হৃদমোহিনী পর্ব ৬০শেষ পর্ব

0
3436

হৃদমোহিনী
শেষ পর্ব
মিশু মনি
.
পরদিন দুপুর হয়ে গেলো কিন্তু মেঘালয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। মিশু তবুও অফিসে এসেছে। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এত বড় টেনশনের মাঝেও অফিসের দায়িত্ব সামলাতে ভূল করলো না। মেঘালয়ের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত আর অফিসে আসবে না তাই সবাইকে সবার কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলো মিশু।

এমন সময় একটা মেয়ে দরজায় এসে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলো। মিশু অনুমতি দিয়ে মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকালো। অনেক চেনা চেনা লাগছে। মেয়েটাকে দেখে মনেহচ্ছে এখানকার কোনো শ্রমিক।
মেয়েটা ভেতরে আসার পর মিশু বসতে বললে সে বললো, ‘আমি বসবো না, দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলবো।’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘কেন?’
– ‘বসলে মনের কথাগুলো বলতে পারবো না।’
– ‘আচ্ছা দাঁড়িয়ে থেকেই বলুন। তার আগে আপনার পরিচয়?’
– ‘আমি সবেমাত্র ট্রেনিং শেষ করেছি। ট্রেইনিংয়ের জন্যও আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু অন্যকিছুর জন্য আরো বেশি। আমি সারাজীবন আপনাকে মনে রাখবো ম্যাডাম।’
– ‘বুঝলাম না, অন্যকিছু মানে? আমি কিভাবে আপনার উপকার করেছি?’
– ‘শুধু উপকার না ম্যাডাম। আপনি আমার পুরো জীবনটাই বদলে দিয়েছেন। আপনি এই কোম্পানির মালিক সেটা আগে জানতাম না। এখানে ট্রেনিং করতে এসেই আপনাকে দেখি। অনেক চেষ্টা করেছি আপনার সাথে কথা বলার কিন্তু সুযোগ হয়নি।’

মিশু ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ওহ আচ্ছা। কিন্তু বোন আমি তো আপনাকে চিনতে পারলাম না। আপনি কি আগে থেকেই আমাকে চিনতেন?’
– ‘যার জন্য আমার পুরো জীবনটাই বদলে গেছে তাকে চিনবো না? তার জন্য তো সারাজীবন মন থেকে দোয়া করি।’

মিশু বিস্মিত হয়ে বললো, ‘তাই নাকি! খুলে বলুন তো ঘটনা কি? আর আমি কিভাবে আপনার উপকারে এসেছিলাম?’

মেয়েটা মিশুর পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। আমি দেহ ব্যবসা করে খেতাম।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মিশু- মানে!

মেয়েটা করুণ মুখে বললো, ‘আপনার মনে আছে এক বছর আগে আপনি মেঘালয় স্যারকে নিয়ে হানিমুনে গিয়েছিলেন? স্যার হোটেলে ফেরার পর আমি ওনাকে ভূলিয়ে ভালিয়ে কাস্টমার বানানোর চেষ্টা করছিলাম। সেই মুহুর্তে আপনি কোথ থেকে এসে হঠাৎ আমার গালে কষে থাপ্পড় বসালেন। তারপর রেগে কয়েকটা কথা বলেছিলেন। সেদিনের অপমান আর ওই কথাগুলোই আমার জীবন পালটে দিয়েছে বোন। আপনি বলেছিলেন, আল্লাহ দুটো হাত দিয়েছেন, একটা মাথা দিয়েছেন। যতক্ষণ শরীরে কাজ করার সামর্থ্য আছে ততক্ষণ সৎ পথে উপার্জন করার চেষ্টা করতে। অভাব আছে মানে এই নয় যে নিজের সম্মান বিক্রি করে খেতে হবে। গায়ে কাজ করার শক্তি থাকতে কাজ করে খাও। দুই হাতে যথেষ্ট শক্তি আছে। আপনার সেদিনের কথাগুলো আমার খুব লেগেছিলো। বাড়িতে গিয়ে সারারাত কান্নাকাটি করেছি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সৎ পথে রোজগার করবো। আমি আর কখনো খারাপ পথে যাইনি বোন।’

মিশু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। এক বছরেরও বেশি সময় পর একটা মেয়ে এসে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে আসে বলা যায় না। এই কঠিন সময়েও মিশুর মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানাতেই সে বললো, ‘আমি আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চাই ম্যাডাম। আপনি কি অনুমতি দিবেন?’
– ‘ছুঁয়ে দেখা বলতে!’
– ‘এখানে আসার পর দেখেছি সবার সাথে কত হাসিমুখে কথা বলেন, সবাইকে কত ভালোবাসেন, পরামর্শ দেন। আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখার খুব ইচ্ছা আমার। একবার ছুঁয়ে দেখার অনুমতি দিবেন ম্যাডাম?’

