#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_২০
#Tahmina_Akther
আধার কাটিয়ে পুরো ধরনী আলোকিত হয়েছে সূর্য মামার উপস্থিতিতে।নতুন দিন, নতুন সূচনা,কারো ঝুলিতে প্রাপ্তির হাসি তো কারো ঝুলিতে অপ্রাপ্তির আক্ষেপ।
কেউ হয়তোবা অপেক্ষা করছে নতুন দিনের সূচনার যেখানে তার জন্য থাকবে প্রাপ্তির হাসি।
হিয়া আর অভিকের পুরো পরিবার বসে আছে গেস্ট হাউজের একটি কক্ষে। বেশ গুরত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে। সবারই এতে মতামতের প্রয়োজন বিশেষ করে হিয়ার আর অভিকের। অভিকের বাবা সবাইকে জরুরি তলব করেছে একসঙ্গে। রোকন জামান অভিক-হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
-আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এতে তোদের দুজনের কোনো আপত্তি আছে?
– না বাবা আমার কোনো আপত্তি নেই।
– না চাচ্চু আমারও কোনো আপত্তি নেই।
– বেশ ভালো। তবে তোরা দু’জন তৈরি হয়ে নে আমি ডাক দিলেই চলে আসিস এখানে।
অভিক আর হিয়া সায় জানিয়ে চলে গেলো যার যার রুমে।
ওরা যেতেই বাকি সদস্যদের একটাই কথা,
-এটা কি ঠিক হবে আত্মীয় স্বজন সবাই তো চলে এলো। এইমূহর্ত্বে এমন একটা কাজ কতটুকু উচিত হবে বুঝতে পারছি না।
-আসলে আমি যা করছি এতে সবার ভালো হবে। তোমরা চিন্তা করো না আমি সব সামলে নিবো। এখন যাও তোমরা হলুদের ব্যবস্থা করো।
সবাই চলে গেলো কিন্তু রোকব জামান চিন্তা করছে, আসলে উনি যেরকমটা পরিকল্পনা করছে আদতেই কি সফল হবে?
——————-
পার্লার থেকে দুজন মেয়ে এসেছে হিয়াকে সাজিয়ে দিতে। সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি,সূর্যমুখী ফুলের অর্নামেন্টস,খোপায় বেলি ফুলের গাজরা । ঘন্টাখানেক লাগলো হিয়ার পুরো সাজ কমপ্লিট হতে।আয়নায় এবার নিজের দিকে তাকালো হিয়া। গায়ের শাড়ি, ফুলের গহনা, খোপায় ফুলের গাজরা সব মিলিয়ে ভালোই লাগছিলো। এই সাজ সে আগেও একবার সেজেছিলো কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ আবারও সেই দিনের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সূর্যমুখী ফুল হিয়ার পছন্দ নয় কিন্তু অভিকের পছন্দের তাই ও আর মানা করে নি। যদি পাগলটার মন খারাপ হয় তখন তো মুখ গম্ভীর করে হুতুম পেচার মতো করে রাখবে।
কারো কথায় হিয়ার ধ্যান ভগ্ন হলো,
-ম্যাম আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। অভিক স্যার যদি দেখেনা আ’ম শিওর স্যার আর আপনার থেকে চোখ সরাতেই পারবে না।
-তোমাদের স্যার এমনিতেই আমাকে দেখতে পারবে না। কারণ, গায়ে হলুদে শুধু মেয়েরা থাকবে।
-ও আচ্ছা, আমরা তাহলে আসি ম্যাম। আমাদের পেমেন্ট আগেই এডভান্সড করা হয়েছিলো।
-আচ্ছা, আগামীকাল এসো কিন্তু? আর মেহেদী আর্টিস্ট কি তোমাদের এখান থেকে আসবে না?
– নো ম্যাম। স্যার হয়তো অন্য?
-আচ্ছা ঠিক আছে। পরে দেখ যাবে এই বিষয়ে।
ওরা চলে যেতেই মা আর চাচী আসলেন।মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। চাচী মা’কে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হয়েছে কাঁদছো কেন তুমি?
