তোমরা? না খেলেতো শরীর খারাপ করবে।

কিছু হবে নারে, যখন উঠবো তখন খেয়ে নিবো।

রুমন আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের রেস্ট করার সুযোগ করে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি সাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলাম। এরপর গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে গেলাম।

দুপুর আড়াইটার সময় ঘুম ভাঙলো, চাচীর ডাকে।

চাচী: মাথা হাতিয়ে দিতে দিতে মা রুমন তোদের উঠতে বললো। ওরা নাকি চারটার সময় আসবে। তোরা উঠে গোসল করে খাওয়া করে নে।

আমি উঠে বসলাম, আমি বেশ বুঝতে পারছি আমি না খেয়ে থাকবো একবেলা রুমন তা হতে দিবে না। চাচীকে বললাম তুমি যাও আমি সাবাকে নিয়ে আসছি। চাচী ঘর ছেড়ে বের হতে আমি সাবাকে ডেকে তুললাম। মা মেয়ে জামা কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেলাম।

ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে দুপুরের খাবার ভেয়ে নিলাম। সাড়ে চারটার দিক কনের বাড়ি থেকে লোকজন আসলো। উনাদের আপ্যায়ন আর গল্প করতে করতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেলো। দুই পক্ষের মাঝে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো আগামি কাল বর কনে দু’জনেরই গায়ে হলুদ দেয়া হবে সন্ধ্যার পর পর। এরপর কনে পক্ষের লোকজন বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

পরদিন নাস্তার পর আমি রুমনকে বললাম আমার সাথে পাশের গ্রামে, মানে আমার শ্বশুড় বাড়িতে যাবার জন্য।

রুমন: কি করবা বুবু ঐখানে যেয়ে। যেখানে কেউ নেই।

কেউ নেই তাতে কি ঐখানে আমার অনেক অনেক স্মৃতি জমা রয়েছে।

রুমন আমি আর সাবা রওনা হলাম আমার শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির চাবি রুমনের কাছে। শাকিল মারা যাবার পর রুমন তাকে মাটি দিয়ে বাড়ি তালা মেরে চাবি সাথে করে নিয়ে যায়। কেননা শাকিল মারা যাবার আগে এ বাড়ি সাবার নামে লেখে দিয়ে গিয়েছে। আর সাবাই হচ্ছে মির্জা বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী। আমাদের বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখে আসে পাশের অনেকেই আমাদের দেখার জন্য ছুটে আসলো।

প্রতিবেশীরা আমাকে বললো কোথাও না যেয়ে থেকে যাবার জন্য। যে সম্পত্তি রয়েছে তা আমি আর সাবা সারা জীবনেও শেষ করতে পারবো না। আমি তাদের বললাম সম্পত্তির লোভ আমার কোন দিনই ছিলো না থাকলে আমি এখান থেকে কখনোই যেতাম না। তার চেয়ে বরং আপনারা দোয়া করবেন আমি যেখানেই থাকি যেন আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি। মেয়েটাকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। তাদের আরও জানালাম, যত জায়গা জমি রয়েছে সব রুমন দেখা শোনা ও আবাদ করবে। মানুষ জন কমার পর আমি আমাদের থাকার রুমে ঢুকলাম অসংখ্য স্মৃতি জড়ানো রুমটাতে ঢুকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলো অসংখ্য পুরনো স্মৃতি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে। সে সব স্মৃতি মধুময় দিন গুলোর কথা ভাবতেই।

সাবা: শাড়ির আঁচল টেনে ধরে মা তুমি কাঁদছো কেন?

কিছু না মা এমনি। এটা তোমার বাড়ি, তোমার গ্রামের বাড়ি। রুমনের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি মা আর শাকিলের কবর দেখতে যাবো দূর থেকে দেখেই চলে আসবো। রুমন আমাকে সেখানে নিয়ে গেলো। আমি দূর থেকে তাদের দু’জনের জন্য দোয়া করে বিকেলের আগে আগে চলে আসলাম বাড়িতে।

সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। এ বাড়ি ঐ বাড়ি দুই বাড়িতে গায়ে হলুদ দিতে দিতে রাত হয়ে এলো। পুরো বাড়ি মেহমানে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। পরদিন বিয়ের আয়োজন পুরো বাড়ি আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো হয়েছে। সন্ধ্যার পর পর আমরা কনের বাড়িতে এসে পৌছালাম। সময় মত বিয়ে হয়ে গেলো। একে একে বিয়ের সব আয়োজন শেষ হয়ে গেলো। দুই দিন কেটে গেলো আমার ছুটিও শেষ হয়ে এলো। রুমন আর ওর নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসলাম রাঙা মাটি। সকালে বাচ্চাদের পড়াচ্ছি আর বিকেলে ওদের নিয়ে ঘুরতে বের হচ্ছি। উচু উচু পাহাড়, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা কাপাই হ্রদ, কখনো বা ঘুরে বেড়িয়েছি ঝুলন্ত ব্রীজ। এভাবেই কেটে গেলো আরও সাতটি দিন।

