“হালাল প্রেম” পর্ব- ৩৪

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৩৪
(নূর নাফিসা)
.
.
ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোচিং বন্ধ। তবে তার শ্বশুর মশাই এতোগুলো নোট ধরিয়ে দিয়েছে শারমায়ার হাতে। এগুলো সব কমপ্লিট করতে হবে। শেষ সময়ে যেন তার পড়ার চাপ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তাকে এক্সাম দিতে হবে স্কলারশিপ সেশনে। এজন্যই তার পাসপোর্ট করার এতো তাড়া। যদি স্কলারশিপ পেয়ে যায় তাহলে তো ভালোই আর না পেলে শারমায়ার পছন্দ অনুযায়ী প্রয়োজনে তারা ভিন্নদেশে মেডিকেল কোর্স করাবে। যখনই পড়তে বসে তখনই তার মাথায় ঘুরপাক খায়, তাকে অন্যত্র পাঠালে স্বজনদের ছেড়ে থাকবে কিভাবে! নিজ দেশেও তো কোর্স কমপ্লিট করা যায়। এতো শত ভাবনার মাঝেও বাবার উৎফুল্লতা মনে করে সে পড়াশোনায় মনযোগ দেয়৷ সাখাওয়াত সাহেব মনে বড় আশা বেধে রেখেছেন মেয়েদের নিয়ে। আর আশরাফ আহমেদ খান তো যথেষ্ট প্রণোদনা দিয়ে চলেছেন। দুই বাবার স্বপ্ন নিয়ে ভাবতেও যেন শিহরিত হয়ে যায় সে। তখন আবার ভাবে, পারবে তো তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে?
শারমায়ার বাবা ও চাচা একত্রে কুরবানি দিবে। ঈদুল আজহার পূর্বের দিন বউ বাচ্চা নিয়ে ফুয়াদ এসেছে বাসায়। আজ তারা কুরবানির গরু কিনতে যাবে। বিকেলে ফুয়াদ শারমায়াদের ফ্ল্যাটে এসে বললো,
“চাচ্চু কোথায়?”
শারমায়া জবাব দিলো,
“আব্বু রুমে আছে, ভাইয়া। তোমরা দুজনই যাবে? আর কেউ যাবে না?”
“একটা গরু আনতে দশজন যাওয়া লাগে? গাড়িতে তুলে পাঠিয়ে দিবো।”
সাফওয়ানা হেসে বললো,
“আপুকে নিয়ে যাও, ভাইয়া। গরুর গলায় ধরে ঝুলে থাকবে।”
ফুয়াদ হেসে বললো,
“যাবি?”
“হু। খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই তো। সাফুকেই নিয়ে যাও। খুব ভালো ঝাড়ুদার। রাস্তায় রাস্তায় গোবর পরিষ্কার করে আসবে। পরিবেশ রক্ষণশীল ব্যক্তি।”
সাফওয়ানা রেগে তাকালো আর ফুয়াদ হাসলো। সাখাওয়াত বদরুদ্দোজা রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
“আম্মা, গরু কি রঙের হবে এবার?”
শারমায়া বললো,
“রঙ একটা হলেই হলো।”
বড় মেয়ের কাছে নিরপেক্ষ জবাব পেয়ে খুশি হলেন না তিনি। সাফওয়ানাকে বললেন,
“আম্মা, তুমি বলো।”
“অবশ্যই লাল গরু।”
ফুয়াদ শারমায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“বলদি, রঙ একটা হলেই হয়? পছন্দের একটা ব্যাপার আছে না?”
“গায়ের রঙ দেখে পছন্দ করে কি লাভ, ভাইয়া? চামড়া তো আর খাচ্ছি না। রক্তমাংস তো সব একই।”
“চুপ কর তুই। সৌন্দর্যের বুঝিস কিছু? সাফওয়ানার কাছে শিখ।”
“হুহ্! সাফু তো পশু গবেষক হবে। আমি ওসবে নাই। ছি, গবেষকের সাথে কি দুর্গন্ধ!”
সাফওয়ানার উপর নাক ছিটকে রুমে চলে গেলো শারমায়া। সাফওয়ানা চিৎকার করে বললো,
“তুই কেচো গবেষক হবি, ডাইনী।”
ফুয়াদ হেসে চাচার পিছু পিছু বেরিয়ে গেলো। শারমায়া ফোন হাতে নিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ আগে জোভান কল করেছিলো। সে ডায়াল করতেই জোভান কেটে দিয়ে কলব্যাক করলো। আজ জোভানই প্রথম সালাম দিলো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ। মিষ্টি বউটা কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ। সকালে কল দিলেন না যে? আমি দিলাম তা-ও রিসিভ করলেন না।”
সারারাত হাটে কাটিয়ে গরু কিনে সাড়ে চারটায় বাসায় ফিরেছি৷ গোসল করে আযানের সাথে সাথে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছি৷ দুপুর দুটোর দিকে মা ডেকে তুলেছে। তারপর তোমাকে কল দিলাম, পাইনি। এরপর যোহরের নামাজ পড়ে লাঞ্চ করলাম। আর এখন তুমি স্মরণ করলে।”
“ইশ! কত বড় হিস্ট্রি! একটা গরু কিনতে সারারাত কেন হাটে কাটলো? ভালোই তো ক্রেতা আপনি।”
“একটা কিনেছি কে বললো?”
