হৃদমোহিনী পর্ব ৪৮

0
2228

হৃদমোহিনী
পর্ব ৪৮
মিশু মনি
.
একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে!
মেঘালয় ছুটে সামনে এসে দেখলো একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে একটা বাইক উলটে পড়ে আছে রাস্তায়। বাইকের উপর সেই সংশয় নামের ছেলেটা। মেঘালয় নিজেই আগে দৌড়ে এসে সংশয়কে টেনে তোলার চেষ্টা করলো। সংশয়ের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, মাথায় হেলমেট দেয়া ছিলো না। মেঘালয় ওকে টেনে তুলেই কোলে নিয়ে এসে মায়ের গাড়িতে তুলে দিলো। তারপর বললো, ‘ওকে আগে হসপিটালে নিয়ে যাও।’

সংশয়ের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, তবুও বর্ষা আহমেদকে দেখে ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো ওনার দিকে। মা সংশয়ের কাঁধটা নিজের কোলের উপর নিয়ে ড্রাইভারকে বললেন ফাস্ট এইড বক্সটা দিতে। মুহুর্তের মধ্যেই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে দিলেন উনি। সংশয়ের অবস্থা যাকে বলে বাকরুদ্ধ হওয়া। ও যাকে ফলো করতে এসে আজ এক্সিডেন্ট করলো, তিনি ই ওকে গাড়িতে তুলে সেবা করছেন আবার হাসপাতালেও নিচ্ছেন। কি অদ্ভুত ব্যাপার!

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। রাস্তার লোকজন পাশে সরে গিয়ে গাড়িটাকে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো। মেঘালয় উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললো, ‘কখন কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায় আমরা কেউই জানিনা। এ জন্যই বাইকে উঠলে সবসময় মাথায় হেলমেট পড়া উচিৎ।’
একজন লোক বললো, ‘হ্যা। এই গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে, ওনার কাছে জরিমানা দাবী করো।’

যে গাড়িটাকে আটক করা হয়েছে সেই গাড়ির ড্রাইভার বলে উঠলো, ‘আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করুন। ওই বাইক টাই হঠাৎ সাইড চেঞ্জ করে এই সাইডে এসেছে আর আমার গাড়িতে ধাক্কা খেয়েছে। পুরোটা ওই বাইকের ছেলেটার কারণেই হয়েছে।’

লোকজন চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। দু একজন আবার ড্রাইভারকে নির্দোষ ও বললো। মধ্য থেকে এক লোক বলে উঠলো, ‘ড্রাইভারের কোনো দোষ নেই। ওনাকে ছেড়ে দেন।’

মেঘালয় অবস্থা দেখে বললো, ‘ছেলেটার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, তবুও ওকে হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। এখন আপনারা যে যার কাজে যান। আমি নিজেও খেয়াল করেছি ছেলেটা আঁকাবাঁকা ভাবে বাইক চালাচ্ছিলো।’

লোকজন আর কেউ কিছু বললো না। সবাই চলে গেলো যে যার মত। মেঘালয় নিজের গাড়িতে এসে উঠলো। তারপর চলে এলো মায়ের হাসপাতালে। আসামি নিজে থেকেই ধরা পড়েছে, আর ওকে ছাড়বে কে? ঘটনার নাড়িভুঁড়ি সব টেনে বের করবে মেঘালয়।