মিশু মৃদু হেসে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এভাবে জড়িয়ে ধরবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি মেয়েটা। ওর চোখে পানি এসে গেছে। মিশু জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমাকে ম্যাডাম বলার দরকার নেই। মিশু আপু বললেই হবে।’

মেয়েটাকে ছেড়ে দেয়ার পর সে বললো, ‘আমি শুধু একটু হাত ধরতে চাইছিলাম। অথচ আপনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আপনি অনেক ভালো একজন মেয়ে। অনেক ভালো একজন বউ।’
– ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন সবসময়।’

মেয়েটা মাথা দুলিয়ে আচ্ছা বলে চলে গেলো। মিশু একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। মেঘালয়! কোথায় আপনি? আপনার কি কিছু হয়েছে? আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি আপনার খোঁজ পাইয়ে দেন।

৮৭
আজ রাতের মধ্যেই খোঁজ না পেলে থানায় ডায়েরি করতে হবে। অফিসের কাজ রেখে বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো মিশু। বাসায় পৌঁছানোর পর দাড়োয়ান এসে একটা চিরকুট দিয়ে গেলেন। চিরকুট দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো ওর। মেঘালয়ের হাতের লেখা! চোখ বড়বড় করে চিরকুটে নজর দিলো মিশু। সেটাতে লেখা-

Midnight
Dhaka- Chittagong Highway
Nearest Meghna Bridge

চিরকুটে আর কিছুই লেখা নেই। অবাক হয়ে দুবার উলটে পালটে দেখলো মিশু। তারপর ছুটতে ছুটতে বাসার ভিতরে ঢুকলো। চিরকুটটা আকাশ আহমেদের হাতে দিয়ে বললো, ‘আব্বু দেখুন! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

আকাশ আহমেদ অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলেন চিরকুটের দিকে। সত্যিই কিছু বোঝার উপায় নেই। কোনো কিডন্যাপারের কাজ হলে টাকার কথা উল্লেখ থাকতো। নাকি কেউ শত্রুতা করে মেঘালয়কে আটকে রেখেছে? কোনো পুরনো হিসাব নিকাশ মেটাতে চায় হয়ত। কিন্তু সেরকম হলেও তো কোনো সূত্র থাকতো। পুলিশকে নিয়ে যেতে বারণ করতে পারতো, চালাকি করতে বারণ করতে পারতো। ব্যাপারটা রহস্যজনক মনেহচ্ছে!

দাড়োয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো একটা ছোকড়া এসে দিয়ে গেছে। চিন্তায় ভেঙে পড়লো মিশু। মেঘনা ব্রীজের আগে নাকি পরে সেটাও উল্লেখ করেনি। কৌতুহল আর টেনশন দুটোই একসাথে কাজ করছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার মাঝরাতের কথা উল্লেখ করা। অদ্ভুত!

দুশ্চিন্তায় পুরোটা বিকেল মিশুর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে রইলো। সন্ধ্যে নামার পরপরই ও তৈরি হয়ে এসে শ্বশুরমশাইকে বললো এখুনি বেড়িয়ে পড়তে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার খুব খারাপ লাগলো। চিন্তায় একদিনেই মেয়েটার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে!

