#বসন্তের_ফুল🌺🌺
#তারিন_জান্নাত
#পার্ট৩৪
আজ বৃহস্পতিবার। প্রেমা আর আরিয়ানের গায়ে হলুদ এবং মেহেদির অনুষ্ঠান।আরিয়ানের ইচ্ছে দু’পরিবারের অনুষ্ঠান একসাথে করবে। কিন্তু প্রেমা তাতে ইচ্ছুক নয়। প্রেমা চাইছিলো ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠান হোক। যাতে বাইরের কেউ থাকবে না।দু’পরিবারের লোকজন, গনিষ্ঠ আত্মীয় এবং বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠান হবে নয়তো প্রেমা এ বিয়ে করবেনা।সাফ জানিয়ে দেয়। সবাই প্রেমার হঠাৎ গম্ভীরমুখে বলা কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যায়।চূরান্ত সিদ্ধান্ত হয় দু’পরিবার মিলে গায়ে হলুদ এবং বিয়ের অনুষ্ঠান হবে এবং তা আরিয়ানদের বাড়িতে।
এরমধ্যে প্রেমা আর কিছু বলেনি।বলার ইচ্ছেও নেই এ মুহুর্তে তার। বিকেলের দিকে প্রেমাদের পরিবার সবাই ও’বাড়ি যাবে।আর প্রেমা আর নাতাশা যাবে পার্লারে।
বদ্ধ ঘরে বসে ভাবনায় মগ্ন প্রেমা।কাল যদি বিয়েটা হয়ে যায় তাহলে এরপর থেকে সম্পূর্ণরুপে আরিয়ানের স্ত্রী হয়ে যাবে।কিন্তু প্রেমা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।আবার বাড়ি থেকেও পালাতে পারছেনা। মানসম্মান হারাবে আবারও। শেষ আশাতে ছিলো অভ্র।তাতেও জল ঢেলে দিয়েছে অভ্র।’দেবর’ নামক ট্যাগ লাগিয়ে।
নিজ বারান্দায় গিয়ে ফুলগুলোর দিকে একবার নজর দেয় প্রেমা। সবচেয়ে অপছন্দের ফুল ও আজ ওর জন্য সহস্র অনুভূতির প্রাসাদ তৈরির মাধ্যম। প্রতিটা ফুলের রঙে নিজের অনুভূতিগুলোর মিলন ঘটাতে মন চাচ্ছে তার। কিন্তু এই ফুলের প্রতি অনুভূতি জন্মানো সেই ব্যক্তিই আজ স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে। পুরনো সব জমানো কথার ঝুড়ি খুলে আজ কোনো কথায় খোঁজে পাচ্ছেনা প্রেমা। অথচ একসয়ম মনের মধ্যে হাজারো কথার জমিয়ে রেখেছিলো বলার জন্য।যা বৃষ্টির মতো করে জড়াবে ভেবেছিলো। আজ সব মাটি।সব বৃথা।
কী আশ্চর্য। এতো সবকিছুর মাঝে প্রেমার চোখে অভ্রের বয়সটা চোখে পড়ছেনা। এক বছরের ছোট।এটা কোনো ব্যপার না। এমন সব ভাবনা প্রেমার মন কোটরে। না সমাজ,না পরিবার কারো কথা সে মানবে না। অভ্রকে ওর চাই-ই চাই। চোখমুখ শক্ত করে ফেলে।
দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখজোড়া মুছে নেয় প্রেমা। সর্দি লেগে গিয়েছে। অতিরিক্ত কান্নার কারণে। সকাল থেকে কিছু খায়নি প্রেমা। পেট খালি তবুও খাওয়ার সামান্যতম রুচিও নেই তার। এখন দুপুরের খাবার না খেলে রাতের অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেনা।তখন স্টেজের বদলে বেডে শুয়ে থাকতে হবে।
গোসল সেরে খাবারের জন্য বের হয়।প্রেমার মা মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। মেয়ে পরের বাড়ি চল যাবে। ভাবতেই উনার চোখমুখ ও ভিজে আসছেন। কপালে চুমু দিয়ে খাওয়ানোতে মনোযোগ দেন উনি।