৭০
গাড়ি মোটামুটি ভালো গতিতেই এগোচ্ছিলো। বাইপেলে ঢোকামাত্র শুরু হলো জ্যাম। মিশু ফুল ভলিউমে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো। তন্ময় কোনো কথা না বলে একটানাভাবে ফেসবুকিং করে যাচ্ছে। মিশুর ঘুম ভাংলে দেখলো গাড়ি এখনো ঢাকা ছাড়েনি, জ্যামেই আটকে আছে।
চোখ কচলে ফোনটা বের করলো মিশু। দেখলো মেঘালয় অনেকবার কল দিয়েছে। ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো বলে বুঝতে পারে নি ও। কল ব্যাক করামাত্র মেঘালয় রিসিভ করে বললো, ‘ঘুমাচ্ছিলে?’
– ‘রাগ কমেনি তোমার?’
– ‘উহু, ঘুমাচ্ছিলাম।’
– ‘আচ্ছা। শরীর কেমন লাগছে?’
– ‘অনেক ভালো কিন্তু বাস এখনো জ্যামে আটকে আছে। ঢাকা ছাড়তে পারিনি এখনো।’
– ‘তোমাকে গাড়িতে পাঠানো দরকার ছিলো। কিন্তু ড্রাইভারের অনেক কাজ এখন, বোঝো ই তো। বিয়ে বাড়ির কত ঝামেলা।’
– ‘আমি ঠিক আছি। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি সময়মত লাঞ্চ করে নেবেন।’
– ‘মিশু, আমি একটা ঝামেলায় আছি। সংশয়..’
– ‘কিসের সংশয়?’
– ‘তোমাকে পরে বলবো সবকিছু। এখন একটু রাখি?’
মিশু ‘আচ্ছা’ বলে ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলো। পানির পিপাসা পেয়েছে খুব। কিন্তু পানি রাখা আছে ব্যাগে আর ব্যাগ মাথার উপরে। ওটা নিতে হলে সিট থেকে বের হতে হবে। মিশু উঠে দাঁড়ালে তন্ময় জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনো সমস্যা?’
– ‘আমার ব্যাগটা নিতে হবে।’
– ‘আমি দিচ্ছি।’

ব্যাগ নামিয়ে দিলো তন্ময়। মিশু ব্যাগ থেকে চিপস, কেক ও পানির বোতল বের করে নিলো। গাড়িতে ওঠার সময় একগাদা খাবার কিনে দিয়েছিলো মেঘালয়। তন্ময় আবারো ব্যাগটা উপরে রেখে সিটে বসে পড়লো।
মিশু কেক এর প্যাকেট খুলে এক পিস কেক বের করে কামড় দিলো। খেতে খেতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিলো। পুরো কেক শেষ করে ঢোক ঢোক করে পানি খেলো। পানি খাওয়ার সময় গাড়ি ব্রেক কষতেই খানিকটা পানি জামার ভেতর ঢুকে গেলো মিশু’র। তন্ময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো। মিশুর’ও হাসি পেয়ে গেলো।

বোতল টা সামনে রেখে চিপসের প্যাকেট খুলে টুকটুক করে খেতে আরম্ভ করলো। তন্ময় কোনো কথা বলছে না। গাড়ির জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো মিশু। তন্ময় মুচকি হাসলো।

মিশু চিপস খেতে খেতে আবারো ইয়ারফোন ঢুকিয়ে দিলো কানে। মাথা দুলাতে দুলাতে চিপস খেতে লাগলো কুড়মুড় করে। কানে গান বাজছে, ‘বাদ্রি কি দুলহানিয়া…’

গানের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে মিশু। গাড়ি ছুটেছে সাঁইসাঁই করে। জানালা দিয়ে বাতাস আসছে, বাতাসে চুল উড়ছে মিশুর। মেঘালয় ওকে এসি গাড়িতে তুলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু জানালা দিয়ে বাতাস আসাটাকেই মিশুর বেশি পছন্দ বলে এসি গাড়িতে ওঠেনি ও। চিপস খাওয়া শেষ হলে খোসাটাকে সামনের সিটের পিছনের ঝুঁড়িতে রেখে দিলো। তারপর বললো, ‘এখন কি খাই?’