রাত নামার পর আকাশ আহমেদ মৌনি ও মিশুকে নিয়ে রওনা দিলেন। মিশু টেনশনে রীতিমতো ছটফট করছে। মেঘালয়ের নাম্বার বন্ধ। গাড়ি ছুটলো দ্রুতগতিতে। মেঘনা ব্রীজ পার হয়ে অনেকদূর আসার পর বাবা গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন। অনেকদূর চলে এসেছি, এখনো তো কোনোকিছুর সন্ধান পেলাম না।

মিশু উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, ‘আব্বু আমাদের বোধহয় পুলিশ নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো।’
– ‘থাক টেনশন করিস না। আমরা রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।’

ড্রাইভারকে বলা হলো গাড়ির গতি কমিয়ে দিতে। মৌনি মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুশ্চিন্তার রেখা সবার মুখে!

রাত সাড়ে এগারো টায় মৌনি মেঘালয়ের নাম্বারে কল দিতেই কল ঢুকলো। ও রিসিভ করে একটা ঠিকানা দিয়ে বললো সেখানে চলে যেতে। মেঘালয়ের গলা শুনে মৌনির দুশ্চিন্তা খানিকটা কমেছে। কোনো বিপদ ঘটেনি এটা নিশ্চিত।

ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে দেখা গেলো সেখানে কয়েকটা দোকানপাট ছাড়া কিছুই নেই। মানুষের সমাগম খুব অল্প। গাড়ি থেকে নেমে সবাই কৌতুহলী হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মিশুর টেনশনে পা কাঁপছে, ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছে না। বাবা ও মৌনিকে রেখে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালো মিশু।

রাত বেড়েছে অনেক। চারপাশ অনেক নিস্তব্ধ। রাস্তাও প্রায় ফাঁকা। অনেক্ষণ পরপর হুশ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে গাছের সারি হওয়ায় এলোমেলোভাবে বাতাস বইছে। এদিকে ঠাণ্ডায় হাত পা জমে যাওয়ার মত অবস্থা। মিশু একটা হালকা শোয়েটার পড়েছে, দুশ্চিন্তার চোটে শীতের কাপড় নেয়া হয়নি।

এমন সময় গাড়ির সামনে একজন মানুষের ছায়া পড়লো। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় মানুষটার ছায়া দেখেও এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না মিশুর। ও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে মেঘালয়ের সামনে দাঁড়ালো। হাঁসফাঁস করতে করতে বললো, ‘কি হয়েছে আপনার? কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার ফোন বন্ধ কেন? চুপ করে আছেন কেন?’

মেঘালয় হেসে মিশুকে বুকে টেনে বললো, ‘একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দিবো বলো?’

মিশু ড্যাবড্যাব করে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। মেঘালয় মিশুকে এক হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে বললো, ‘আজকের রাতটা অনেক সুন্দর না?’

মিশু হা হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে! মেঘালয় হেসে বললো, ‘আমার একটা কাজ ছিলো তাই বাসায় যেতে পারিনি।’
– ‘আজব! আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?’
– ‘ওয়েট বাবুউউ, ধীরেধীরে বলছি।’

মেঘালয়কে মিশুকে ধরে বাবা ও মৌনির সামনে আসলো। বাবা অবাক হয়ে একবার মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার মিশুর দিকে। মৌনি উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো, ‘ভাইয়া তোর সমস্যাটা কি?’
– ‘এসব তোমাদের জানতে হবে না। তবে টেনশনের কোনো কারণ নেই। তোমরা মিশুকে রেখে বাসায় চলে যাও।’

মেঘালয়ের ফুরফুরে গলা শুনে আকাশ আহমেদ এটা নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে এর পিছনে সারপ্রাইজ টাইপের কিছু লুকিয়ে আছে। যাক, আপাতত দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেলো। কিন্তু ব্যাপারটা নিতান্তই ছেলেমানুষি হয়ে গেছে। মেঘালয়ও যে হঠাৎ করে এরকম ছেলেমানুষি করবে সেটা ভাবা যায়না।

মেঘালয় টংয়ের উপর বসে দোকানদারকে বললো, ‘মামা এখানে চার কাপ চা দিও।’
আকাশ আহমেদ বললেন, ‘আমরা এখানে কেন এসেছি?’
– ‘আমি ডেকেছিলাম তাই।’
– ‘তুমি কেন ডেকেছিলে?’
– ‘চা খাওয়ার জন্য।’

মিশু চেঁচিয়ে বললো, ‘মানে কি? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আমি কাল থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আর আপনি চা খাওয়ার জন্য..?’

