জীবনের গল্প পর্ব-১৭

0
426

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১৭___________
রাজ জড়িয়ে ধরতেই মনি একেবারে ভেঙে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে চললো সে। রাজ তাকে সান্ত্বনা দিয়েও থামাতে পারলো না। যখনই কারও আসার শব্দ শোনা গেল, মনি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। দুজন পাশাপাশি বসলো খাটের উপর। রাজ নির্বাক। এই মুহূর্তে সে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ইতস্তত করে বললো,
-পাগলি মেয়ে, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে এভাবে কাঁদতে হয়? সব মেয়েরই তো বিয়ে হয়। তোর না হয় একটু আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে…’
জবাব দিলো না মনি। কান্নার রেশ তখনও কাটেনি তার। নাক দিয়ে ফুঁপাচ্ছে। একটু পর সে রাজের উদ্দেশ্যে বললো,
-আমার বিয়ে হয়ে গেলে মনে পড়বে আমাকে তোর? মিস করবি আমাকে?’
রাজ মনির দুহাত নিজের দুহাতে শক্ত করে ধরে, চোখ টিপে উপর নিচ মাথা দুলিয়ে উচ্চারণ করলো,
-হুমমম… খুউউব…’
-কেন মিস করবি? আমি না থাকলে তো তোকে কেউ জ্বালাবে না। তোকে খোঁচা দিয়ে কেউ কথা বলবে না। দাদু যখন বাজার থেকে নাস্তা কিনে আনবে, মজার মজার খাবার কিনে আনবে, ভাগটা এখন থেকে বেশি পাবি।’ ভারি শুনালো মনির কণ্ঠ। রাজ ওর দু’গাল আলতো করে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,
-তোর জ্বালাতনগুলোকেই আমি বেশি মিস করবো, তোর খোঁচাগুলোকেই আমি বেশি মিস করবো। এটা ভেবে আমার খুব কষ্ট হবে যে, আমাকে আর কেউ জ্বালাচ্ছে না, আমাকে আর কেউ খোঁচা দিচ্ছে না। আর দাদুর নাস্তার কথা বলছিস? তুই না থাকলে কে আমার জন্য নিজে না খেয়ে নিজের ভাগটা আমার জন্য রেখে দেবে বল? তোর এই ভালোবাসাগুলোকে আমি মিস না করে কী করে থাকবো বল?’ রাজের গলাটাও কেঁপে ওঠলো। আবেগে ভারী হয়ে আসছে দুজনের চোখ। এক ফোঁটা অশ্রু মনির নাকের ডগায় এসে থামলো। হাত দিয়ে অশ্রুফোঁটাটুকু মুছে মনি বললো,
-তাইলে এতদিন ঠিক করে কথা বলিসনি কেন আমার সাথে? আমার কতো কষ্ট হয়েছে তুই জানিস?
-আমি একটু জেদি তুই তো জানিস। কিন্তু তোর সাথে যেসব ব্যবহার করেছি, তা মন থেকে করিনি রে। ছোট বেলা থেকেই আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আমাদের পরিবারে আমি তোকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। বীথিকে যতটা ভালোবাসি, তার চেয়ে বেশি আমি তোকে বাসি। তাইতো ছোটবেলায় তোকে বাঁচানোর মিথ্যে ধারণায় নেমে গিয়েছিলাম পুকুরের গভীর জলে। অথচ আমি সাঁতার জানতাম না। ভেবেছিলাম পুকুরের জলে গিয়ে প্রার্থনা করলে তুই বেঁচে যাবি। নিজের জীবনের কথা তখন মাথায় আসেনি।’
মনি এবার ‘হু হু’ করে কেঁদে উঠলো রাজের কথা শুনে। কাঁদতে কাঁদতে আবারও জড়িয়ে ধরলো রাজকে। রাজ তাকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে সে জানে, কিন্তু সে যেরকম রাজকে ভালোবাসে, তার চেয়ে ভিন্ন এই ভালোবাসা। হয়তো আরও বেশি পবিত্র। আজীবন এই পবিত্র ভালোবাসা অটুট থাকুক। নিজের ভালোবাসাটুকু না হয় আজীবন আড়ালেই ঢেকে থাকুক। আরও কিছুক্ষণ কেঁদে মাথা তুললো মনি। দেখলো রাজের চোখেও জল। মনি তা সযত্নে মুছে বললো,
-ছিঃ পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই।’ একটু থেমে গলাটা পরিষ্কার করে নাক টেনে আবার বললো,
-ঠিকমতো খাবি, শরীরের যত্ন নিবি। আর এভাবে বাইরে বাইরে ঘুরবি না। রোদে কালো হয়ে যাবি।’
মনির কথা শুনে রাজ ভাবে, কে কাকে বেশি ভালোবাসে? এই মেয়েটা এই মুহূর্তেও তাকে নিয়ে কতকিছু ভাবছে। হয়তো তার ভালোবাসাটাই বেশি। মনির কথার জবাবে সে কেবল মাথা নাড়লো। তারপর চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো মনি, বেরিয়ে গেল সে রুম থেকে। আর রাজ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।
.
