#যখন_দুজনে_একা
৪৫ পর্ব
রুবা মাহির হাত ধরে বলল, আমি চেষ্টা করছি আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ।
মাহি রুবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো,
: অবশ্যই ,তুমি তোমার মত সময় নাও আমার কোন সমস্যা নেই, কোন তাড়াহুড়ো নেই কিন্তু নিজে নিজে কষ্ট পাওয়া যাবে না রুবা।
তারপর ফিসফিস করে রুবার কানে বলল, আর আমাকে কথা দাও যেদিন তুমি আসবে আমার হয়ে সেদিন তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে, তোমার সব কিছু দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে রুবা। আমি অন্ধের মত তোমার হাত ধরে থাকব তুমি আমাকে এক আলোর পৃথিবী দেখাবে । যে পৃথিবী আমি কখনো দেখিনি রুবা।
আমি এই মুহূর্তে তোমাকে পাগল করে দিতে পারি রুবা, কিন্তু আমি চাই তুমি তোমার ইচ্ছায় তোমার সবটুকু নিয়ে আমার কাছে আসো আমার হয়ে, সম্পূর্ণ আমার হয়ে।
মানুষের মন জিনিস টা পৃথিবীর সবচেয়ে বিচিত্র এক জায়গা, তাকে নিয়ন্ত্রণে র ক্ষমতা সব সময় সবার থাকে না। রুবা নিজের মনকে পারছে না কোন দিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে। তার এক মন মাহির আদরে ভাসতে চায়, আরেক মন মাহির কাছ থেকে পালাতে চায় ওর যে খুব সব হারানোর ভয়!
রুবা চোখ বন্ধ করে মাহির বুকে লেপ্টে আছে। ওর ভেতরে এক তোলপাড় চলছে ।
মাহি হঠাৎ গাইতে শুরু করলো,
” যেটুকু কাছেতে আসে
ক্ষনিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে
স্বপনের ছবি আঁকে,
যেটুকু যায় রে দূরে
ভাবনা কাঁপায় সুরে
তাই নিয়ে যায় বেলা
নুপূরেরও তাল গুনি
রচি মম ফাল্গুনী।
একটুকু ছোঁয়া লাগে
একটুকু কথা শুনি
তাই দিয়ে মনে মনে
রচি মম ফাল্গুনী ! ”
রুবা মাহির গান শুনে ভাবছে এমন কিছু কি সত্যিই হচ্ছে, ওকে বুকের কাছে নিয়ে মাহি গান গাইছে নাকি এসব তার কল্পনায় ঘটছে !
মাহি গান থামিয়ে বলল রুবা, এই রুবা,।
: হুঁ বলো?
: আমার মনে হচ্ছে তোমার বুয়ারা কেউ দরজায় এসেছে। আমি তোমার এত কাছে আর ওরা ডিস্টার্ব করতে আসবে না তা তো হয় না ! মাহি হো হো করে হাসছে!
: সব সময় ফান করা তাই না, বলে রুবা দরজার কাছে যেতে নিলো।
মাহি হাত টেনে ধরে বলল,
: আমি দেখছি!
দরজা খুলে দেখে ফরিদা বুয়া দূরে দাঁড়ানো!
: যাও বুয়া তোমার ভাবি অপেক্ষা করছে ভেতরে।
মাহি মুচকি মুচকি হাসছে!
বুয়া ভেতরে ঢুকে বলল,
: ভাবি আম্মা ফোন দিসলো আপনাদের রাতের খাবার রেডি করতে,কখন দিমু? আব্বার খাওয়া হয়েগেছে ।
: যাও রেডি করো আসছি আমরা !
বুয়া বের হয়ে গেলেও মাহি হাসছে রুবার দিকে তাকিয়ে !
: তুমি কিভাবে বুঝলে বুয়া এসেছিল , আমি তো দরজায় কোন আওয়াজ পেলাম না!