মিশুর রাগ দেখে মেঘালয় হেসে বললো, ‘এরা সুন্দর চা বানায়। একবার খেলে সারাজীবন মুখে লেগে থাকবে। বাপের জনমে এরকম চা খাওনি।’
– ‘আজব!’

মিশু রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। আকাশ আহমেদ ও মৌনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চা আসার পর মেঘালয় চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির সাথে বললো, ‘ওহ অসাধারণ চা! তোমরা হা করে তাকিয়ে আছো কেন? খাও?’

সবাই তখন হতভম্ব! মেঘালয় বাবাকে বললো, ‘আব্বু আমি তোমাকে না জানিয়েই একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। আশাকরি তুমি খুশি হবে। আগামীকাল সকালে ভিডিও কলে তোমাদেরকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিবো।’

মিশু বললো, ‘কিসের প্রজেক্ট? আমাকে অন্তত বলা যেতো। আর আগামীকাল সকালে কেন? আজকে কি আমরা চলে যাবো?’
– ‘না। আব্বু আর মৌনি চলে যাবে। তুমি আর আমি কক্সবাজার যাবো।’
– ‘মানে কি!’
– ‘আমাদের প্রজেক্টটা কক্সবাজারে।’

মিশু রাগে মুখ বাঁকা করে একবার বাবার দিকে তাকালো, আরেকবার মৌনির দিকে। মেঘালয় বললো, ‘ওনাদের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, আমার দিকে তাকাও। তুমি এখন আমার সাথে কক্সবাজার যাবে।’
– ‘অফিসের এতগুলো কাজ ফেলে রেখে আমি কক্সবাজার যাবো?’
– ‘আমি জানতাম তুমি যাবে না। আর সে কারণেই এই বুদ্ধি করে তোমাকে নিয়ে আসলাম।’

মিশু রেগে উঠে গটগট করে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। মেঘালয় এসে মিশুর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘রাগ তো আমার সাথে। চায়ের কাপ নিশ্চয় কোনো দোষ করেনি।’
– ‘আপনি একটা অসহ্য। এ সময়ে এত কাজের চাপ অথচ আপনার মাথায় ভূত চেপেছে।’
– ‘এত কাজ কাজ উফফ! একটা বছর দুজনে যন্ত্রের মত কাজ করেছি। আমাদের রিল্যাক্সের প্রয়োজন আছে। আমার অন্তত সাধ আহ্লাদ বলে কিছু আছে। তোমার মত এতটা সিরিয়াস আমি হতে পারিনা।’
– ‘ইচ্ছে করছে চায়ের কাপের সমস্ত চা আপনার মাথায় ঢেলে দেই। আমাকে বললেই তো সময় করে ঘুরতে যেতাম।’

মেঘালয় জোরে জোরে বললো, ‘আমাদের বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে। ম্যারেজ এ্যানিভার্সারিতে তোমাকে তেমন কোনো গিফট দেয়া হয়নি। সেই দিনটাকে আমি আয়োজন করে তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা এক বছর একসাথে আছি। আর এটাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে- যে দম্পতি একসাথে ভালো থাকার সাথে সাথে ক্যারিয়ারেও সমানভাবে আগাতে থাকে সেটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যাপিয়েস্ট রিলেশনশিপ।’

মিশু চমকে উঠলো! মেঘালয়ের কথাগুলো বারবার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। সত্যিই তো! ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করতে করতে মিশু ব্যবসায়ের ব্যাপারে মেঘালয়ের থেকেও বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে। যেখানে মেঘালয় দিনে বড়জোর ছয় ঘন্টা অফিসে কাটায় সেখানে মিশু আট/নয় ঘন্টা অফিসে কাটিয়েও বাসায় এসে বিভিন্ন বিষয় হিসাব নিকাশ করতে বসে। যেদিন ক্লাস থাকে, সেদিন গভীর মনোযোগ সহকারে ক্লাস করার পর বাসায় এসে অনেক রাত পর্যন্ত জামাকাপড় ডিজাইন করতে থাকে। এত ব্যস্ততার মাঝে ভূলেই গিয়েছে দুজনে একসাথে অনেক ভালো থাকার কারণে সম্পর্কটার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ। একটু সময় নিয়ে নিজেদের কথা ভাবার সময়টাও প্রয়োজন।

মিশু কাছে এসে চায়ের কাপ নিয়ে একবার চুমুক দিয়ে বললো, ‘আহ! অমৃতের মত স্বাদ!’

