🌺#বসন্তের_ফুল🌺
#তারিন_জান্নাত
#পার্ট২৪
নদীর পাড়ে লাল রঙের শাড়ি পরিহিতা এক মেয়ে হাঁটছে দিশাহীনভাবে ।খোঁপা করা চুলের চারপাশে ফুলের মালা পেঁছানো।
গলায়,হাতে,এবং কোমড়েও ফুলের গহনা। লাল রঙে রাঙানো ঠোঁটজোড়া। শাড়ির লম্বা আঁচল মাটি ছুঁই ছুই।
মনে হচ্ছে যেনো সদ্য ফুটন্ত ফুল।
চোখের পাঁপড়ি ঘনঘন নেড়ে অভ্রের দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে আসছে সেই ফুলকন্যা।
উঁহু ফুলকন্যা নহে এই যে অভ্রের ফুলরানী।
বুকে বাম পাশে হাত দিয়ে অপলক চেয়ে আছে অভ্র তার ফুলরানীর দিকে।ঠোঁটে লেগে আছে কিঞ্চিৎ মৃদু হাসি। হাসিরও পরিবর্তন ঘটছে।প্রেমা যতই অভ্রের দিকে এগোচ্ছে ততই যেনো অভ্র বুকের অস্বাভাবিক ধুকপুকানিতে নিজেকে হারাচ্ছে।এ অনুভূতির শুরু আছে শেষ নেই।ভাষাশূন্যতায় ভোগে অভ্র।ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে কিছু শব্দ উচ্চারণ করে বাক্যে রুপান্ত করার চেষ্টায় পদার্পন করবে,
ওমনি এক পশলা স্নিগ্ধ টিপটিপে বৃষ্টির আগমন।
গগনের বুক ছিড়ে পরা ঝুম বৃষ্টিতে
ভিজে যাচ্ছে ‘প্রেমাভ্র’!
আহ! এমন বৃষ্টিতে মরনও সহে।
আচমকা একটা বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অভ্রের।
ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে চারপাশে তাঁকাতে শুরু করে। নিজেকে মাতাল লাগছে।কি হচ্ছিলো এতোক্ষণ।কোথায় ছিলো সে?? স্বপ্নে??
“উপ! স্বপ্ন এতো সুন্দর হয় জানা ছিলো না।(অভ্র)
” এই অভ্র কি বিড়বিড় করছিস?(অভ্রের নানি)
ধুম করে অভ্রের স্বাভাবিক দুনিয়াই ফিরে আসে। এতোক্ষণ কোন জাহানে ছিলো তা সে নিজেও জানে না।কিন্তু চোখেমুখে পানির স্পর্শত অনুভব করে সচকিত হয়। কি হচ্ছে তার সাথে।
নানির কথার উত্তর না দিয়ে অভ্র গলা টেনে পেঁছনে তাঁকায়।দেখে প্রেমা হাতে জগ নিয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাঁকিয়ে আছে।
এবার অভ্রের কাশি উঠে যায়।এতোক্ষণ যে বৃষ্টির পানিতে ভিজছিলো সেটা বৃষ্টির পানি ছিলোনা জগের পানি ছিলো।
নিভু স্বরে অভ্রে জিজ্ঞেস করে,
“কয়টা বাজে??
” সকাল নয়টা চল্লিশ!(প্রেমা)
“ওহ,নানি আরো আগে ডাক দিতে পারো নাই,আমি
নয়টা অবধি কোনোদিন ঘুমিয়েছি।আজই প্রথম ছিলো।
প্রেমা দাঁত চেপে বলে উঠে,
” জ্বি আপনাকে সকাল আটটা থেকে আমরা বিরতিহীন ভাবে ডেকে গিয়েছি।আপনি তো বেহুস ছিলেন!
“ওহ ‘ বলে চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াসরুমে চলে যায়।কোনো কথা বলার কিঞ্চিৎ পরিমাণ ইচ্ছে ও নেই তার।মাথাটা কেমন খালি খালি হয়ে আছে।
ওয়াসরুমে গিয়ে জোরে একটা লাথি মারে দরজায়।
” কি হতো আর কতক্ষণ স্বপ্নে থাকতাম! পুরাই মাটি করে দিলো,ধ্যাত!(অভ্র)
“কি হয়েছে অভ্র পরে গেলে নাকি?(প্রেমা)
প্রেমার কথা অভ্রের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও নিরুত্তরে সে হাতমুখ ধোয়াই মনোনিবেশ করে।রাগ হচ্ছে প্রেমা আর তার নানির উপরে বিষণ।
ফ্রেস হয়ে বের হয়ে ধরাম করে দরজাটা লাগায়।যেনো সব দোষ দরজার।তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে চোখ যায় বিছানার দিকে।দেখে প্রমা দুগালে হাত দিয়ে চোখের পলক প্রায়শই নাড়িয়ে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে।অভ্রের হাবভাব কেমন অদ্ভুত লাগছে প্রেমার।তাই পাহারা দিতে এসেছে।
” তুমি?(অভ্রের মৃদু স্বরের প্রশ্ন)
“আমি’ হ্যাঁ আমিই,চলো নাস্তা করবো।(প্রেমা)
” তুমি এতক্ষণে হলো তাও নাস্তা করোনি কেন?(হালক ধমক দিয়ে বলে অভ্র)
“ক্ষিদে পায়নি তাই” (প্রেমা)
“পায়নি কেন??” (অভ্র)
“জানিনা! চলো,
অভ্র আর কথা আগায়নি।মৌনতার সহে
প্রেমার আগে রুম ত্যাগ করে।
নাস্তার পর অভ্রকে তাড়া দিচ্ছিলো প্রেমা চলে যাওয়ার জন্য।কিন্তু অভ্রের নানি জানালো অভ্রের মা-দাদিরা আসবেন আজ।তাই এখন আর যাওয়া হচ্ছেনা।
বাধ্য হয়ে প্রেমা চুপচাপ সোফায় বসে থাকে।আর অভ্র টিবিতে নিউস দেখতে বসে। অভ্র টিবির সামনে বসে থাকলেও,অভ্রের মনে অন্যসব ভাবনার বিচরণ।হঠাৎ মনে পড়ে আগামী কাল শুক্রবার।
প্রেমাকে বলে ছিলো শুক্রবারে ওর গিপ্টটা দিবে।
তারমানে হাতে সময় আছে একদিন।
হুট করে মস্তিষ্কে একটা কথার আগমন ঘটে।সাথে সাথে ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে মৃদু আমোদিত কন্ঠে অভ্র বলে উঠে, প্রেমা আর অভ্র অর্থাৎ “প্রেমাভ্র”
চমৎকারতো!
“প্রেমা,
” হু” বলো(ফোনের দিকে তাঁকিয়ে)
প্রেমার এই অভ্যাসে অভ্র টোটাল বিরক্ত,ফোন ঘাটা,
“পাশে পদ্মবিল আছে যাবে,(অভ্র)
অভ্রের কথায় পিলে চমকায় প্রেমা,সে ভাবছে,
অভ্র ওকে এমন এমন অতুলনীয় জিনিস দেখিয়েছে,যা
সে কখনো ভুলতে পারবেনা।আনন্দিত হয়ে প্রেমা বলে,
” যাবো মানে অবশ্যই যাবো,(প্রেমা)
প্রেমার আনন্দিত কন্ঠ শুনে অভ্র গভীর একটা নিঃশ্বাস নেয়। আপাততে সে প্রেমাকে সব রকমের আনন্দের সাথে পরিচয় করাতে চাই।যতটুকু সম্ভব।
“চলো,হেঁটে যেতে হবে কিন্তু,(অভ্র)
” সমস্যা নেই,
তখনি স্বপ্না এসে ওদের মাঝে উপস্থিত হয়।
স্বপ্নাকে দেখে প্রেমা অভ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