: রুবা আমি জানি তো আমি তোমার কাছে আসলেই ওরা আসবে, মাহি হাসছে !
: তাহলে এখন আমি তোমার কাছে আসি দেখি এরকম হয় কিনা , রুবা বলল?
: এভাবে আসলে হবে না রুবা ম্যাডাম !
বুঝেছো তুমি যেদিন আমার কাছে আসতে চাইবে এদের দুজন কে ওদের ঘরে তালা লাগিয়ে আসবে মাহি নিজের কথায় নিজে হো হো করে হাসছে। রুবা মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখছে। হাসতে হাসতে মাহির চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে।
: আমি বুয়ার নক করার শব্দ শুনেছিলাম, মাহি বলল! আর এত অবাক হওয়ার কিছু নেই , আমরা না খেয়ে ঐ বাসা থেকে এসেছি মা তো ফোন করবেই বুয়াকে এটাই স্বাভাবিক!
রুবা উঠে গেল ওর সামনে থেকে!
ডিনার করার সময় রুবা বলল,
: আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম তুমি ইদানীং খুব কম খাও , কারণ কি?
: কোথায় আমি তো সব সময় যতটুকু খাই সেরকম ই খাই রুবা !
: না সেরকম না আমি নোটিশ করেছি!
: আমি কিন্তু খুব একটা ফুডী না। আমি বাঁচার জন্য খাই, খাওয়ার জন্য বাঁচি না !
: তাই বলে এত কম খাওয়া ?
হাসলো মাহি ! আমি সব সময় ই এমন।
: সে জন্যই এত শুকনা তুমি !
: মোটেও সেরকম কিছু না আমার ওয়েট পার্ফেক্ট আছে । নিজে খাও ঠিক মত । আসছে আমাকে জ্ঞান দিতে।
: ডাক্তারের বউ না , ডাক্তারের মত জ্ঞান দিচ্ছি রুবা হেসে বলল।
ওরা ডিনার করার সময়ই সাফিয়া বেগম চলে আসলেন বিয়ে বাড়ি থেকে।
: তোমরা এখনো খাওনি?
: এই তো মা অল মোস্ট শেষ !
: রুবা তোমার শরীর কেমন এখন?
: ঠিক আছি মা !
: সবাই তোমাদের কথা বলছিল, তোমার খালামনি না খেয়ে আসলে দেখে আফসোস করছিল।
নিঝুম খাবার দিয়ে দিতে চেয়েছিল আমি বলেছি ওরা অলরেডি ডিনার করে ফেলেছে হয়তো।
: মা আমরা আসার পর কি আরো মজা হয়েছে , রুবা বলল!
: এখনো ওরা হুড়োহুড়ি করছে !
আমি রুমে গেলাম তোমরা খাও কেমন! সাফিয়া বেগম উঠে নিজের ঘরে র দিকে চলে গেলেন।
: চলে এসেছো বলে,তোমার এখন আবার আফসোস হচ্ছে নাকি রুবা ?
: না সেরকম কিছু না।
খাওয়া শেষ করে রুমের দিকে আসছে ওরা মাহির ফোন বাজছে , নিঝুম ফোন করেছে। মাহি ফোন রিসিভ করলো।
: হ্যালো বল, নিঝুম।
রুবা রমে ঢুকে গেল , মাহি করিডোরের চেয়ারে বসে কথা বলছে!
: তোরা চলে গেলি, রুবার শরীর কি সত্যি খারাপ বেশি?
: না বেশি কিছু না এখন ঠিক আছে । সরি রে নিঝুম বলে আসতে পারিনি!
: ঠিক আছে ব্যাপার না। তোদের না দেখে ভাবলাম নিচে বাসায় গিয়েছিস। ছাদ থেকে এসে শুনি রুবার খারাপ লাগছে তোরা চলে গেছিস।
: হুঁ ।
:মাহি তুই অপার কে কি বলেছিস?
