হৃদমোহিনী পর্ব ৪৬

0
2327

হৃদমোহিনী
পর্ব ৪৬
মিশু মনি
.
চোখের জল মাটিতে পড়ার আগেই ওষ্ঠে তুলে নেয়ার মত মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। না চাইতেই রত্ন পেয়ে সেটাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার মত বোকামিটা মিশু অন্তত করবে না। মেঘালয় যে কঠিনভাবে ভালোবাসার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে, সেটাকে তুচ্ছ করে দেখার সাধ্য ওর হবেনা কখনোই। মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে অনবরত এসবই ভেবে চলেছে। মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘ফ্রেশ হয়ে আসি।’
মিশু কিছু বললো না। মেঘালয় বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভিজতে ভিজতে মিশুকে ডেকে বললো, ‘এই টুকটুকির মা শুনছো? আমার গামছা টা দিয়ে যাইয়ো তো বউ।’
মিশু তোয়ালে নিয়ে এসে দরজাটা টান দিতেই দেখলো মেঘালয়ের পুরো শরীরে জলের ফোঁটা চিকমিক করছে। এতটা লোভনীয় লাগছে যে নিজেকে সামলে রাখা দায়। মুহুর্তেই ঘোরের মাঝে চলে গেলো মিশু। মেঘালয় হাত বাড়িয়ে তোয়ালে নেয়ার ছলে মিশুর হাতটা একবার ছুঁয়ে দিলো। আর্দ্র শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে যেতেই আর কিছু বলতে হলো না। হাত বাড়িয়ে পুতুলের মত তুলে ধরে মিশুকে বাথরুমের ভেতরে টেনে নিলো মেঘালয়।

৬৮
স্নানের পর মিশুর চেহারায় একটা অনবদ্য স্নিগ্ধতা এসে ভর করে। ভেজা চুল গুলো চিবুকের পাশে দুলছে। মেঘালয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য… ‘
মিশু আড়চোখে তাকিয়ে বললো, ‘তারপর?’
– ‘অতিদূর সমুদ্রের পর, হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা;
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, যমুনা ব্রিজে ট্রাকের উপর..
বলেছিলাম আমি, এতদিন কোথায় ছিলেন?
রংপুরের বনলতা সেন?’

মিশু হাসিতে গড়িয়ে পড়ে বললো, ‘গল্পটা কিন্তু সেখানেই শুরু হয়েছিলো। আমি যদি ছেলেমানুষি করে সেদিন জোৎস্না দেখতে না চাইতাম তাহলে কিন্তু আজকের দিনটা আসতো না।’
– ‘হুম। মাঝেমাঝে কিছু ভূল জীবনটাকে কিছু প্রাপ্তি ই দেয়। তাইনা?’
মিশু কিছু বলতে যাবে এমন সময় শ্বাশুরি মা এসে দরজায় দাঁড়ালেন। পর্দার ওপাশ থেকে বললেন, ‘আসবো মেঘ?’
মেঘালয় শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে বললো, ‘হ্যা আম্মু আসো।’
মা ভেতরে এসে বিছানায় মেঘালয়ের পাশে বসলেন। তারপর কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘দাঁড়ি বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে। ছোট করে ফেলিস। আর তোর মামারা কালকে চলে আসবে। তোর নানুবাড়ির সবাই কালকেই এসে যাবে। অলরেডি সবার বাসায় কার্ড পৌঁছে গেছে। দুদিনের মধ্যেই দেখবি বাড়ি লোকজনে গিজগিজ করছে।’
মেঘালয় বললো, ‘হুম। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। আজকে ফটোগ্রাফার আসার কথা ছিলো। এসেছিলো?’
– ‘না। শোন, মিশুকে তো রংপুরে চলে যেতে হবে। মেহমানরা এসে পাত্রীকে এখানেই দেখে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাক সেটা চাচ্ছি না। আমরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে আয়োজন করে ওকে নিয়ে আসবো। আজকে শপিং শেষ হলে সকালে ওকে পাঠিয়ে দিই?’

মেঘালয় মিশু’র দিকে তাকালো। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছে ওর। গতবার মিশু বাসায় চলে যাওয়ার পর তন্ময় গিয়ে হাজির হয়েছিলো। এবার যেন কোনো ঝামেলা না হয়।

মিশু হঠাৎ বলে উঠলো, ‘আমি হাইকমিশনার অফিস থেকে মিট করে আসি? তারপর বাড়ি যাই?’

