#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২১
বিছানার উপর পা তুলে বসে আছে স্পর্শী। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। নির্বাণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে বারংবার গালে ঘর্ষণ চালাচ্ছে আর বিরবির করে কিছু একটা বলেই চলেছে। মাঝে মধ্যে ঘুরে স্পর্শীকে জিজ্ঞেস করে উঠছে, “পরিষ্কার হয়েছে?” স্পর্শী হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেওয়া সত্ত্বেও ক্ষান্ত হচ্ছে না সে, বার বার গাল ঘষেই চলেছে। ইতিমধ্যে গালের সেই অংশটুকু রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কিয়ৎক্ষণের বেশি এইভাবে চলতে থাকলে হয়তো জায়গায়টা ছুঁলে যাবে। নির্বাণের এমন কান্ড দেখে স্পর্শী বিকেলের কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় নাহিদ নির্বাণকে জড়িয়ে না ধরলেও মাস্কের ভেতর দিয়ে গালে হালকা কাঁদা ছুঁয়ে দেয়। এই নিয়ে নির্বাণের যে কাণ্ড। বকে-টকে রাখেনি নাহিদকে। তবে, সারা শরীরে কাঁদা লেগে থাকায় নাহিদ মাইর থেকে বেঁচে যায়। অন্যথায় নির্বাণের হাতে হয়তো আজ সে শহিদ হয়েই যেত। মেলা থেকে নির্বাণ কোনমতে তড়িঘড়ি করে বাসায় এসে দু’বার ফ্রেশ হয় তবুও যেন তার মনের খুঁতখুঁতানি ভাবটা অতিক্রম করে উঠতে পারেনি। সে যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কার্য চলমান রেখেছে তো রেখেছেই।
স্পর্শীর ভাবনার মাঝেই নির্বাণ চতুর্থবারের মত জিজ্ঞেস করে উঠে,
“দেখ তো, পরিষ্কার হয়েছে কি-না?”
স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়৷ অবসন্ন সুরে বলে, “বলছি তো হয়েছে। এই নিয়ে চারবার একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, এখন আর কিভাবে বুঝাই আপনাকে আমি?”
নির্বাণ অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবার স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় আয়নাতে তাকালো। হাতের টিস্যুটা ফেলে আবার নতুন টিস্যু নিয়ে পূর্ণ উদ্যোমে গালে ঘষা শুরু করলো। স্পর্শী এইবার হতাশাজনক নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, শব্দহীনভাবে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই আবার ফিরে আসলো সে, বাটিতে বরফ নিয়ে৷ বাটিটা বিছানার উপর রেখে এগিয়ে গেল নির্বাণের দিকে। নির্বাণের চলন্ত হাতের কব্জি ধরে মন্থর কন্ঠে বলে, “হয়েছে, আর কত? জায়গায়টা কেমন লাল হয়ে আছে দেখেছেন? আরেকটু হলে তো চামড়া ছিলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। থামেন এবার।”
কথাটা বলে স্পর্শী নির্বাণের হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে ফেলে দিল। অতঃপর নির্বাণকে টেনে বিছানায় বসালো। বাটি থেকে এক টুকরো বরফ নিয়ে চেপে ধরলো গালে। সপ্তপর্ণে গালের চারপাশে হিম পরশ বুলিয়ে দিতে থাকলো। কন্ঠে তীব্র রাগ মিশিয়ে বলল,
“আপনি না বলেন, অতিরিক্ত কিছুই ভালো না? তাহলে নিজের বেলায় কেন মানেন না? সামান্য কাঁদা লেগেছে। কোন ক্ষতিকারক এসিড না যে আপনি এমন করছেন। ইশশ কি অবস্থা করেছেন জায়গাটার, দেখেছেন একবার?”
নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না, নীরব রইলো। নিভৃতে তাকালো স্পর্শীর দিকে। দুইজনের মাঝে দূরত্ব কিঞ্চিৎ, দূরত্ব ঘুচে গেলেই তীব্রভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি গণনা করা যাবে। ক্ষণে নির্বাণের ইচ্ছে করলো দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিতে। ভাবনাটা কার্যকরী করতেই নির্বাণ কিঞ্চিৎ সময় বিলম্ব না করে স্পর্শীর কোমর চেপে ধরে তাকে নিজের দিকে টান দেয়। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠার আগে স্পর্শী ঝুঁকে পড়ে নির্বাণের দিকে, দুই আঙ্গুলের ফাঁক থেকে ছুটে পড়ে বরফের টুকরোটি। ভর সামলাতে হাত গিয়ে ঠেকে নির্বাণের বুকে। এক গাছি চুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুখে, বৃহৎ বিস্ময়ান্বিত দৃষ্টি তাকায় সে। নির্বাণ ধীর হাতে স্পর্শীর মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়,
“নিজের স্যারের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছ? মনে ডর-ভয় নেই? এখন আমি যদি তোমায় শাস্তি দেই, মানা করার সাধ্য আছে তোমার?”
স্পর্শী অস্ফুটস্বরে বলে, “এইটা ভার্সিটি না, আর না আপনি এখন আমার স্যার।”
“তাহলে আমি এখন কি তোমার? সেটা বুঝে না-হয় শাস্তি দিব তোমায়।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। লজ্জায়,সংশয়,সংকোচে মেদুর গালে ছড়ায় রক্তিমা। শব্দ,বাক্য হয় নিরুদ্দেশ। নির্বাণ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হয় নাহিদের কন্ঠ। ভড়কে উঠে দু’জনেই। নির্বাণ তৎক্ষনাৎ কোমর থেকে হাত সরাতেই স্পর্শী লাফিয়ে সরে দাঁড়ায় নির্বাণের নিকট হতে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় দরজার দিকে। পরমুহূর্তে নাহিদ এসে বলে,
“ভাবী আপনাকে মা ডাকছে আর ভাই মা তোকে সব গুছিয়ে রাখতে বলেছে। রাতের খাবার খেয়েই রওনা হবো আমরা।”
স্পর্শী কোনমতে মাথা দুলিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে শয়নকক্ষ ত্যাগ করে। স্পর্শী যেতেই নির্বাণ রাগান্বিত নয়নে তাকায় নাহিদের দিকে, ক্ষণেই নাহিদের অভিব্যক্তি পাংশুটে হয়ে যায়। নির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুই একবার ঢাকা চল। সব হিসাব-নিকাশ যদি সুদে আসলে না চুকিয়েছি আমি তাহলে দেখিস।”
নির্বাণের কথার শুনে নাহিদ ধরে নিল নির্বাণ তাকে বিকেলের ঘটনার জন্যই শাসাচ্ছে। সেই ঘটনার রেশ ধরে নাহিদ আমতা-আমতা সুরে বলে, “আরেহ ভাই সরি না, আমি ফাজলামো করতে চাচ্ছিলাম শুধু। তোকে কাঁদা লাগানোর কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না, সব ভুলবশত হয়েছে। এইবারের মত মাফ করে দে, জীবনেও আর তোর ধারের কাছে ঘেষবো না। প্রমিস!”
নির্বাণ পুনরায় চোখ রাঙানো মাত্র নাহিদ মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে, “মৃদুল আমায় বিছানায়, ধুর! রুমে ডাকছে। আমি যাই!”
কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়ে। নির্বাণ সেদিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় গিয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। তার মনে এখনো আশঙ্কা আছে তার গাল পরিষ্কার হয়নি।
_____________________
নিস্তব্ধ রাত্রি। অনিলের তীক্ষ্ণতা পেরিয়ে হাইওয়ের রাস্তা ধরে শা শা শব্দে চলছে গাড়ি। গাড়ির ইনার লাইট অফ থাকায় বুঝা যাচ্ছে না ভিতরকার অবস্থা। বাহিরে হতে মাঝে মধ্যে সোডিয়াম লাইটের টুকরো টুকরো আলো গাড়ির জানালা ভেদ করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে স্পর্শীর ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। শ্যামময়ী নারীর ঘুমে ব্যাঘাত আনার প্রবল চেষ্টা যেন। পিছনে নিলুফা আর নাহিদও তন্দ্রাঘোরে বিভোর। নির্বাণ রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিমর্ষচিত্তে তাকালো স্পর্শীর পানে। ঘুমন্ত মানবীর মুখশ্রী জুড়ে তখন আদুরে ভাব বিরাজমান। আর কিঞ্চিৎ প্রহর আছেই তারা একসঙ্গে, অতঃপর পুনরায় দুইজনে দুই প্রান্তে। ফের কবে একত্রে আসবে দুইজনে কে জানে? যত গাড়ি এগুচ্ছে ততো নির্বাণের হৃদয়ে দহনক্রিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কয়েকদিনের ব্যবধানেই মানুষটা যে অজান্তেই তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে, সেই অভ্যাস এখন কি করে ছাড়াবে সে? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো নির্বাণ৷
কিঞ্চিৎ প্রহর পরেই পূবাকাশে অগ্নিপিণ্ডের স্নিগ্ধ আভার দেখা মিললো। কৃষ্ণ আকাশ আবৃত হলো নীলাভ-সাদা চাদরে। পাখিদের কলধ্বনি গুঞ্জিত হলো চারদিক। নির্বাণ নাহিদ ও নিলুফাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ছুটলো স্পর্শীর কোলানির দিকে৷ দেখতে দেখতেই গাড়ি এসে থামলো ‘ব্যাংক টাউন’ কোলানির সামনে। নির্বাণ সিটবেল খুলে ঘুরে বসলো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী তখনও ঘুমে কাঁদা। আলতো স্বরে ডাকলো নির্বাণ। কিয়ৎকাল পর গোঙানির মত শব্দ করে স্পর্শী পিটপিটিয়ে চাইলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে? এত সকালে ডাকচ্ছেন কেন?”
নির্বাণ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “তোমার বাসা এসে গিয়েছে। উঠো!”
কথাটা কর্ণপাত হওয়ার মাত্র স্পর্শী টনক নাড়লো। চোখ টানটান করে তাকালো চারিপাশে। নিজের কোলানীর সামনে গাড়ি দেখে স্থির হলো সে। অতঃপর পিছন সিটের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মা আর নাহিদ ভাই কোথায়?”
“বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি।”
স্পর্শী চমকিত হবে বলে, “কখন? আর আমাকে ডাকেননি কেন? মা কি ভাবছে বলুন তো? বিদায়ও নিতে পারলাম না।”
“কিছু ভাবছে না সে। মা এইসব বিষয় এত একটা গুরুত্ব দেয় না। চিন্তার বিষয় নেই।”
স্পর্শী অপ্রসন্ন হয়, “তাও তো!”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “আচ্ছা, আমি যাই।”
নির্বাণ তখন স্পর্শীর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মুহূর্তে চোখাচোখি হলো তাদের। স্পর্শী লজ্জায়,সংকোচে দৃষ্টি নামালো। নির্বাণ অকস্মাৎ বলে উঠে, “স্পর্শী!”
নির্বাণের মোলায়েম কন্ঠে সম্মোধনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “জি?”
“সাবধানে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো।”
“আপনিও রেখেন।”
নির্বাণ কিছু বলল না। নীরবে এগিয়ে এলো স্পর্শীর মুখের সম্মুখে৷ নির্বাণ এগিয়ে আসতে দেখে স্পর্শী পিছালো না, সে জানে নির্বাণ তার সিটবেল খুলে দেওয়ার জন্যই এগুচ্ছে। খামাখা মাথা পিছিয়ে ইজ্জতের ধূলিসাৎ করার মানে হয়-না। কিন্তু নির্বাণ স্পর্শীর ভাবনার উর্ধ্বে গিয়ে এক অপ্রকাশিত কাজ করে বসল। নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া আলতোভাবে চেপে ধরে স্পর্শীর ললাটে। অনন্তর, খুব আদুরে ভঙ্গিতে স্পর্শীর গালে হাত রেখে বলে, “আমার অভ্যাসগুলো এইভাবেই পরিবর্তন না করলেই পারতে।”
কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীর সিটবেল খুলে দিয়ে সরে আসে সে। দৃষ্টি স্থির করে সামনে। ঘটনাক্রমে স্পর্শী বিমূঢ়,বিহ্বল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায় সামনে৷
#চলবে