: আর বলিস না আমি রুবাকে খুঁজে পাচ্ছি না অস্থির হয়ে আছি তখন সে রাস্তা আটকে ওর কথা বলা শুরু করলো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আজ, সাফ বলে দিসি কিছু কথা । তোর কাছে কমপ্লেইন করেছে?
: খুব মন খারাপ করে ছিল, কাঁদল তোর রাগ কি আর সবাই সহ্য করতে পারে মাহি! তুই যেমন উথালপাথাল ভালোবাসতে পারিস তোর রাগ টাও তো সেরকম তাই না ? আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!
: বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি বুঝি ?
: না ঠিক আছে, দরকার ছিল। প্রথম থেকেই শক্ত না হলে এই মেয়ে তোর প্রতি এট্রাকশন কোন ভাবেই কমাতে পারবে না।
: আমি কি করব বল সত্যি পারছিলাম না ঐ মুহুর্তে, রুবাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম তাই হয়তো বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি।
: চিন্তা করিস না অপার নিশ্চয়ই তার জবাব পেয়ে গেছে। কালকে আসছিস তো ?
: দেখি!
:রাখছি ভালো থাকিস ।
: আল্লাহ হাফেজ!
মাহি ফোন রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো ব্যাপার টা নিয়ে। সে ঠিক করেছে রুবাকে অপারের বিষয় টা বলবে এবং আজি !
রুমে ঢুকে দেখে রুবা শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছে।
মাহি ওর কাছে গিয়ে বলল,
: তোমার সাথে কথা আছে ।
: বলো, রুবা ওর দিকে ফিরল।
: পাঁচ মিনিট সময় দাও আমি আসছি বলে মাহি ওয়াস রুমে ঢুকে গেল।
রুবা একটু টেনশনে পড়ে গেল মাহিকে দেখে। হঠাৎ এত সিরিয়াস কেন ও !
বিছানায় বসে রুবা একটু টেনশন করছে , মাহিকে খুব সিরিয়াস লাগছে।
মাহি এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল।
: রুবা আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে হুঁ!
: বলো তাড়াতাড়ি আমার টেনশন হচ্ছে !
: টেনশন এর কিছু নাই রুবা! বলে মাহি রুবাকে পূর্বাচলের সেই রিসোর্ট এ নিঝুমের সঙ্গে অপারের কথা গুলো থেকে আজ মাহি ওকে যে ব্যবহার করছে সব বলল!
: রুবা সব মনোযোগ দিয়ে শুনলো ! তারপর কিছুক্ষণ মাহির দিকে তাকিয়ে বলল, এই পিচ্চি মেয়ে অপার তাই না , সিরিয়াসলি মাহি ?
: কি বলতে চাইছো রুবা ?
: এই বাচ্চা মেয়ে ও তোমার প্রেমে পড়ে গেল ডাক্তার সাহেব বলেই রুবা হাসছে তো হাসছেই!
: মাহি ওর হাসি দেখছে বোঝার চেষ্টা করছে বাতাস কোন দিকে বইতে পারে!
: তুমি এই নিয়ে এত টেনশনে কেন , রুবা বলল?
: আমি ঐ মেয়ে কে নিয়ে টেনশনে নাই রুবা আমি তোমাকে নিয়ে টেনশনে আছি!
: মানে?
: তুমি কষ্ট পাচ্ছো না তো , মানে তোমার এসব শুনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে না তো?
: আমার কারও উপর ই মেজাজ খারাপ হচ্ছে না, কেন হবে অপার একটা বাচ্চা মেয়ে এই বয়সের মেয়ে রা যে কারও উপর কোন কারণ ছাড়াই আকর্ষণ ফীল করতে পারে । এর জন্য অত শত ওরা ভাবেও না। আর আজকালকার মেয়ে বলো আর ছেলেরা ওরা কি বলছে আর করছে সবসময় কি বুঝে!
: ওর কথা গুলো তো বাচ্চাদের মত ছিল না!
