বসন্তের_ফুল🌺পার্ট ৪৫

0
1745

#বসন্তের_ফুল🌺🌺
#তারিন_জান্নাত
#পার্ট৪৫

রাত একটা ত্রিশ মিনিট।সবেমাত্র বাড়ি পৌঁছাল প্রেমা আর অভ্র। প্রেমা অভ্রকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলছে।কেমন তারাহুরো করছে অভ্র।বাড়ি চলে এসে তাতেও যেনো বাড়ি ফেরার চিন্তায় অশান্ত।তার উপর কথা বললে কখনো চুপ থাকে তো আবার ‘হুম’ ‘হ্যাঁ’ বলে কথার সমাপ্তি ঘটাচ্ছে।

সোফায় সাইকান আর জেরিন ঘুম চাদর জড়িয়ে।অভ্র এক পলক দেখে দ্রুত পা চালিয়ে উপরে উঠৈ যায়।

প্রেমাও ক্লান্তির শিষ তুলে দৃঢ় পায়ে রুমে আসল। মুখহাত ধুয়ে কাপড় চেঞ্জ করে রুম থেকে বাইরে যায়।
ক্ষিদায় পেট জ্বালা শুরু করে দিয়েছে প্রেমা।সেই এগারোটায় নাস্তা করেছিলো,এখন অবধি পেটে ভাত যায়নি। ভেবে-চিন্তে অভ্রের রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে করাঘাত করে। দু-তিন বার দরজায় আঘাত করতেই অভ্র দরজা খুলে।
অভ্রকে দেখতেই প্রেমার চোখমুখে আতংকিত হওয়ার চাপ ফুটে উঠে। বুকের ভেতর ব্যথা শুরু হয়ে যায় আচমকা।

চোখমুখের অবস্থা কেমন যেনো অদ্ভুদ হয়ে আছে অভ্রের। চোখ আধো নিভু নিভু,এলোমেলো চুল।প্রেমার ভাবনার মধ্যে অভ্র ব্যঘাত ঘটায়,
‘কিছু বলবে’

হঠাৎ থমথম খেয়ে যায় প্রেমা,সেই অবস্থায় বলে,
‘খাবে না? ক্ষিদে পেয়েছে প্রচুর চলো।

‘আমার ক্ষিদে নেই,তুমি খেয়ে নাও।
অভ্র দরজা বন্ধ করতে নিলে প্রেমা দরজা ঠেলে ঢোকে
অভ্রের হাত ধরে বলে, ‘চলো। আমি একা খাবো না।

প্রেমার কথার মাঝে অভ্র হাত ঝাঁটকা মেরে দূরে সরে দাঁড়ায়। তাতেই প্রেমা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।কিন্তু সেটা তোয়াক্কা না করে সেও এলোমেলো পায়ে হেঁটে অভ্র হাত শক্ত করে চেপে ধরে। হঠাৎ প্রেমা হতবিহ্বল হয়ে যায়।অভ্রের হাতের তালু বিষণ গরম।দ্রুত চোখ তুুলে অভ্রের দিকে তাকাল। গাল স্পর্শ করতেই প্রেমা উপলব্ধি করে অভ্রের গাল হাতের চেয়েও দ্বিগুন গরম।
কপালে হাত দিতেই দেখে একি অবস্থা।
প্রেমা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠে,
‘অভ্র,তোমার তো জ্বর এসেছে, এবং সেটা অতিরিক্ত।

অভ্র গরম শ্বাস ছাড়ে। অন্যদিকে ফিরতেই প্রেমা ক্ষেপে যায়। অভ্রের হাত ধরে বলে, ‘ চলো খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।চলো,

‘প্লিজ আমাকে জোর করো না,আমার ইচ্ছে করছে না।

অভ্রের কথা প্রেমা কানে আসার আগে সে রুম থেকে চলে যায়। নিচ থেকে এক প্লেট খাবার এনে অভ্রের রুমে এসে উপস্থিত হয়।অভ্র তখন বিছানায় বসেছিলো।
প্রেমা খাবার অভ্রের সামনে বিছানায় রেখে বলে ‘নাও খেয়ে নাও।’