-মা’রে আমি ও তো এমন একটা খুশির দিনে কাঁদতে চাই না। কিন্তু কেন যে এই চোখের পানি গুলো বেরিয়ে যাচ্ছে? জানিস আল্লাহর কাছে কত দোয়া করেছি যেন আমার এই পুতুলটা আবারও কারো রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিক। আল্লাহ আমার ডাক কবুল করছেনে। আমাদের অভিক এলো তোর জীবনে যে তোকে সর্ববস্থায় ভালোবাসে। মা’রে কখনো অভিকের মনে কষ্ট দিস না। সে তোকে ভালোবেসে এই সমাজের নিয়মের তোয়াক্কা পর্যন্ত করেনি। দোয়া করি তোরা দুজন এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখির জোড়া হতে পারিস। ঠিক যেন এক জোড়া লাভ বার্ড।
-হয়েছে হয়েছে বুঝতে পেরেছি তুমিও এখন অভিকের গুনগান করতে এসেছো। চাচি তুমিও কি এইসব বলবে বলো? আমি এমনিতেই নার্ভাস হয়ে আছি।
-আমি এইসব বলবো না। শুধু একটাই চাওয়া তোদেরকে আল্লাহ সকল মুসিবত থেকে রক্ষা করুক। আয় দেরি হয়ে যাচ্ছে সবাই নিচে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
বাড়ির ছাঁদে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। নানা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টেজ। কিন্তু এই স্টেইজের কোনো কাজ নেই। অভিক হিয়ার জন্য নতুন দোলনা এনেছে আর এই দোলানাতেই তার ফুল বসবে আর সবাই হলুদ ছুয়ে দিবে তার ফুলের গায়ে।
হিয়াকে বসানো হলো দোলনায় একে একে সবাই হলুদ ছুয়ে দিলো হিয়াকে।মিরা আর তিয়ানাও হলুদ ছুয়ে দিলো হিয়াকে। ওরা দুজন হিয়ার কানে কি যেন বলতেই লজ্জ্বায় কুঁকড়ে গেলো হিয়া। এবার গোসল করানোর পালা। পুকুরের পানি দিয়ে গোসল করানো হলো হিয়াকে একে একে তিন কলসি দিয়ে।
গোসল পর্ব শেষ হতেই হিয়াকে রুমে নিয়ে আসা হলো। কারন, এরপরের অনুষ্ঠানে হিয়াকে মেহেদী পড়ানো হবে।
—————–
এদিকে
অভিককে গায়ে হলুদ দেয়া হলো বাড়ির বাগানের একপাশে। সেখানেই আরেকটি স্টেইজে বসানো হয় অভিককে। গায়ে ছিলো সাদা লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি। লুঙ্গি পড়া নিয়েও বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি হলো ওদের বন্ধুদের মাঝে।
প্রথমে বাড়ির বড়রা বেশ ভালোভাবেই হলুদ ছুয়ে দিলো। কিন্তু যখন ওর বন্ধুদের পালা এলো বেচারা অভিককে পুরো হলুদ
কাকতাড়ুয়া বানিয়ে ফেললো। এরপর একেকজনের সে কি হাসি? অতঃপর ওর বন্ধুরা মিলে ওকেও পুকুরের পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিলো।
——————
এবার আর তেমন সাজ দেয়নি হিয়া। তবুও বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। হয়তো বিয়ের হলুদ গায়ে ছুঁয়েছে বলে!সবুজ চুড়িদার, কানে সবুজ স্টোনের ঝুমকো,দু’হাতে সবুজ স্টোনের চুড়ি,খোপায় এবার আর্টিফিসিয়াল গাজরা পুরো সাজের সাথে মিলিয়ে। এবার যেন হিয়াকে পুরোই প্রকৃতির কন্যার মতো দেখাচ্ছে।
মিরা, তিয়ানা এসে হিয়াকে নিয়ে চললো ছাঁদের উদ্দেশ্য।
সময়টা বিকেলের আকাশ তখন রক্তিম আলোয় পরিপূর্ণ। চারদিকে মন জুড়ানো বাতাস বইছে ।পাখিদের কলরবে যেন পরিবেশ এক অনিন্দ সৌন্দর্যে ডুবে আছে। কিন্তু আজ আর এইসবের খেয়াল কার আছে। কেউ ব্যস্ত অনুষ্ঠানের প্রোগ্রামে কি হবে।কেউ ব্যস্ত তাদের সাজ নিয়ে, কেউ বা ব্যস্ত সন্তান নিয়ে আর কেউ বা ডেকোরেশন নিয়ে।
হিয়াকে নিয়ে আসার পর এই কোলাহল যেন একটু কমে গেলো।একে একে সবাই হিয়াকে নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত।এরই মাঝে অভিকের নানু বললো,
-কি রে রেহনুমা মেহেদী আর্টিস্ট কই? এখনো আসে নাই।
-মা মেহেদী আর্টিস্ট বাড়িতেই আছে। অপেক্ষা করেন আসছে হয়তো।
একটু পর ছাদের দরজায় একজন এলো যার উপস্থিতিতে সবাই অবাক হলো বেশ। কারণ বিয়ের বর যখন কনের মেহেদির ফাংশনে উপস্থিত হয় পরিবেশ তখন হয় হতবিহ্বল।
হিয়া যেন অবাকের শীর্ষে ও এখানে কেন এসেছে? আচ্ছা ওকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন? ফর্সা গায়ে সবুজ পাঞ্জাবি বেশ ফুটে উঠেছে। আচ্ছা, আমি ছাড়া আর কেউ ওকে দেখছে না তো? আশেপাশে তাকালাম অদূরে দাড়ানো এলাকার কিছু পরিচিত মেয়ে ওকে বেহায়ার নজরে দেখছে।কি দরকার ছিলো সবুজ পাঞ্জাবি পরার?
এসবের তোয়াক্কা না করে অভিক এগিয়ে গেলো হিয়ার দিকে।হিয়াও বেশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে অভিকের দিকে।অভিক যেয়ে হিয়ার পাশে বসলো।হিয়ার ডানহাত টেনে ওর কোলের উপর রাখলো। এরপর ওর পকেট থেকে একটি মেহেদীর টিউব বের করে মেহেদী দিতে শুরু করলো।
ব্যস, উপস্থিত সকলে হেসে ফেললো আর বলতে লাগলো ও তাহলে আজ হিয়ার মেহেদী আর্টিস্ট।
হিয়া যেন বেশ লজ্জা পেলো সকলের কথা শুনে। আস্তে করে অভিককে বললো,
-কি দরকার ছিলো এখানে আসার? এখন দেখলে তো সবাই কিভাবে হাসাহাসি করছে?
-উনাদের হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই হাসছে। আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর তুমিও চুপচাপ বসে দেখো আমার মেহেদী দেয়া ঠিক হচ্ছে কি না?
-কেন? যে দিতে পারে না সে কেন আমায় মেহেদী দিতে আসে? যদি ডিজাইন খারাপ হয়ে যায় তখন?
-হিয়া একটা কথা মনে আছে তোমার? বেশ কয়েক বছর আগে আহানকে তুমি বলেছিলে আর আমি শুনেছিলাম কারন তোমাদের সাথে আমিও ছিলাম। ছোট ছিলাম কি না!
– কি কথা?
– একবার আহানের সাথে তুমি বলেছিলে, তোমার খুব ইচ্ছে যেন তোমার হবু স্বামী তোমায় বিয়ের মেহেদী পড়িয়ে দেয়। কিন্তু, আহান তোমার সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেনি। তাই আজ আমি তোমার সেই ইচ্ছে পূরন করছি মাত্র।তুমি খুশি হয়েছো ফুল?
-আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি কিভাবে মনে রাখলে? ও মাই গড এই জন্যই গতকাল রাতে আমায় মেসেজ বলেছিলে আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
অভিক মাথা নাড়িয়ে হু জানিয়ে মেহেদী দেয়ায় মনোনিবেশ করলো। আর হিয়া অভিকের মুখের দিকে ভাবছে,
কত ছোট থেকে ছোট জিনিস গুলো সুক্ষ্মভাবে খেয়ালে রেখেছে সে। তার এত ভালোবাসা আমার জন্য কেন? তাহলে কি আমি ভাগ্যবতী? হয়তো! নইলে এতকিছু হারিয়েও আমি পেয়েছি অভিকের অফুরন্ত ভালোবাসা। অভিকের সুপ্ত ভালোবাসায় যার সবটা জুড়ে শুধু আমারই বিচরণ।
#চলবে