: আজকাল বাচ্চাদের কথা শুনলে তুমি আরো তাজ্জব হবে বুঝলে ডাক্তার সাহেব।
: ও সহজ সরল মেয়ে তোমাকে তার মনের কথা বলে দিয়েছে , তুমি এত কঠিন ভাবে রিয়েক্ট না করলেও পারতে !
: আমার মাথা কাজ করছিল না ! সরি বলা উচিত তাই না রুবা?
: কালকে গায়ে হলুদ এর সময় আমি আর তুমি দুজনে মিলে ওকে বুঝিয়ে বলব ঠিক আছে !
মাহি রুবার দিকে তাকিয়ে আছে !
কি আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখো ?
মাহি ওর গাল টিপে দিয়ে বলল,
দেখি এই মেয়েটা কত অবুঝ কখনো নিজের বেলায়, আবার এখন এত সিরিয়াস বিষয়ে কত সুন্দর করে হ্যান্ডেল করে ফেলতে পারে!
: তাই , আমি একটা মেয়ে তো এসব ব্যাপারে মেয়ে দের ফিলিংস টা বুঝি! ও তোমার সৌন্দর্য দেখে, তোমার পার্সোনালিটি দেখে, তোমার এত এত গুন দেখে তোমার প্রতি উইক হয়ে গেছে মাহি ।
: ওরে বাপরে বাপ, রুবা ম্যাডাম কত গভীরে চিন্তা করে !
মাহি রুবাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, আচ্ছা রুবা আমি যদি বিয়ের পর বলতাম আমার একটা পছন্দের মানুষ ছিল তখন কি বলতে শুনে ?
: আমি খুব কষ্ট পেতাম , এই জন্য নয় যে তোমার মনে আরেক জন আছে আমি কষ্ট পেতাম আমার জন্য তোমাদের ভালোবাসা টা হারিয়ে গেল । এটা আমার জন্য খুব কষ্টের , খুব যন্ত্রণা র কারণ হতো আমি কারো ভাগ্য কেড়ে নিয়েছি, আমি কারো ভালোবাসা র মানুষ কে কেড়ে নিয়েছি এটা কিভাবে সহ্য করব বলো? ভালোবাসা কি জিনিস আমি তো জানি, তোমার ভাইয়া কে হারিয়ে আমি ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা জানি, আজ তুমি আমাকে ভালোবাসো আমি তোমার ভালোবাসার উন্মাদনা দেখছি তাই তোমার জীবনে এরকম কিছু হলে আমার কষ্টে শেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকতো না ! এমনিতেই তুমি আমার জন্য নিজের জীবন সেক্রিফাইস করেছো ভালোবাসাও সেক্রিফাইস করেছো এটা সহ্য করতে পারতাম না।
: মাহি রুবার কথা শুনে শরীরের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এই মেয়ে কে কখনো নিঝুমের কথা বলা যাবে না কখনো ই না । রুবা নিঝুম কে খুব পছন্দ করে । রুবা তাহলে শেষ হয়ে যাবে দুঃখে, কষ্টে, আত্মগ্লানি তে ।
আমি নিঝুমের ভালোবাসা নিজের হাতে শেষ করেছি এখন রুবার কিছু হোক সহ্য করতে পারব না !
: কি ঘুমিয়ে গেলে , রুবা বলল!
: হুঁ ঘুম চলে আসছে রুবা !
: তাহলে ঘুমাও !
মাহি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছে ঘুম তো হারাম করে দিলে রুবা !
আমাকে আজীবন এই যন্ত্রনা টুকু বয়ে বেড়াতে হবে, সব সময় সতর্ক হয়ে থাকতে হবে । ওফফ।
রুবা আলো নিভিয়ে দিল । মাহি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ! ওর চোখে ঘুম নেই।
মাহি ঘুমিয়ে গেছে ভেবে রুবা একবার ওর গালে আদর করে দিল। মাহি জেগেই ছিল কিন্তু কোন ভাবে টের পেতে দিল না।
ওর খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে ! যদি কখনো রুবা জেনে যায় নিঝুমের কথা কি হবে?
