#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৫
#আর্শিয়া_সেহের
-“মেহেদী ভাইয়া, তুমি চাকরি পেয়েছো সেই উপলক্ষে আজকে ট্রিট চাই।”
মেহেদীর একবার বলতে ইচ্ছে করলো ,’আমাকে ভাইয়া ডাকলে কোনো ট্রিট দিবো না।’ কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলা হলো না। এই মেয়েটার সবকিছুই সে মেনে নেয়। মেনে নিতে ভালো লাগে। এই যে ,রুমঝুম তাকে ভাইয়া ডাকে,এটা তার খারাপ লাগলেও সে অনায়াসে মেনে নেয়। এই জিনিসটার মধ্যেও অসম্ভব শান্তি পায় ।
মেহেদী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“অবশ্যই ট্রিট দিবো। অপেক্ষা করো একটু। আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আসছি।”
-“আচ্ছা এসো।”
আধঘন্টায় মেহেদী সব কাজ সেরে রুমঝুম আর মেঘাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। দুজন মেহেদীর টাকায় প্রান ভরে ফুসকা খেলো।আর মেহেদী প্রান ভরে দেখলো তার দুই প্রিয় রমনীর খাওয়া। একজন তার বোন অন্যজন হৃদয়ের গহীনে রাজ করা এক রানী।তার ঝুমরানী।
ফুসকা খাওয়া শেষ করে আশেপাশে কিছুসময় ঘোরাঘুরি করলো তিনজন। সন্ধ্যার আগে আগে মেহেদী বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি ঠিক করতে গেলে ঝুম বললো,
-“আমার আরেকটা কাজ ছিলো মেহেদী ভাইয়া।”
-“কি কাজ?”
-“একটা নতুন সীম কার্ড কিনতে হবে।”
-” নতুন সীমকার্ড কেন?”
-“পুরাতনটা ব্যবহার করবে না তাই। তুই এতো কথা বলিস কেন?”
মেহেদী আর কোনো কথা না বলে দু’জনকে নিয়ে সীমকার্ড কিনতে গেলো।
সীমকার্ড মেঘার নামে রেজিস্ট্রেশন করতে দেখে মেহেদী বললো,
-“ঝুমের সীম তোর আইডি কার্ড দিয়ে কিনছিস কেন?”
-“ভাইয়া ও লুকিয়ে এসেছে।আর ও লুকিয়ে থাকতে চায়। বুঝেছিস?”
-” হুম ।”
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজলো ওদের। রুমঝুম ফ্রেশ হয়ে সীমকার্ড ওপেন করলো। সেই নাম্বার দিয়ে সবার প্রথমে এসএমএস করলো রুশানকে। প্রায় তিন মিনিট পর রুশানের রিপ্লাই পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুমঝুম।
রুশান রুমঝুমের নাম্বার মুখস্থ করে নিলো।তারপর নাম্বারটা ডিলিট করে দিলো ফোন থেকে। তবে রুমঝুমের বাদ দেওয়া নাম্বারটা ফোনে সেভ করে রেখে দিলো।
-“ঝুম, খেতে আয়। মা ডাকছে।”
মেঘা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো।
-“আসছি, দাঁড়া।”
-“দাঁড়াতে পারবো না।”
-“তাইলে বস।”
দুজনই হেঁসে উঠলো কথার মাঝে। বাইরে থেকে আসার পর রুমঝুমের মনটাও বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।
রুমঝুম আর মেঘা একসাথে এলো ডাইনিং এ। তাদেরকে আসতে দেখে মাহেরা খাতুন মেহেদীকেও ডাকলেন।মেঘার বাবা গতবছর মারা গেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তারা চট্টগ্রাম শিফট হয়েছে।
খেতে খেতে মাহেরা খাতুন বললেন,
-” আমি মেঘার কাছে সবটাই শুনেছি ,ঝুম। তুই নাকি বাসা ভাড়া থাকার কথা বলেছিস?”
