যখন দুজনে একা পর্ব-১১

0
3708

#যখন_দুজনে_একা

১১তম পর্ব

নিঝুম যাওয়ার পর মাহি দরজা টা লক করে দিল ! রুবার শিরায় স্যালাইন চলছে! মাহি উঠে গিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো !
আকাশে চাঁদ না থাকলেও একটা আবছা আলোয় ভরা!
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো র উপর বাজে!
স্যালাইন আরো কিছুক্ষণ চলবে!
মাহি কোন কিছু আর চিন্তা করতে পারছে না ! কি হচ্ছে ওর ফ্যামিলির সঙ্গে! এত টা অসহায় আর কখনো ছিল না ওরা!
হঠাৎ একদিন ভাইয়া মরে গেল! বাবা একদম নিজেকে গুটিয়ে নিলো! রুবার সঙ্গে তার বিয়ে ! আর আজ ভাইয়ার শেষ স্মৃতি টুকু ও ধরে রাখতে পারলো না!
রুবা এত টা কষ্টের ভাগ্য নিয়ে কিভাবে বাচবে!
আল্লাহ ! তুমি সকল কিছু ভালো র জন্য করো নাকি?
এসব করে কি ভালো হচ্ছে আল্লাহ?
আমি জানি না!
তুমি আমাকে শক্তি দাও আমি সব ঠিক করতে চাই! আমি চেষ্টা তো করছি আল্লাহ ! তুমি তো জানো আর কেউ না জানুক!
নিজের ভালোবাসা কে নিজের হাতে দূরে সরিয়ে দিলাম !
রুবাকে বিয়ে করলাম , তাও কারো জীবনে আসছে না শান্তি , একটা র পর একটা কষ্ট আসছেই!
আমি আর পারছি না আল্লাহ!
তুমি আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা দাও !
কালকে যখন রুবার জ্ঞান ফিরবে তখন কিভাবে আমি সত্যের সামনে ওকে দাঁড় করাব!

মাহি জানালার পাশ থেকে সরে আসলো! রুবার স্যালাইন টা শেষ হয়ে যাচ্ছে বন্ধ করে ক্যানোলা টা ঠিক করল!
কালকে কি ওকে ডিসচার্জ করবে?
মায়ের অবস্থা চিন্তা করলেই তার কষ্ট হচ্ছে, ভাইয়ার বাচ্চা টা নিয়ে অনেক আশায় ছিল মা!
এখন মা ও কি ভেঙে পড়বে? মা যদি ভেঙ্গে পড়ে তাহলে ও আর সহ্য করতে পারবে না সারাজীবন মা ওর শক্তি !
সব চিন্তা করতে করতে মাহি গিয়ে রুবার বেডে র পাশে গিয়ে বসলো!
রুবা অচেতন হয়ে পড়ে আছে !
সুন্দর চোখ দুটো শুধু কেঁদেই গেলো জীবনের ধাপে ধাপে!
মাহি রুবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে!

ওভাবেই একটা সময় সারাদিনের ক্লান্তি তে ঘুমিয়ে গেল মাহি!

দরজায় নক হচ্ছে, শব্দে ঘুম ভাঙল মাহির । চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজে!

রুবার পাশ থেকে উঠে মাহি দরজা খুলে দিল ।
ডিউটি নার্স আসছে!
স্যার ওষুধ গুলো দিতে আসলাম !
মাহি ওষুধ নিয়ে নিল দরজা থেকেই !
নার্স চলে গেল !

মাহি ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলো!
ফোন নিয়ে তার ছোট মামি তারানা কে কল দিলো ,
হ্যালো মামি, মা কেমন আছে এখন?
বড়পা ঘুমাচ্ছে মাহি , তারানা বলল।
মায়ের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন মামি!
তোমাকে এই কথা বলে দিতে হবে মাহি? আমরা সবাই আছি বড়পা র সঙ্গে তুমি চিন্তা করো না !রুবা কেমন আছে এখন ?
ঘুমাচ্ছে মামি!
মামি রুবার জন্য একটু স্যুপ কুদরত ভাই কে দিয়ে পাঠান ! উঠলে খাওয়াতে হবে কিছু!আর রুবার এক সেট ড্রেস পাঠাবেন !
আমি পাঠাচ্ছি তুমি চিন্তা করো না মাহি, তারানা বলল।
ঠিক আছে রাখছি মামি !