মেঘালয় দুষ্টুমি করে বললো, ‘জীবনে অমৃত খেয়েছো? এমনভাবে বললা যেন কতবার অমৃতের স্বাদ নেয়া হয়ে গেছে.. হে হে।’

মিশু একহাতে মেঘালয়ের কলার চেপে ধরে বললো, ‘এত খারাপ কেন আপনি?’
– ‘তুমি ভালোবাসো তাই।’

মিশু হেসে ফেললো। চা শেষ করে মেঘালয়ের কথামত গাড়িতে উঠে বসলো সবাই। মেঘালয় গাড়ি থেকে চাদর নিয়ে গলায় জড়িয়ে নিলো। ড্রাইভারকে বলে দিলো কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার জন্য। গাড়ি থেকে নামার পরপর মিশু দেখলো সামনে একটা ট্রাক বাঁকা করে দাঁড় করানো। এদিক থেকে আর কোনো গাড়ি সামনে আগাতে পারবে না। মেঘালয় ওর হাত ধরে ট্রাকের সামনে নিয়ে এলো। ট্রাকের হেডলাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে হাইওয়ের মাঝখানে হাঁটুগেরে বসে পকেট থেকে রিং বের করলো। মিশু পুরোপুরি থ!

মেঘালয় মিশুর হাত ধরে হাতে রিং পড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট। সারাজীবন আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় জুরে তোমার ভালোবাসারা লেগে থাকুক।’

মৌনি হাত তালি দিলো। মিশু মেঘালয়ের জ্যাকেট খামচি দিয়ে ধরে ওকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মৌনি ও বাবা গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। মেঘালয় মিশুর হাত ধরে ট্রাকের পিছন দিকে এসে বললো, ‘ওঠো।’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘উঠবো মানে!’
– ‘আমরা ট্রাকে জার্নি করবো। আমাদের প্রথম দেখা যেদিন হয়েছিলো, আমরা ট্রাকে জার্নি করেছিলাম। এমন ই এক শীতের কনকনে ঠাণ্ডায়। এক চাদরে দুজন।’

মিশু পিছনে তাকিয়ে দেখলো ট্রাকের পিছনে লম্বা গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে। সামনের গাড়ি সমানতালে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো গাড়ি থামিয়ে রোমান্স করা হচ্ছে ভেবেই অন্যরকম মজা লাগলো। মেঘালয় হাত ধরে টেনে মিশুকে ট্রাকের উপরে তুলে নিলো। তাদের পিছনে থাকা বাসের যাত্রীরা অনেকেই ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে। মেঘালয় হেড লাইটের আলোয় মিশুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কবুল কবুল কবুল।’
মিশু হাসতে হাসতে বললো, ‘পাগল একটা।’

৮৮
ট্রাক ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে মেঘালয় ও মিশু। শো শো করে বাতাস লাগছে। দুজনে বস্তার উপরে বসে একই চাদরের ভেতরে জড়াজড়ি করে রইলো। মিশু ফিসফিস করে কথা বলছিলো আর মেঘালয় হাসিতে ফেটে পড়ছিলো। রাতটাকে মনে হচ্ছিলো একেবারে স্বপ্নের মত!

কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিদিক। ঠাণ্ডা বাতাসে দুজনের হাত হিম হয়ে এসেছে। তবুও আনন্দ এতটুকু কমছে না। মেঘালয় ফিসফিস করে মিশুকে বললো, ‘এক বছর আগের তুমি আর এখনকার তুমি’র মাঝে পার্থক্য কি জানো? আগে ছিলে কিশোরী আর এখন হয়েছো রমণী।’
মেঘালয়ের কথায় শিউরে উঠলো মিশু।

ওরা কক্সবাজার পৌঁছে গেলো সকালবেলা। সূর্য অনেক আগেই উঠে গেছে। তবুও শীতের কারণে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। মিশু সৈকতে এসে খালি পায়ে দিগ্বিদিক হয়ে ছুটতে আরম্ভ করলো। ওর ছোটাছুটি দেখাতেই মেঘালয়ের যত আনন্দ। কিছুক্ষণ ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে মেঘালয়ের কাছে আসলে ও বললো, ‘এখন তোমাকে আসল জায়গায় নিয়ে যাবো।’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘সারপ্রাইজ আভি বাকি হ্যায়!’
মেঘালয় মুচকি হেসে ওকে নিয়ে এসে সিএনজিতে উঠলো। মিশু মেঘালয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কি বোঝা যাচ্ছে না তো! কৌতুহল! কৌতুহল!