অভ্র খাবারের দিকে তাকাল। এরপর মৃদু আওয়াজে বলে, খেতে ইচ্ছে করছে না,তুমি খেয়ে নাও।
প্রেমা চোখ ছোট করে অভ্রের দিকে তালাল।প্রেমার মনে হচ্ছে অভ্র ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্টে আছে। জ্বরের তোড় বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে অন্যরকম। তার উপর কেমন যেনো চিন্তিত ও দেখাচ্ছে। প্রেমা আপাততে অন্য ভাবনা মনে আনতে চাই না।তাই প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা নিয়ে অভ্রের সামনে ধরে বলে, ‘খাও নাহলে আমিও খাবো না,আর না খেয়ে আমি চলে যাবো। প্রমিস আমাকে জীবণেও খোঁজে পাবেনা।’
প্রেমার এতটুকু বাক্য ওষুধের মতো কাজে দেয়।
অভ্রের বুক কাঁপে,প্রেমা ওর থেকে দূরে সরে যাবে ভাবলে। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো প্রেমার হাতে খাওয়ার। তবে মুখ ফুটে বলেনি।আজ যখন সুযোগ এসেছে সে খাবারে অনিহা দেখাচ্ছে। অভ্রের প্রেমার হাত ধরে বলে, ‘আগে তুমি খাও তার পরেই আমি।’

প্রেমা সেকেন্ড মতো নিশ্চুপ থেকে এক লোকমা মুখে পুড়ে নিলো। পরে দৃঢ়ে দৃঢ়ে অভ্রকে খাইয়ে দেয়। দু’জনে আজ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। অভ্রের তো এখন পেটওই ভরছে না।

‘জ্বরের ঔষুধ আছে?
প্রেমার কথায় অভ্র ড্রয়ারের দিকে তাকাল।
‘নেই, ওষুধ খেতে হবেনা।ঘুমালেই কমে যাবে।তুমি
যাও।
প্রেমা সেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল,আজ সে এমনিতেই ঘুমাতে পারবেনা।তাছাড়া জ্বর যদি আরো বাড়ে। অভ্রকে একা রেখে যেতে পারবেনা। কিছু বলতে নিবে তার আগেই হুড়মুড়িয়ে সাইকান আর জেরিন রুমে প্রবেশ করে। সাইকান ভিতূ চোখে অভ্রের দিকে তাকাল।
‘কী হয়েছে তোর অভ্র?(সাইকান)

‘ জ্বর এসেছে সাইকান,আশেপাশে ডাক্তার পাওয়া যাবে? (প্রেমা)
‘এখানে তো নেই তবে দূরে রয়েছে,ফো..
হঠাৎ অভ্রের কড়া চাহনি তে সে চুপসে যায়।তখন
অভ্রের মেসেজটা সে দেখতে পাইনি।যখন দেখেছে তখন দেড়ি হয়ে যায়।হালকা হেসে সাইকান বলে, ‘আপু তুমি যাও আমি অভ্রকে দেখে রাখবো। জেরিন তুমিও যাও। (সাইকান)
‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলো আপু।(জেরিন)
‘তোমরা শুয়ে পড়ো যাও।আমি এখানেই থাকছি।

প্রেমা অভ্রের দিকে তাকালে অভ্র ধপ করে বিছানায় শুয়ে বলে, ‘তোমরা সবাই যাও প্লিজ।আর লাইট নিভিয়ে দাও।আমার অস্বস্থি লাগছে। ‘
সাইকান আর জেরিন দ্রুত পায়ে চলে যায়,নাছোড়বান্দা প্রেমা। সে জেদ করে রুমেই থেকে
যায়। লাইট নিভিয়ে সোফায় শুয়ে অভ্রের দিকে তাকাল। প্রেমার অনুপস্থিতি অভ্র টের পেলেও চুপ মেরে থাকে যাতে প্রেমা চলে যায়।

আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে অভ্র।এতোক্ষণ চোখমুখ জ্বালা করছিলো।চোখ বন্ধ করতেই আরো বেশি অনুভব করছে।
___________________