তন্ময় ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, ‘কিছু বললে?’
মিশু ইয়ারফোন খুলে মুখ বাঁকা করে বললো, ‘না।’
– ‘ভালো করে বলো। মুখ বাঁকা করছো কেন? আমার সাথে কি কখনো তোমার শত্রুতা ছিলো?’
– ‘ছিল। তুমি আমার হাজার জনমের শত্রু।’
– ‘হাজারবার জন্ম নিলেও কি তুমি মেঘালয়কেই বিয়ে করবা?’
– ‘একশোবার করবো।’
– ‘হাজারবার জন্ম নিয়ে একশোবার ওকে বিয়ে করবা। বাকি নয়শো বার কাকে করবা?’
মিশু মুখটা বাঁকা করে চোখ পাকিয়ে বললো, ‘চুপচাপ বসে থাকো। এত পেঁচাল পারো কেন?’
– ‘ওহ সরি। তোমার পাশে বসে থাকলে আপনা আপনি মুখ দিয়ে ক্যাসেটের মত আওয়াজ বের হয়।’

মিশু আবারো ইয়ারফোন কানে দিলো। অযথা কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। তন্ময় যে ওর পাশেই বসেছে সেটা মেঘালয়কে জানানো দরকার। কিন্তু মেঘ কি এটাকে সহজভাবে নিতে পারবে? যদি দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়?
ভাবতে ভাবতে মেঘালয়কে কল দিলো মিশু। দুবার রিং হলো কিন্তু রিসিভ করলো না। হয়তো কোনো ঝামেলায় আছে। এদিকে তন্ময়ের কথাটা ওকে জানাতে না পারলে শান্তি লাগবে না মিশু’র। আবার এটাও মনে হচ্ছে মেঘালয়কে না জানিয়ে জার্নিটা শেষ করাই যায়। ওকে বললে অযথা দুশ্চিন্তা করবে, তারচেয়ে বরং কোনো কথা না বলে চুপচাপ জার্নিটা শেষ করে ফেললেই হয়। বিয়েটা ভালোভাবে হয়ে যাক, এরপর একদিন বুঝিয়ে বললেই হবে।

চোখ বন্ধ করে এসবই ভাবছিল মিশু। জানালা দিয়ে শোঁ শোঁ করে বাতাস আছে। চোখ তুলে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করলো ও। তলপেট খামচি ধরে আছে, একবার ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু বগুড়ার আগে বাস কোথাও ব্রেক দেবে বলে মনে হয় না। পেট চেপে ধরে বসে রইলো মিশু।

অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মিশু আর থাকতে পারছে না, এবার ওয়াশরুমে যেতেই হবে। এদিকে গাড়ি আগাচ্ছে খুব ধীরেধীরে। একটু পরপরই জ্যামে আটকে যাচ্ছে। বগুড়া পৌঁছাতে আজকে বোধহয় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু এতক্ষণ পেট চেপে ধরে বসে থাকাটা কষ্টকর।

মিশুর মুখ দেখে তন্ময় হয়তো আন্দাজ করেছে কিছু। ও জানতে চাইলো, ‘কোনো সমস্যা?’
– ‘আমি ওয়াশরুমে যেতাম।’
তন্ময় কি যেন ভাবলো। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এখন কোথায় আছে। মিশু মুখ বিকৃত করে বললো, ‘গাড়িটা এদিকে কোথাও ব্রেক দিতে পারে না?’
– ‘খুব কষ্ট হচ্ছে?’
– ‘আবার জিজ্ঞেস করে কষ্ট হচ্ছে কিনা। মূত্রথলির প্রেশার কমাতে হবে বাবা। গাড়িটা থামবে কখন?’

তন্ময় চিন্তায় পড়ে গেলো। মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে ওকে দেখে। কিন্তু বাস থামবে বগুড়ায় গিয়ে। এখনো কয়েক ঘন্টা লাগতে পারে। মেয়েটা এতক্ষণ সহ্য করবে কি করে?
বাধ্য হয়ে উঠে এলো তন্ময়। বাসের ড্রাইভারের পাশে বসে ওনাকে বললো, ‘গাড়িটা সামনে কোনো রেস্টুরেন্ট দেখে থামাবেন।’

ড্রাইভার অবাক হয়ে তন্ময়ের দিকে একবার তাকালো। সুপারভাইজার এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনো সমস্যা আপনার?’