রুবা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেছে ।
মাহি শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে ।
একটা সময় উঠে সে রুম থেকে বের হয়ে গেল , পোর্চের ছাদ এ গিয়ে বসলো। আকাশে কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
মাহি সিগারেট জ্বালিয়ে আরেকটা চেয়ারে পা তুলে দিলো।
একদিকে রুবার মানসিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা আরেক দিকে এই মানসিক অবস্থায় যদি রুবা নিঝুম এর ব্যাপার টা জানে তাহলে কি হবে ? সব মিলিয়ে মাহি বুঝতে পারছে না সে সব কিভাবে সামলাবে !
বেশ অনেকক্ষণ ছাদে বসে রইল।
মাহি কে অবাক করে দিয়ে ওর বাবা এসে পাশে দাঁড়ালো।
সিগারেট হাতে ছিল বলে সে একটু অস্বস্তি তে পড়ে গেল। ও যে স্মোক করে এটা বাবার সামনে চলে আসবে এরকম ঘটনা কখনো ঘটেনি।
বাবা মাহিকে দেখে বলে উঠল,
: ঘুম আসছে না মাহি ?
: না বাবা এমনি বসে ছিলাম। তুমি এখানে ?
: রুবাকে নিয়ে টেনশন করছো তুমি ?
: রুবা ঘরে ঘুমাচ্ছে আর এখন ঠিক আছে বাবা !
: টেনশন করো না সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি যখন পাশে আছো, রুবা ঠিক হয়ে উঠবে তুমি ওকে ব্যস্ত করে রাখো দেখবে মন খারাপ করে থাকার মত সময়ই পাবে না সে।
: ঠিক বলেছো । তুমি এত রাতে এখানে, শরীর খারাপ লাগছে না তো বাবা?
: আমি ঠিক আছি , হঠাৎ মনে হল শিহাবের ঘরটা তে যাই একটু। তোমার মা ঘুমাচ্ছে ও জেগে থাকলে আসি না ।
: তুমি প্রায় সময়ই ভাইয়ার রুমে ঢুকে বসে থাকো তাই না বাবা ?
: হুঁ মনে হয় ও আশেপাশে ই আছে মাহি!
: তুমি ভাবছো মা টের পাচ্ছে না , মা সব জানে বাবা । ইচ্ছে করে ই তোমাকে বাঁধা দেয় না ।মাহি উঠে বাবার চেয়ারের পিছনে দাঁড়ালো । বাবার ঘাড়ে হাত রাখলো।
: কালকে তোমার হসপিটাল আছে এত রাত জেগে থেকো না যাও ঘুমিয়ে পরো ।
: তার আগে তুমি আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমাকে ঘরে দিয়ে আসি বাবা !
: আই এম ফাইন মাই সান !
: আই নো ইউ আর এ স্ট্রং পার্সন বাট ইটস মাই রেসপনসিবিলিটি বাবা!
: ওকে লেট গো।
: মাহি বাবাকে ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো। আজগর সাহেব ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।
: যাও মাহি ঘুমিয়ে পড় গিয়ে !
মাহি নিজের ঘরে ফিরে এলো। বিছানায় শুয়ে চিন্তা করলো বাসার প্রতিটা মানুষ এক একটা দ্বীপের মত একা।
রুবা অন্য দিকে পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। ও ওর যন্ত্রণা তে দিশেহারা হয়, বাবা বাবার যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখে, মা তো সব ভুলতে কত কি করে যায় সারাদিন। মাহি নিজের কষ্ট টা দূর করার জন্য নিজেকে বোধ দিল যা হবার হবে রুবার কাছ থেকে সব গোপন রাখার চেষ্টা সে শেষ পর্যন্ত করবে আর যদি রুবা কখনো জানে সে নিজের সবটুকু দিয়ে রুবাকে বোঝাবে রুবার কোন দোষ কখনো ই ছিল না সব দায় মাহির।
রুবার কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো সে । দেখা যাক ঘুম আসে কিনা।
শেষ রাতের দিকে মাহি ঘুমিয়ে গেল !