রুবা নড়াচড়া করতেই মাহি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো!
মাহি রুবার সামনে ঝুঁকে ডাকলো , রুবা ! রুবা!
রুবা চোখ মেলে তাকাল!
মাহি মুখে হাসি টেনে বলল , গুড মর্নিং রুবা!
রুবা তাকিয়ে আছে ! কোন কথা বললো না !
আমি কি সারারাত হসপিটালে ছিলাম ? রুবা মাহি কে প্রশ্ন করলো!
হ্যাঁ তুমি আমি দুজনেই হসপিটালে ছিলাম ! তোমার শরীর টা খারাপ ছিল বলে তুমি ছিলে আর তোমাকে পাহারা দিতে আমি ছিলাম ! মাহি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বলল!
এখন কেমন আছো বলো তো তুমি ?
রুবা উঠে বসতে চেষ্টা করছে, মাহি ধরে বসালো ওকে।

মাহি রুবার খাওয়ার আগে একটা ওষুধ আছে সেটা খুলে নিল হাতে ,পানির বোতল টা নেয়ার জন্য পাশ ঘুরতেই রুবা পাশ থেকে ওর শার্ট টা টেনে ধরলো !
মাহি ঘুরে তাকালো!
রুবা বলে উঠলো , সব ঠিক আছে তো ?
মাহি এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করলো , কি বলবে এখন?
কি ? মাহি উল্টো রুবাকে প্রশ্ন করলো?
বুঝতে পারছো না , আমি জানতে চাইছিলাম কালকে আমার প্রচন্ড ব্যথা ছিল হসপিটালে আসার পর আল্ট্রাসনোগ্রাম করলো ডাক্তার, তারপর ওটিতে যখন ডাঃ সুরাইয়া আসলো এরপর আমি ঘুমিয়ে গেলাম ! আমার তো এখন ব্যথা নেই! তুমি বলো তো সব ঠিক আছে না ? রুবা মাহির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছে!
মাহি একবার ভাবলো একটা কিছু বলে পরিস্থিতি সামাল দিবে কিন্তু পরোক্ষনে মনে হলো ,কিভাবে ও তো একটু পর বুঝেই যাবে !
তাই মাহি সত্যি টাই বলবে ঠিক করলো।
রুবার পাশে বসলো , রুবার দুটো হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিল ! তুমি ঠিক আছো রুবা !
রুবা বলল, আর আমার বেবি ?
মাহি ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে চুপ করে !
প্লিজ বলো না ? রুবা চিৎকার দিয়ে উঠল।
মাহি উঠে দাঁড়ালো, রুবা কোন কান্নাকাটি না প্লিজ শোন আমার কথা , তোমার প্রেগন্যান্সি টা একটা ইনকমপ্লিট প্রোবলেমেটিক প্রেগন্যান্সি ছিল ! তাই ন্যাচারালি এবোরশন হয়ে গেছে ! আসলে এটা কোন প্রেগন্যান্সি ছিল‌ই না।
মাহি এক নিঃশ্বাসে কথা টা বলল!
রুবা ফেলফল করে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে ! কোন কথাই বলতে পারছে না !
ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে শুধু ।
মাহি কাছে এসে রুবার মাথাটা নিজের বুকের সাথে ধরলো !
মাহির চোখ দিয়েও পানি পড়ছে ! কিন্তু রুবা একেবারে চুপ হয়ে গেছে !
মাহি চোখ মুছে বলল, তোমাকে কি বলে স্বান্তনা দেই বলো তো ?
আমি জানি এই বেবিটা আমাদের ফ্যামিলির জন্য কি ছিল , তোমার জন্য কি ছিল কিন্তু আমাদের ভাগ্য টা এত খারাপ যে যাই আঁকড়ে ধরতে চাইছি সেটাই আমাদের ছেড়ে চলে যায় !
রুবা কোন কথাই বলছে না, একদম চুপ করে বসে আছে ।
মাহি রুবাকে ধরেই বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ।
কথা বলো রুবা , প্লিজ?
ঠিক সেই সময় দরজা খুলে ডাঃ সুরাইয়া ম্যাডাম, নিঝুম, ডিউটি নার্স ঢুকে পড়লো!