“বাবার কাছে শুনেছি আমি সকালেই। স্যার কল করে জানিয়েছে গরুর কথা।”
জোভান মৃদু হেসে বললো,
“আমাদের একটা হলেই কি, আমরা কি আর একজন যাই? আমাদের দলবেঁধে যেতে হয়। আটজন সারারাত ঘুরেফিরে ছয়টা গরু, একটা খাসি কিনেছি।”
“কাদের এতো গরু?”
“তোমার স্যারের একটা, ইফাজদের একটা, সাদাতের একটা, মিরাজদের দুইটা আর একটা খাসি, আরও একজন ফ্রেন্ডের একটা।”
“বাব্বাহ! যেকেউ দেখলে বলবে পাইকারি ক্রেতা।”
“ক্রেতা না গো। বিক্রেতাই ভাবছে। লোকজন আমাদের কেনা গরুর দরদাম করতে শুরু করেছিলো। মিরাজ তো এক লাখ টাকায় কেনা গরু দেড় লাখ টাকায় বিক্রিই করতে যাচ্ছিলো।”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো এবং বললো,
“কুরবানির উদ্দেশ্যে কেনা গরু আবার বিক্রি করে?”
“আরে, ক্রেতারা দরদাম শুরু করাতে দুষ্টুমি করেছে। গরু আর কিনেছি কতক্ষণে, দুষ্টুমিতে টাইম পাস।”
” ক্রেতাগণ কে কে ছিলেন?”
“ইফাজ, মিরাজ ও তার দুইটা কাজিন, সাদাত ও তার বড় ভাই, আমাদের আরেক বন্ধু শিমুল এবং তোমার বর।”
“অসুস্থ বোধ করছেন না এখন?”
“একটু একটু। একটু ঘুরাফেরা করলে ঠিক হয়ে যাবো আশা করি। তোমাদের গরু না আজ কেনার কথা?”
“হুম। এইমাত্র বাবা আর ফুয়াদ ভাইয়া বেরিয়েছে।”
জোভান আরও কিছুক্ষণ কথা বলে তাদের গরুর ছবি পাঠালো। শারমায়া তার মা ও সাফওয়ানাকে দেখালো। সাফওয়ানার বেশ পছন্দ হয়েছে। সন্ধায় ফুয়াদ হাটে থেকে ভিডিও কলে সাফওয়ানাকে গরু দেখালো। একটা কালো ও দুইটা লাল গরু থেকে সাফওয়ানাকে একটা বাছাই করতে বললে সাফওয়ানা লালের মধ্যে একটা বাছাই করে ফেললো। আজ দ্রুতই খাওয়াদাওয়া শেষ করে সাফওয়ানা নুহাশকে মেহেদী পরিয়ে ফারিয়ার হাতেও পরিয়ে দিলো। অতঃপর নিজের একহাতে দিলো আরেক হাতে ফারিয়া দিয়ে দিয়েছে। শারমায়া নিজেরটা নিজেই একহাতে মেহেদী অঙ্কন করলো। মেহেদী না পরলে যেন ঈদের দিন মনেই হয় না। সন্ধ্যা থেকে চাচীদের ফ্ল্যাট থেকে নিজেদের ফ্ল্যাটে ছোটাছুটি, কাজকর্ম, গল্পগুজবেই কেটেছে সময়। রাত আটটার দিকে বাবা আর ভাইয়া ফিরলো গরু নিয়ে। সাফওয়ানা বরাবরের মতো খুব বেশিই খুশি। তারা সবাই ই নিচতলায় নেমে এলো গরু দেখতে। সাফওয়ানা গরুর কাছে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো কিন্তু সাহস হচ্ছে না। ফুয়াদ ভয় কাটিয়ে তাকে কাছে নিয়ে গেলো। তারপর গরুকে স্পর্শ করেই সেল্ফি তুললো। ফুয়াদ ফারিয়া, শারমায়াকেও ডাকলো কিন্তু তারা ভয়ে আর গেলোই না। তারা আবার উপরে চলে এলেও সাফওয়ানা ভাইয়ের ছেলে নুহাশকে নিয়ে বারবার নিচে যাচ্ছে আর আসছে। অন্যান্য দিক থেকে কাজিনগুলো কল করছে, একে অপরের গরুর ছবি পাঠাচ্ছে। দশটার দিকে ভাবির সাথে গল্প করার সময় সাফওয়ানা এসে বললো,
“আপু, ভাইয়া এসেছে তো।”
“কোথায়?”