সকালে রুবা ডেকে তুললো মাহিকে। ডাক্তার সাহেব,
: কয়টা বাজে খেয়াল আছে ?
: মাহি ঘড়ির দিকে তাকালো , ও গড সাড়ে সাত টা বেজে গেছে মাহি লাফ দিয়ে উঠলো।
:রুবা আমার কাপড় বের করে দাও তাড়াতাড়ি আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
রুবা অবাক হয়ে বলল,
: আমি বের করে দিব?
: কেন কোন সমস্যা?
: আমার সমস্যা নাই তুমি তো তোমার কাজ নিজে করতে পছন্দ কর। তোমার ড্রেস সিলেকশন সব তো তোমার মত তাই বলছি!
: আজ থেকে না হয় তোমার পছন্দে পড়ব কখনো কখনো ,আর এত দিন আমার সঙ্গে থেকে তুমি নিশ্চয়ই আমার সব কিছু বুঝে গেছো !
: ঠিক আছে তুমি যাও আমি রেডি করে রাখছি সব।
মাহি ওয়াস রুমে ঢুকে গেল।
রুবা খুব এক্সাইটেড হয়ে মাহির আলমারি খুলল। কত সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা সব কিছু। বুয়া রা কাপড় ধুয়ে , লন্ড্রি থেকে আয়রন করিয়ে সেই কাপড় রুমে রেখে যাবে কিন্তু আলমারিতে তুলবে মাহি নিজে। ওর আলমারি ধরে না কেউ।
রুবা বিয়ের পর প্রায় সময় ওকে কাপড় এগিয়ে দিতে, গুছিয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু মাহি ই তাকে বলতো আমি আমার টা ম্যানেজ করতে পারি তুমি টেনশন করো না।
আজ মাহি নিজের থেকে বলাতে ওর খুব ভালো লাগছে।
সে একটা আইস ব্লু কালারের শার্ট আর ডীপ এশশ কালারের প্যান্ট বের করলো । মাহি ঘড়ির ব্যাপারে খুব চুজী তাই ঘড়ির পুরো বক্স ধরে বের করে রাখলো সে সিলেক্ট করুক কোনটা পড়বে।
মাহি ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে সব দেখে বলল,
পার্ফেক্ট সিলেকশন ! বলে প্যান্ট নিয়ে ড্রেসিং রুমে ঢুকে গেল।
: পারফিউম কোন টা বলো?
: তোমার যেটা ভালো লাগে আজ সব তোমার পছন্দে হবে রুবা!
: তুমি কি আমার কাছে থাকবে যে আমার পছন্দে র পারফিউম দিলে আমার ভালো লাগবে, তুমি থাকবে রোগীদের সঙ্গে বলেই রুবা হাসা শুরু করলো।
: এটা ভালো বলেছো রুবা , তারপর ও তুমি ই ঠিক করে দাও।
রেডি হয়ে মাহি ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং এ গিয়ে দেখে সব রেডি তারপরও সে রুবাকে বলল,
: তোমার হাতের ডিম ভাজি খাব আর চা রুবা!
: রুবা করার জন্য কিচেনে দৌড় দিল ।
ডিম ভাজি করে নিজেই নিয়ে এলো। মাহিকে খাবার তুলে দিচ্ছে।
সাফিয়া বেগম পেপার পড়ছিলেন পাশেই।
: মা আজকে রুবার পছন্দ করা ড্রেস পড়ে যাচ্ছি সব ঠিক আছে কিনা দেখে বলো তো?