নিঝুম মাহির দিকে তাকালো !
মাহি নিঝুমের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ডাঃ সুরাইয়া র দিকে তাকিয়ে সরে গেল!

কি অবস্থা এখন রুবার? ডাঃ সুরাইয়া প্রশ্ন করলো রুবাকে !
রুবা চুপ করে আছে ! একদম নড়াচড়া ও করছে না !
মাহি ডাক্তার এর সঙ্গে কথা বলছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে!
নিঝুম রুবার কাছে এসে মাথায় হাত রাখলো!
তবুও রুবা চুপ ই করে আছে !

ওকে কি আজকে ডিসচার্জ করে দিবেন ম্যাডাম , মাহি প্রশ্ন করলো!
আমার মনে হয় বাসায় নিয়ে যাওয়াই ভালো ! নিজের ঘরে ই বেটার ফীল করবে !
তুমি আমার রুমে আসো মাহির আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি।

ডাক্তার সুরাইয়া চলে গেলেন! নিঝুম তখনো রুবার সামনে বসা!
নিঝুম বলল, খেয়াল রাখ ওর আমি একটু ঐ দিকে যাচ্ছি মাহি।
মাহি মাথা নাড়ল শুধু।
বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসছে কেয়ারটেকার কুদরত।
মাহি বাটিতে স্যুপ ঢেলে নিয়ে রুবার সামনে চামচ ধরলো!
রুবা মুখ সরিয়ে নিলো!
মাহি ফুঁ দিয়ে আবার সামনে ধরে বলল, প্লিজ খেতে হবে!
রুবা হাত দিয়ে সরিয়ে দিল !
প্লিজ রুবা , এমন করে না !
নিঝুম মাহির জন্য কফি নিয়ে ঢুকলো তখন ‌!

মাহি আমি খাইয়ে দেই রুবা কে ! তুই কফি খা ! ঠান্ডা হয়ে যাবে !
সমস্যা নাই আমি খাওয়াচ্ছি ওকে , মাহি বলল।
কেন আমি দিলে কি সমস্যা হবে ? নিঝুম বলে উঠলো ।
মাহির এই মুহূর্তে কোন তর্ক করতে চাইছে না বলে স্যুপের বাটি বাড়িয়ে দিল নিঝুমের দিকে ।

নিঝুম রুবাকে খাওয়াতে চেষ্টা করছে !
মাহি কফির গ্লাস টা নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল ।
রুবা নিঝুমের পীড়াপীড়ি তে দুইবার নিল । কিন্তু কোন কান্নাকাটি না কোন কথা বলছে না এটাই মাহিকে চিন্তায় ফেলে দিসে।

মাহি নিঝুম কে বলল, তুই এখানে থাকবি একটু ওর পাশে। আমি একটু ওদিকে যাব।
নিঝুম বলল, ঠিক আছে আমি আছি এখানে!