“নিচে। গরু দেখতে এসেছে।”
শারমায়া তাদের ফ্ল্যাটে আসার জন্য বের হতেই দেখলো বাবার সাথে জোভান ও আশরাফ স্যার সিড়ি দিয়ে উঠছে। শারমায়া মাথায় কাপড় টেনে সালাম দিলো। জোভান মুচকি হেসে জবাব দিলো, আশরাফ স্যার সালামের জবাব দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো। শারমায়া কথা বলতে বলতে তাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। অতঃপর বর ও শ্বশুরের আপ্যায়নে কাটলো সময়। তবে জোভানের সাথে তার তেমন কোনো কথা হয়নি। বড়দের সামনে তার সাথে কথা বলতে আনইজি ফিল করে শারমায়া। জোভানও হয়তো বুঝতে পারে, তাই সে-ও তেমন কিছু বলে না। কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটিয়ে বাবাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেলো জোভান। বরাবরের মতো হৈ-হুল্লোড়ে আজ বারোটার পরে ঘুমালো সবাই। ফুয়াদ ভাইয়া ও ভাবি আসাতে যেন মজাটা আরও বেড়ে গেছে। কাজিনরা একত্রিত হলে মুহূর্তগুলো জমজমাট হয় বেশি।
ঈদের দিন মোটামুটি ব্যস্ততায়ই কাটলো বাবামায়ের। মেয়েরা কেবল একটু আধটু সহযোগিতা কেরেছে। কুরবানি দেওয়া হয়েছে বাসার পাশেই রাস্তার ধারে। কাজকর্ম সেড়ে তারা মেয়েরা ছাদে আড্ডা দিয়েছে বিকেলের কিছুটা সময়। সন্ধ্যায় নিজের রুমে খাটে বসে ফেসবুকে নিউজফিড দেখছে শারমায়া। হঠাৎ কানে জোভানের কন্ঠ ভেসে এলো। জোভান এসেছে নাকি! রুমের দরজাটা খোলা থাকায় আবার একটু মনযোগ দিয়ে শুনার চেষ্টা করে নিশ্চিত হলো, হ্যাঁ জোভানই আব্বুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আর কে এসেছে সাথে? সে কি এখন ড্রইং রুমে যাবে দেখা করার জন্য নাকি এখানেই বসে থাকবে? নাহ, আব্বু আম্মু ডাকলেই যাবে। বরং দরজাটা চাপিয়ে রাখা যাক। আর কিছু না ভেবে দরজা লাগাতে গেলে জোভান সামনে এসে হাজির! জোভানকে রুমের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে সালাম দিয়ে দরজার কাছ থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে এলো। শারমায়া ঠিক যেই গতিতে পিছিয়ে এসেছে, জোভান সালামের জবাব দিয়ে ঠিক সেই গতিতে রুমে প্রবেশ করলো। তারপর দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে তার নিকটে আসতে আসতে শার্টের টপার বোতাম খুলে বললো,
“ওফ্ফ! মাই লাভ, খুব গরম পড়েছে না আজ?”
শারমায়া কিছু বলার আগেই সে খুব শক্ত করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ঈদ মোবারক, সুইটহার্ট…”
জোভানের এই এক স্বভাব, হুটহাট আক্রমণ করে বসে! এই পর্যন্ত কতবার ঈদ মোবারক জানালো, তার হিসেব নেই। কখনো ফেসবুকে, কখনো কল করে, কখনো এসএমএস এ আর দিনশেষে এখন সামনাসামনি। শারমায়া লজ্জিত গলায় বললো,
“ঈ..ঈদ মোবারক।”
“জান, এখানে আসার আগে শাওয়ার নিয়েছি। দেখোতো শরীরে মাংসের গন্ধ লেগে আছে কি না?”
“হুহ্! সব জড়িয়ে ধরার বাহানা। আমি কি বুঝিনা নাকি কিছু।”
শারমায়ার বিড়বিড় শুনে জোভান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
“আমি জানি তো তুমি যে বুদ্ধিমতী। বুদ্ধিটা শুধু সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে জানো না।”
“ইশ! কোথায় প্রয়োগ করতে পারিনি?”
“এই যে, কখন থেকে এভাবে জড়িয়ে ধরে আছি, শার্টের বোতামও খুলে রেখেছি তাও এই বুকে একবার মুখ লুকালে না।”
“ভীষণ খারাপ লোক।”
জোভান হাসলে এবার ঠিকই তার বুকে মুখ লুকালো তবে সেটা জোভান বলাতে নয়, সেটা লজ্জায়। জোভানের শরীরের স্মেলে কেমন একটা নেশা ধরে যায়। সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো আপুদের বাসায় থাকাকালীন। একঘুমে রাত পাড় হয়ে গিয়েছিল। এখন তার শরীর খুব ঠান্ডা। বুঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে শাওয়ার নিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here