হৃদমোহিনী পর্ব ৪৪

0
2352

হৃদমোহিনী
পর্ব ৪৪
মিশু মনি
.
৬৫
মিশু বলতে আরম্ভ করলো, ‘আচ্ছা স্বামীরা কেন বোঝেনা তাদের স্ত্রী রা কি চায়?’

মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাদের কথা বলছো বলো তো?’
– ‘আরে আমার একটা কাজিন। ওদের প্রেমের বিয়ে। কিন্তু…’

মেঘালয় কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। মিশু আমতা আমতা করছে দেখে বললো, ‘বলো? কি হলো আবার?’
– ‘আমার না খুব লজ্জা করছে। যদিও আপনার কাছে লজ্জা করাটা ঠিক না। আর আমিতো এসব কথাবার্তা আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলতেও পারবো না।’
– ‘তুমি নির্দ্বিধায় বলো। কোনো অসুবিধা নেই। সময় লাগলে সময় নাও, তবুও লজ্জা কোরোনা।’

মিশু মাথা ঝাঁকালো। মেঘালয় বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মিশুকে কোলের উপর টেনে নিলো। ওর কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো মিশু।

মেঘালয় ভেজা চুলের গন্ধ শুঁকে বললো, ‘পাগল করা ঘ্রাণ তোমার চুলে। আমার ঘুম এসে যায় এই গন্ধে।’
– ‘মন খারাপের রাত গুলোতে চুলের ঘ্রাণ শুঁকিয়ে ঘুম পাড়াবো আপনাকে।’
– ‘মন খারাপের রাত গুলো কখনো না আসুক। এবার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তোমার গল্পটা শুরু করো।’

মিশু আবারও শুরু করলো, ‘আপু প্রচন্ড ভালোবাসতো ভাইয়াকে। দীর্ঘদিন প্রেম করে বিয়ে। বিয়ের আগে শুধুমাত্র হাগ, কিস এইগুলোই হয়েছে ওদের মধ্যে। একজন আরেকজনের অনেক কেয়ার করতো, বোঝাপড়াও ভালো ছিলো। দুজনে মিলে বাসায় জানালো তারা একে অপরকে পছন্দ করে। বাসা থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে হলো। দুজনে কত খুশি ছিলো বিয়ের সময়! বিয়ের আগে পনের বিশ দিন ধরে শুধু প্লান ই করে গেছে। শুধু কি বিয়ে, প্রেম করার সময়েই তো সবাই প্লান করে ফেলে হানিমুন, বাচ্চাকাচ্চা এগুলো নিয়ে। ভাইয়া ওকে বলত বিয়ের রাতে সারারাত ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিবে, অনেক গল্প করবে দুজন মিলে। কিন্তু….’

মেঘালয়ের কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মিশু কি যেন ভাবছে। দুই ভ্রুয়ের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে ওর। দেখতে ভালো ই লাগছে মেঘালয়ের।

মিশু বললো, ‘বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই ভাইয়া বিছানার দিকে এগোতে থাকে। আপু উঠে এসে সালাম করবে ভেবেছিলো। কিন্তু ওঠার পরপরই ভাইয়া আচমকা এসে ওকে জাপটে ধরে। আপুও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে ওকে। ভাইয়া আপুর চুলের গন্ধ নেয়, গালে চুমুও খায়। আর তারপর পরই পাগল হয়ে যায় একেবারে। আপুকে একটুও শাড়ি গয়না খোলার সুযোগ দেয়না। জোরে চাপ দিতে থাকে বুকে। আপুর গায়ে ভরি ভরি গয়না থাকায় ও প্রচুর ব্যথা পাচ্ছিলো। আপু উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, আমাকে একটু চেঞ্জ করার সময় দাও। কিন্তু ভাইয়া ওকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে পিছনে পুরুষাঙ্গ ঠেকিয়ে বারবার ঘষছিলো। কষ্টে কান্না করে দেয় আপু। মেয়েটা চেয়েছিলো স্বামী একবার হাসিমুখে পাশে বসবে, জিজ্ঞেস করবে এই বাড়িতে তার কেমন লাগছে? বাসার জন্য যেন মন খারাপ না করে, আগামী দিনগুলোর জন্য দু একটা কথা বলবে। মেয়েটা তার পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছে, তার অনুভূতিটা একবারও বোঝার চেষ্টাও করেনি। মেয়েটা চেয়েছিলো স্বামী তাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরুক। অনেক ভালোবেসে স্পর্শ করুক। কিন্তু ছেলেটার তর সইছিলো না।’

মিশুর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে বিতৃঞ্চা। মেঘালয় ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

মিশু বললো, ‘এটা কেমন ভালোবাসা মেঘমনি? বিয়ের অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। এখন দিনের পর দিন আপু তার স্বামীর কাছে ধর্ষিত হয়। যে স্পর্শে কোনো ভালোবাসা নেই, সেটা তো ধর্ষণ ই। একটা মেয়ে চায় একটু আদর, একটু কেয়ারনেস, ভালোবাসাময় স্পর্শ। কিন্তু অনেকের ই আজকাল বিয়ের পরপরই প্রেম পালিয়ে যায়। কত অদ্ভুত না? শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কের জন্যই কি বিয়ে?’

মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘উহুম। বিয়ে মানে প্রেম। সবাই দায়িত্ব নিতে পারে কিন্তু প্রেমিক কি আর সবাই হতে পারে?’
– ‘প্রেম করেই তো বিয়ে।’
– ‘ধুর। আজকাল প্রেম করে বিয়ে করা সহজ কিন্তু বিয়ের পর প্রেম ধরে রাখাটা কঠিন। শুধুমাত্র বাবু খাইছো, একটু ঘোরাঘুরি, হাত ধরাধরি, চুমু খাওয়াকে প্রেম বলে? প্রেম হচ্ছে ঈশ্বপ্রদত্ত ক্ষমতা। এটা সবার থাকেনা।’

মিশু তাকালো মেঘালয়ের চোখের দিকে। ফিক করে হেসে বললো, ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা? দারুণ বলেছো তো।’

মেঘালয় বললো, ‘প্রেম হচ্ছে একটা শক্তিশালী মানসিক ও শারীরিক আকর্ষণের নাম। কোনো প্রেমে শারীরিক সম্পর্কের পর মায়া কমে যায়। এদের ক্ষেত্রে মানসিক আকর্ষণ কম থাকে, এরা আলাদা হয়ে যায়। কোনো প্রেমে শারীরিক সম্পর্কের পর মায়া বেড়ে যায়, এদেরকে বলে স্বামী স্ত্রী আর এটা বেশিরভাগ সময় স্থায়ী হয়। যে প্রেমে মানসিক ও শারীরিক দুটোরই আকর্ষণ শক্তিশালী হয়, তারা আজীবন সুখী হয় আর আর এরা কখনো আলাদা হয়না।’

মিশু হুট করেই বললো, ‘আমাদের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক আকর্ষণ দুটোই শক্তিশালী।’

হেসে ফেললো মেঘালয়। বললো, ‘ এতকিছু বোঝো? বাব্বাহ!’

লজ্জা পেয়ে হাসলো মিশু। মেঘালয়ের গলা জাপটে ধরে বললো, ‘সত্যিই। আগে বুঝতাম না এটা। এখন বুঝি। আপনার থেকে দূরে থাকতে আমার কি যে কষ্ট হতো। আপনি যদি চুপচাপ আমার সামনে বসে থাকেন, আমার তাতেও প্রশান্তি। দেখার জন্য কি যে ছটফট লাগে…’
– ‘আমাদের ভালোবাসাটা পবিত্র। তাই এটার অনুভূতি গুলোও বিশুদ্ধ।’
– ‘আহ! হুট করে বিয়েটা হয়ে ভালোই হয়েছে দেখছি। অবশ্য বরটা যদি মেঘালয় না হতো, আমি তো জানতাম ই না সুখ কি জিনিস।’
– ‘তাহলে যে অভিমান করে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে? আর কক্ষনো এরকম হবে না তো?’
– ‘না গো হবেনা। আমিতো কনফিউজড ছিলাম শেষ পর্যন্ত আপনার থেকে দূরে থাকতে পারবো কিনা। এত যে দেখতে ইচ্ছে করতো…’

কথাটা বলেই মেঘালয়ের চোখে চোখ রাখলো মিশু। এই চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বাকি জীবন টা পার করে দেয়া সম্ভব। সত্যিই স্বামী স্ত্রী দুজনের মনে যদি একই সাথে, একইরকম ভাবে ভালোবাসা তৈরি হয়, এটার মত সুখ বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও থাকেনা।

মেঘালয় মিশুর আঙু্লের ফাঁকে আঙুল রেখে বললো, ‘একটা গুড নিউজ আছে।’
মিশু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
– ‘তন্ময় সুস্থ হয়ে গেছে। আজকে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।’

চমকে উঠলো মিশু। এই তন্ময়ের জন্যই এত ভূল বুঝাবুঝি, আবার সেই তন্ময়! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে।

মেঘালয় বললো, ‘তন্ময় কথা বলতে পারে। আমার সাথে ওর অনেক ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। ছেলেটা অনেক ভালো বুঝলে।’

মিশু একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘হুম জানি। কিন্তু তুমি হসপিটালে যাও এটা জানতাম না।’
– ‘তুমি আমাকে এখনো কিছুই জানোনা মিশমিশ। আমার কোনো শত্রু নেই। শত্রুদেরকে বন্ধুতে পরিণত করাটা আমার অভ্যেস। সেখানে তন্ময়কে ওই অবস্থায় ফেলে আসার পর আমি আর খোঁজ নিবো না এটা ভাবলে কি করে?’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘কি বলছেন!’
– ‘হুম ম্যাম। আমি অনেকবার গিয়েছি ওকে দেখতে। কখনো তোমাকে বলিনি কারণ ওর কথা তুললেই তুমি বিব্রতবোধ করবে।’

মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো মিশু। কেন যেন চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এই মানুষটা এত ভালো কেন! ইস! সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

৬৬
সকালবেলা
মিশুর ঘুম ভাংলো মেঘালয়ের ডাকে। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করলো, ‘এত সকালে ডাকলেন যে?’
– ‘আম্মু উঠে নাস্তা বানাচ্ছে। তুমি গিয়ে একটু হেল্প করো।’
– ‘আচ্ছা।’

মিশু উঠতে উঠতে চুল বাঁধছিলো। মেঘালয় মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘ঘুম থেকে ওঠার পর তোমাকে খুব মায়াবী লাগে।’

মিশু মাথাটা নিচু করে মেঘালয়ের কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘আমি যাচ্ছি। রান্নাঘরের আশেপাশে একটু ঘুরঘুর করবেন প্লিজ?’

মেঘালয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, ‘কেন?’
– ‘আপনি ঘুরঘুর করলে আমার আনন্দ হবে।’

হাসি পেলো মেঘালয়ের। হাসি চেপে রেখে বললো, ‘আচ্ছা যাও, আমি আসছি।’

মিশু ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মুচকি হাসলো মেঘালয়। পাগলী একটা। এভাবে কেউ বলে? রান্নাঘরের আশেপাশে একটু ঘুরঘুর করবেন প্লিজ? ভেবে আরেক ঝলক হেসে নিলো মেঘালয়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here