মা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার সাথে মিট করবে?’
মিশু বলার আগেই মেঘালয় বললো, ‘আম্মু, মিশুর স্কলারশিপটা এসে গেছে। ওকে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হয়েছে। স্কলারশিপ নেবেই না যখন, তাহলে যাওয়ার কি দরকার আছে?’
মা ঝটপট বললেন, ‘মানে কি? না যাওয়ার কি আছে? এত বড় একটা সুখবর তোরা আমাকে জানাসনি কেন? স্কলারশিপ কি ক্যানসেল করে দেয়ার ব্যাপারে ভেবেছিস?’
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ্যা। আমরা একসাথে থাকি। অযথা একা একা বাইরে গিয়ে করবে টা কি?’
মা তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘এসব কি মেঘ? মেয়েটা কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়েছে, সিলেক্ট হয়েছে এখন অবশ্যই ভাইভাতে যাবে। আর দেশের বাইরে কেন, ওর ভালোর জন্য যদি মহাকাশে স্পেসশিপেও পাঠাতে হয় সেখানেও যাবে।’
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, ‘মা তুমি এসব কি বলছো? মিশুকে বাইরে পাঠালে আমি একা একা… ওর তো বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তাইনা মা?’
মা বললেন, ‘প্রয়োজন অবশ্যই আছে। একটা মেয়ে ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া মানে গবেষণার ক্ষেত্রটা অনেক বড় হয়ে যাবে। অনেক কিছু জানার, দেখার, শেখার সুযোগ পাবে। এতে করে ওর জ্ঞান সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ কিছু আবিষ্কার করেও ফেলতে পারে। সম্ভাবনা কোথায় লুকিয়ে আছে আমরা কেউ তো জানিনা তাইনা?’
মেঘালয় কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, ‘কোনো শ্বাশুরি চায় না তার ছেলের বউ পড়াশোনা করুক, চাকরি করুক কিংবা কোনোকিছুর সাথে যুক্ত হোক। সেখানে তুমি কিনা ওকে বাইরে পাঠাতে বলছো?’
– ‘আমি তথাকথিত শ্বাশুরিদের মত নই। জ্ঞান অর্জনের জন্য তোকে মঙ্গলে পাঠাতে বললেও আমি পাঠাবো। যদি সেখান থেকে ফিরে নাও আসিস, আমার আফসোস থাকবে না। যদিও তুই আমার একমাত্র ছেলে।’

মিশু অবাক হয়ে শ্বাশুরির দিকে তাকিয়ে আছে। একজন মহিলা একইসাথে একজন সুন্দর মেয়ে, একজন ভালো ডাক্তার, ভালো স্ত্রী, ভালো মা, আবার চিন্তাধারাও কত উন্নত! সত্যিই জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কথাবার্তা সবসময়ই আলাদা হয়। আর চিন্তাধারাটাও সাধারণের বাইরে। মুগ্ধতার রেশ কাটতে চাইছে না মিশু’র।
মা মিশুকে বললেন, ‘তুমি ভাইভা দিয়ে আসো। মেঘের কথায় কান দিও না। দেশের বাইরে যাবে কি যাবে না সেটা আমরা আলোচনা করে ঠিক করবো। আগে দেখো তোমাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন দেয়। যাবে কি না পরে দেখা যাবে। আপাতত ভাইভাটা দিয়ে আসো, ইন্ডিয়া হাইকমিশনারের সাথে সাক্ষাতের একটা এক্সপেরিয়েন্স হোক।’
মিশু উঠে এসে শ্বাশুরিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আম্মু, আপনি অনেক স্মার্ট।’
– ‘হা হা হা পাগলী টা। এখন রান্নাঘরে যা, গরুর মাংস মেরিনেট করে রাখবি। আমার মেঘের সাথে একটু কথা আছে।’
– ‘আমি কি থাকতে পারিনা?’
– ‘না। প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু ব্যাপার থাকে, যেগুলো রেস্ট্রিক্টেড দু একজন ছাড়া কাউকে বলা যায়না। সব কথা সবার সামনে বললে তো হবেনা।’
মিশু হেসে বললো, ‘আপনাকে মোটিভেশনাল স্পিকার মনেহচ্ছে। আমি বরং আপনাদের সাথেই থাকি। একজন অতিমানবীর সাথে থাকলে অনেক কিছুই জানা যাবে।’
মা হেসে বললেন, ‘সে পরে দেখা যাবে। এখন বিদায় হ তো। সাবধানে কাজ করবি।’