: হুঁ সব পার্ফেক্ট।
রুবা খুশি হলো।
খেতে খেতে মাহি বলল,
: দুপুরে একটু দেরি হবে কিন্তু বাসায় লান্চ করব রুবা তুমি কিছু রান্না করবে না আমার জন্য?
: কি কি খেতে চাও বলো আমি রান্না করব ?
: মাছ রান্না করো তোমার যা ইচ্ছা। শুধু খুব বেশি কাঁটা র মাছ খেতে পারি না। কিন্তু ইলিশ খাই ,তো তোমার কাছে যেটা ভালো লাগে রান্না করবে ঠিক আছে । এখন চা দাও তাড়াতাড়ি।
রুবা চা আনতে চলে গেল কিচেনে আবার।
সাফিয়া বেগম অবাক হয়ে বললেন,
: কি ব্যাপার মাহি তোমার কি হলো আজ, রুবাকে এত দৌড়ের উপর রাখছো । তুমি ডিম ভাজি খাও সকালে ? আজ ডিম ভাজি খাচ্ছো , মাছ রাঁধতে বলছো, ওকে দিয়ে ড্রেস রেডি করাচ্ছ ! বুঝলাম না ?
: ব্যস্ত রাখছি মা । ওর সবচেয়ে বড় ওষুধ ওকে ব্যস্ত রাখা। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তাহলেই আর উল্টাপাল্টা চিন্তা করার সময় পাবে না !
: তাই তাহলে তো ভালো ! আবার খেয়াল রেখো ওকে দিয়ে আমি কোন কাজ এখন পর্যন্ত করাই না যা করে নিজের ইচ্ছায় ভুল হলে বকাঝকা দিও না।
: কি যে বলো মা , ও এখন বকা নেয়ার অবস্থায় নাই ওকে শুধু ভালবাসা দিয়ে হ্যান্ডেল করতে হবে ।
: দেখে ভালোই লাগছে ব্যস্ত হয়ে আছে , বলে হাসলেন সাফিয়া বেগম।
: তুমি ও কিছু কাজ দিয়ে ব্যস্ত রেখো মা।
: না দরকার নাই তোমার টা আগে সামলাক।
রুবা মাহির জন্য আর শ্বাশুড়ি র জন্য চা নিয়ে এলো।
মাহি চা খেয়ে বের হয়ে গেল । যাওয়ার সময় রুবার মাথায় হাত দিয়ে বলল , একদম যেভাবে রেখে যাচ্ছি এভাবেই থাকবে কোন ব্যতিক্রম যেন না হয়। মা ওর দিকে খেয়াল রেখো। আর রান্না করে রাখবে কিন্তু।
রুবা হাসলো।
মাহি যাওয়ার পর সাফিয়া বেগম বললেন, তোমাকে কাজ দিয়ে চলে গেল মাহি !
: সমস্যা নেই মা । আচ্ছা মা কোন মাছ রান্না করি বলেন তো ?
: দেখো ফ্রীজে কি আছে , বুয়াদের ডাকো। এক কাজ করো ফ্রীজ থেকে না ফ্রেস মাছ কিনতে পাঠাও কুদরত কে ।
: গুড আইডিয়া মা ।
রুবা মাহির জন্য ইলিশ মাছ রান্না করলো । ও ভর্তা খেতে পছন্দ করে দুই তিন টা ভর্তা করলো।
সাফিয়া বেগম বললেন,
:ওর আসতে দেরি হবে তুমি কি আমাদের সঙ্গে খেয়ে নিবে ?