বিকেলের দিকে প্রেমা আর নাতাশা পার্লারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সাথে প্রিয়াও।
_____________________
উপরে কোণায় দাঁড়িয়ে বাড়ির ডেকোরেশন দেখতে ব্যস্ত আদ্র। কিছুক্ষণ পর পর গেইটের দিকে উঁকি মারছে।আবার গাল ফুলিয়ে সবার কাজকর্ম ভালোভাবে পর্যনেক্ষণ করছে।রাগ উপচে পরছে আদ্রেরও। প্রেমার বিয়ে আরিয়ানের সাথে হোক মনেপ্রাণে চাইছে না সে৷ প্রেমার বিয়ে হলে ওদের বাড়িতে আসবে এতে ওরই লাভ হতো।কিন্তু তাতেও নারাজ সে।
অভ্র কিছুক্ষণ অাদ্রের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।পরে অল্প হেসে আদ্রের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অভ্রের উপস্থিতি আদ্র ঠাওর করতে পারেনি। মুখ ভাড় করে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।তাই ফিসফিস শব্দে জিজ্ঞাসু স্বরে বলে উঠে,
“কী করছিস?(অভ্র)
” আমার বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি।(আদ্র)
হঠাৎ আদ্রের কথায় অভ্রে চমকে কেশে উঠে।কাশির শব্দে আদ্রও চমকে পাশে তাকায়।অভ্র দেখে চুপসে যায়।তখন কথাটা আনমনে বলে ফেলেছে।অভ্রকে এ মুহুর্তে আশা করেনি।অভ্র নিজেকে সামলায়।
” কার অপেক্ষা বললি?(অভ্র)
“ইয়ে মানে,ভাইয়ার বউয়ের।(আদ্র)
আদ্রের কথায় অভ্র বাঁকা চোখে তাকায়।এরপর রাগত্ব স্বরে বলতে শুরু করে, ” আমি শুনেছি, আর মিথ্যে বলিস না। পাঁকনামি বেশি হচ্ছে।আজ যেহেতু বাড়িতে অনুষ্ঠান তাই ছাড় দিলাম। নেক্সট টাইম যাতে এসব না শুনি।
অভ্রের কথায় আদ্র বিড়বিড় করে বলে ” কতো ভালো ভাগ্য,ছাড় দিয়েছো। ”
“কিছু বলেছিস? (অভ্র)
” ডেকোরেশন ভালো হচ্ছে। (ক্লোজআপ হাসি দিয়ে বলে আদ্র)
অভ্র আদ্রের কথা শুনে একবার আশেপাশে তাঁকায়।এরপর হাতে থাকে প্যাকেটটির দিকে একবার চোখ দেয়।এরপর আদ্রের দিকে তাঁকায়। এরপর বলে;
“চলকেল খাবি? (অভ্র)
আদ্র ভ্রু-জোরা কুঁচকে বলে,
” হঠাৎ এই প্রস্তাব? কি করতে হবে সোজা বলে দাও। আজ চকলেট খাওয়ার মোড নেই। (আদ্র)
আদ্রের কথা শুনে অভ্রে হেসে দেয়।
হাসিখুশী আরিয়ানকে দেখে বন্ধুরা রীতিমতো বউ পাগলা বলে উপাধি দেয়।হাসি-তামাশায় মশগুল উভয়ে। আরিয়ান আশেপাশে তাকিয়ে অভ্রকে খোঁজছে।সবকিছুর ক্রেডিট অভ্রের।যাকে বারবার কৃতজ্ঞ জানলেও কম হয়ে যাবে আরিয়ানের ধারনা। তাই বন্ধুদের রেখে আরিয়ান অভ্রের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। দরজা মেলে অভ্রের রুমে প্রবেশ করে। পরিপক্ক রুম দেখে আবারও একটা হাসি দেয়। অভ্রকে না দেখে চলে আসার জন্য পেঁছন ফিরে।তখনি অভ্রের কন্ঠ শুনে আরিয়ান।
“কিছু বলবে? (অভ্র)
চেয়ারা তাওয়াল মেলে দিতে দিতে বলে,আরিয়ান অভ্রের দিকে ফিরে একটা হাসি দেয়।যা দেখে অভ্র একটা বিরক্তির শ্বাস ছাড়ে।
” হ্যাঁ, কিছু বলার ছিলো তাইতো আসলাম।(আরিয়ান)
“বলো। ( শার্ট পড়তে পড়তে বলে অভ্র)