মাহি কেবিন থেকে বের হয়ে ডাঃ রিয়াদ কে ফোন দিল!
ভাই আপনি কোথায়?
রিয়াদ বলল, রুমেই আছি !
ভাই একটু গাইনী তে আসেন সুরাইয়া ম্যাডাম এর রুমের সামনে ।
মাহি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রিয়াদ চলে আসলো!
কি অবস্থা এখন রুবার ? রিয়াদ জানতে চাইলো!
ট্রমাটাইজ হয়ে গেছে ! কোন কথা বলছে না কাঁদছে ও না! মাহি বলল।
এটাই তো হ‌ওয়ার কথা ! একের পর এক শক পাচ্ছে!
ভাই আমার বাসার পরিস্থিতি তো জানেন আমার কিছুদিন ছুটি লাগবে ? মাহি বলল।
একটু ম্যানেজ করে দেন প্লিজ!
আমি বুঝতে পারছি ওয়াইজ ডিসিশন , রিয়াদ বলল।
ঠিক আছে আমি কথা বলছি!
রিয়াদ বলল,
চল ম্যাডাম রুমেই আছেন , যাই।
দুজনে ডাঃ সুরাইয়া র রুমে ঢুকলো!

কি অবস্থা মাহি এখন রুবার বলো তো ?
ম্যাম , পুরাই শকে চলে গেছে! মাহি বলল।
সুরাইয়া বলল, এটাই তো হ‌ওয়ার কথা!
বাসায় নিয়ে যাও , যত্ন করো ঠিক হয়ে যাবে !
আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছি ওর হিমোগ্লোবিন লেভেল কম সেটাও খেয়াল রেখো !
আর একটা কথা নেক্সট বেবি একটু সময় নিয়ে নিও এবং তার আগে অবশ্যই কিছু টেস্ট করিয়ে নিও। ঠিক আছে, যাও!

মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পিছন ঘুরেই দেখে নিঝুম তাকিয়ে আছে !
মাহি কিছু বলার আগেই নিঝুম বলল, আম্মা আছে রুবার কাছে !
মাহি রিয়াদ বের হয়ে এলো ডাঃ সুরাইয়া র রুম থেকে।
রিয়াদ মাহিকে বলল, শোন তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে!
করিডোরে র একটা কর্নারে গিয়ে দাঁড়ালো দুজন !
রিয়াদ পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট বের করে মাহির দিকে বাড়িয়ে দিল !
মাহি মাথা নেড়ে না করলো।
রিয়াদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এখন রুবার এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হলো তোর কাছে!
তুই ওর পাশে থাক !
মাহি বলে উঠলো, আমি তো ওর পাশে ই আছি!

রিয়াদ বলল, আমি জানি কিন্তূ এভাবে না স্বামীর অধিকার নিয়ে ,ওকে স্ত্রীর অধিকার দিয়ে পাশে থাক।
এক রুমে , এক বিছানায় ঘুমালেই স্বামী র দ্বায়িত্ব পালন হয়ে যায় না রে, ভালোবাসা টাই আসল!
ওর এখন তোর ভালোবাসা টাই বেশি দরকার !

তুই এখন যা করছিস শুধু দ্বায়িত্ব পালন এখানে ভালোবাসা নেই । ভালোবাসা দিয়ে দেখ রুবা তার অতীত ভুলবে ই !
একটা কথা মনে রাখিস মৃত মানুষ কে ভুলে যাওয়া সহজ কারণ প্রকৃতিই ভুলিয়ে দেয় ! এটাই নিয়ম ।

আর জীবিত মানুষ কে কিভাবে ভুলবো রিয়াদ ভাই ? মাহি বলে উঠলো!
রিয়াদ বলল, নিঝুম কে ওর ভালোর জন্যই ভুলে যা মাহি !

একটা কাজ কর মাহি কয়দিনে র জন্য রুবাকে নিয়ে কোথা থেকে ঘুরে আয় ওর জন্যেই ভালো হবে , রিয়াদ বলল।
কি যে বলেন ভাই! এই অবস্থায় রুবাকে নিয়ে অসম্ভব!

কথা বলতে বলতে ওরা রুবার কেবিনের সামনে চলে আসছে !
রিয়াদ বলল, তুই আমার কথা গুলো মেনে দেখ রুবা ঠিক হয়ে যাবে !
রিয়াদ ভাই , আমি রুবার জন্য সব কিছু করব চিন্তা করিয়েন না !
সামনে নিঝুম কে দেখেই চুপ হয়ে গেল দুজন !

নিঝুম অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিল !

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here