যখন দুজনে একা পর্ব-৬৬

0
2895

#যখন_দুজনে_একা

৬৬ পর্ব

জ্বরে মাহি ভালোই কাবু হয়ে গেল কয়দিন। রুবা বলতে গেলে সারাক্ষণ ওর পাশে ই আছে। বোঝা যাচ্ছে রুবার অনেক কষ্ট যাচ্ছে। ছেলেদের সময় দিতে হচ্ছে , আবার মাহির খাওয়া, ওষুধ খাওয়ানো , ওকেও সময় দেয়া।
দুপুরের পর বাচ্চারা দাদা দাদি র সঙ্গে থাকে রুবা মাহির পাশে শুয়ে কথা বলতে বলতে আজ ঘুমিয়ে গেল।
মাহি তাকিয়ে দেখে রুবা ঘুমিয়ে গেছে।
মাহি ওর ঘুমন্ত মুখটা র দিকে তাকিয়ে রইল ! ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একটা মুখ । ছেলেদের জন্য রাত জাগতে হচ্ছে, দিনে মাহির জন্য দৌড়াচ্ছে।
মাহির খুব ইচ্ছে করছে রুবাকে নিয়ে আর বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে।
জানে সম্ভব না এটা । এই কথা শুনলে মা মেরেই ফেলবে তাকে।
তার খুব ইচ্ছে করছে রুবাকে একটু রেস্ট দিতে । একটু সময় দিতে। ঐ দিন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে রুবা সারাক্ষণ ওর পাশে পাশে থাকার চেষ্টা করছে সেই জন্য দুই ঘরে বারবার দৌড়াচ্ছে।
মাহি রুবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিভাবে স্বপ্ন টা দেখলাম আমি !
দুই দিন থেকে সে বারবার চিন্তা করছে এই কথা ! তার মানে কি ওর মনে ভাইয়ার ফিরে আসা নিয়ে কোন আতংক ছিল কোথাও না কোথাও ?
কিন্তু ও তো শিহাব এর প্লেন টা ক্রেশ করেছে শোনার পর ও এই চিন্তা করেনি কখনো যে ভাইয়া ফ্লাইট টা মিস করেছে কোন কারণে !
সেই সম্ভাবনা ই ছিল না কারণ শিহাব পিয়ারসন এয়ার পোর্টে চেক ইন করে , ফ্লাইটে উঠেও ওর সঙ্গে কথা বলেছে।
সে কিভাবে ভুলে যাবে ভাইয়ার সঙ্গে র শেষ কথা গুলো।
রুবা যে তাহিতিয়ান পার্ল পছন্দ করে এটা তো সেদিন ই ভাইয়া বলেছিল । রুবা কি করছে দেখে আসতে বলেছিল ভাইয়া।
মাহি যখন বলল, ছবি তুলে পাঠাব ?
: লাগবে না তোর চোখ দিয়েই দেখে নিলাম যা , মোবাইল বন্ধ করতে হবে এখন এটাই তো ছিল ভাইয়ার শেষ কথা ! মাহি তো ভুলেনি সেই কথা গুলো ভাইয়া তখন এয়ার ক্রাফট এ অলরেডি বসা!
তাহলে তো কোন আশাই ছিল না ।
অন্য সবার মত সে আশায় বুক বাঁধতে পারেনি সেদিন ও না কোন দিন ও না !
তাহলে কেন এই স্বপ্ন ও দেখেছে ! তবে কি রুবার ভালোবাসা ওকে দূর্বল করে দিয়েছে বলেই এরকম অবাস্তব স্বপ্ন ওকে তাড়া করেছে।
যেখানে ভালোবাসা যত বেশি হারানোর ভয় ও তো সেখানে অনেক। রুবা আর ছেলেদের নিয়েই তাই এত বড় দুঃস্বপ্ন ওকে তাড়া করলো !
মাহি চোখ বন্ধ করে আছে।
রুবা ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ বলে উঠল ,
: তোমার চোখের কোণে পানি কেন ?