“অভ্র স্বপ্নাকেও আমাদের সাথে নিয়ে চলো,(প্রেমা)
” না না আপু,আমার কাজ আছে,আমি যাবো না,তাছাড়া দাদিমণি একা,(স্বপ্না)
“ওহ,আচ্ছা ঠিক আছে,
প্রেমা রুমে গিয়ে চুলে খোঁপা করে কাটা দিয়ে আটকায়।
কাপড় পাল্টায় নি,অভ্র ও নিজের রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নেয়।বেশিরভাগ সময় অভ্র এখানেই থাকতো,তাই ওর কাপড় চোপড় ও রয়েছে এখানে।
প্রেমা বের হতেই অভ্রকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাঁকায়।
” আরে,একি রানকাটা প্যান্ট পরেছো কেন তুমি?(প্রেমা)
প্রেমার কথায় অভ্র হাসে,
“এমনি পরলাম,কেন খারাপ লাগছে নাকি?(অভ্র)
” না না, তবে অন্যরকম লাগছে,(মিষ্টি হেসে বলে প্রেমা)
অতঃপর দুজনে একসাথে বের হয়ে যায়।বাড়ির পেঁছনে বড় একটা খালি জায়গা রয়েছে।সে জায়গাটা পেরুতেই মাটির সরু রাস্তা দেখা যায়,দু’পাশে ঘন জঙ্গল,গাছপালাও প্রচুর,সঙ্গে প্রাণজুরানো বাতাস।
রোদ উঠলেও গাছপালার জন্য ওরা রোদের সংস্পর্শে আসেনি।
প্রায় অনেক্ষণ হাঁটে তবে তা নিরবতার সহে।এবার প্রেমার আর চুপ থাকতে পারছে না,মনের মধ্যে একটা কথা কিলবিল করছিলো, তাই অভ্রকে জিজ্ঞেস করে ফেলে,
” বলছি অভ্র একটা কথা জানার ছিলো?(প্রেমা)
অভ্র হাঁটা থামায়,প্রেমার দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“কী?? (অভ্র)
” আসলে,তোমার আর আদ্রের চেহারা একরকম।কিন্তু তোমাদের মতো চেহারার সাথে কারো মিল নেই,আন্টি আর আংকেলের চেহারার সাথেও মিল নেই??, তুমি মাইন্ড করো না প্লিজ, আমি নিজের কৌতূহল আটকাতে পারি না, তাই..(প্রেমা)
প্রেমা কথাগুলো বলে অভ্রের দিকে তাঁকায়,দেখে অভ্র নিজের হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে,এরপর নত অবস্থায় মলিন হাসে,কিন্তু প্রেমার দিকে তাঁকায়নি।
“জানি না আমিও,(কথাটা বলেই আগে হাঁটতে লাগে)
” ওহ,কিন্তু তোমরা দু’জনেই কিউট।(প্রেমা)
“মুচকি হাসে,প্রেমার দিকে তাঁকিয়ে অভ্র,
তারপর আবারও হাঁটায় মন দেয়।
চোখের পানি টলমল করছে অভ্রের,কাঁদতে পারলে হয়তো শান্তি পেতো,কিন্তু ছেলেদের যে কাঁদতে নেয়।
পকেট থেকে টিস্যু নিয়ে প্রেমার অগোচরে চোখজোড়া মুছে ফেলে অভ্র,
” আর যাইহোক,এ ভুল আর দ্বিতীয়বার যাতে ফেস করতে না হয় সেই প্রচেষ্টায় থাকবো।(মনেমনে অভ্র বলে কথাটা)
কপালের রগ কিছুক্ষণ পরপর ফুলছে অভ্রের।কারো প্রতি তীব্র ঘৃনার ফলেই এমনটা হচ্ছে।আর যায় হোক ভালোবাসা নামক শব্দটার কোনো মূল্য অভ্রের কাছে নেই।ওর কাছে সবার উর্ধে নিজের অনুভূতি।
কয়জনেই বা ভালোবাসা এবং অনুভূতির পার্থক্য বুঝে,একটু ভলো লাগলেই ভালোবাসা হয়ে যায়।এটা কেমন লজিক?