: না মা আমি ওর সঙ্গে খাব , আপনি আর বাবা খেতে বসেন আমি সব দিচ্ছি।
রুবা মাহির জন্য অপেক্ষা করছে । আসতে দেরি হচ্ছে মাহির কিন্তু ওর খুব ভালো লাগছে অপেক্ষা করতে ।
রুবা আর সাফিয়া বেগম পোর্চে বসে গল্প করছে । মাহি ফোন দিয়েছে ওর আসতে আধ ঘন্টা লাগবে ।
একটা বাইক নিয়ে হেলমেট মাথায় কে যেন ঢুকলো গেট দিয়ে । রুবা আর সাফিয়া বেগম উৎসুক দৃষ্টিতে উপর থেকে নিচে তাকালো ।
হেলমেট খোলা র পর ওরা তো অবাক মাহি কে দেখে।
নিচ থেকে মাহি রুবাকে ডাক দিলো
:রুবা নিচে এসো তোমার জন্য বাইক ।
: রুবা চিৎকার দিয়ে দৌড় দিল নিচে !
: সাফিয়া বেগম হাসছেন উপরে বসে ।
রুবার চিৎকার শুনে আজগর সাহেব ও এসে দাঁড়ালেন সাফিয়া বেগম এর পাশে।
: কি হয়েছে ?
: তোমার ছেলে রুবার জন্য বাইক কিনে নিয়ে এসেছে তাকিয়ে দেখো রুবা বাচ্চাদের মত লাফাচ্ছে।
: অনেক দামি বাইক মনে হচ্ছে, মাহিকে বলো এটা বাবার পক্ষ থেকে ওর আর রুবার জন্য গিফট!
: সাফিয়া বেগম হাসলেন ঠিক আছে বলে দিব, রুবাকে দেখছি আমি কি করছে দেখো তাকিয়ে !
: রুবাকে তুমি দিন দিন এত বেশি ভালোবাসছো সাফিয়া আমি শুধু দেখি , আজগর সাহেব বললেন।
: কেন জানো, আমি ওর মাঝে শিহাব কে দেখি ! ও শিহাবের ভালোবাসা আর শিহাব আমার কি ছিল তোমার চেয়ে ভালো আর কে জানে ! সাফিয়া বেগম এর চোখ ভিজে উঠেছে।
শিহাব যাওয়ার সময় শেষ কথাটা বলেছিল, মা রুবা রইল তুমি দেখো ! কথাটা সব সময় আমার কানে বাজে শিহাবের বাবা !
: আজ অনেক দিন পর তুমি আমাকে শিহাবের বাবা বললে সাফিয়া !
: ইচ্ছা করেই বলি না !
রুবা নিচ থেকে ডাকছে সাফিয়া বেগম কে ,
: মা আমি উঠবো বাইকে?
: অবশ্যই , তোমার জন্য মাহি বাইক নিয়ে এসেছে যাও ঘুরে আসো।
সাফিয়া বেগম অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছলেন!
মাহি বলল,
: রুবা তুমি উঠে বসে থাকতে পারবে কিনা আগে বলো ?
: পারব পারব !
: ঠিক আছে সাবধানে দুই দিকে দুই পা দিয়ে বসো শক্ত করে ধরবে আমাকে কিন্তু।
: রুবা উঠে বসলো মাহির বাইকের পিছনে।
:শক্ত করে ধরে বসো তুমি পড়লে কিন্তু মা আমাকে আস্তো রাখবে না রুবা ।
: তুমি ফেলে দিও না আবার!
: আমি ফেলে দিব কেন , পাগল।
লেটস গো উইথ দ্যা উইন্ড রুবা বলে মাহি বাইক টান দিল ।
জীবনের প্রথম বাইকে উঠে রুবা খুব এক্সাইটেড ।
সাফিয়া বেগম আর আজগর সাহেব উপর থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে । আজ সাফিয়া বেগম এর খুব শিহাব কে মনে পড়ছে । রুবা আনন্দে থাকলে উনার মনে হয় শিহাব ই আনন্দে আছে।
এর ব্যাখ্যা কি উনার কাছে ও জানা নেই !
আজগর সাহেব বললেন,
: চলো সাফিয়া রুমে যাই ওরা ফিরে আসবে তাড়াতাড়ি, ততক্ষন তুমি আমার পাশে এসে একটু বসো।
: হুঁ এসো।
( চলবে)