-“হ্যাঁ আন্টি। আসলে…”
রুমঝুমের কথার মাঝেই তিনি বললেন,
-“কোনো আসলে না ঝুম,তুই আমার বাড়িতেই থাকবি। আমার আরেক মেয়েকে কি আমি খাওয়াইনি এতোদিন? এখন মিলি নেই ,সেই জায়গায় তুই আছিস। মিলির রিজিকের টুকু এখন তুই খাবি। তুই আমার কাছে এবাড়িতেই থাক মা। কি রে মেহেদী তুই কিছু বল?”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ ঝুম।তুমি এখানেই থাকো। এখানে তোমার কোনো সমস্যা হবে না। যতদিন ইচ্ছা থাকো।”
মনে মনে বললো,’সারাজীবন থেকে যাও। তোমায় দেখে দেখে নয়ন জুড়াক আমার।’
রুমঝুমের চোখ পানিতে ভরে উঠলো। এরা ওর আপন কেউ না তবুও কতটা সাপোর্ট করছে ওকে। সে চুপচাপ মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো।
মেঘা বললো,
-“ওর তো ভার্সিটিতেও ভর্তি হতে হবে। ওখান থেকে কাগজপত্র তো আনা হয়নি।”
-“ওটা নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। ওর ভর্তির বন্দোবস্ত আমি করে ফেলবো। কাল থেকে ওকে সাথে নিয়ে ভার্সিটিতে যাস।”
রুমঝুম মেহেদীর কথায় কৃতজ্ঞতাপূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মেহেদী সেদিকে চেয়ে মুচকি হেঁসে বললো,
-“তোমার আগের ভার্সিটিতে সবকিছু গোপন থাকবে। সে ব্যবস্থাও আমি করবো।”
রুমঝুম কেঁদে উঠলো এবার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,
-“তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই । অনেক উপকার করেছো আমার। তোমাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব আমি।”
মেহেদী মনে মনে বললো, ‘ধন্যবাদ জানাতে হবে না,অল্প একটু ভালো তো বাসতে পারো।’
…
তাহমিনা বেগম আরমানের মুখোমুখি বসে আছে। আরমান ভয়ংকর চাহনি নিক্ষেপ করে আছে তাহমিনা বেগমের দিকে। তাহমিনা বেগমের হার্টবিট বেড়ে গেছে দ্বিগুনেরও বেশি। সে একদম চুপচাপ বসে আছে সোফায় আর মনে মনে রুমঝুমের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। একসময় আরমান চিৎকার করে বলে উঠলো,
-“আপনার মেয়ে এই শহরেই নেই। পুরো দুইটা দিন হয়ে গেছে সে আমাদের নাগালের বাইরে। আমি পুরো শহরে লোক লাগিয়ে খুঁজেছি ওকে। ও কোথাও নেই । বুঝতে পারছেন আপনি আমার কথা?”
আরমানের তেজী কন্ঠের সামনে বিড়াল ছানা হয়ে পড়লেন তাহমিনা বেগম। তোতলাতে তোতলাতে বললো,
-“ক..কি বুঝবো? ”
-” আপনার মেয়ে খুলনা-যশোর কোথাও নেই। আপনার কথা মতো আমি ওর খালা বাড়িতেও খোঁজ নিয়েছিলাম।ও গতকাল সেখানে গিয়েছিলো আর গতকালই সেখান থেকে চলে গেছে। ওখান থেকে কোথায় চলে গেছে কেউ জানেনা। ”
-“এখন আমি কি করবো বলো ? আমি তো জানি না।”
-“আপনি জানেন না কিন্তু আপনার ছেলে জানে। রুমঝুমকে না পেলে সেই খেসারত আপনার ছেলেকে দিতে হবে। কথাটা মাথায় রাখবেন।”
তাহমিনা বেগম আঁতকে উঠলেন। সে নিজের ছেলেকে কোনভাবেই হারাতে পারবেন না। ছেলে হারানোর ভয়ে তিনি কেঁদেই ফেললেন।
তাহমিনা বেগমের কান্নায় বিরক্ত হলো আরমান। একে তো ছেলের থেকে রুমঝুমের নাম্বার বা ঠিকানা কোনোটাই জোগাড় করতে পারে নি আবার এখানে এসে মরা কান্না কাঁদছে। আরমান ধপধপ শব্দ তুলে বড়বড় পা ফেলে সেখান থেকে চলে গেলো। পাখিকে তো সে খাঁচায় আটকাবেই। সোনার ডিম পাড়া পাখি বলে কথা।
তাহমিনা বেগম বিলাপ করেই চলেছেন। তার ভুলের মাশুল যেন তার ছেলেকে না দিতে হয়। তার ছেলে তো কোনো দোষ করেনি। তার পাপের শাস্তি তার ছেলে কেন পাবে?
