||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ১৯||
দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতেই ভয়ে আৎকে উঠে প্রহেলি। দিব্য ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে আসে। হাতে খাবারের প্লেট। প্রহেলি নিজের জায়গাতেই বসে রয়। টি-টেবিল টেনে তার উপর প্লেট রেখে বলল, “অনেক ক্ষুধা লেগেছে তাই না? স্যরি আমার খেয়াল করা উচিত ছিল সারাদিনে কিছু খেতে পারোনি তুমি। চলো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
সেই ছোট বেলায় মায়ের হাতে খেয়েছিল সে। আজ অবধি নিজের হাতেই খেয়ে আসছে। এভাবে হুট করে কারো হাতে খেতে হবে ভাবতেও কেমন জানি লাগছে তার।
ইতস্তত করে বলল, “আমি কারো হাতে খেতে পারি না।”
“কোনো সমস্যা নেই তাহলে নিজের হাতে খেয়ে নাও। আমি তোমার পাশেই বসছি।”
একবার ভেবে ওয়াশরুমে যায় প্রহেলি। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসে। দিব্য এখনো সেই আগের জায়গাতেই বসে আছে। দিব্যের চোখ তার উপর পড়তেই থমকে যায়। নীল, সাদার মধ্যে একটা ড্রেস পরে এসেছে সে। কিন্তু সে তাকে লেহেঙ্গাতেই দেখতে চেয়েছিল রাতভর।
ভারাক্রান্ত মনে বলল, “ইশ! লেহেঙ্গা খুললে কেন?”
“মানে!”
“আমার অনেক ইচ্ছে ছিল…”, বলতে বলতে থেমে যায় সে।
কিছুটা মন খারাপ হয় তার। তবু নিজেকে সামলে মৃদু হাসে। আজ মন খারাপ করা চলবে না। তার ইচ্ছেটা না হয় ইচ্ছেতেই সীমাবদ্ধ রইল। সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয় না। তাছাড়া প্রহেলিকে নিজের করে পেয়ে গেছে এর থেকে বড় আর কিছুই নয় তার কাছে।
প্রহেলি তার সামনে বসে খাচ্ছে। আর সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বিষয়টা বেশ অদ্ভুত বটে। কেউ একজন খাচ্ছে আর কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায় না। প্রহেলিও তেমন খেতে পারলো না। প্লেটটা রেখে পানি ঢালতেই যাচ্ছিল দিব্য তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। এঁটো খাবারটা সে নিজে খেতে শুরু করে।
ভ্রুজোড়া ঈষৎ কুঁচকে বলল, “আরেহ! কী করছিস এসব!”
দিব্য খাওয়া থামিয়ে বলল, “আমাকে কী তুই করেই বলবা?”
“তুই যে আমাকে বড় আপু থেকে বউ করে নিবি তা কী আমি জানতাম? ছোট ভাই মনে করে তুই তুই করেই বলতাম এখন কীভাবে তুমি আসবে!”, অদ্ভুত গলায় বলল।
দিব্য ভাবনায় পড়ে যায়। সবার সামনে যদি প্রহেলি তাকে তুই করে বলে তাহলে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। খাওয়া শেষ করে বলল, “তুমি বরং আমাকে তুইও বলিও না, তুমিও বলিও না।”
ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কী আপনি বলব?”
“আরে না, এমনভাবে কথা বলিও যাতে তুই বা তুমি কোনোটাই না আসে।”
ক্ষণকাল ভেবে বলল, “আচ্ছা চেষ্টা করব।”
“তুমি করে বলার?”
“না, তুই বা তুমি কোনোটাই না বলার।”
প্রহেলির পায়ের কাছে গিয়ে বসে দিব্য। তার কোলে মাথা রেখে দু’হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে। সম্পূর্ণ শরীর দুলে উঠে। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে যায় প্রহেলি। কেমন একটা ভয় ঘর করে আছে তার মনে। কয়েকটা নীরব মূহুর্ত কেটে যায় তাদের মধ্যে। দিব্য মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?”
আচমকা এমন আবদারে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় সে। কোমল চুলের রাজ্যে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কতক্ষণ যাওয়ার পর মাথা থেকে হাতটা নিজের হাতে নিয়ে দিব্য অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “খুব কষ্ট পেয়েছি আমি৷ প্রতিটা মূহুর্তে কষ্ট পেয়েছি যখন তোমাকে ওই নাহিয়ানের সাথে দেখেছি। এখনো কষ্ট পাই এটা ভেবে, যে শরীরের প্রথম ছোঁয়া আমি পেয়েছিলাম সে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অন্য কেউ সুখ খুঁজে পেয়েছে। মনে আছে আমার গাল টেনে দেওয়া? আমাকে করা সেই প্রথম চুম্বন? আমি আজও সেই স্বাদ ভুলিনি। আমাকে একটা চুমু দেবে? শুধু একটা, এর বেশি কিছুই চাই না।”
প্রহেলি শক্ত হয়ে বসে আছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে দিব্যের চাওয়াটাও বেরিয়ে আসে। কেউই চাইবে না বিয়ে করে বউ সাজিয়ে রাখুক। দিব্যের চাওয়াটাও অনর্থক নয়। তবু প্রহেলির মন আগাচ্ছে না। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। সমস্ত দেহ কুঁচকে একটুখানি হয়ে আসে তার। কম্পিত কণ্ঠে বলল, “আমি এখনই এসবের জন্য প্রস্তুত নই। কয়টা দিন সময় দেওয়া যায় না?”
