__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১৫___________
এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরলেন আশরাফ সাহেব। উঠানে একবার চক্কর দিলেন। গোয়ালের মহিষগুলো ঠিকঠাক বাঁধা হয়েছে কি না টর্চের আলো ফেলে দেখে নিলেন। তারপর ঘরের ভেতর ঢুকে খাটের উপর বসলেন। পদ্মাবতী খাটের উপর একটা কাপড় বিছিয়ে স্বামীর জন্য খাবার সাজালেন। রাজ এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। তাকে দেখে আশরাফ সাহেব প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন,
-আয় ভাই, ভেতরে আয়।’
রাজ ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসলো।
-খেয়েছিস?’ জিজ্ঞেস করলেন আশরাফ সাহেব।
-হুমম…’ মুখের ভেতর শব্দ করলো রাজ।
-কী রান্না করেছে আজ তোর মা?
-ট্যাংরা মাছ আর লালশাক ছিল।
-ও। আমাদের এখানেও খা। পদ্ম, ওর জন্য একটা প্লেট দাও।’ আশরাফ সাহেবের কথার আড়ালে আবেগ লুকিয়ে ছিল। সংসার আলাদা হওয়ার পর থেকে সবই যেন আলাদা হয়ে গেছে, সবই যেন ‘আমাদের আর তোমাদের’ হয়ে গেছে। একসাথেই তো কত মজা ছিল। এখন আলাদা খেয়ে যেন তৃপ্তি পায় না রাজ। নিঃশব্দে খেতে বসলো সে দাদুর পাশে আবার। বিদ্যুৎ চলে যায় হঠাৎ তখন। ভেতর থেকে কুপি জ্বালিয়ে নিয়ে এলো মনি। কুপিটা খাটের উপর রাখার সময় মনির মাথার কিছু চুল গাল বেয়ে ঝুলে পড়লো। রাজ ওর দিকে তাকিয়ে চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল না। কুপিটা রেখে যখন মনি চেয়ারে বসলো তখন রাজ আরেকবার তাকালো ওর দিকে। কুপির সোনালি আলো মুখে পড়েছে ওর। সোনালি আলোতে ওর মলিন মুখটাকে বড়বেশি অসহায় লাগছে এই মুহূর্তে। মনে হচ্ছিল ও যেন কতদিন হাসে না। কপাল থেকে চুল সরিয়ে ফুঁপানোর শব্দ করলো মনি। তারপর দাদুর উদ্দেশ্যে বললো,
-দাদু, ওকে জিজ্ঞেস করো ওর কিছু লাগবে কি না, ও তো আবার আমার সাথে কথা বলে না।
-লাগবে না।’ মুখের ভেতর এক গ্রাস খাবার পুরে বললো রাজ। আশরাফ সাহেব এক গ্লাস পানি গিলে গ্লাসটা রেখে বললেন,
-কীরে দাদুভাই। এতদিন রাগ পুষে রাগলে চলে? রাগ সম্পর্কের উন্নয়ন করে না কখনও।
-দাদু, ও-ই তো প্রথম আমার সাথে কথা বলা অফ করেছিল।’
রাজের কথা শেষ হতেই মনি উঠে চলে গেল। ওর চলে যাওয়ার দিকে রাজ একবার তাকালো শুধু।
ওখান থেকে বের হয়ে এসে মনি বাইরে দাঁড়ালো অন্ধকারে। একটা নারকেল গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
-কীরে এখানে দাঁড়িয়ে এভাবে কাঁদছিস কেন?’ বলেই পেছন থেকে বীথি এসে হাত রাখলো মনির কাঁধে। মনি চোখ মুছে বললো,
-কিছু না।
-মন খারাপ?
-না…
-চল, ঘরে চল…’
চোখ মুছে বীথির সাথে সাথে চললো মনি।
.
.