: কোথায় , আরে ও কিছু না এমনি! তুমি উঠে গেলে কেন ঘুমাও একটু।
: এমনি চোখে পানি সত্যি বলছো তো খারাপ লাগছে না তো আবার শরীর?
: না রুবা আমি ঠিক আছি!
: ছাদে যাবে তুমি ?
: এখন !
: হুম চলো বিকাল টা ছাদে বসে কাটাই । ছেলেরা এখন বাবা মায়ের রুমে!
: উঠতে ইচ্ছে করছে না রুবা , আচ্ছা চলো !
: কি করতে ইচ্ছে করছে তোমার ?
: সত্যি করে বলব, তোমাকে আর বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে !
: নিয়ে আসব ওদের তোমার কাছে ?
: থাক বাবা এই সময় টা ওদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে সন্ধ্যায় এনো ! এখন তুমি আমার কাছে থাকো ! হাত বাড়িয়ে মাহি রুবাকে বুকের কাছে টেনে নিলো।
: তোমার কি হয়েছে বলো তো মাহি ?
: কোথায় কি হয়েছে ?
: তোমার মুখটা এত মলিন লাগছে চোখ গুলো এত শান্ত কেন ?
: কয়দিন সেইভ করি না তাই হয়তো তোমার কাছে এমন লাগছে ! তুমি খালি খালি চিন্তা করছো রুবা !
: দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু নিয়ে খুব চিন্তা করছো !
: সেরকম কিছু না রুবা । ছেলেদের জন্য মনটা খুব কেমন করছে !
: আমি সন্ধ্যায় নিয়ে আসব তোমার কাছে ওদের বললাম তো!
: তারপর আমরা চারজন অনেকক্ষণ সময় একসঙ্গে কাটাব রুবা !
: ঠিক আছে।
সন্ধ্যায় রুবা ছেলেদের মাহির রুমে নিয়ে এলো ! ছেলেদের পেয়ে মাহি পুরো বাচ্চা হয়ে গেল। রুবা মাহির কান্ড কারখানা দেখছে। বুকের উপর নিয়ে কচলাচ্ছে কত কি করছে। ওদের তিন জন কে দেখে রুবার এত ভালো লাগছে ,ওর জীবনটা এই তিনজনের মুখের হাসিতে আলোকিত হয়ে যায়।
মাহি দুই ছেলের সঙ্গে ছবি তুলছে ।
: রুবা তুমিও আসো সেলফি তুলি!
: আমার কাছে দাও তোমাদের তিন বাপ বেটার ছবি তুলে দেই !
: তুমি এসো তুমি ছাড়া আমরা ইনকমপ্লিট রুবা ! আমাদের তিনজনের সব কিছু তুমি!
: ঠিক আছে ।
মাহি তিনজনকে নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটালো। ওর মনের মধ্যে দুইদিন ধরে যে কষ্ট ছিল ,বাচ্চাদের আর রুবার সঙ্গে কাটানো সময় টা সব কষ্ট ভুলিয়ে দিল ।
: রুবা থ্যাঙ্কস !
: থ্যাঙ্কস কেন , তোমার সন্তান তোমার কাছে এসেছে এর জন্য আমাকে থ্যাঙ্কস দেয়ার কিছুই নেই !
: তারপরও থ্যাঙ্কস কারণ তুমি আমার জীবনে ওদের এনেছো আমার জীবনটা সুন্দর করে দিয়েছো !
রুবা মাহির হাত ধরে বলল, তুমি কি করেছো, কি কি দিয়েছো জীবনে আমাকে সেই সব গুনতে বসলে আমার জীবন তো ফুরিয়ে যাবে বলা শেষ হবে না।
: তাহলে থাক দুজন‌ই না বলি চুপ ই থাকি !
: সেটাই ভালো ।
হাসছে দুজন।
যাও ওদের দাদির কাছে নিয়ে যাও ঘুমাবে ওরা!