.
♥পনেরো♥
বরের গাড়ি এসে থামলো আশরাফ সাহেবের বাড়ির সামনে। বরপক্ষ যখন গাড়ি থেকে নামলো, পাড়ার ছেলেমেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করে দৌড় গাড়ির দিকে। গেইট দিয়ে ঢোকার সময় কিছু ছেলেমেয়ে আবার পথ আটকিয়ে রাখলো। বরপক্ষ থেকে বখশিশ না পেলে পথ ছাড়বে না এরা। পরে ওদেরকে বখশিশ দিয়েই ভেতরে ঢুকতে হলো বরপক্ষকে।
আশরাফ সাহেবের বাড়ির উঠানে বানানো হয়েছে বিরাট প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের নিচে বরপক্ষকে সযত্নে বসানো হলো। কিছু লোক টেবিল পরিষ্কার করছে ওখানে। পাড়ার লোকেরা খেয়ে গেছে ওগুলো। টেবিল পরিষ্কার করা হয়ে গেলে বরপক্ষের সবার সামনে খাবার দেয়া হলো। মাঝেমাঝে আশরাফ সাহেব এবং তাঁর বড় দুই ছেলে এসে তদারকি করে যাচ্ছে বরপক্ষকে খাবার ঠিকমতো দিচ্ছে কি না। ছোট ছেলে রায়হান নেই বলে আশরাফ সাহেবের মন কিছুটা খারাপ। রায়হানকে কত করে বলেছে দেশে আসার জন্য, কিন্তু দেশে আসার নাম নেয় না সে। দেশে আসলে এতদিনে তার বিয়েটাও হয়ে যেতো। তবে রাতে ফোন করেছিল রায়হান। ফোনে অনেকক্ষণ কথাও বলেছে সে মনির সাথে। নিজের একমাত্র ভাগ্নিকে দূর থেকেই দোয়া করে দিলো সে, যেন সংসার জীবন ভালো হয়। নিজের কপালে তো সংসার জুটলো না।
বরপক্ষকে খাওয়ানো শেষ হয়ে গেলে এবার শুরু হলো বিয়ের আসল কাজ। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। মনির বুকটা ধকধক করতে শুরু করেছে তখন। খুব কান্না পাচ্ছে তার। চারদিকে তাকালো সে। কোথাও রাজকে দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকেই রাজের কোনো খোঁজ নেই। কোথায় যেন চলে গেছে সে। রাজের চিন্তায় সে এতটাই বিভোর ছিল যে, কাজী তাকে ‘কবুল’ বলতে বলেছে তাও শুনতে পায়নি সে। কাজী আবারও আওয়াজটা বাড়িয়ে মনিকে কবুল বলতে বললো। মনি সম্বিত ফিরে পেয়ে উচ্চারণ করলো,
-ক…ক….ক্ববুল…’ গলা কেঁপে উঠলো মনির। চোখ বেয়ে টুপ করে কয়েকফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। এই মুহূর্তে কাউকে জড়িয়ে ধরে জোরে আর্তনাদ করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাও পারছে না সে।
.
.
বিয়ের কাজ শেষ হয়ে গেলে বরপক্ষ কনেকে নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু মনি কিছুতেই যেতে চাইলো না। চারদিকে আবারও রাজকে খুঁজতে লাগলো সে। আশরাফ সাহেব এসে জিজ্ঞেস করলেন,
-কাকে খুঁজছিস দাদু?’