…
-“শান, আর ইউ ওকে? সারাদিন তোর কোনো খোঁজ নেই। কোথায় তুই? ”
তিহানের কথায় শান হালকা হাসলো। এই ছেলেটার এই এক সমস্যা। সবকিছুতে অল্পেই সিরিয়াস হয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক ঘন্টা শানের খোঁজ পায়নি বলে বিচলিত হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে প্রান্ত,সে একবছর কারো খোঁজ না পেলেও বিচলিত হবে না। সে বিশ্বাস করে সঠিক সময়ে সকলেই গর্ত থেকে বেরিয়ে সামনে চলে আসবে।
শানের উত্তর না পেয়ে তিহান আবারও বললো,
-“শান , আর ইউ দেয়ার? আমাকে শুনতে পাচ্ছিস তুই? ”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। আসলে আমি টায়ার্ড ছিলাম খুব। বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে ভার্সিটিতে যেতে পারিনি ।তবে কাল বেঁচে থাকলে যাবো, পাক্কা।”
-“মনে থাকে যেন। তুই তো এমন ছিলিনা। কখনো কথা দিয়ে তার হেরফের করিসনি।আজ কি হলো তোর বুঝলাম না।”
শান মনে মনে বললো,’আমার গতানুগতিক জীবনেই হেরফের হচ্ছে আর তুই আছিস কথা দেওয়া নিয়ে’। তবে মুখে বললো,
-“আরে কিছুই হয়নি। রাখছি এখন। ”
ফোন রেখে নিজের খাঁড়া চুল গুলোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে রইলো শান। নিজ দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে সে।কোথায় হারাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না। তবে তার সবকিছু যে উলটপালট হয়ে যাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে।
শানের ভাবনার মাঝেই দরজায় টোকা পড়লো।
-“শাফায়াত,খেতে এসো। ডিনার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে।”
শান মুখ উঠিয়ে দরজা না খুলেই বললো,
-“আমি একটু পরে আসছি, আম্মু। তোমরা শুরু করো।”
-“আমরা অপেক্ষা করছি। দ্রুত এসো।”
শান লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেললো। সে জানে তাকে ছাড়া তার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউই খেতে বসবে না।
বেলকনির দরজা ঠেলে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো শান। চাঁদের আলো তার উজ্জ্বল, স্নিগ্ধ আভা না ছড়ালেও আকাশে সাধু-সন্ন্যাসী বেশ ধারন করে ঠিকই বসে আছে।
কি আশ্চর্য! চাঁদের দিকে তাকালেও চন্দ্রকন্যার চেহারা ভেসে ওঠে। সব দোষ ওই সিন্থিয়ার।ও যদি মেয়েটাকে না দেখাতো তবে এসব কিছুই হতো না।
না না সিন্থিয়ার দোষ না। ও তো এর আগেও কতশত মেয়েকে দেখিয়েছে ।কই? তাদের জন্য তো শানের এমন লাগেনি। তাহলে?
হুম পেয়েছে। সব দোষ ওই চাঁদের বাচ্চার। কি দরকার ছিলো নিজের আলোতে ওই মেয়েকে রাঙানোর? চন্দ্র রঙে ওকে রাঙিয়েই তো আমার সর্বনাশ করে ফেললো। এখন যেদিকে তাকাই সেদিকেই চন্দ্রকন্যা। ধেত ভাল্লাগে না।
শান বিরবির করতে করতে খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো।তার পুরো পরিবার সেখানে অপেক্ষা করছে।শান এসে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। শানকে বসতে দেখে তার মা শাফিয়া আক্তার সবাইকে খাবার দেওয়া শুরু করলেন।
-“এই ভাইয়া তোমার না আজকে আমাকে ম্যাথ করিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো? সেটা না করিয়ে দিয়ে সারাদিন ঘরে পড়ে পড়ে ঘুমালে কেন?”