তন্ময় বললো, ‘গাড়িটা সামনে কোথাও দাড় করাবেন, একজন মহিলা ওয়াশরুমে যাবেন।’
– ‘না না গাড়ি কোথাও দাড় করানো যাবে না। এইমাত্র রাস্তাটা ফাঁকা পেলাম, সোজা চলে যাবো। একেবারে বগুড়ায় গিয়ে বাস ব্রেক হবে, এর আগে হবে না।’

তন্ময় রেগে উঠে এসে বললো, ‘বাস চালানোর সময় ঠিকই দু জায়গায় দাড় করিয়ে তোমরা পুরুষরা গাড়ি থেকে নেমে প্রস্রাব করতে বসো। এজন্য বোঝো না একটা মেয়েরও সমস্যা হতে পারে। হয় বাস থামাবা, আর নয়তো আমি ই বাস থামিয়ে দিবো। থামাও বলছি।’

তন্ময়ের রাগ দেখে ড্রাইভার বাস থামাতে বাধ্য হলো। সকল যাত্রী মাথা তুলে তাকালো সামনের দিকে। সবার চোখে কৌতুহল। মিশু একবার তাকিয়েই বুঝে গেছে কাহিনী কি। বাস ড্রাইভার তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভাই চিল্লাচিল্লির দরকার নাই। গাড়ি থামিয়েছি, কে ওয়াশরুমে যাবে নিয়ে যান আপনি।’
তন্ময় সিটের কাছে এসে মিশুকে বললো, ‘আসো আমার সাথে।’

তারপর বাসের দরজায় এসে ড্রাইভারকে বললো, ‘আবার আমাদেরকে রেখেই বাস ছেড়ে দিও না। নইলে কিন্তু সারাজীবনের মত আপনার বাস চালানো বন্ধ করে দিবো।’
সুপারভাইজার বিরক্ত হচ্ছে, সাথে ক্ষোভ নিয়ে তাকাচ্ছে। কিন্তু ড্রাইভার কিছু বলছে না। সে জানে যাত্রীরা চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। চুপচাপ বাস থামিয়ে বসে আছে।

তন্ময় মিশুকে নিয়ে নেমে গেলে আরো কয়েকজন লোক ওনাদের স্ত্রীকে নিয়ে নেমে আসলো। সবাই বলছিলো বাসটা ব্রেক দিয়ে ভালোই করেছে। জ্যামে তিন ঘন্টা আটকে থাকার পর বাস ছেড়েছে। যাত্রীরা তো আর যন্ত্র নয়।

মিশু ফ্রেশ হয়ে এসে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। তন্ময় বললো, ‘হাসছো কেন আবার?’
– ‘তোমার রাগ দেখে। ড্রাইভার যা ভয় পেয়েছে বাবাহ।’
– ‘তুমি এখন খুশি?’
– ‘থ্যাংকস।’
বাসের আরো কয়েকজন যাত্রী এসে ধন্যবাদ জানালো তন্ময়কে। তন্ময় প্রসন্ন হাসি ফিরিয়ে দিলো। তন্ময় মিশুকে বাসে উঠতে বলে নিজে দোকানে গিয়ে কিছু খাবার কিনে নিলো। সবাই এসে বাসে উঠলে বাস চলতে শুরু করলো আবারো।

মিশু হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে। তন্ময়ের আচরণের কারণে এখনো হাসি থামছে না ওর। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। মেঘালয় ফোন করেছে। মিশু রিসিভ করে হাসতেই লাগলো।
মেঘালয় হেসে বললো, ‘এই পাগলী, হাসছো কেন এভাবে?’
– ‘একটা কথা বলবো, রাগ করবেন না তো?’
– ‘আমি তোমার উপর রাগ করিনা কখনো। বলো?’
– ‘আমার পাশের সিটে না তন্ময় বসেছে, ও বগুড়ায় যাবে। কি অদ্ভুত ব্যাপার, আমার পাশের সিটটাই ওর হলো।’
– ‘জানি।’
– ‘মানে! কিভাবে জানো?’
– ‘তন্ময় ফোন করে বলেছে আমাকে।’