রুমন, ওর নতুন বউ সাবা সকলেই বেশ খুশি। সাবা এর আগে কখনো এতো ঘুরাঘুরি করেনি। আমারও মন বেশ ভালো হয়ে গেলো। নতুন করে যেন আমার জীবনে সব কিছু শুরু হলো। রুমন বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আবারও একা হয়ে পরলাম। সকালে স্কুল করে বাড়ির টুকটাক যে সকল কাজ থেকে সব শেষ করে সাবাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে পরি। যখন যেখানে মন চায়। রাতে ফিরে এসে সাবাকে পড়াতে বসাই। আর যখন মন খুব খারাপ থাকে তখন বের করি স্যারের লেখা ডায়েরিটা। স্যারের কথা মায়ের কথা অনেক মনে পরে। নিজেকে বুঝিয়ে রাখি। স্যার ঝর্ণাকে বিয়ে করুক। তাকে নিয়ে সুখে থাকুক এতে করে মা ভালো থাকবে স্যার ও ভালো থাকবে।

দিন গুলো কেটে যাচ্ছে বেশ ভালোই খারাপ বলা যাবে না। দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে গেলো। সাবাকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করাতে হবে। রুমনকে ফোনে বললাম আমি চাই ও ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক, অনেক বড় হোক। তার জন্য যদি ওকে দূরে কোথাও রেখে পড়াতে হয় তবে তাই করবো।

রুমন প্রথমে ওর কাছে রেখে পড়াতে বললো। আমি মানা করলাম। বললাম ওকে একা একা লড়াই করতে শিখতে হবে। রুমন বললো তাহলে ও ঢাকায় কোন ভালো স্কুলে যেয়ে কথা বলবে। যেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি ভালো থাকার পরিবেশ থাকবে। রুমন ভালো একটা স্কুলের খোঁজ জানালো। আমি সাবাকে নিয়ে গেলাম সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলাম।

সাবা অনেক কান্নাকাটি করলো সে একা থাকবে না। আমি অনেক বুঝিয়ে রেখে আসলাম তাকে। হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো। আমিই বা কি করে একা থাকবো তাকে ছেড়ে। তবুও নিজেকে নিজের মনকে পাথরের মত শক্ত বানিয়ে তাকে রেখে চলে আসলাম রাঙামাটিতে। আমার ছোট বাড়িটা একদম নিরবতায় ভরে গেলো। চারিদিকে শূন্যতার হাহাকার। প্রতিটা মুহুর্তে যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। কষ্টের মুহুর্তের দিন গুলোও যেন কাটতে চাচ্ছিলো না। রুমনকে জানানোর পর ও স্ত্রীকে আর ছোট ছেলেটাকে নিয়ে বেড়াতে চলে আসলো আমার এখানে। এক বছর আগে ওদের ঘর আলো করে এসেছে ছোট শিশুপুত্র দেখতে অবিকল রুমনের মত। ওরা আসায় পুরো বাড়িটা আবার আনন্দে ভরে উঠলো। মন আবার ভালো হয়ে গেলো। রুমন আর ওর স্ত্রী আমাকে ভরসা দিয়ে চলেছে যা হবে ভালোই হবে মন খারাপ করো না। দেখবে একদিন সাবা আমাদের সকলের মুখ উজ্জল করবে। আমিও সেই বিশ্বাস করি। রুমনরা চলে গেলো। আমি প্রতি তিন মাসে একবার করে যেয়ে সাবাকে দেখতে আসতে লাগলাম আর ঈদের সময় ওকে বাড়িতে নিয়ে আসি। এভাবেই কেটে গেলো আরও দশটি বছর।

হঠাৎ এক রাতে আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠে অপরিচিত এক নাম্বারে। আমি ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত এক কণ্ঠ বলে উঠলো রত্না?

আমার সমস্ত পৃথিবী যেন আরেক বারর উত্তাল পাতাল করে দিলো। সেই কণ্ঠ স্বর। আমার মাঝে এক শীতল প্রবাহ বয়ে যেতে শুরু করলো সে কণ্ঠ শুনে। আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে সে কণ্ঠ আরেক বার বলে উঠলো রত্না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here