: হুম।

রাতে মাহি ছাদে উঠে রুবাকে খবর পাঠালো ছাদে আসার জন্য !
বিকালে ছাদে আসতে চেয়েছিল রুবা । রুবার ইচ্ছে গুলো তার কাছে অনেক কিছু ! আগে দুজন ছাদে বসে কত গল্প করতো !
আজ বাহিরে বাতাস ও আছে ভালোই লাগছে বসতে ।
পিছনে পায়ের আওয়াজ শুনে তাকালো মাহি !
তাকিয়ে দেখে রুবা না দিশা দাঁড়িয়ে আছে !
: মাহি তুমি ছাদে কি করছো ?
: আমি ভেবেছি রুবা এসেছে !
: দিশা তুমি হঠাৎ ছাদে ?
: আমি তোমাদের ছাদে আসি তো বাসায় থাকলে ! বসতে পারি এখানে ?
: ও শিওর বসো ! মাহি হাত দিয়ে ইশারা করলো।
: তোমরা দুজন কি প্রায়ই ছাদে আসো নাকি মাহি ?
: একটা সময় আসতাম, রুবা কনসিভ করার পর সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা নিষেধ ছিল তাই আর এই ছাদে উঠে আসা হতো না ! পোর্চের ছাদ টা আমাদের প্রিয় জায়গা । বিয়ের পর থেকে ওখানে কত সময় কাটিয়েছি আমি আর রুবা !
রুবা আর তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে মাহি !
: তাই , থ্যাঙ্কস !
: আসলে আমি যে দেশে বড় হয়েছি সেখানে কে কাকে বিয়ে করবে সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত থাকে । হ্যাঁ আমরা যারা বাঙালি আমাদের বেড়ে উঠা র পরিবেশ যাই হোক ফ্যামিলি র আর বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত অনেক বড় ব্যাপার । তারপর ও তুমি চাচীর এক কথায় রুবাকে, তোমার ভাইয়ের উইডো কে বিয়ে করলে সেটাই আমাকে অনেক টা অবাক করেছে !

: অনেক কাহিনী ছিল দিশা এত কথা বলতে পারবো না তবে আমি সত্যিই মায়ের এক কথায় বিয়ে করেছি । আমি রুবাকে সুখী করতে ওকে ভালো রাখতে একটা নিরাপদ সুন্দর জীবন দিতে ওকে বিয়ে করেছি !
: আমি তো দেখছি তুমি ও অনেক হ্যাপি রুবার সঙ্গে !
: হ্যাঁ দিশা সুখী করতে গিয়ে আগে নিজেই সুখের সাগরে ভেসে গেছি ! হাসলো মাহি !
: কেন জানি জানতে ইচ্ছে করছে সেই গল্প টা মাহির !
: গল্প টা বিশেষ কিছু না ! ঐ যে বললাম আমি রুবাকে সুখী করতে চেয়েছি ! আমি রুবাকে সত্যি ই সুখী করতে চেয়েছি । তাই বিয়েটা যখন করেছি বিয়ের সম্পর্কে র মর্যাদা রাখার চেষ্টা করেছি।
দিশা বিয়ে দুটো মানুষ কে কাছে আনে ঠিকই কিন্তু এক করতে পারে না যদি দুটো মন এক হতে না চায় !
দিশা বলল, দুটো মন কখন এক হয় তোমার ধারনা প্রেম থাকলেই ?
: দুটো মন তখনই এক হয় যখন দুটো মানুষ সত্যিই চায় , চেষ্টা করে । আমি চেষ্টা করেছি । প্রেমে সহজেই পড়া যায় প্রেম আর ভালোবাসা এক জিনিস ও না।
আমি রুবাকে অর্জন করার চেষ্টা করিনি আমি রুবাকে জয় করার চেষ্টা করেছি !