মিশু চমকে তাকালো তন্ময়ের দিকে। চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনাতে। তন্ময় মেঘালয়কে ফোনে জানিয়েও দিয়েছে! অদ্ভুত!
মেঘালয় বললো, ‘তন্ময়ের অসুস্থতার সময়ে প্রায়ই ছুটে গেছি হসপিটালে। দুজন নার্সকে বলে দিয়েছিলাম সার্বক্ষণিক ওর খেয়াল রাখতে। এখন ও আমাকে অনেক রেসপেক্ট করে মিশু। বাসে উঠেই তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তখন তন্ময় আমাকে ফোনে জানিয়েছে।’

মিশু আর কিছু বললো না। শত্রুতার বদলে বন্ধুত্ব দেখে ওর অবাক লাগছে। কেবলমাত্র মেঘালয় বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। মেঘালয়ের সাথে মিশুর চরিত্রের ও অদ্ভুত মিল! আল্লাহ তায়ালা দুজনকে দুজনের জন্যই সৃষ্টি করেছেন!
মেঘালয় বললো, ‘তুমি টেনশন কোরো না, সাবধানে যেও।’

মিশু কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা হরবর করে বলে দিলো মেঘালয়কে। বলতে বলতে খিলখিল করে হাসছিলো। সবটা শুনে মেঘালয় মনেমনে ধন্যবাদ জানালো তন্ময়কে। তারপর টুকটাক কথা সেরে ফোন রেখে দিলো।

মিশু সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো তন্ময়ের সাথে। মেঘালয় বলে দিয়েছে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে। ওয়েডিং প্রোপ্রামে আসার জন্যও দাওয়াত করে বলেছে। তবুও আগ বাড়িয়ে কথা না বলে চুপ করে রইলো মিশু।
তন্ময় চিপস বের করে মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো। প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে চিপস নিয়ে মিশু বললো, ‘থ্যাংকস। মেঘকে ফোন করে বলে দিয়েছো বলে আরেকবার থ্যাংকস।’
– ‘তুমি বলতে হয়ত আনইজি ফিল করবে তাই আমি ই বলে দিলাম।’
– ‘তুমি সবদিক থেকেই অনেক ভালো তন্ময়। শুধু..’
– ‘শুধু কি?’
– ‘কিছু না।’
– ‘জানি। শুধু তোমাকে অপমান করে ফিরিয়ে দেয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভূল ছিলো। তাই না?’

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হুম ছিলো। এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো হবে। তো, এখন কি করবে বলে ভেবেছো? পড়াশোনা কিংবা চাকরি?’
– ‘আমার জীবনের মোড়টাই ঘুরে গেছে মিশু। বাবা নেই, মা নেই, ভাই বোন নেই। একেবারে একা একা বেঁচে থেকে কি করবো? আপনজন বলে তো কেউ নেই আমার। একমাত্র তুমি ছিলে, তোমাকেও তো আর কোনোদিনো পাবো না। কার জন্য পড়াশোনা বা চাকরী করবো বলো তো?’

মিশু নিশ্চুপ হয়ে শুনলো। তন্ময়ের কথা শেষ হওয়ার পর বললো, ‘নিজের জন্য বাঁচো তন্ময়। যা হারিয়েছো, এগুলো একটাও আর ফিরে পাওয়ার মত নয়। নিজেকে গুছিয়ে নাও, জীবনটাকে নতুন ভাবে শুরু করো।’
– ‘তোমার জীবনটা তো তুমি নতুনভাবে শুরু করেছো। কিন্তু আমার জীবনে তো সব একেবারে শেষ হয়ে গেছে। এখানে শুরু করার মত আর কিছুই নেই।’
– ‘এটা ভূল ধারণা তন্ময়। সবকিছু শেষ থেকেও শুরু করা যায়। নিজের জন্য বাঁচো, নিজেকে ভালোবাসো। আংকেল যা কিছু রেখে গেছেন, সব দেখাশোনা করো। তোমার লাইফে আবার কেউ আসবে। তাকে নিয়ে একটা নতুন জীবন সাজাতে হবে।’