” তোকে আরো একবার ধন্যবাদ জানাতে চাই।তুই সেদিন প্রেমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিস বলেইতো আমি আজ প্রেমাকে বিয়ে করতে পারছি। তুই না চাইলে কিন্তু এমনটা কোনোদিন ও হতো না।(আরিয়ান)
শার্টের বোতাম লাগানোর পর পার্ফিউম দিতে দিতে আরিয়ানের দিকে ফিরে অভ্র। পার্ফিউম দেওয়া শেষ করে পার্ফিউমটা বেডে ছুড়ে মারে। আকস্মিক ভাবে পার্ফিউমটা বেডে ছুড়ে মারার কারণটা আরিয়ানের অজানা।তবে আচরণটা ওর কাছে অদ্ভুদ মনে হয়েছে।
অভ্র মৃদু হেসে জবাবে বলে,
“স্বাগতম! (অভ্র)
আরিয়ানও হেসে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে। বেচারা খুশীতে পাগল পাগল অবস্থা।অভ্র আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরেনি। কিছুক্ষণ পর আরিয়ান ছেড়ে দেয় এরপর বলে,
” দেখিস তুইও তোর মনের মানুষটাকে পাবি আসি। (আরিয়ান)
আরিয়ান কথাটা বলে হেসে চলে যায়। অভ্র কিছুক্ষণ আরিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।এরপর সামনে কপালে ল্যপ্টে থাকা চুল হাত দিয়ে উপরের দিকে ঠেলে দেয়।এরপর বলে,
” দেখা যাক। তবে তোমার হাসিমাখা মুখ দেখলে আফসোস হয় আমার।বিষণ আফসোস।(অভ্র)
_____________________
প্রেমার গায়ে হলুদের লেহেঙ্গাটা খুলে নাতাশা অবাক হয়ে যায়। চোখমুখ কুঁচকে লেহেঙ্গাটার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেমা তখনো ড্রেস চেঞ্জ করেনি।
“প্রেমু আমার ফোনটা দেতো? (নাতাশা)
” কেন? (প্রেমা)
” আরে দেখনা এটা অন্য লেহেঙ্গা, কাল যখন আন্টি লেহেঙ্গা নিয়েছিলো তোর জন্য আমি তখন উনার সাথেই ছিলাম।তোর জন্য যে লেহেঙ্গা নিয়েছিলো সেটা হলুদ রঙের ছিলো।আর এটা দেখ গাঢ় সবুজ রঙের।(নাতাশা)
প্রেমা আর কথা না বলে চুপচাপ ফোনটা এগিয়ে দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।(নাতাশা)
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, মা কিছু বলবে?(আরিয়ানের মা)
“জ্বি! আন্টি বলছি লেহেঙ্গাটা…
” হ্যাঁ লেহেঙ্গা যেটা পাঠিয়েছি সেটা প্রেমার জন্য।তোমরা তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি এখন ফোন রাখছি।(আরিয়ানের মা)
নাতাশাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আরিয়ানের মা ফোন রেখে দেয়।কারণ উনি এখন প্রচুর ব্যস্ত।
নাতাশাও ফোনটা রেখে লেহেঙ্গাটা প্রেমাকে পড়তে দেয়।
_____________
দু’পরিবার, গনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন,এবং বন্ধুরা সবাই মিলে বেশ রমরমা পরিবেশ। অতিরিক্ত মেহমান না।তবুও হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে সকলে। ছেলের বিয়েতে সবকিছু পার্ফেক্ট হওয়া চাই আরিয়ানের মায়ের।
ঘড়িতে রাত আটটা। প্রেমারা পার্লার থেকে চলে আসে।