: বাহ্ মাহি তুমি কত সুন্দর ভাবে জীবন টাকে দেখো ! রিলেশন জিনিস টাকে কত সুন্দর ভাবে গড়ে নিয়েছো। আচ্ছা একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছে ,কেউ কখনো ছিল না তোমার লাইফে আই মিন কারো সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা ?

মাহি দিশার দিকে তাকিয়ে হাসলো, ফ্যামিলির কেউ জানে না বিয়ের আগে আমি একজনের কাছে কমিটেড ছিলাম। ভালোবাসতাম !
: তারপর ? দিশা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
: মায়ের সিদ্ধান্ত কে সন্মান জানাতে গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম যদিও জানি না আজ‌ও সে ক্ষমা করেছে কিনা !
: সত্যি মাহি !
: হুম !
: রুবা জানত ?
: অনেক পরে জেনেছে ! ততদিনে আমি রুবাকে , রুবা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে !
: আগে বলো নি কেন ওকে ?
: সেই সুযোগ ছিল না আসলে আমার আর রুবার, বিয়েটা করা ছাড়া অপশন ছিল না ! বিয়েটা আমাদের করতেই হতো পরিস্থিতি তাই ছিল । সে জন্যই জানানোর তাগিদ ছিল না আর মেয়েটি আমার রিলেটিভ ।
জানাজানি হলে ও অপ্রস্তুত হতো সবার কাছে , রুবার কাছে।
: ওয়েট আমি কি দেখেছি প্রথম দিন ওকে ?
: হুম !
দিশা বলল, ডাক্তার কাজিন টা তোমার ?
: হুম কিভাবে বুঝলে ? মাহি এবার দিশার কথায় অবাক হয়ে গেল!
: ওর চোখে তোমার প্রতি একটা মুগ্ধতা এখনো আছে ! মাহি আমি বুঝেছিলাম কিছু একটা ! আমি ওর তোমার পাশে বসে গল্প করতে থাকার সময় ই বুঝতে পেরেছি ওর চোখে আজ‌ও অনেক কিছু রয়ে গেছে !
: আমি বিয়ের পর একটা সেকেন্ডের জন্য ওর প্রতি আগ্রহ নিজের ভেতরে তৈরি করিনি ! কারণ আমি রুবার প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি যদিও আমার আর রুবার মাঝে স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক ছিল না বিয়ের পর পর ।
: সেটাই তো স্বাভাবিক ! কবুল বলেই হাজব্যান্ড ওয়াইফ হয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতি তোমাদের ছিল না !
: হুঁ ! রুবা তখন‌ও ভাইয়ার শোকে দিশেহারা । ওর পুরো অস্তিত্ব জুড়ে ভাইয়া । জীবনে সব হারাতে হারাতে রুবার ভেতরে কিছু নিয়ে বাঁচার ইচ্ছে টাই হারিয়ে গিয়েছিল। আমি সেই পরিস্থিতি থেকে আমার সবকিছু দিয়ে রুবাকে বের করার চেষ্টা করেছি। ওর প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে
একদিন দেখি ওকেই আমি ভালোবেসে ফেলেছি!
: খুব সুন্দর মাহি !
: রুবার মাঝে একটা ব্যাপার আছে কি জানো ওকে খুব আপন মনে হয় । মা কে দেখেছো , রুবা আর মায়ের সম্পর্ক টা অন্য রকম । যে দেশে ব‌উ শ্বাশুড়ি র সম্পর্ক থাকে দা কুমড়া সেখানে মা আর রুবা বড় বেমানান। ওরা মা মেয়ে শুরু থেকেই ছিল। আমার আর রুবার বিয়ের পর তো মা রুবাকে বুকে আগলে রেখেছে।
: আমার‌ও ওকে অনেক সুইট লাগে মাহি !
: ওর সৌন্দর্যের চেয়েও ওর সিমপ্লিসিটি , ওর সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা , এক কথায় ও আমার মনের মত । ও একদিকে খুব শান্ত অন্য দিকে আবার কিছুটা পাগলামোয় ভরা । এমন একটা মানুষ যার মধ্যে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তীব্র মাহি হেসে বলল।
: সেই ক্ষমতা ই তোমাকে টেনে নিয়েছে মাহি ?