♥চৌদ্দ♥
আশরাফ সাহেবের বাড়ির আশেপাশের বিলগুলোতে হালচাষ হয়েছে। ছোট ছোট ধানের চারাগুলো একটু একটু করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চরপাশটা সবুজে চেয়ে আছে। তবে বিলের মাঝখানে কিছু জায়গা খালি পড়ে আছে। ওটা খেলার মাঠ। বিকেল টাইমে ওখানে ছেলেমেয়েরা খেলা করে।
সূর্যটা যখন নিস্তেজ হয়ে গেছে, সেই মাঠে এসে খেলতে শুরু করলো পাড়ার ছেলেমেয়েরা। কিছু ছেলেমেয়ে মাঠের একটা জায়গা জুড়ে লম্বা দাগ টেনে টেনে কিছু ঘর বানিয়ে খেলছে দুই পক্ষ হয়ে। খেলাটা এমন, প্রথম ঘর থেকে শেষ ঘরে যেতে হবে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের ছোঁয়া থেকে রক্ষা পেয়ে। প্রতিটা ঘর চেক দিচ্ছে বিপক্ষ দলের একজন করে খেলোয়াড়। যারা খেলাটা খেলছে না, তারা কিছুটা দূরে ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত। রাজও ঘুড়ি উড়াচ্ছিল। তাকে ঘুড়ি উড়াতে দেখে মনি খেলা বাদ দিয়ে ঘুড়ি উড়াতে এলো। একটা বাচ্চা ছেলের হাত থেকে ঘুড়ি নিয়ে আকাশে উড়াতে লাগলো মনি। আকাশে তখন অনেকগুলো ঘুড়ি উড়ছিল। ওখান থেকে রাজের ঘুড়িটা খুঁজে নিয়ে ওটার পাশাপাশি নিজেও ঘুড়ি উড়াতে লাগলো মনি। হঠাৎ ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে মনি ইচ্ছে করেই রাজের ঘুড়ির সাথে নিজের ঘুড়ির সুতো পেঁচিয়ে দিলো। তাতে রাগ উঠে গেল রাজের।
-এই কে রে এমন করেছিস?’ বলেই রাজ মনির দিকে তাকালো। মনি হাসতে লাগলো ‘হি হি হি’ করে। রাজ তাকে মারতে এলে সে জিভ বের করে ভেঞ্চি কেটে পালাতে শুরু করলো ঘুড়ি ফেলে। রাজও দৌড়াতে থাকে পিছুপিছু ঘুড়িটা একজনকে ধরতে দিয়ে। ক্ষেতের আইল দিয়ে দৌড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল মনি। জোরে জোরে হাসছে সে। পেছন থেকে রাজ এসে পিঠের উপরের পাশের ফ্রক ধরে টান দিলো। পড়ে গেল মনি ধান ক্ষতের উপর। তার উপর পড়লো রাজ। দুজনে কাদায় গড়াগড়ি খেলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনি স্তব্ধ হয়ে যায়। নিজের শরীরের উপর রাজের পুরো শরীর। কাঁদার মধ্যেও সে ঘামতে থাকে, বুক ঘনঘন উঠানামা করে তার। রাজ তাকে চেপে ধরেছে, কোনো বাঁধা দেয় না সে। তার আরও ভালো লাগছে। আরও অনেকক্ষণ থাকতে চায় সে এভাবে। কিন্তু রাজ তাকে উপরে তুললো। ধানের চারাগুলো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। জমির মালিক এসে দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি সে দৌড় দিলো ঘরের দিকে। মনিও কাদামাখা শরীর নিয়ে দৌড়াতে লাগলো ওর পিছুপিছু।
পুকুরপাড়ে এসে পুকুরে ঝাপ দিলো রাজ। মনিও ঝাপ দিতে চাইলো। তখন রাজ বললো,
-এই তুই টিউবওয়েলে যা। এখানে আসবি না।
-হুহ, পুকুর কি তোর একার নাকি?’ বলে মনিও ঝাপ দিলো পুকুরে। এক ডুব দিয়ে রাজের সামনে গিয়ে উঠলো। মুখ থেকে কুলির পানি ফেললো রাজের মুখে। তারপর হাসতে লাগলো। রাজ মনিকেসহ ডুব দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পানির নিচে থেকে মাথা তুললো। হাঁপাতে লাগলো দুজনে। হাঁপাতে হাঁপাতে মনির হাসিটাও কমলো না। রাজ রাগ করে এসব করলেও মনির কিন্তু ভালোই লাগে, কারণ এতে সে রাজের স্পর্শ পায়। মনির হাসির দেখে রাজের রাগ আরও বেড়ে যায়। শার্টটা খুলে পুকুর থেকে উঠে চলে যায় সে। হাসতে হাসতে পানির উপর চিত হয়ে ভাসতে থাকে সে। চোখ বন্ধ করে আবারও কল্পনা করে কাদায় পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা। কল্পনায় আবার রাজের স্পর্শের অনুভূতি নেয়। তারপর আবার নিজে নিজে হাসতে থাকে।
.
.
