#যখন_দুজনে_একা
৫৬ পর্ব
মাহি ঘুমিয়ে গেছে । রুবা খুব সাবধানে মাহির হাতটা ওর শরীরের উপর থেকে সরালো। এসির ঠান্ডায় ওর শরীর কাঁপছে। মাহি এত টেম্পারেচার কমিয়ে রাখে ওর গা কাঁটা দিয়ে উঠে।
পাশ ফিরে মাহির দিকে তাকালো । কত শান্ত একটা মুখ । সেইভ করেনি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওর ফর্সা মুখটাতে অনেক কিউট লাগছে।
দুটো রাত স্বপ্নের মত সুন্দর গেছে। কিন্তু আজ ওর বুকের ভেতরে একটা খচখচানি কাঁটা দিচ্ছে।
রাতের শুরুতে যখন মাহির আদরে সে পাগল হয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ নিঝুম আপুর জন্য ওর বুকের কাছে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠলো।
এতটা খারাপ লাগলো অন্যমনস্ক হয়ে গেছে যে সেই মুহূর্তে মাহি পর্যন্ত নোটিশ করলো! ওকে প্রশ্ন করলো কি হয়েছে?
রুবা এড়িয়ে গেছে। নিঝুম আপুর দিকে তাকালে এত অপরাধবোধ হচ্ছে।
আজ ওদের দুজনের দিকে যখন তাকিয়ে ছিল আপু, নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হচ্ছিল ?
মাহিকে বলতে খুব আনইজি লাগছে , কিন্তু ওকে ছাড়া আর কাউকেই কিছু সে বলতে পারবে না।
ওর সকল সমস্যার সমাধান মাহি করতে পারে নিমিষেই।
রুবা মাহির গালটা ছুঁয়ে দিল।এত ভালোবাসাও ওর জন্য ছিল কোথাও ভেবেই রুবা অবাক হয়!
হঠাৎ সেই পুরোনো কষ্ট , আশংকা ওর মনে পড়ে গেল । এই যে এত সুখ আবার কি কোন দাম চুকাতে হবে ?
মাহির কিছু হবে না তো ?
ওর সুখ তো সব সময়ই ধরা দিয়েই হারিয়ে যায় ! ওর বুকটা কাঁপছে।
চোখ ভিজে গেল।
আবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, এসব তার অহেতুক ধারণা। ওর মানসিক সমস্যা এটা। মাহি তো বলেছেই , কিছু হবে না ওর।
কিন্তু ভয় টাকে তো ও পিছু ছাড়াতে পারছেনা ! দম বন্ধ লাগছে।
মাহি কে ডাকবে ?
থাক ও কষ্ট পাবে , রাগ ও হবে !
রুবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
ভয় টা বেড়ে যাচ্ছে আরো। ও মাহিকে শক্ত করে আকড়ে ধরলো !
মাহির ঘুম খুব পাতলা ও জেগে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে !
: কি হয়েছে ঘুমাও নি তুমি , ঘুম জড়ানো কন্ঠে মাহি বলল?
: কিছু না ভয় লাগছে কেন জানি ?
: স্বপ্ন দেখেছো, আচ্ছা ঠিক আছে সোনা আমি জড়িয়ে ধরে আছি আর ভয় লাগবে না । সব আলো জ্বলে দিব?
রুবা মাহির বুকের ওমে ঢুকে গিয়ে বলল, না লাগবে না ।
মাহি ওর কপালে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে গেল! কিন্তু মাহি জানে না এই ভয় আলো জ্বলে দিলে যাবে না রুবার ভেতর থেকে। এই ভয় ওর রক্তের সাথে মিশে গেছে।
সকালে মাহি যখন হসপিটালে র জন্য বের হয়ে গেল তখন রুবা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ।
মাহি ওকে আর ডাক দেয়নি। বাসায় ফিরে জিজ্ঞাসা করবে কি স্বপ্ন দেখে রাতে এত ভয় পেল রুবা ! যে সারারাত মাহিকে এক সেকেন্ডের জন্য ছাড়েনি।
রুবা দুপুর পর্যন্ত ঘুমালো। শ্বাশুড়ি এয়ার পোর্টে এসে কল করেছিল , সেই কলে তার ঘুম ভাঙল।
তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে সে শ্বশুর শ্বাশুড়ি র জন্য অপেক্ষা করছে।
সাফিয়া বেগম বাসায় না থাকলে তার খালি খালি লাগে। এবার তো আরো একা ছিল সে ।
সাফিয়া বেগম কে দেখে রুবা দৌড়ে নিচে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলো। সাফিয়া বেগম প্রথম কথাই বলল,
: তুমি একা পুরো বাড়িতে কিভাবে ছিলে রুবা ?