: হুম। অবস্থা এমন ছিল আমাদের ,ঐ যে থাকে না পাশের বাড়ির মেয়ে যাকে দূর থেকে দেখতে ভালো লাগে, ওকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তারপর আস্তে আস্তে গল্প হয় একটু একটু কাছে আসা হয় । দুজনেই বুঝি এক জনকে আরেকজন পছন্দ করি কিন্তু প্রকাশ করতে দ্বিধা , জড়তা । একদিন বলা হয়ে যায় ভালোবাসি তারপর প্রেম অতঃপর ভালোবাসা আর ভালোবাসা। মাহি হাসতে হাসতে বলল, আমাদের সম্পর্ক টা এভাবে তৈরি হয়েছে। ব‌উ এর সঙ্গে প্রেম করেছি তারপর ভালোবাসা !
: দারুন তো !
: সত্যি দারুন ছিল সব দিশা । ওর লজ্জা মাখা মুখ আমাকে লুকিয়ে দেখা , ওর নিঃশ্বাস এর দূরত্বে থেকেও আমি অনেক দূরের কেউ ছিলাম। ওর বুকের ধুকপুকানি শুনছি কিন্তু কাছে যাওয়া হতো না আমাদের কারো, এভাবেই কত রাত কত দিন পার হয়েছে।
ঐ যে বললাম অর্জন করতে চাইনি জয় করতে চেয়েছি । যখন ওকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করে ফেলেছি পুরোটা সেদিনই ওকে নিজের করেছি তার আগে না।
: তোমার তাহলে অনেক ধৈর্য্য মাহি!
: যার উপর শুধু আমার অধিকার তাকে নিয়ে আমার এত তাড়াহুড়া ছিল না আমি জানতাম ভালোবাসা যদি দিতে পারি একদিন ভালোবাসা ফেরত পাবোই ।
: খুব সুন্দর মাহি তোমাদের গল্প টা। কিন্তু কি জানো সব ভালোবাসর গল্প এত সুন্দর হয় না ! হাজার এফোর্ড দিলেও কোথাও না কোথাও কমতি থাকেই। দিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
: দীর্ঘ শ্বাস কেন দিশা তোমার গল্প টা কি সুন্দর না ?
: আমার গল্প মানে ?
: তোমার জীবনের গল্প টা ?
: ও আমার গল্পে সব ভুল আর ভুল! দীর্ঘ শ্বাস ফেলল দিশা।
: তাই নাকি , কিভাবে বুঝলে ?
: মানুষ সিলেকশন থেকে সকল সিদ্ধান্ত ছিল ভুল!
দিশা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো !
তারপর মাহির দিকে সিগারেট এর প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
আমি এই ছাদে আসতাম সিগারেট খেতে। একটাই বাজে অভ্যাস আমার ।
: দিশা আমি স্মোক করি ঠিক আছে কিন্তু কখনো কোন মেয়ের সঙ্গে বসে করা হয়নি !
: সমস্যা কি ?
: সমস্যা নেই , কিন্তু থাক তুমি খাও! দিশা সিগারেট জ্বালিয়ে বলা শুরু করলো
ফাহিম এর সঙ্গে আমার দেখা হয় আটলান্টায় একটা সেমিনারে !
ওর কথা শুনে , ওর পার্সোনালিটি দেখে বলতে গেলে ফাস্ট লুকেই প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু আমি ছিলাম ভাঙ্গব কিন্তু মচকাবো না টাইপের আমি কখনো প্রকাশ করিনি। ও শুধু আমার জন্য নিউইয়র্ক চলে আসে সব ছেড়ে ছুড়ে।
ওর ফ্যামিলি থাকতো নিউ মেক্সিকো তে । ও একটা মাল্টিন্যাশনাল এ জব করতো। নিউইয়র্কে এসে সোজা আমাকে প্রোপোজ করে বসে, আমি এমন ভাব করেছি যেন আমি আসলে এমন কিছু হোক চাইনি। কিছুদিন ওকে ঘুরালাম যাকে বলে নাকে দড়ি দিয়ে ।
একটা সময় ওর প্রোপোজাল একসেপ্ট করলাম । দুই ফ্যামিলি কে নিয়ে বিয়ে হয়ে গেল। আমি চলে গেলাম আটলান্টায়। সেখানে সংসার।
: ভুল টা হলো কোথায় দিশা ?