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে একটা দৌড় দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। মা মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলা শুরু করলেন। মেঘালয়ের ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সম্প্রতি যে শেয়ারগুলো কেনা হয়েছে সেগুলোতে লসের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। ওই কোম্পানির প্রোডাক্ট হঠাৎ করেই বিক্রি কমে গেছে। অনেকগুলো টাকা ধরা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
মেঘালয় সব শুনে গালে হাত দিয়ে টেবিলের উপর হাত রাখলো। তীক্ষ্ণ চোখে কিছু একটা চিন্তা করছে ও। মা কাছে এসে বললেন, ‘যেটা বলার জন্য এসেছিলাম। সংশয় নামে এক ছেলে আমাকে কয়েকদিন থেকে ফলো করছে। যেখানেই যাচ্ছি, ওকে দেখছি। যদিও ও অনেক কেয়ারফুলি ফলো করে। কিন্তু আমার চোখে এড়ায়নি ব্যাপারটা। ছেলেটা কিডন্যাপড করতে চাচ্ছে নাকি অন্যকিছু ধান্ধা করছে আমি বুঝতে পারছি না। তোর বাবাকে বললে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। তুই দ্যাখ তো ব্যাপারটা।’
মেঘালয় মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই সংশয় আবার কে? বয়স কেমন?’
– ‘পঁচিশ ছাব্বিশ হবে।’
– ‘আচ্ছা আমি দেখছি। কাল তোমাকে ফলো করে আমি যাবো। আর কিছু বুঝতে পারো?’
– ‘না। তবে সংশয়ের চেহারার সাথে একজনের চেহারার খুব মিল। সেটা ভাবছি।’
– ‘কার?’
মা বললেন, ‘মেডিকেলে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় এক ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। তোর বাবা ওকে পাবলিক প্লেসে কান ধরিয়ে উঠবোস করানোর পর ছেলেটা আমার মুখে এসিড মারতে আসে। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে পাবলিক টের পেয়ে যায় আর কিছু আবাল ওর এসিড ওর গায়েই ঢেলে দেয়। ছেলেটা বিকলাঙ্গ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর আর কখনো ওকে দেখিনি। কিন্তু সংশয়ের চেহারারর সাথে অদ্ভুত মিল আছে। তাই তোর বাবাকে জানাচ্ছি না।’

মেঘালয় চিন্তিতমুখে বললো, ‘কাহিনীর জটিলতা আছে দেখছি। কালকেই দেখবো, তুমি সাবধানে চলাফেরা কোরো। ডিউটি না থাকলে বাইরে যাওয়ার দরকার নাই। বিয়েবাড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকো, বাকিটা আমি দেখছি। কিন্তু আম্মু, ওর নাম সংশয় তুমি জানলে কি করে?’
– ‘ছেলেটা আমাকে ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রোফাইল ঘেঁটে দেখলাম ওর নাম সবাই সংশয় বলছে।’
– ‘এই বয়সী ছেলে মায়ের মত মহিলাকে ফলো করবে কি কারণে? ব্যাপারটা রহস্যজনক লাগছে।’
– ‘শতবর্ষী বৃদ্ধাকে যুবকেরা ধর্ষণ করছে। আর কি বলবো..’

মেঘালয় হঠাৎ মাকে জাপটে ধরে বললো, ‘মা গো। এভাবে বোলো না।’
– ‘মনে অনেক ক্ষোভ বুঝলি। তুই নাহয় তোর ফ্যামিলিকে আগলে রাখলি, যাদেরকে আগলে রাখার কেউ নেই। সেসব মা মেয়েরা কি পথেঘাটেই ধর্ষিতা হবে? একটা সময়ে ভাবতাম ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো। কিন্তু এখন মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে এতটাই কষ্ট হয় যে ইচ্ছে করে দেশ ছেড়ে চলে যাই।’
– ‘এসব ভেবে কষ্ট পেওনা আম্মু। যারা পরিবার থেকে শিক্ষা পায়না, তারা কারো কথায় ভালো হবার নয়। তুমি চিন্তা কোরো না।’
– ‘আচ্ছা, থাক কাজ আছে।’
মেঘালয় করুণ সুরে বললো, ‘মিশুকে কি বাইরে পাঠাতেই হবে মা?’
মা মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালেন। ছেলের মুখটা দেখে বড্ড মায়া লাগলো ওনার। হাসার চেষ্টা করে বললেন, দেখা যাক। আগে দেখা করে আসুক। তোকে যেটা বললাম সেটা একটু দেখিস, আমি রান্নাঘরে যাই।’
মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। মেঘালয় গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। একসাথে দুটো খারাপ খবর, ভেবেচিন্তে সমাধানে আসতে হবে। খারাপ সময়ের থেকেও কঠিন হচ্ছে এমন সময়ে নিজেকে শক্ত রাখাটা।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here