তন্ময় হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘তোমার পরে কাউকে নিয়ে ভাবাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয় মিশু। আমি একেবারে কোমায় চলে যাচ্ছিলাম, তখনও প্রতি মুহুর্তে আমার আত্মাটা তোমার জন্য ছটফট করেছে। তোমার প্রতি আমার যে ভালোবাসাটা আছে, এটা আজীবন থাকুক। মরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটাও তোমরা হতে দিলে না। তোমাকে ভালোবেসেই বাকিটা জীবন কেটে যাক।’

মিশু’র অপ্রস্তুত লাগছে। কিন্তু এই মুহুর্তে কথাটা এড়িয়ে যেতেও পারছে না।
ও বললো, ‘আমাকে ভালোবেসে গেলেও বিনিময়ে এখন কিছুই পাবে না। বিয়েটা না হলে আমি নির্দ্বিধায় তোমাকে ক্ষমা করে দিতাম, কিন্তু আমার এখন কিছুই করার নেই।’
তন্ময় একবার তাকালো মিশুর মুখের দিকে। খুব মায়া লাগলো ওর। এই এক মাসেই মিশুর ফিটনেস, চেহারার উজ্জ্বলতা সবকিছু বেড়ে গেছে। ত্বকে লাবণ্যময়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিশুকে দেখলেই এখন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এই মেয়েটাকে কিভাবে ছাড়তে পেরেছিলো সেটা ভাবতে পারছে না তন্ময়। ভাবলেই নিজেকে নিজেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে।

কেউ আর কোনো কথা বললো না। অনেকটা পথ কেটে গেল এভাবেই। মিশু ইয়ারফোন কানে গুঁজে দিয়ে বসে রইলো চুপ করে। তন্ময়ও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। এখন নিজের মুখটাও মিশুকে দেখাতে ইচ্ছে করছে না ওর।

বাস যমুনানদী ক্রস করার সময় মিশু উৎফুল্ল হয়ে উঠছিলো। এই জায়গাটায় মেঘালয়ের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হাত ধরে সেতু দেখানো, নতুন এক থ্রিল উপহার দেয়া, গাড়ি থেকে লাফ দেয়া, ট্রাকে ওঠা.. সবকিছু ভাবলে দিনটাকে আবারো ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। মিশুর অদ্ভুত লাগছে একটা জিনিস ভেবে, সেই রাতে ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো খুব। সুইসাইড করতে চাইছিলো বারবার করে। মেঘালয় ওকে কতকিছু বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলো। তন্ময়কে ফোন করে দেখেছিলো নাম্বার ব্লাকলিস্টে রাখা। মিশু সেদিন প্রচুর কেঁদেছিলো। অথচ আজ আবারো সেই একই জায়গায় তন্ময়ের সাথেই যাচ্ছে ও। আর তন্ময় এখন ঠিক একইভাবে মিশুকে চাচ্ছে, কিন্তু পাশাপাশি বসে থাকার পরও মিশু আজ অন্য কারো। যার জন্য মিশুর মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো, সেই মানুষটা ওর জন্যই মতে বসেছিলো। কি অদ্ভুত নিয়ম জগতের!

ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বাসও চলছে দ্রুত গতিতে। বাকি পথটা কেউ কোনো কথা বললো না। দেখতে দেখতে বগুড়ার কাছাকাছি চলে এলো বাস। বিকেল পেরিয়ে এসেছে, কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যে নামবে। বগুড়ায় পৌঁছালেই নেমে যাবে তন্ময়। ও ভাবছিলো শেষবারের মত মিশুর সাথে আর কোনো কথাই হলো না। কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ কি ঘটে গেলো বোঝা গেলো না। বাসটা অনেকদূর উপরে উঠে প্রকট শব্দ করে থেমে গেলো। বাসের যাত্রীরা সামনের সিটের সাথে ধাক্কা খেলো এসে। মিশুও টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলো। তন্ময় দুহাতে জাপটে ধরলো ওকে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here