: মা আপনার ছেলে ছাড়া বাকি সবাই ছিল , আমার সমস্যা হয়নি।
: অনেক সাহসের পরিচয় দিলে তুমি ! সাফিয়া বেগম হাসলেন।
: আপনার জন্য আমার খুব খারাপ লেগেছে মা ।
: এখন আমি চলে এসেছি মাহি যখন ইচ্ছা আসুক তুমি আমার কাছে থাকবে ।
: জ্বি মা।
সারাদিনে বেশ অনেকবার সে মাহিকে ফোন দিলো। সাধারনত সে মাহিকে এত বার ফোন দেয় না । মেসেজ দেয় । একবার মাহি দুষ্টামি করে প্রশ্ন ই করলো ,
: রুবা তুমি কি আমাকে খুব মিস করছো ?
: সেরকম কিছু না ?
: তুমি একটু পর পর ফোন দিচ্ছ তাই ভাবলাম!
: না এমনি ফোন দিচ্ছি, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি কাজ কর বলে রুবা ফোন রেখে দিল।
শ্বাশুড়ি র সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে বারবার উঠে দেখছিল মাহির গাড়ি আসে কিনা !
সন্ধ্যায় যখন মাহি ফিরে এলো তখন সে কিছুটা স্বাভাবিক হলো।
মাহি কে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখালো শ্বাশুড়ি কি কি গিফট এনেছে তার জন্য। সাফিয়া বেগম রুবার জন্য এমারেল্ড আর ডায়মন্ডের এক জোড়া কানের দুল এনেছেন, মাহিকে সেগুলো পড়ে দেখালো। পারফিউম , ব্যাগ, মেকআপ আইটেম মাহি রুবার উচ্ছাস টা দেখে আনন্দ পাচ্ছে।
মাহি বলল, মা আমার গিফট কোথায় , সব কি রুবার ?
সাফিয়া বেগম হেসে বললেন, তোমার জন্যেও আছে !
রুবা মাহির জন্য আনা পারফিউম , লুইস ফেলিপের শার্ট, বেল্ট বের করে দিল!
: তুমি ফর্মাল শার্ট পছন্দ করো তাই এনেছি , মা বলল!
থ্যাঙ্কস মা , আমি তো ভাবলাম সব তোমার রুবার জন্যই এনেছো আমার কিছু নেই।
রুবা বলল, দেখলেন মা কি জেলাস আপনার ছেলে !
গিফট তো তোমার ই বেশি থাকে রুবা!
সাফিয়া বেগম হাসছেন ওদের খুনসুটি দেখে !
মাহি তার মা কে নিয়ে হসপিটালে গেল খালু কে দেখতে রুবা ইচ্ছে করে ই গেল না । ওর নিঝুমের সামনে যেতে কষ্ট হয় ।
ওরা যাওয়ার পর আবার তার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো । মাহিকে নিয়ে ভয় । আচ্ছা মাহি কি আজ হসপিটালে থাকবে ?
রুবা ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে শুধু। মাহি বলেছে কোন কারণে অস্থির থাকলে, মন অন্য দিকে সরিয়ে রাখতে ।
সে মন অন্য দিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলো । মুভি দেখা শুরু করলো কিন্তু ভালো লাগছেনা তার । একটা ম্যাগাজিন বের করে শুয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে এক সময় ঘুমিয়ে গেল।
বাসায় আসার পর মাহি রুমে ঢুকে দেখে রুবা ঘুমিয়ে আছে। পাশে ম্যাগাজিন উল্টে আছে । হঠাৎ খেয়াল করলো চোখের কোণে পানি শুকিয়ে আছে। কেঁদেছে নাকি?
রুবার পাশ ঘেঁষে শুয়ে ওর মাথায় হাত রাখলো মাহি।
কিছুক্ষণ পরেই রুবার ঘুম ভেঙ্গে গেল । হাসি মুখে তাকালো মাহির দিকে। মাহি প্রশ্ন করল,
: কি হয়েছে তোমার ?
: কোথায় কিছু না তো?
: না আমি শিওর তোমার কোন একটা সমস্যা হচ্ছে !
: রুবা চুপ করে আছে !
মাহি বলল, এখনই বলবে নাকি আরো সময় নিবে ?
রুবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো , তারপর
জাপটে ধরলো মাহিকে !
: রুবা ,কি হয়েছে ? মাহি তো পুরোই আবাক!
: ভয় করছে আমার ?
: কিসের ভয় ,কাল রাতেও ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠে গেলে। সারারাত আমাকে আঁকড়ে ধরে পরে রইলে ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না !
রুবা ফিসফিস করে বলল ,
: ঐ যে ঐ ভয় টা , তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় ! সবাই কে হারিয়ে ফেলার ভয়!
: আমাকে হারিয়ে ফেলবে কিভাবে ?
: হুঁ তোমার ভাইয়ার মত !
মাহির বুকে ধাক্কার মত লাগলো রুবার কথাটা! রুবার চেহারা পুরো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে !
: আমি কোথায়ও হারিয়ে যাচ্ছি না, সোনা ! এই যে তোমার পাশে আছি । এভাবে চিন্তা করে করে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে !
রুবা তুমি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছো তাই বলে সারাটা জীবন শুধু কষ্টই পেয়ে যাবে তা নিশ্চয়ই না ! আমি তোমার জীবন টা সুন্দর করে দেয়ার জন্য আছি তো !
: তুমি দূরে থাকলেই আমার ভয় হয় !
: ঠিক আছে আমি দূরে যাচ্ছি না , বলো তো চাকরি ছেড়ে দেই । সারাদিন আমার রুবার পাশে বসে থাকব ! আর আদর করব বলে ই মাহি হেসে দিল!
: না সেরকম কিছু করতে হবে না !
: কি আদর করতে হবে না , নাকি চাকরি ?
: ওফফ মাহি সব সময় শুধু ফান করা !
: রুবা শোন , মানসিক সমস্যা এমন এক জিনিস যা হুট করে ওষুধ খাইয়ে ভালো করে দেয়া যায় না এর জন্য নিজের ও চেষ্টা থাকতে হয় এবং আশেপাশের মানুষের ও। তুমি মানসিক ভাবে এত দূর্বল হয়ে গেছো যে সামান্য কিছু তেই তুমি তাড়াতাড়ি আতঙ্ক গ্রস্থ হয়ে যাও। খারাপ কিছু পেয়ে কষ্ট পেতে পেতে এখন ভালো কিছু পেলেও তুমি আতংকিত হয়ে উঠছো।
নিজেকে নিজের মটিভেট করতে হবে। সুখ , দুঃখ সব নিয়ে জীবন মুরগির বাচ্চা।
সুখ যেমন দুই হাত ভরে নিব দুঃখ গুলো নেয়ার জন্য ও মানসিক ভাবে শক্তিশালী থাকব ।
মাহির বুকে মাথা রেখে রুবা বলল,
: কতটুকু দুঃখ বলে দাও?
: আমি তো জানি আল্লাহ তার বান্দাদের তার সহ্য ক্ষমতা র বাহিরে র বেশি দুঃখ কষ্ট দেন না রুবা !
: তার মানে আমার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা এত বেশি !
: হয়তো ! এখন এসব কথা বাদ দাও রুবা ভালো কিছু বলো!
: হসপিটালে নিঝুম আপুর সঙ্গে দেখা হয়েছে ?
: তো ?
: আপু কেমন আছে ?
: ভালো ই তো দেখলাম, কেন হঠাৎ নিঝুমের কথা আসছে কেন ?
: আচ্ছা তোমাকে একটা কথা বলব?
: বলো রুবা আমি তোমার কথাই শুনতে চাইছি ? মাহি শুয়ে রুবার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল।
: নিঝুম আপুকে দেখলে আমার কেন এত অপরাধবোধ কাজ করে , কেমন জানি একটা স্বার্থপর মানুষ মনে হয় নিজেকে ! এমনকি এই যে তোমার এত কাছে আছি তোমার আদর পাওয়ার সময়ও নিঝুম আপুর জন্য মন খারাপ লাগতে থাকে !
: মাহি রুবার কথা শুনে কি বলবে বুঝতে পারছে না ! মনে মনে বলল , পাগল মেয়ে তাও যদি বলতে তুমি , আমার আদর পাওয়ার সময় তোমার ভাইয়ার কথা মনে পড়ে! তোমার কিনা নিঝুমের কথা মনে পড়ে খারাপ লাগে ? সে জন্যই তুমি রুবা, যাকে না ভালোবেসে পারিনি আমি!
: মাহি ওকে ধাক্কা দিয়ে বুকের থেকে তুলে দিল , যাও তাহলে দূরে সরো আমার বুকের কাছে এলেও তোমার খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই নিঝুমের জন্য !
তুমি এসব ভাবো কিভাবে রুবা ?
আমার তো এরকম মনে হয় নাই! তোমার কাছে এসে একবার ও তো মনে হয়নি এখানে নিঝুম হতে পারতো ? বরং আমার ভেতরে এই জিনিস টা কাজ করার কথা হলেও হতে পারতো !
নিঝুম আমার বিশেষ মানুষ ছিল ঠিক, কিন্তু আমার ওয়াইফ তুমি, নিঝুম আমার অতীত। আমার বর্তমান তুমি আমার ভবিষ্যৎ তুমি। আমার ভালোবাসায় খামতি আছে তাহলে বুঝতে হবে রুবা, তা না হলে এই কথা কেন তোমার মনে হবে ? তুমি এভাবে ভেবে আমার অপরাধবোধ টা বাড়িয়ে দিচ্ছ !
: সরি !
: না সরি বলো না দূরে থাকো, তোমার নিঝুম আপুর কথা চিন্তা করতে থাকো!
রুবা মাহিকে জড়িয়ে ধরতে নিলো মাহি সরিয়ে দিচ্ছে বারবার, না না আর কাছে আসতে হবে না নিঝুম কষ্ট পাবে দূরে থাকো!
: প্লিজ সরি বললাম তো এরকম করছো কেন !
: আমি কিছু ই করছি না তুমি একটা পাগল যতসব পাগলামী চিন্তা ভাবনা !
মাহি কতক্ষণ কপট রাগে রুবাকে দূরে সরিয়ে দিল। কিন্তু রুবা ও টানাটানি করে ওকে নিজের কাছে এনে ছাড়লো।
: কি এখন মনে হচ্ছে না নিঝুমের কথা ? এক কাজ করি নিঝুম তো সিঙ্গেল আছে ওকেও বিয়ে করে ফেলি এতই যখন তোমার মন কাঁদছে ওর জন্য !
: রুবা মাহির মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো!
: হাত সরাও শুনতে হবে রুবা ,তখন আমার বুকে আসার জন্য মারামারি লাগবে দুজনের সেটাই ভালো জমবে মাহি হাসছে !
: সরি বলেছি তো মাহি চুপ করো !
: এখন শুনতে খারাপ লাগছে ?
: হুম, এরকম কথা বলো না !
মাহি হাসতে হাসতে বলল, আমার ভাগ দেয়া যাবে না !
: কখনোই না , কাউকেই না !
: পাগল হলে কি হবে জাতে মাতাল তালে ঠিক ! আমি পুরোটাই আপনার বুঝলেন মিসেস মাহির আসগর আপনি শুধু উল্টাপাল্টা পাগলামী চিন্তা করতে থাকবেন!
: শুধু তো এটা না , তুমি আমাকে নিয়ে ইনসিকিউর ফীল করাও বন্ধ করো রুবা! আমি সেইফ থাকি সারাক্ষণ আতংক নিয়ে থাকলে হবে ?
এতটা দূর্বল মানসিকতার হলে হয় না রুবা ! মা কে দেখো ? মা কতটা স্ট্রং ! মায়ের কি দুঃখ কম ! মায়ের পরে তোমাকে এই সংসারের হাল ধরতে হবে আমাদের বাচ্চাদের সামলাতে হবে ! পুরো জীবন পরে আছে সামনে!
: ঠিক আছে !
: অন্তত চারটা বাচ্চা তো থাকবেই আমাদের তাই না রুবা ?
: তুমি কি এসব সিরিয়াসলি বলো মাহি ?এই তুমি বললে তুমি আমাকে শেয়ার করতে চাও না কারো সাথে এখন বলছো ভবিষ্যতে চারটা বাচ্চা! চার বাচ্চা র পেরেন্টস এর অবস্থা এখন কেমন পাগল পাগল জানো ?
চার বাচ্চা সামলাতে থাকব আমি তুমি আমাকে সারাদিনে ভাগেও পাবে না মনে রেখো ডাঃ মাহির আসগর।
: রুবার কথায় মাহি হো হো করে হেসে উঠলো!
: এই অবস্থা হলে তো চিন্তার বিষয় রুবা, আমার তোমাকে সারাক্ষণ ই লাগবে । বললাম না কারো সঙ্গে তোমাকে শেয়ার করতে পারব না !
: বাচ্চাদের সঙ্গে তো করতেই হবে ! আমি অনেক ভালো একজন মা হব দেখো !
: তাই বুঝি !
: হুম !
: আর যাই করো আমার বাচ্চাদের তোমার মত ফার্মের মুরগী বানাবে না রুবা , প্লিজ! সারাক্ষণ শুধু ভয় ভয় আর ভয় পাবে !
দুজনেই হাসছে !
মাহি আর রুবা যখন নিজেদের ভবিষ্যৎ এর গল্প নিয়ে খুনসুটি তে ব্যস্ত তখন মাহির মোবাইল এ বারবার নিঝুম ফোন দিয়ে যাচ্ছে । সাইলেন্ট মুড়ে থাকায় মাহি অতি সহজেই ইগনোর করতে পেরেছে।
তা না হলে রুবার সামনে নিঝুমের ফোন তাকে ধরতেই হতো।
মাহি পুরো দুই মাস নিঝুমের সঙ্গে কোন কথা বলেনি। এই দুই মাসের ভেতরে নিঝুমদের বাসায় খালু কে দেখতে গেছে তবুও নিঝুমের দিকে ফিরেও তাকায় নি সে।
নিঝুম লাগাতার কল করেছে সে রিসিভ করেননি। প্রতিদিন মেসেঞ্জার এ মেসেজ পাঠিয়েছে ইচ্ছে করে সীন করেনি। সীন করলেও কোন রিপ্লাই দেয়নি। এমনিতেও বিয়ের পর নিঝুমের মেসেজ এর রিপ্লাই সে দেয় না। ঐ দিনের ঘটনার পর সে আরো নিজেকে শক্ত করে ফেলেছে।
ওর সঙ্গে হসপিটালে দেখা করতে এসেছে ও কাজের বাহানা করে চলে গেছে।
বাসায় এসে হাজির হয়েছে ও নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে বসে ছিল রুবাকে নিয়ে অসময়ে। কিংবা বাসার বাহিরে কাজের বাহানা দেখিয়ে চলে গেছে। নিঝুমকে পুরোপুরি ইগোর করছে সে।
এই দুই মাসের ভেতরে রুবাকে নিয়ে মাহি দেশের বাহিরে ঘুরতে ও গেছে। তিন দিন নরওয়েতে ছিল রাতের আকাশের অরোরা দেখেছে রুবার হাত ধরে। সালবার্ড এর লংইয়ারবেন সিটিতে গিয়ে স্কী ড্রাইভ করেছে। স্বপ্নের মত ছিল মাহির কাছে সেই সময় টা। সেখান থেকে গ্রীস এর সান্তোরিনি। এজিয়ান সমুদ্রের তীরের শ্বেত শুভ্র ইয়া গ্রামের রাস্তায় যখন দুজনে হাত ধরে হেঁটেছে রুবার আনন্দ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেছে । মনে মনে সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে, এই মেয়েটাকে যেন সে এভাবেই সুখী করতে পারে সারাজীবন। ওর সুখে যেন আর নজর না লাগে কারো।
ঘুরে আসার কয়দিন পর শিহাবের মৃত্যুর দিন টা ওদের বাসাকে আবার এক শোকের চাদরে ঢেকে দিল। মাহির বাবা সারাদিন নিজের মায়ের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন।
সাফিয়া বেগম সারাদিন একদম চুপ হয়ে রইলেন । আত্মীয়-স্বজন এ বাসা ভরে গেল। যাবতীয় কাজকর্ম মাহি একাই সামলেছে।
রুবা নিজের বিছানায় পড়ে রইলো। মাহি ওকে ওর মত শোক কাটাতে দিল কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণ পর পর ওর কাছে গিয়ে বসেছে কান্নাকাটি করতে বাধাও দেয়নি ।
মনে মনে বলেছে থাক ও নিজের মত আজ।
বিকালে সাফিয়া বেগম একবার রুবার কাছে এসে বসতেই রুবা নিজেকে আর সামলাতে পারেনি মা কে ধরে ব্যাকুল হয়ে কেঁদেছে।
মাহি রুমের বাহিরেই বসে ছিল তখন।
সে জানে তার ভাইয়া ,তার চেয়ে বেশি কিছু এই দুজন মানুষের কাছে। জীবন তাদের যেখানেই নিক রুবা আজও শিহাবের কথা মনে পড়লে চুপচাপ হয়ে পড়ে। ঐ ঘরটার দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যায়। মাহির কোন ভালোবাসাই রুবার ঐ জায়গায় স্বান্তনা হতে পারে না।
সারাদিন না খাওয়া, কান্নাকাটি করে ক্লান্ত রুবার কাছে মাহি যখন সন্ধ্যায় গিয়েছে, রুবা তখনও শুয়ে চোখ মুছছে। মাহি ওর মাথায় হাত রাখতেই রুবা মাহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
রুবাকে বুকের কাছে টেনে নিলো মাহি।
: অনেক হয়েছে রুবা এখন শরীর খারাপ করবে , সারাদিন কিছু খাওনি তুমি, উঠো ।
: আমার কিছু ই ইচ্ছে করছে না ।
: প্লিজ রুবা, মাও খায়নি কিছু ই তুমি না খেলে খাবেও না !
দরজায় নক করার শব্দে মাহি তাকালো ।
রিয়া আর নিঝুম এসে ঘরে ঢুকলো।
মাহি রুবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে যেমন বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। সব পরিস্থিতিতে লোকজনের তোয়াক্কা সে কোন কালেই করতে পারে না।
রিয়া রুবার কাছে এসে ওর মাথায় হাত রাখলো।
রুবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তখনও মাহির বুকে।
নিঝুম বলল,
: সারাদিন এভাবে কেঁদেছে পানিও তো খায়নি ডিহাইড্রেশন হয়ে যাবে তো !