সিএনজি থেকে নেমে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো মেঘালয়। মিশুর হাত ধরে ওকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক দূর হেঁটে আসার পর দূর হতে একটা কিছু দেখে মিশু লাফ দিয়ে উঠলো। মেঘালয়কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘মারমেইড রিসোর্ট নাকি?’
মেঘালয় তাচ্ছিল্যের সুরে হো হো করে হেসে উঠলো। মিশু ভ্রু কুঁচকে দিলো একটা দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো। একদিকে নারিকেল গাছের সাথে একটা দোলনা দুলছে। তার পাশেই গেটের সামনে সাইনবোর্ডে সুন্দর করে লেখা- ‘হৃদমোহিনী’

একটা লাফ দিয়ে কয়েক হাত উপরে উঠে ধপ করে বালিতে বসে পড়লো মিশু। নিমেষেই গম্ভীর হয়ে গেছে মুখটা। চোখ দুটো শুধু ছলছল করছে।

মেঘালয় কাছে এসে বললো, ‘তোমার সাধের কাঠের বাড়ি।’

মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকানো মাত্র ওর চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। ও মেঘালয়ের বুকে শার্টে খামচি দিয়ে ধরে বললো, ‘এটা কি? আমার জন্য কাঠের বাড়ি! কিভাবে কি করলেন!’

মেঘালয় মুচকি হেসে বললো, ‘মনে আছে একদিন বলেছিলাম, এরকম একটা কাঠের বাড়ি করে দেবো তোমায়। একদিকে থাকবে বিশাল কাঁচের দেয়াল। দেয়ালের কাছে বসে তুমি জোৎস্না দেখবে, মাঝেমাঝে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসবে। বাড়িটার নাম হবে, হৃদমোহিনী। কারণ সেদিন আমি তোমাকে হৃদমোহিনী নামে ডেকেছিলাম। তুমি আমার হৃদয়ের মোহিনী হয়ে এসেছিলে।’

মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মেঘালয় মিশুর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো। মিশু দেয়ালে স্পর্শ করে বললো, ‘কত টাকা খরচ হয়ে গেছে আপনার!’
মেঘালয় বললো, ‘খুব বেশি হয়নি। জায়গাটা কিনতেই যা লেগেছিলো। তবে তোমাকে আমি একদিন মিথ্যে বলেছিলাম। সেটার জন্য সরি।’
– ‘কি মিথ্যে?’

মিশুর কৌতুহলী চোখের দিকে তাকিয়ে মেঘালয় বললো, ‘তোমাকে বলেছিলাম আমার বিজনেসে ছয় লক্ষ টাকা লস হয়েছে। তখন কোনো লস হয়নি বরং একটা কনটেস্টে জিতে আমি আরো অনেকগুলো টাকা পুরষ্কার পেয়েছিলাম। আমার জমানো টাকা থেকে এই জমিটা কিনে রেখেছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম কবে সেই স্বপ্নের কাঠের বাড়ি করে দেবো আমার রাজকন্যার জন্য। সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম যাতে তুমি বিদেশে না গিয়ে সিরিয়াস হয়ে আমার সাথে বিজনেসে হাত দাও। তুমি যতটা সিরিয়াস হয়েছো তা অবিশ্বাস্য!’

মিশু একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আর প্রজেক্ট?’
– ‘আমাদের এই বাড়ির পাশেই একটা রিসোর্ট হবে। বর্তমান সময়ে রিসোর্টের বিজনেস অনেক লাভজনক। যদিও এর পুরোটাই ব্যাংক লোন থেকে। এবার এই লোন শোধ করার জন্য আমাদেরকে আবারো সিরিয়াস হয়ে কাজ করতে হবে।’
– ‘আপনি অনেক ট্যালেন্ট। জীবনে পরিশ্রমের সাথে সাথে বুদ্ধিটাও অনেক দরকার হয়। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারিনা।’

মিশু হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দূর হতে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। নীলাকাশ নীলাভ সমুদ্রে এসে মিশেছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে মিশু বললো, ‘অপূর্ব! এখানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনেহচ্ছে এতদিনের সব পরিশ্রম সার্থক।’
– ‘বলো তো আমাদের জীবন থেকে কি শিক্ষা পেয়েছো?’