আরিয়ানের মা এবং অভ্রের প্রেমাকে নিতে আসে।দৃঢ় পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে প্রেমা।মনের মধ্যে হাজারো ভয় এবং উত্তেজনা কাজ করছে তার।আরিয়ানের মা হঠাৎ প্রেমাকে দেখে ক্ষণিকটা রেগে যান।
“আরে এ লেহেঙ্গা পড়েছো কেন? আমি তো এমন লেহেঙ্গা প্রেমার জন্য নেয়নি।(আরিয়ানের মা)
” আন্টি কি বলছেন,আপনিই তো বলেছিলেন এ লেহেঙ্গাটা ওর জন্য পাঠিয়েছিলেন। (নাতাশা)
“আমি হলুদ লেহেঙ্গা পাঠিয়েছিলাম।এটা সবুজ আর আর সোনালি রঙের।হলুদ রঙের লেহেঙ্গাটা কোথায়?(নাতাশা)
” আন্টি ড্রাইভাট আংকেল এটাই দিয়েছেন।তাইতো আমি আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম।(নাতাশা)
“দেখেছিস কান্ড? রহিম এসব কী? আমি তোকে দিয়ে যে লেহেঙ্গা পাঠিয়েছিলাম সেটা কোথায়? (রেগে)
” আমি জানি না আপা,আপনি যেটা দিয়েছিলেন সেটায় আমি উনাদের দিয়েছি।(রহিম ড্রাইভার)
“ভাবি কাল শপিংমলে চেঞ্জ হয়ে যায়নি তো?(অভ্রের মা)
অভ্রের মায়ের কথা শুনে আরিয়ানের কিছুটা শান্ত হন।প্রেমা কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলো না।কারণ সে কাল ছিলোই না। তাই চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।কথার মাঝে হঠাৎ নাতাশার দৃষ্টি যায় ছাদের দিকে।কারো ইশারা বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে প্রেমার দিকে তাকায়।
” আন্টি হয়তো চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে,কিন্তু এটাতে খারাপ লাগছেনা।বরং সুন্দরই দেখাচ্ছে।(নাতাশা)
আরিয়ানের মা প্রেমাকে ভালোকরে দেখে একটা মুচকি হাসি দেয়।এবং প্রেমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেন,
“মাশা-আল্লাহ! সত্যই সুন্দর দেখাচ্ছেন।(আরিয়ান)
বাড়িতে প্রবেশ করতেই সবার চোখ প্রেমাতে নিবদ্ধ হয়।সবুজ রঙের লেহেঙ্গার মাঝে সোনালি কাজ করা।আর মাথার উরনাটাও সোনালি রঙের। সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে সতেজ ফুলের গহনায়। যেনো সদ্য তাজা ফুল দিয়ে গহনাগুলো তৈরি করেছে। প্রেমার রুপে সকলে মুগ্ধ। আরিয়ানের বারবার ওর দিকে তাকানো প্রেমার রাগ হচ্ছে।শীতল চোখজোড়া অভ্রকে খোঁজে চলেছে।প্রেমার ছটপটানি অন্য কেউ খেয়াল না করলেও নাতাশা ঠিক খেয়াল করছে। নিজ মনে হাসছে নাতাশা।দুপুরের ব্রেনওয়াসটা হয়তো কাজে দিয়েছে।
অবশেষে অভ্রের দেখা মিলে।অভ্র সোনালি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরিধান করে।চুল সুন্দর করে সেট করা।অভ্রের হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে প্রেমার রাগ বুদবুদ করে উঠে।নীরব দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে ।আচমকা চোখ দিয়ে প্রেমা নোনাজল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে।যেনো ওর বুকে কেউ চুরি দিয়ে আঘাত করছে। অভ্রকে অন্য একটা মেয়ের সাথে হাসতে দেখে প্রেমার সহ্য হচ্ছিলোনা।
(চলবে) Tarin Jannat