“আমার অনুভূতির ব্যাখ্যা আপাততে আমি নিজের মধ্যেই পুষে রাখছি,সঠিক সময়ে তার ব্যাখ্যাও দিয়ে দিবো।(অভ্রের নিজ মনের কথা)
অবশেষে পদ্মবিলে এসে পৌঁছায় তাঁরা।পুরোটা বিল জুড়েই বড় বড় ঘন সবুজ পাতা,তারমধ্যখানেই লম্বা লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মফুল,বিশাল বড় কোনো বিল নয়,ছোটখাটো, তবে সুন্দর্য্যে ভরপুর।
মাঝে মাঝে কিছু সাদা বক উড়ে আসে,আবার চলে যায়। খুশী হয়ে চারপাশে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে প্রেমা। সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে তার।অভ্র ওকে যা দেখাই তা-ই দেখে প্রেমা বিমোহিত হয়ে যায়।
” পদ্মবিলের আসল সৌন্দর্য্য উপভোগ্য হয় মেঘলা দিনে।সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি,বিশ্বাস করো এখানে আসলে আর যেতে ইচ্ছে করবে না তখন।,(অভ্র)
আমারতো এখনো যেতে ইচ্ছে করছে না।কি সুন্দর!(প্রেমা)
প্রেমার কথার ফাঁকে অভ্র হাত টেনে কয়েকটা পদ্মফুল ছিড়ে প্রেমার হাতে দেয়।ব্যস,প্রেমার এবার ফুল নিয়ে নানা স্টাইলে পুজ দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে দেয়।প্রেমার কান্ডে অভ্র না হেসে পারে না,হেসেই দেয়।
_________
বাড়ি ফেরার পর দেখে অভ্রের মা বাবা সবাই চলে এসেছে।বিয়ে থেকে হুট করে চলে আসার কারনে তেমন জবাবদিহি করতে হয়নি তাদের।
প্রিয়া আর আদ্র প্রেমার সামনে মুখ ভাড় করে বসে আছে।কারন একটায়,ওদের না নিয়ে প্রেমার একা চলে এসেছে,
প্রেমা ওদের বুঝাতে বুঝাতে হাঁপিয়ে উঠে,তাই রাগ করার বান করে চলে আসে রুম থেকে।
আশেপাশে তাকিয়ে অভ্রকে খুঁজে নেয় প্রেমা।পরে মুচকি হেসে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।কারন ছাদেই অভ্রকে পাওয়া যায়।
ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে অভ্র ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো।প্রেমাকে দেখতেই ফোন কেটে দেয়।
“তোমার জন্য প্রিয়া-আদ্র আমার সাথে রেগে আছে,
” আমি কি করেছি,(অভ্র)
“আমাদের সঙ্গে আনিনি বলেই ক্ষেপে আছে,(প্রেমা)
” না এনে ঠিক করেছি,যদি কালকের ছেলেগুলো ওদের কিছু করতো,তাহলে??(অভ্র)
অভ্রের কথায় প্রেমার বুক ধক করে উঠে,আসলেই প্রেমার মনেই ছিলোনা।যাক যা হয় ভালোর জন্য হয়।
প্রেমা চুপচাপ চলে আসার জন্য পা বাড়ায়,
“প্রেমা শুনো,(অভ্র)
” হু’ কিছু বলবা?(প্রেমা)
“কাল শুক্রবার! (অভ্র)
” হ্যাঁ,তো??(প্রেমা)
“গিপ্টের কথা ভুলে গিয়েছো নাকি?(অভ্র)
” আরেহ! মনেই ছিলো না,(প্রেমা)
“কাল সময় হবে বের হওয়ার জন্য? (অভ্র)
“কাল তো আমরা চলে যাবো,আমাদের বাড়িতে,(প্রেমা)
” কি বলো, কে বলেছে? কয়দিন হলো আসছো?একসপ্তাহ ও হয়নি,(অভ্র উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে)
“আসলে, আমার ভালো লাগছিলোনা তাই,দাদি থাকবে আমি আর প্রিয়া চলে যাবো,(প্রেমা)
প্রেমার কথা শেষ হলেই অভ্র পুরো কথা না শুনেই ধপাধপ পা চালিয়ে নেমে যায়।যাওয়ার সময় ধরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
প্রেমা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কি হয়েছে মাথায় ঢুকছে না তার।
সব ভুলে প্রেমাও হাঁটা শুরু করে অভ্রের পেঁছন পেঁছন।
(চলবে)Tarin Jannat