-“শান্ত,এগুলো কেমন কথা? ভাইয়ার খারাপ লাগছিলো তাই তোমাকে ম্যাথ করিয়ে দিতে পারেনি। কাল করে নিয়ো ভাইয়ার থেকে। এখন চুপচাপ খাও।”
মায়ের ধমকানীতে চুপ হয়ে গেলো শান্ত। তার মা বড় ভাইয়াকে বেশি ভালোবাসে ভেবে কাঁদতে যাবে তক্ষুনি শাফিয়া আক্তার আবার হুকুম করলো,
-“ভাইয়াকে পানির জগ এগিয়ে দাও ,শান্ত।”
বেচারা নিরীহ শান্ত আর কান্না করার অবকাশ পেলো না। মনে মনে ভেবে রাখলো রুমে গিয়ে শান্তিতে কান্না করবে।
শানের এদিকে কোথাও ধ্যান জ্ঞান নেই। সে প্লেটে খাবারের মধ্যে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। শানের বাবা ইমতিয়াজ মাহমুদ সেটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছেন। শান বেশ কিছুক্ষণ খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। তারপর মুখে একটু খাবার দিয়েই উঠে পড়লো ডাইনিং টেবিল থেকে। সেদিকে তাকিয়ে ইমতিয়াজ মাহমুদ মুচকি হাসলেন।
শানের পরপরই শান্ত উঠে চলে গেলো। ইমতিয়াজ মাহমুদ হাঁসি হাঁসি মুখ করে বললেন,
-“বুঝলে শাফু, আমাদের বড় ছেলে বোধহয় প্রেমে পড়েছে।”
কথা শেষ হতেই ইমতিয়াজ মাহমুদের কানে এলো একজোড়া মেয়েলি কন্ঠের চমৎকার হাঁসির শব্দ। মনে হচ্ছে তারা কোনো বড়সড় জোকস্ শুনেছে। ইমতিয়াজ মাহমুদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিজ স্ত্রী ও কন্যার দিকে। শিরীন হাঁসতে হাঁসতেই বললো,
-“থ্যাংকস পাপা,আমার খাবার হজমে সহায়তা করার জন্য।”
ইমতিয়াজ মাহমুদ বুঝতে না পেরে বললেন,
-” মানে? আমি কিভাবে তোমার খাবার হজমে সহায়তা করলাম?”
-” এই যে, এত্তো সুন্দর একটা জোকস্ বলে। তোমার ওই গোমড়া মুখো ছেলে নাকি করবে প্রেম।”
-“আমিও তো ওমন গোমড়া মুখোই ছিলাম প্রেম করা….. আআউউ
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই শাফিয়া আক্তার তার উড়ুতে চিমটি কাটলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,
-“মেয়ের সামনে একটু সামলে কথা বলতে পারো না? হাঁদারাম।”
শিরীন পেট ফাটা হাসি হাঁসতে হাঁসতে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। ইমতিয়াজ মাহমুদ কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
-” আমি মিথ্যা কি বলছিলাম যে চিমটি দিলে? তোমার সাথে প্রেম করার আগে তো আমিও গোমড়া মুখোই ছিলাম।”
-“হ্যাঁ,আমার মাথা ছিলে। এখন বলো , তোমার কেন মনে হলো আমার ছেলে প্রেম করতেছে?”
-“আরে আমিও যখন নতুন নতুন তোমার প্রেমে পড়ছিলাম তখন এরকম নিজেকে সারাদিন ঘরবন্দি রাখতেন আর তোমার কথা ভাবতাম। তারপর ঠিক মতো খেতেও পারতাম না। খাবার রেখে উঠে যেতাম। খেতে ইচ্ছে করতো না। তোমার ছেলেরও এমন লক্ষন প্রকাশ পাচ্ছে বুঝলে?”
শাফিয়া আক্তার চোখ বড় বড় করে তাকালেন স্বামীর দিকে। তার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার ছেলে প্রেমে পরতে পারে। শাফিয়া আক্তারের এমন মুখভঙ্গি দেখে ইমতিয়াজ মাহমুদ ঠোঁট টিপে টিপে হাসতে লাগলেন।
চলবে…………
(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)