পরদিন দুপুরের কাঠফাটা রোদে আশরাফ সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে ঘরে আসলেন। ছাতাটা বন্ধ করে তিনি স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন,
-এক জগ পানি নিয়ে এসো তো, মুখটা একটু ধুই…’
পদ্মাবতী ভেতরে গেলেন পানি আনতে। আশরাফ সাহেব সামনের রুমে বসলেন পাঞ্জাবি খুলে। গরম লাগছে তাঁর। তাই পাঞ্জাবিটা দুলিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। মাথার উপরে ফ্যান আছে, কিন্তু বিদ্যুৎ নেই বলে ফ্যানটা চলছে না। একটুপর পদ্মাবতী এলেন জগ হাতে পানি নিয়ে। স্ত্রীর হাত থেকে জগটা নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বললেন,
-সবাইকে একটু ডাকো। কথা আছে সবার সাথে।’
পদ্মাবতী কিছু না বলে সবাইকে ডাকতে গেলেন। স্বামী সবাইকে কেন ডাকতে বলছে জানার জন্য কৌতূহল বেড়ে গেছে তাঁর।
আশরাফ সাহেব মুখ হাত ধুয়ে মাথার চারপাশ পানি দিয়ে মুছে নিয়ে ঘরে এসে বসলেন। সবাই তখন এসে বসেছে ওখানে। জগটা একপাশে রেখে আশরাফ সাহেব বললেন,
-বড় বউমাকেও ডাকো।’
বীথি গিয়ে ডেকে আনলো তার মাকে। আয়েশা বেগম ঘোমটাটা ঠিক করে পদ্মাবতীর পাশে গিয়ে বসলেন। সবাই তখন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশরাফ সাহেবের দিকে, কী বলে দেখার জন্য। আশরাফ সাহেব সবার দিকে তাকালেন, দেখলেন বড় ছেলে আমান ছাড়া সবাই উপস্থিত। আমান রাতে ঘরে ফিরলে তার সাথে তখন কথা বলা যাবে। আশরাফ সাহেব বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-মনির জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে। খুব ভালো ঘর। আমার ইচ্ছে মনির বিয়েটা ধুমধাম করে হোক।’
দাদুর কথা শুনে মনির বুকটা মোছড় দিয়ে উঠলো। সে কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বললো,
-আমি বিয়ে করবো না। আমি পড়াশোনা করবো।’
তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে তার মা জিজ্ঞেস করলো,
-ছেলে কী করে?
-ছেলে বরফ মিল চালায়। ভালোই টাকা-পয়সা আছে শুনছি। ঘরবাড়িও নাকি ভালো।
-ওটা তো ওরা বলছে। আমরা গিয়ে ওদের ঘরবাড়ি দেখে আসলে ভালো হতো। যাচাই না করে আমাদের মেয়ে বিয়ে দেবো না।’ আয়েশা বেগম মন্তব্য করলো।
-হ্যাঁ, তা তো যাচাই করবো। পছন্দ হলে বিয়ে দেবো, নয়তো দেবো না।’
-ছেলের বয়সটাও দেখতে হবে। মনির বয়স এখনও কম, ছেলের বয়স ত্রিশের বেশি হলে হবে না।’ কথাটি বললো জামাল।
-ছেলের বয়স ঠিক আছে। ত্রিশের কম।
-সেটা ছেলেকে দেখলেই বোঝা যাবে।
-কিন্তু বাবা, ওরা কি মেয়ে পছন্দ করবে?’ মনির মা সংশয় প্রকাশ করলো।
-কেন? আমার নাতনি কোনদিক দিয়ে কম? যে ছেলে আমার নাতনিকে দেখবে, সেই বিয়ে করতে চাইবে।’ কথাটি বলেই পদ্মাবতী মনির হাত ধরতে চাইলো। মনি উঠে চলে গেল ওখান থেকে। ওর খুব কান্না পাচ্ছে এখন। বাইরে বের হয়ে এসে তুলাগাছের ছায়ার নিচে দাঁড়ালো সে। তারপর পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগলো। বীথি এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। কাঁধে হাত চাপড়িয়ে বললো,
-কাদিস না মনি।’
মনি আর আবেগ ধরে রাখতে পারলো না। বীথিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। বীথি তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
-এভাবে ভেঙে পড়িস না।’
কাঁদতে কাঁদতে মনি বললো,
-আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে বল, দাদু আমাকে বিয়ে দিতে চাইছে।
-এখনও তো বিয়ে দিয়ে দেয়নি। আগে দেখুক সবকিছু, পছন্দ হলেই না বিয়ে।
-আমার খুব ভয় করছে বীথি, খুব কান্না পাচ্ছে।’ মনি এবার ভেঙে পড়লো একদম। বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগলো। বীথি তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে ভাষা খুঁজে পেল না। শুধু পিঠে আলতো করে হাত চাপড়াতে লাগলো।
.
.
(চলবে….)