দিব্য ফ্লোর থেকে উঠে প্রহেলির পাশে বসে। মোমের আলোয় তার মুখের রঙ রক্তবর্ণ দেখাচ্ছে। দু’হাত তার দু’গালে রেখে একদম কাছে এসে বলল, “সাতটা বছর অপেক্ষা করেছি। তুমি চাইলে আরো সাত বছর অপেক্ষা করব। আমার এই একটা আবদার কী তুমি রাখতে পারো না?”
ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে আছে দিব্য। প্রহেলির চোখ নিচের দিকে। লজ্জা আর ভয়ের অপূর্ব এক মিশ্রণ এসে ভর করেছে তার মাঝে। মুখটা আরক্ত হয়ে আসে।
মৃদুস্বরে বলল, “চোখ বন্ধ কর।”
আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আসে দিব্যের মুখ। চোখে যেন সুখের কান্না নেমে আসতে চাচ্ছে। তবু এই সময়টাতে আটকে রেখেছে সে। দ্রুত চোখ বন্ধ করে বসে রয়। প্রহেলি একটু একটু করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দিব্যের কাঁধে একটা হাত রাখে। উষ্ণ নিশ্বাস এসে তার গাল ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আটকে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার। অন্য হাত তার একটা গালে রেখে অন্য গালে আলতো করে চুমু এঁকে দেয়। সাথে সাথে দিব্য তাকে শক্ত করে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে। সবচেয়ে বড় পাওয়াটা যেন সে আজ পেয়ে গেছে।
“ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটা ক্ষণ একেক যুগের মতন। আমাকে ছেড়ে যেও না কখনো। তোমাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতেও কষ্ট হয়। তুমি আমার, শুধুই আমার।”, বলতে বলতে তার চোখে জল এসে যায়। প্রহেলির নজরে সেই জল পড়ে না।
দিব্যের প্রতি প্রহেলির মনটা কোমল হয়ে এসেছে। গতকালও এই মানুষটার জন্য তার কোনো অনুভূতি ছিল না। আজ হঠাৎ কী এমন হলো যে তার এমন ছোট ছোট কান্ডে একটুও মন ভারি হচ্ছে না। কিংবা তার স্পর্শগুলোও খারাপ লাগছে না। যেভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছে মনে হচ্ছে যেন কোনো বাচ্চা তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসে তার।
সকালবেলা চোখ খুলতেই দিব্যকে চোখের সামনে পেয়ে আৎকে উঠে। একটা হাতের উপর মাথা রেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ কচলে সে বলল, “আমি কখন ঘুমালাম?”
“আমার বুকে তুমি এতটাই শান্তি খুঁজে পেয়েছ যে ক্ষণকালের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছ। তোমাকে আর জাগাইনি আমি। শুইয়ে দিয়ে আমিও পাশে শুয়ে পড়লাম।”
দিব্যের চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি। প্রহেলি আগ্রহ ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “তুই কী সারারাত ঘুমাসনি?”