: ও ছিল ট্রিপিক্যাল সংসার করা টাইপের ছেলে আমি ছিলাম মুক্ত পাখি । তাই আমাদের অমিল টা খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে গেল একেঅপরের কাছে। যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি অলরেডি প্রেগন্যান্ট। ও খুশিতে আটখানা আমি দুঃখে শেষ হয়ে যাচ্ছি কি হলো এটা!
মাহি আমার বারবার মনে হচ্ছিল, ভুলের ডালে ভুল‌ই ধরে ফুল ফোটানো যায় না ! বাচ্চা টাও ভুলের ফলাফল। চাইলাম এবোরশন করাতে কিন্তু কেউ দিল না । শুরু হলো অশান্তি।
: তারপর ?
: মেয়ের মা হলাম । মেয়ের কথা ভেবে সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাইলাম । কিন্তু আমার স্বাধীন জীবন টা আরো বেশি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল । ফাহিম মেয়ে কে নিয়ে আহ্লাদ করে আমি জব ছেড়ে ঘরে বসে বসে ডিপ্রেশন এ ভুগি । একটা সময় হাঁপিয়ে গেলাম। চলে এলাম নিউইয়র্ক। মেয়েকে ছাড়া ফাহিম থাকতে পারছিল না ও মেয়ের জন্য নিউইয়র্ক এ এসে পড়ে রইলো। কোন ভাবেই ম্যাচ হচ্ছিল না আমাদের । সেপারেশন টাই টিকে গেল আমরা পথ টা বদলে ফেললাম। এই আমার কাহিনী মাহি !
: ডিভোর্স ?
: এখনো ফাইনাল হয়নি তবে হয়ে যাবে এবার।
: মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, সম্পর্ক গড়া , ভেঙ্গে ফেলা সহজ টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করতে হয় দিশা তোমার গল্প যতটুকু শুনলাম তুমি মনে হয় চেষ্টা টাই করো নি ! তুমি অতি সহজেই ধরেই নিয়েছো‌ তোমরা মিসম্যাচ ! তুমি বিয়েটা যে একটা বন্ধন সেটাই মানতে চাও নি, নাকি ভেবেছিলে কোর্টশিপ এর মত একদিন ইচ্ছে হলো হিসাব চুকটা করে আল্লাহ হাফেজ দিয়ে চলে আসা হলো বিয়ে ?
: আমি সংসার টা এনজয় করতে চেয়েছিলাম মাহি !
: কিন্তু কিভাবে , সংসারের ভেতরে থেকেই তো সংসার টাকে এনজয় করতে হয় দূরে গিয়ে তো না ?
আচ্ছা এখন বলো সব তো চুকিয়ে দিলে সুখী আছো তো ? মাহি প্রশ্ন করলো।
: মানে ?
: মানে হলো সংসার থেকে বের হয়ে এসে মুক্ত জীবন তোমার ,তুমি কি পুরোপুরি সুখী ?
: মাহি মানুষের জীবন পানির মধ্যে কাটা দাগ না যে একটু পর সেখানে আর কোন চিহ্ন থাকবে না । আছে ভুলের চিহ্ন বয়ে নিয়ে যেতে হয় জীবন ভর । ফ্যামিলি র কথা শুনতে হয় । মেয়ে কখনো আমার কাছে কখনো তার বাবার কাছে তার এই ভাগাভাগির জীবন টা দেখে কষ্ট পেতে হয় ।
: একটা কথা জিজ্ঞাসা করব দিশা , সংসার সন্তান নিয়ে মায়ায় বাঁধা পড়োনি তুমি ?
: মায়া টাই হয়তো ছিল না মাহি !
: কি বলো আমার তো সবকিছুতেই মায়া পড়ে । রুবার খোঁপার বাসি বেলী ফুলের মালাটা যখন টেবিলে পড়ে থাকে সেটাতে মায়া পড়ে, ওর টিপ গুলো যখন আয়নায় লাগানো থাকে আমার দেখতেও মায়া লাগে , ও কে ছাড়া জীবনের একটা মুহূর্ত স্বপ্নে ভাবতেও বুক কাঁপে দিশা । সংসার মানেই তো চারদিকে মায়া! সন্তানের মুখে মায়া , হাসিতে মায়া !
দিশা অবাক হয়ে বলল,আমাদের কি তাহলে ভালোবাসা ই হয়নি কখনো ?
: জানি না চিন্তা করে বের করো দিশা ! সম্পর্ক টা এত সহজে শেষ করে দেয়ার আগে চিন্তা করতে পারতে !
: মাহি একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ?
: হুম!
: যদি শিহাব সাম হাউ তোমাদের বিয়ের পর কিংবা এখন ফিরে আসে কি হতো বা হবে ?
: মাহি এরকম প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না দিশার কাছ থেকে ! সে অন্য দিকে তাকালো ।
: সরি মাহি এমনি প্রশ্ন টা করলাম ! কিছু মনে করো না !
মাহি দিশার সিগারেট এর প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো ! একটা টান দিয়ে শূন্যে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
: দিশা সে রকম সম্ভাবনা সেন্ট পার্সেন্ট ও নেই কারণ এটা বাস্তব জীবন কোন মুভি না । আর ভাইয়া ফ্লাইটে বসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে । সে যাই হোক তোমার প্রশ্নের উত্তর দেই ,ভাইয়া আসে যদি তাহলে ভাইয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আমার কিছু নেই । ভাইয়া যেখানে রুবাকে রেখে গেছে , আমি রুবাকে তার থেকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছি এখান থেকে আমার বা রুবার ফেরত যাওয়ার উপায় নেই । কখনোই না কোন ভাবেই না !
: মাহি রুবাকে খুব ভালোবাসো তুমি তাই না ?
: দিশা রুবা আমার জীবন , আমার আনন্দ, আমার বেঁচে থাকার অর্থ । পৃথিবীর কারো জন্য আমি রুবাকে সেক্রিফাইস করতে পারব না। আমার প্রিয় ভাইয়ের জন্যেও না । রুবার বেলায় আমি খুব স্বার্থপর ! আমাদের দুটো সন্তান আছে ওদের জন্য রুবার জন্য ই আমার জীবনটা এখন সুন্দর।
: তোমাদের দেখে আমার হিংসা হচ্ছে মাহি !
: মাহি হেসে উঠলো, চেষ্টা এখনো কিছু করলে তোমার জীবনটা কি সুন্দর হয় না দিশা , ডিভোর্স তো হয়নি এখনও ? ফাহিম তোমাকে কি ভালোবাসে না ?
: জানি না মাহি দিশা আবার সিগারেট জ্বালালো !
: আমার মনে হচ্ছে তুমি খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলে দিশা !
: আমার‌ও তাই মনে হয় !
: একবার চেষ্টা করে দেখতে পারতে দিশা !

মাহি হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখে মাহি দিশার পিছনে দূরে রুবা
দাঁড়িয়ে আছে ও দেখার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দৌড় দিয়ে নিচে নেমে গেল !
এত তাড়াতাড়ি হলো ঘটনাটা মাহি কিছু বলার বা ডাকার কোন সুযোগ ই পেলো না !
কি হলো এটা ? ও কি রাগ করলো নাকি ? আশ্চর্য ! মাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পিছনে !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here