মাহি নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল ,
: বুয়াদের কাউকে বলবি এক গ্লাস শরবত দিয়ে যেতে আর মা আর রুবার খাবার টাও রেডি করতে বল।
দুই মাসে এই প্রথম মাহি নিঝুমের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলল! যদিও রুবার জন্য তারপরও নিঝুমের খুব ভালো লাগছে।
সে উঠে গিয়ে শরবত নিয়ে এলো। নিজেই রুবার মুখে দিতে নিলো মাহি ওর হাত থেকে নিয়ে রুবার মুখের সামনে ধরল ।
অনেক জোর করার পর রুবা দুই ঢুক খেয়ে রেখে দিল।
নিঝুম বলল, মাহি খাবার টেবিলে ডিনার দিয়েছে বুয়া, তুই রুবাকে নিয়ে যেতে পারিস।
: ঠিক আছে , রিয়া আপু তুমি আর নিঝুম মায়ের কাছে যাও আমি রুবাকে ঠিকঠাক করে নিয়ে আসছি।
ওরা বের হয়ে যাওয়ার পর মাহি জোর করেই রুবাকে টেনে নিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে দিল । ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য, ড্রেস বের করে দিল । নিজে হাতে চুল আঁচড়ে দিল।
: রুবা তাকিয়ে দেখো তো ঠিক মত হয়েছে তো চুল আঁচড়ানো ?
রুবা শুধু আয়নার দিকে তাকিয়ে ই রইলো । মাহি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই হলুদ কামিজে তোমাকে সত্যি সত্যি মুরগির বাচ্চা লাগে সোনা। রুবার গাল টিপে দিয়ে বলল, দেখো কেঁদে একেবারে গোল্ডফিস এর মত মুখ ফুলে গেছে তোমার!
এখন চলো খেতে যাবে বাসায় কেউ খায়নি সারাদিন।
মাহি তার বাবাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে এলো।মা আর রুবাকে নিয়ে খাওয়ার টেবিলে বসালো।
মায়ের দিকে খাবার বেড়ে দিতে নিলো সাফিয়া বেগম বললেন,
: তুমি রুবাকে দেখো আমি আর বাবা ঠিক আছি !
: রুবাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে মাহি।
দূরে লিভিং রুমে নিঝুমের পাশে বসে রিয়া বলল, দেখ নিঝুম মাহি কে ! ভালোবাসা, দ্বায়িত্ব , কর্তব্য সব একটা মানুষ কে কতটা সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করে । মাহি আজ একদিকে দ্বায়িত্বশীল ছেলের কাজ করছে অন্যদিকে দেখ রুবা আজ তার মৃত স্বামীর জন্য কাঁদছে, কার বুকে তাঁর বর্তমান স্বামী এই মাহির বুকের পরে। তাকে স্বান্তনা দিয়ে , আদর দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে মাহি! নিজে কতটা বড় মনের মানুষ না হলে এমন হতে পারে বলতো!
আমি তো মাহি কে দেখি আর মুগ্ধ হয়ে যাই, পুরুষ মানুষ ও এতটা কম্পোজড হয়! হোক শিহাব ভাই তার আপন বড় ভাই কিন্তু তবুও !
রুবা আসলেই এই দিকে অনেক ভাগ্যবতী মাহির মত একজন জীবন সঙ্গী পেয়েছে।
রিয়া জানে না সে যতটা মুগ্ধ হয়ে মাহিকে দেখছে তার চেয়েও বহুগুণ মুগ্ধতা নিয়ে নিঝুম মাহি কে দেখে । নিঝুম গত দুটো মাস মাহির সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে।
আজ যখন রুবার জন্য শরবত আনতে বলল মাহি ওকে ,ওর পৃথিবী টা আনন্দে ভরে উঠেছে এক কথায়। রুবাকে বুকে নিয়ে ওর সামনে যতই মাহি বসে থাকুক তারপরও মাহিকে সে মুগ্ধ হয়েই দেখে। মাহির জন্য সে নিয়াজের হাত ধরতেও প্রস্তুত এতে যদি তাও মাহি ওর প্রতি রাগ কমিয়ে আগের মত ভালো ব্যবহার করে।
মাহি যদি এডজাস্টমেন্ট এর রিলেশন দিয়ে ভালোবাসা খুঁজে নিতে পারে ,কি জানি একদিন সেও পারবে।
এতে যদি মাহির সঙ্গে সম্পর্ক টা নরমাল থাকে এটাই তার অনেক বড় পাওয়া হয়ে থাকবে।
( চলবে )