সে কিছুক্ষণ ভেবে তার মুখের উপর মুখ এনে ফিসফিস করে উত্তর দিল, “উম… ঘুমিয়েছি দুই ঘন্টা। সারারাত তোমাকে দেখেই কেটে গেছে আমার।”
দিব্য একটা হাতে প্রহেলির চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। খালি গলায় ঢোক গিলে সে। এই সাত সকালে আবার কী করতে যাচ্ছে কে জানে। দিব্য মুখটা তার কাছে নিয়ে যায়। ওমনি সে চোখ বন্ধ করে দু’হাতে তাকে ঠেলে ধরে। দূরে সরানোর চেষ্টা করছে।
সে মৃদু হেসে বলল, “আমার দলিল করা বউ তুমি। তোমাকে আমি খুব জ্বালাবো। কারণে অকারণে জ্বালাবো। তুমি যতটুকু পারো আটকিও আমায়।”
প্রহেলির কপালে গভীর চুমু খেয়ে আবারো বলল, “আজকের জন্য এটুকু। উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
দিব্য উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। ধীরে ধীরে প্রহেলির হৃদস্পন্দনের গতি কমতে থাকে। সে কাছে আসলেই স্পন্দন দ্রুত গতিতে বেড়ে যায়। নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হয়। দিব্যের এত ভালোবাসা দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে বারবার। তাকেই তো ভালোবাসা উচিত ছিল। অথচ সে অপাত্রে ভালোবাসা দান করে বসলো। এমনকি যেটুকু সামলে রাখার ছিল তাও বিলিয়ে দিল। দিব্যকে সে কি-ই বা দেবে! চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কেন সে আগে বুঝলো না! এতটা অবুঝ কেউ কীভাবে হতে পারে। যখন বুঝলো তখন নিজের সর্বস্ব হারিয়ে বসেছে। দিব্যের বলা কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে তার। আসলেই তো তার শরীরটার ভাঁজে ভাঁজে অন্য কারো ছোঁয়া রয়েছে৷ এদিকে দিব্য কাউকে ভালো না বেসে এতটা বছর কেবল তার জন্যেই অপেক্ষা করেছে। কী দাম দিবে সে এই অপেক্ষার! তার সুইসাইড করাই উচিত ছিল। তাহলে সব ঝামেলা মিটে যেত৷ দিব্য কী পারবে পুরনো কথা ভুলে যেতে! প্রহেলিকে যে কথা কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে দিব্যকেও হয়তো কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু মানুষটা মুখ খুলে বলতে পারছে না। ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে তাকে।
দিব্য বেরিয়ে এসে দেখলো প্রহেলি এখনো আগের মতোই শুয়ে আছে।
“কী হলো এখনো উঠোনি যে? ঘুম পাচ্ছে আরো? ঘুম পেলে আরেকটু ঘুমিয়ে থাক।”
কোনো জবাব দেয় না সে। শোয়া থেকে উঠে বসে। চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে। অনুশোচনায় ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। যন্ত্রণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দিব্যের দিকে এক দৃষ্টিতে খানিক্ষন তাকিয়ে ভাবে, নাহিয়ানের আগে কেন দিব্য আসলো না তার জীবনে! তাহলে হয়তো এই ভুলটা তার হতো না। দিব্য তাকে বাঁচিয়ে নিতো।
দিব্য আবার জিজ্ঞেস করলো৷ “ঘুম ছেড়েছে? ওয়াশরুম যাবে?”
প্রহেলি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। সে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে যে আমাকে কোলে তুলে নিস, আমার তো তোর থেকেও ওজন বেশি। কষ্ট হয় না?”
শব্দ করে হেসে ফেলে দিব্য। তাকে কোল থেকে ভেতরে নামিয়ে বলে, “তোমার যতই ওজন হোক না কেন আমার শক্তির কাছে ওসব কিছুই না। মেপে দেখ আমার ওজন হয়তো আরো বেশিও হতে পারে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রহেলি। বিড়বিড় করে বলে, “মাথামোটা ছেলে!”
“কিছু বললে?”, দিব্য জিজ্ঞেস করে।
“উঁহু কিছু না।”
দিব্য তার হাতের স্পর্শে কপাল থেকে গাল ছুঁয়ে থুতনিতে এসে থামে। কিছু ইচ্ছে মনের ভেতর চেপে বেরিয়ে আসে। দিব্য বেরিয়ে যেতেই প্রহেলি দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ভাবে, এই মানুষটাকে সে ভালোবাসতে চায়। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে চায়। ভালোবাসাটা হয়ে যাক তার, খুব দ্রুত হয়ে যাক।
রান্নাঘরে যেতেই এক পনেরো-ষোলো বয়সী মেয়ে এসে বলল, “ঘুম হলো আপা? ভালো আছেন তো? আপনার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় আছিলাম সেই রাইত থেইকা। চিনছেন আমারে?”
অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “চিনলাম না তো…””
“আমি ওই যে তুলি। বকুল ফুলের মালা বিক্রি করতাম। আপনে প্রত্যেকদিন আমার থেইকা ফুল কিইনা নিতেন। দিব্য ভাইজান আমারে নিজের বোন বানাই নিয়া আসছে ঘরে৷ আমারে স্কুলে পাঠায়। এই পরিবারের সকলে অনেক ভালোবাসে আমারে। সব আপনের জন্য আপা। আপনি যদি আমার কথা না ভাবতেন তাইলে আমি আইজ এত ভালো একটা পরিবার পাইতাম না।”, বলতে বলতেই কেঁদে দেয় তুলি।
প্রহেলিকে এমন একটা বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে কল্পনাও করেনি। কোনো মানুষ এতটা ভালো কীভাবে হয়! কাউকে এভাবে পাগলের মতো ভালোবেসে গিয়েছে আর সে জানতেও পারেনি। না জানি আরো কতকিছু অজানা রয়ে গেছে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা