হৃদমোহিনী পর্ব ৫৬

0
2458

হৃদমোহিনী
পর্ব ৫৬
মিশু মনি
.
৮১
কয়েকদিন পর
স্কলারশিপের চিঠি এসে গেছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ। দু’মাস আগে মিশু যেমনটা চেয়েছিলো ঠিক তেমনটাই হয়েছে। কিন্তু এই দু’মাসের মাঝে যে মেঘালয় জীবনে এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেবে সেটা অজানা ছিলো। এলোমেলো বলাটা অন্যায় হয়ে যাবে, সে তো জীবনে আলো হয়ে এসেছে। সেই আলো নিভিয়ে দিয়ে দূর পরবাসে চলে যাওয়াটা কতটা ন্যায়সঙ্গত হবে?

ভাবতে ভাবতে মনটা উদাস লাগছে। চারিদিক থেকে শূন্যতা গ্রাস করে ফেলছে মিশুকে। বসে থাকতে না পেরে ছুটে বসার ঘরে এলো। এ ঘরে পুরো দেয়ালের একদিকে বিশাল কাঁচ লাগানো। বাইরে মেঘের ঘনঘটা জমতে আরম্ভ করেছে। এমন ধূসর কালো মেঘের সাথে দমকা হাওয়া দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। বুকের ভেতর কেমন কেমন করতে শুরু করে। মাঝেমাঝে মনেহয় মেঘ – বৃষ্টির সাথে মনের একটা বিশেষ যোগসূত্র আছে। সবকিছু তোলপাড় হওয়ার মত একটা ধাক্কা লাগে, আবার নতুন নতুন প্রেমে পড়ার স্বাদ অনুভূত হয়।

মিশু জানালার কাঁচ ঘেষে বসে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। কলিংবেলের শব্দ ওর কানে পৌঁছাচ্ছে না। ভীষণরকম উদাসীনতা ভর করলে যা হয়। পুরনো স্মৃতি মনে করতে ইচ্ছে করছে, আবার নতুন স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। আকাশের কালো মেঘের ভেলা আরো কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে।

মেঘালয় এসে পাশে দাঁড়ালো। গা থেকে কোট খুলতে খুলতে বললো, অনেক্ষণ থেকে বেল বাজাচ্ছি শুনতে পাওনি?

মিশু চমকে বললো, ‘না তো। কখন এলেন?’
– ‘এইমাত্র। তোমার মন খারাপ?’
– ‘কারণ জানতে চাইবেন না। মন খারাপের কারণ বলাটা বিরক্তিকর।’
– ‘বেশ। জানতে চাইলাম না। কিন্তু মন খারাপের স্থায়িত্ব কমানোর চেষ্টা করলে কি আমার পাপ হবে?’
– ‘না। তবে সবসময় মন ভালো করার চেষ্টা না করাই ভালো। মাঝেমাঝে মন খারাপের দরকার আছে।’
– ‘বেশ। এখন বিদ্যুৎ চমকাবে। ঘরে এসো।’
– ‘মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে ভালো লাগে।’
– ‘মাঝেমাঝে কি আমাকে অসহ্য লাগে?’

মিশু এবার চোখ তুলে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। একটা হাফ সিল্ক নীল রংয়ের শার্টের সাথে বেগুনি টাই পড়েছে মেঘালয়। সুদর্শন যুবকের মত লাগছে। দেখার পর নিমেষে মন ভালো হতে চাইলেও মিশু মুখ ভার করে বললো, ‘এই মুহুর্তে অসহ্য লাগছে। আমার সামনে থেকে যান।’

মেঘালয় আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। মিশু নিষ্পলকভাবে বৃষ্টির ফোঁটা দেখছে। কতক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে নিজেও জানেনা। মেঘালয় হাত ধরে টেনে তোলার সময় ওর হুঁশ হলো।
– ‘রাজকন্যার হয়েছে টা কি হুম?’
– ‘আমার আজ খুব মন খারাপ।’
– ‘আরেকটু খারাপ করে দেই?’

মিশুর উত্তরের অপেক্ষা না করে মেঘালয় ওকে কোলে নিয়ে রুমে এলো। জানালার পাশে ওকে দাড় করিয়ে দিয়ে বললো, ‘এখন কি আমাকে সহ্য হচ্ছে?’
– ‘এখনো অসহ্য লাগছে।’
– ‘আমি চলে যাবো?’

মেঘালয় চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মিশু ওর শার্ট খামচে ধরে বললো, ‘ভিসার সব কাগজপত্র পাঠাতে বলেছে। আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। আপনি বলে দিন না আমি কি করবো?’
– ‘পাঠিয়ে দাও।’
– ‘যদি না পাঠাই?’
– ‘তাহলে তোমাকে ইন্ডিয়ায় থাকতে দেবে না।’
– ‘না দিলে কি আমার খুব ক্ষতি হবে? প্রত্যেকটা রাত স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে?’

মেঘালয় মিশু’র চোখের দিকে তাকালো। চোখ পাথরের মত কঠিন। সেই পাথর ফেটে জল আসছে মনে হচ্ছে। বাবা মা সবাই মিলে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা মিশুকেই নিতে বলেছে। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা মেঘালয়ের। ও পিছনে সরে এসে সাউন্ডবক্সে একটা গান ছেড়ে দিলো।

মিশু জানালার এক কোণে দাঁড়িয়ে, মেঘালয় আরেক কোণে।
মিউজিকটা শুনেই মনটা কেমন করতে শুরু করেছে। এরপর বাজতে লাগলো গান,

‘স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে, যেন মনেতে উঁকি দেয়,
শিশিরভেজা মনটা আমার, লুকোচুরি খেলে নীলিমায়..
যেন স্বপ্নে হারাই, আমি স্বপ্ন কুড়োই,
হৃদয়ে সুখের অনুরণ।
ভাবে মন অকারণ সারাক্ষণ,
অনুভবে সুখের আলোড়ণ।’

গান বেজে চলেছে। মিশু অস্থির হয়ে বললো, ‘গানটা শুনে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তখন ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ি, রেডিওতে বারবার গানটা বাজতো। প্রতিদিন রাত ১১ টা থেকে বারোটায় আম্মু গানটা শুনতো। আমি আম্মুর পাশে শুয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। কি অদ্ভুত সব স্মৃতি!’

মেঘালয় অবাক হওয়ার ভান করে বললো, ‘তাই!’
মিশু বললো, ‘হুম। আমার আপুর একটা বাটন ফোন ছিলো, সেটা নিয়ে মাঝেমাঝে ইয়ারফোনে গানটা শুনতাম আর ধানক্ষেতের পাশে বসে হাওয়া খেতাম। সেই ছোট্টবেলা, সেই সোনালি স্মৃতি! বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছে।’
– ‘হুম। আমার টিনএজের গান এটা। একদিন কক্সবাজার থেকে আসার পথে পুরো রাস্তাটাই এই গান শুনতে শুনতে এসেছি।’

মিশু কাছে এসে মেঘালয়ের হাত ধরে বললো, ‘স্মৃতি এত পোড়ায় কেন? স্মৃতিগুলো সুন্দর তবুও বুকটা খানখান করে। ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।’
– ‘আর আমাকে কোন স্মৃতিতে বাঁধলে? আমাকে মনে পড়ার মত স্মৃতি কি মগজে একটাও নেই?’

মিশু খপ করে মেঘালয়ের বাহু চেপে ধরে ওকে জাপটে ধরলো। তারপর শুরু করলো আবারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। মেঘালয় এটুকু বেশ ভালো করেই জানে যে এই মেয়েটাকে একা কিছুতেই ছাড়া যাবে না। তবুও সে যদি যেতে চায়, বাঁধা দিলে হয়ত কষ্ট পাবে। কাজেই এমন কিছু করা দরকার যাতে মেঘালয়কে রেখে দূরে যাওয়ার ভূতটা একেবারেই মাথা থেকে দূর হয়ে যায়। এ জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ হচ্ছে একটা ট্যুর। ঘুরতে গেলে তিনদিন একসাথে কাটানোর পর এতবেশি মায়া জন্মে যাবে যে আর দূরে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারবে না মিশু।

মেঘালয় মিশুর মুখ তুলে বললো, ‘শরীর ভালো লাগছে?’
– ‘হ্যা। শুধু মনটাই খারাপ।’
– ‘ঘুরতে যাবা?’

মিশু চোখ তুলে তাকানো মাত্রই ফিক করে হেসে ফেললো। ওর হাসির কারণ বুঝতে না পেরে মেঘালয় হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। মিশু বললো, ‘এই ঝড় বৃষ্টিতে কোথায় যাবো আবার?’

মেঘালয় বললো, ‘রাতের বাসে। ঝুম বৃষ্টিতে, অন্ধকার বাসে তুমি আর আমি। শিরশির করে হাওয়া এসে কানে লাগবে। পানির ঝাপটায় গা ভিজে যাবে তোমার। তুমি হন্তদন্ত হয়ে জানালা লাগাতে গিয়ে হাতে ব্যথা পাবে। তারপর আমি জানালা লাগিয়ে দিয়ে আমার বুকের ভেতর শক্ত করে তোমাকে চেপে ধরবো। তুমি নড়াচড়া করবা, আমি আরো শক্ত করে চেপে ধরবো। বুকের সাথে পিষে ফেলবো তোমাকে।’

মিশু ইতিমধ্যে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে। মেঘালয়ের বলার যা ভঙ্গি, শুনলেই মনের ভেতর আগডুম বাগডুম বাজতে শুরু করে। ইশ! কখন যাবো বেড়াতে?

মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, ‘দাঁড়াও টিকেট বুকিং দিই।’

৮২
অফিসের কাজগুলো গোছানোর জন্য অফিসে গেছে মেঘালয়। মিশু বাসায় বসে ব্যাগ গোছাচ্ছে। এখন ওর মন বেশ ফুরফুরে। স্কলারশিপ, ভিসা দূরে যাক। আগে ট্যুর দিয়ে আসি। মেঘালয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়া মানেই একটা কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করা। সেই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মানেই হয় না।

কলিংবেল বেজে উঠলে দৌড়ে দরজা খুলতে গেলো মিশু। মেঘালয় ভেতরে ঢুকতেই মিশু হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠার বায়না ধরলো। মেঘালয় ওকে সরিয়ে দিয়ে সোজা রুমে গিয়ে ঢুকলো। মিশু মুখ কালো করে পিছুপিছু ছুটলো ওর। এসে দেখলো মেঘালয় টাই খুলে রেখে বাথরুমে ঢুকে পড়েছে। মিশু কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় বাসায় ফিরে একটা কথাও বললো না।
মিশু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসলো। মেঘালয় তোয়ালে চাইলে তোয়ালে হাতে ছুটে বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল মিশু। কিন্তু তোয়ালে নিয়ে গা মুছে মেঘালয় বেড়িয়ে এলো বাথরুম থেকে। একবার মিশু’র সাথে কথাও বললো না। মিশুর কান্না এসে যাচ্ছে।

মেঘালয় তোয়ালে ছুড়ে মেরে রুম থেকে বেড়িয়ে খাবার টেবিলে চলে গেলো। মিশু থ হয়ে বসে পড়লো মেঝের উপর। এই লোকটা আজ এমন কেন করছে? তোয়ালে ছুড়ে মারার অভ্যাস তো কখনোই ওনার ছিল না। এই কয়েক ঘন্টায় কিছু হয়েছে বোধহয়।

মেঘালয়ের গলা শোনা গেলো, ‘মিশু, এই মিশু।’
মিশু ছুটে এলো খাবার টেবিলে। মেঘালয় টেবিলে বসে আছে। মিশুকে দেখে বললো, ‘বসো। খিদে পেয়েছে অনেক।’

মিশু ভয়ে ভয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লো। কোনো কথা না বলে প্লেটে খাবার তুলে দিলো। মেঘালয় খাবার খাওয়ার সময়েও কোনো কথা বললো না। মিশু বারবার ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছিলো ওর দিকে। কিন্তু মেঘালয়ের কোনো ভাবান্তর নেই। সে দিব্যি খেয়েই চলেছে। খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো। অথচ প্রতিদিন মিশু’র খাওয়া শেষ না হলে হাত ও ধোয় না সে। মিশু মুখ কাচুমাচু করে তাকাচ্ছে। আর খেতে পারলো না ও।

মেঘালয় জামাকাপড় বদলে চুল আচড়াচ্ছে। মিশু দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, ‘কি হয়েছে আপনার?’
– ‘কই কিছু না তো।’
– ‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’
– ‘রেগে থাকবো কেন আজব তো।’
– ‘হঠাৎ আপনার সবকিছু বদলে গেছে।’
– ‘আরে পাগলী মেয়ে, কিছু হয়নি আমার।’

মেঘালয় ঘড়ি হাতে পড়ে ওয়ালেট খুঁজতে লাগলো। মিশু সেটা এগিয়ে দিতেই মেঘালয় বললো, ‘থ্যাংকস।’
তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য মাত্রই পা বাড়িয়েছে, এমন সময় মিশু ওর পিঠে শার্ট খামচে ধরলো। মেঘালয় পিছন ফিরে বললো, ‘কি?’

মিশু অনেক জোরে খামচে ধরে শার্ট ছিঁড়ে নিতে চাইলো। মেঘালয় ওর দিকে হাত বাড়াতেই মিশু ওর বুকে ঢলে পড়লো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘কি হয়েছে আপনার? আমি কি কিছু করেছি? আমাকে এভোয়েড করছেন কেন আপনি?’
মেঘালয় মিশু’র মুখটা তুলে ধরে বললো, ‘না রে পাগলী, এভোয়েড করছি না। আমি একটু ঝামেলায় আছি। প্রচুর টেনশন হচ্ছে আমার।’
– ‘কেন? আমি ছোট বলে আপনার টেনশনের কারণ শুনতে পারি না?’
– ‘ছোট বড় ব্যাপার নয়। বললে তুমিও টেনশন করবে তাই বলতে চাই না। আমার আচরণে কষ্ট পেলে সরি হ্যা?’
– ‘সরি বলতে হবে না। শুধু বলুন না কেন এমন করছেন?’
– ‘কিছু হয় নি রে পাগলী। আমি আরেকবার বাইরে যাবো। এসে কথা হবে কেমন?’

মেঘালয় মিশুর হাত ছাড়িয়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মিশু মৃদু স্বরে বললো, ‘আমরা আজকে ঘুরতে যাবো না?’
মেঘালয়ের স্পষ্ট গলা শোনা গেলো, ‘না।’

থ মেরে বিছানার উপর বসে পড়লো মিশু। মেঘালয়ের কি হতে পারে সেটা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here