‘ওই হারামি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস? উঠ….
উক্ত কথাটি বলে এক বালতি পানি এনে ফ্লোরে ঢালে অরি। তখনি আরিয়ান ধড়ফড়িয়ে উঠে, অরির কথা না বুঝলেও আরিয়ান কাঁথায় ভেজা অনুভব করে।লজ্জায় পড়ে যায় মুহুর্তেই। দ্রুত উঠে অরির সামনে গিয়ে দাড়ায়,
-দেখো আমি কিন্তু এই আকাম করি নাই,খবরদার বলছি আমার দোষ দিবে না। (আরিয়ান)
অরি রেগে বলে,
-ভালো কামে নাই তুই,আকামে সেরা। (অরি)
-দেখো সত্যি বলছি আমি করি নাই,মানে আমি বিছানায় ইয়ে করি নাই, (আরিয়ান)
অরি ভ্রু কুঁচিত করে বলে ‘ইয়ে ‘৷ কী?
আরিয়ান থমথম গলায় বলল ‘আমি ইয়ে মানে হিসু করি নি। (আরিয়ান)
আচমকা চারিদিকে তব্দা খেয়ে যায়। সেকেন্ড পাঁচেক পার হওয়ার কারো ধম ফাটানো হাসির শব্দে পুরো রুম কেঁপে উঠে। অরির হাসিতে আরিয়ান টাস্কি খেয়ে যায়।
তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
-এ মেয়ে হাসি থামাও।
রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখে পুরো ফ্লোরে পানি।কাঁথা বলিশ সব ভিজে গেছে। এতক্ষণ সে টের পায় সে আসলেই এসব করেনি।ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝতে পারেনি।

-বিছানা ভিজিয়েছো কেন?
বিছানার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে অরি বলেে উঠে,
-হানিমুনের জন্য মানা করেছিলেন কেন?
-তোমার মতো মেয়ের সাথে আমি হানিমুন তো দূর ঘরের বাইরেও যাবো না।(আরিয়ান)
-সে সময় বলে দিবে,
কথাটা বলে অরি একটা ছুরি বের। আরিয়ানের দিকে তেড়ে যায়।ভয় দেখাতে শুরু করে। আরিয়ানও ভয় পেয়ে যায়। এতোরাতে ছুরি হাতে, কোন মেয়ের আক্রমণ। সে নিতে পারছে না।ভিতু গলায় বলে,
-প্লিজ ছুরি দূরে রাখো,আমাকে কী করতে হবে বলো?
এবার অরি ছুরি নামিয়ে বলে,
-গুড বয়।বেশি কিছু করতে হবেনা।কালকের হানিমুনটা কনফার্ম করতে হবে।আর যদি না করো,প্রমিস ইউ কুপিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে দিবো।
আরিয়ান নরম গলায় বলে, ‘ঠিক আছে’ এবং মনেমনে বলে ‘আগে নিজের জান বাঁচানো ফরজ’
______________________

রাত তিনটা ছুঁই ছুঁই। বিছানায় শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে অভ্র। প্রেমার চোখে পানি থামছেনা।অভ্রের ছটপটানি দেখে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে অভ্রের কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মাথা মুখ যতক্ষণ মুছে ততক্ষণ ঠান্ডা হয়,একটু পরেই আবারও গরম উত্তাপে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

কাঁথা সরিয়ে প্রেমা অভ্রের গলা বুক মুছে দেয়।শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা ছিলো বিধায় পেরেছিলো।
অভ্রের শার্ট খুলতে প্রেমা ইতস্তত বোধ করে। মুছে দেওয়া জরুরি তাই চোখমুখ খিঁচে পুরো শার্ট খুলে ফেলে। চোখ মেলে অভ্রের লোমহীন বুকের দিকে তাকাতেই প্রেমা আঁতকে উঠে।
হাত আপনা-আপনি চলে যায় অভ্রের পেটে। প্রেমা হাত বুলিয়ে আরো কেঁপে উঠে। অভ্রের পেটে নাভির পাশেই লম্বা দু’টো বড় কাটা দাগ।যেনো অনেক বেশিই কেটেছিলো এবং সেলাই করতে হয়েছিলো।
দাগটা দেখে মনে হচ্ছে জীবিত।জানান দিচ্ছে কেমন নৃশংসতার সহে কাটা গিয়েছে। অভ্র কষ্ট পেয়েছিলো ভেবে প্রেমা আরো বেশি দুমড়ে যাচ্ছে।
অভ্রের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বিষণ মায়া হয় প্রেমার।

অভ্রের ডান হাত মুঠোয় নিয়ে আলতো করে ঠোঁট বুলায় প্রেমা। এরপর রেখে দেয়। আবারও জলপট্টি দেয়।তখনি প্রেমার নজর পরে যায় অভ্রের পকেটের ছাবির দিকে।একটা ছাবি। এতো যত্নে পকেটে রাখার মানে সে বুঝতে পারেনি। দৃঢ় গতিতে পকেটে হাত দিয়ে প্রেমা ছাবিটা নেয়। ছাবির দিকে লক্ষ করতেই আচমকা প্রেমার সেদিনের রুমটির কথা মনে পড়ে যায়।
ছাবি মুঠো করে নিয়ে অভ্রের তাকাল।এখন সে কাঁপছে।একরাশ কৌতূহলের ভিড় এসে জমেছে। নিজেকে আঁটকাতে চাইছে।পারছেনা কোন মতেও।

প্রেমা একপলক অভ্রের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ তবে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দে অনেক কিছুই বলছে যা সে বুঝতে পারছেনা।আবার হঠাৎ থেমে যায়। প্রেমা অভ্রের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে দৃঢ় পায়ে রুম থেকে বের হয়।

সেই রুমটির সামনে দাঁড়ায় প্রেমা।খুলবে কী খুলবে না দু’মনা করে একসময় দরজাটা খুলে ফেলে।প্রেমার ভাবতেও অবাক লাগে।ভাগ্য এতো দ্রুত সহায় হয়েছে বলে।
রুমটিতে প্রবেশ করে দরজাটা চেপে দেয়। সুইচবোর্ড খোঁজে লাইট জ্বালায়। তখনি ভেসে উঠে পরিপক্ব রুমটির মধ্যে কিছু অপরিপক্ক জিনিস পড়ে আছে।
প্রেমা টেবিলের সামনে আসতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

টেবিলে অনেকগুলো ছবি রয়েছে।যা ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। নির্জীব ছবি।তারপরেও ছবির প্রতি এতো আক্ষেপ কিসের।কিংকর্তব্যভিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকে টেবিলটির উপরে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো ছবিগুলোর দিকে। হাতে নেয় দেখার জন্য। কিন্তু তেমন লাভ হয়নি। কারণ ছবিগুলোকে ছুরি দিয়ে অতিরিক্ত আঘাত করে এরপর টুকরো করেছে।
যদি মানুষ গুলো সামনে থাকতো তাহলে কী হতো?
অনুসন্ধানি দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল। বড় একটা আলমারি দেখতে পায়। সেটা খোলে দেখে খালি।
হতাশ হয়ে টেবিলের দিকে ফিরলে নিচে চোখ যায় প্রেমার।একটা ডায়েরির পৃষ্টা।সেটা হাতে নিতেই দেখে একটা ছেড়া ছবি। পিন-আপ করা।

ডায়েরির পৃষ্টার লেখাটা না পড়ে প্রেমা ছেড়া ছবিটির দিকে তাকাল। সাথে সাথে মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠে।যেনো কিছুর সাথে আঘাত পেয়েছে।
অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,’এটা কি করে সম্ভব?
তখনি একজোড়া হাতের স্পর্শ পায় প্রেমা।শক্ত করে তার পেট আঁকড়ে ধরেছে। অনুভূতিহীন হয়ে যায় প্রেমা।এভাবে ধরা পড়বে ভাবেনি। চোখ বন্ধ করতেই কানে একটা কোমল কিছুর স্পর্শ পায়। জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে আরো আঁটকে যায় প্রেমা।কাঁপা শরীরে শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই।

তখনি প্রেমার কানে একটা ফিসফিস শব্দ আসে,
“পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না,যেমন তার ভোগান্তুর একমাত্র আমি।
অভ্রের স্পষ্ট ফিসফিস কন্ঠে বলা কথা প্রেমার মাথায় ঢোকেনি।বরং ভারি খেয়ে বেরিয়ে যায়।
প্রেমা ভয়ে আতংকিত হয়ে অভ্রের বুকে জায়গা নেয়,
-তোমার না জ্বর। কেন এসেছো? প্লিজ আমার উপর রাগ করো না।
প্রেমার কথায় অভ্রের ভাবান্তর না হলেও, ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুদ কষ্টের হাসি জায়গা দকল করে নেয়।

(চলবে)

কেমন লেগেছে জানাবেন।খুব তাড়াতাড়ি সব রহস্য উন্মোচন হবে। Tarin Jannat

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here