মিশু হেসে বললো, ‘কিছু কিছু ভূলকে ভালোবাসলে জীবনটাকে সুন্দর করা যায়। কিছু সুযোগকে হাতছাড়া করলে আরো অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হচ্ছে, যোগ্যতা প্রকাশ পায় মানুষের কর্মে। যে যেমন কাজ করবে, সে সেভাবেই সম্মানিত হবে।’

মেঘালয় মিশুর কাঁধে হাত রেখে ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে মিশু। তোমার চিন্তাভাবনা আমার অনেক ভালো লাগে। একজন ভালো বউ হওয়ার চেয়ে ভালো মেয়ে হওয়াটা অনেক ইম্পরট্যান্ট। যে মেয়েটা মেয়ে হিসেবে ভালো, সে নিঃসন্দেহে ভালো প্রেমিকা, ভালো স্ত্রী, ভালো মা।’

মিশু মেঘালয়ের আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে বললো, ‘দর্শন রাখুন। এবার প্রেমে আসুন। আমার প্রেমে আপনি কেন পড়েছিলেন?’
– ‘তুমি অনেক বিশুদ্ধ, স্বচ্ছ। আর তুমি কেন পড়েছিলে?’
– ‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন বলে। ভালোবেসে মাঝেমাঝে হৃদমোহিনী বলে ডাকলেও পারেন।’

মেঘালয় বললো, ‘তা না হয় ডাকলাম, জোৎস্না রাতে বালির উপর বসে তোমার কোলে মাথা রাখলে তুমি গান শোনাবে তো? দেখো তুমি আজো আমাকে আপনি বলে ডাকো। গানের মাঝে, তুমি আমার জীবন- লাইনটাকে আপনি আমার জীবন বলে গাইতে হবে কিন্তু।’

মিশু শব্দ করে হেসে উঠলো। মেঘালয় মিশুর কাঁধে মাথা রেখে চুলের গন্ধ শুঁকে বললো, ‘এভাবে বসেই তো একটা জীবন পার করে দেয়া যায়। মাঝেমাঝে বারান্দায় বসে সমুদ্রের খোলা হাওয়ায় তোমাকে জাপটে ধরে আমি তোমার চুলের গন্ধ নেবো। তখনো কিন্তু আঙুলের ফাঁকে আঙুল রাখতে ভূলে যেওনা। ‘

মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দূরের সমুদ্রের দিকে তাকালো। এই ছোট্ট জীবনটা সমুদ্রের মত। কখনো উত্তাল, কখনো শান্ত। আর এই বিশাল সমুদ্রটা- সুন্দর, ঠিক জীবনের মত!

সমাপ্ত

(লেখকের কথা- দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে হৃদমোহিনী লিখছি। যেভাবে শুরু করেছিলাম, সেভাবে লিখতে পারিনি। নানান ঝামেলায় কখনো এক মাস কখনো দু’মাস বিরতি দিয়ে লিখতে লিখতে গল্পের কাহিনি বদলে গেছে। কিন্তু তারপরও গল্প তার নিজ গতিতেই চলেছে। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শব্দের একটা দীর্ঘ উপন্যাস হয়ে গেছে। এতদিনের বিরতিতেও আপনাদের আগ্রহ কমেনি, অনেকেই অনুরোধ করতেন দেখে অবাক হয়েছিলাম। ভূল ত্রুটি চোখে পড়লে শুধরে দিয়ে কৃতার্থ করবেন। গল্পের মাধ্যমে ছোট ছোট যে মেসেজগুলো দেয়ার চেষ্টা করেছি তা থেকে কারো সামান্যতম উপকার হলেই আমি খুশি৷ এতদিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা৷ আমার জন্য দোয়া করবেন- মিশু মনি, ৮ আগস্ট ২০১৯)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here