মনি আশরাফ সাহেবের বুকে মাথা রেখে সজোরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-রাজ কোথায় দাদু? ওকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না সকাল থেকে। ওকে না দেখলে আমি যাবো না এখান থেকে।’
আশরাফ সাহেবও এবার চিন্তায় পড়ে গেল। তাইতো, ছেলেটা কোথায় গেল সকাল থেকে? খোঁজ করতে লাগলেন তিনি রাজের। তখন পাড়ার একটা ছেলের কাছে জানা গেছে রাজকে খালের পাড়ে দেখা গিয়েছিল সকালে। এবার বীথিকে পাঠানো হলো রাজকে ডেকে আনতে। বীথি দৌড়াতে দৌড়াতে এলো খালের পাড়ে। ওখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিল। ওটাতে রাজ চিত হয়ে শুয়ে আছে, হাতদুটো মাথার নিচে দিয়ে, উপর দিকে তাকিয়ে। কী যেন চিন্তা করছে সে। বীথি গিয়ে নৌকায় উঠলো। ঠের পেলো না রাজ। এতটাই চিন্তায় ডুবেছিল সে। বীথি ডাক দিলো,
-ভাইয়া…’
উঠে বসলো রাজ। বীথি গিয়ে তারপাশে বসলো। কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-কী হয়েছে ভাইয়া তোর? সকাল থেকেই এখানে আছিস? বেলা যে পড়ে গেল। কিছু খাসনিও তুই।
-তুই যা, আমার ভালো লাগছে নারে।’ অন্যদিকে তাকিয়ে বললো রাজ।
-মনি তোকে ডাকছে। তোকে না দেখে সে বরের সাথে যাবে না।’ বলেই বীথি রাজের জবারের আশায় অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো রাজ। বীথি তার হাত ধরে বললো,
-চল ভাইয়া…’
বোনের হাত ধরে উঠলো রাজ। নৌকা থেকে নেমে হাঁটছে সে ঘরের দিকে। প্রতি কদমে তার মনে হচ্ছে কী যেন হারাচ্ছে সে। শূন্যতা গ্রাস করছে তার পুরো অস্তিত্বকে। কেন এমন হচ্ছে তা সে জানে না।
রাজকে আসতে দেখে মনির প্রায় পাগলের মতো অবস্থা। আশেপাশের কোনোকিছুতে তার খেয়াল নেই। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রাজকে। বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগলো ‘হু হু’ করে। কাঁদতে কাঁদতে রাজের বুকে দুহাতে কিল-ঘুষি মারতে লাগলো। প্রচণ্ড অভিমানে সে বললো,
-কোথায় ছিলি সারাদিন? আজ তুই না এলে আমি যেতামই না ওদের সাথে।’
-তুই চলে যাবি, তা নিজ চোখে দেখে সহ্য করতে পারবো না বলেই সকাল থেকে বাইরে ছিলাম।’
-এমন করলে কিন্তু আমি যাবো না একদম।’ বলে আবার ‘হু হু’ করে ওঠলো মনি।
আশরাফ সাহেবের চোখেও জল এসে গেল দুজনের ভালোবাসা দেখে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বরের বাবা মা। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি মন্তব্য করলেন,
-ছোটকাল থেকেই একসাথে বেড়ে উঠেছে তো, তাই ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে দুজনের। খুব ভালোবাসে দুজন দুজনকে।’
আশরাফ সাহেবের কথা শুনে বরের বাবা মা মৃদু হাসলেন। এবার তারা ফিরতে চাইলেন বউমাকে নিয়ে। বউমার ইচ্ছেটা তো পূরণ হয়েছে। যাকে দেখতে চেয়েছে তাকে দেখেছে। এবার যাবার পালা। কিন্তু মনি আবারও জেদ ধরলো। নিজ চোখে সে রাজকে খেতে দেখে তারপর যাবে। সকাল থেকে রাজ কিছুই খায়নি। মনির এই আশাটাও পূরণ করলো ওরা। রাজকে খেতে দেয়া হলো, আর সামনে বসে ওর খাওয়া দেখতে লাগলো মনি। হাত ধুয়ে এক গ্রাস খাবার নিয়ে সে তুলে দিলো রাজের মুখে। রাজ খেয়াল করলো মনির চোখে তখনও অশ্রু জ্বলজ্বল করছে। নীরবে খেয়ে নিলো রাজ মনির তুলে দেয়ে গ্রাসটুকু। তারপর মনি গ্লাসে পানি ঢেলে রাজের মুখের সামনে ধরলো। রাজ পানিতে চুমুক দিলো। আর মনি নিজের চোখের জল মুছলো অন্যহাত দিয়ে।
সবশেষে এবার কনেকে তোলা হলো গাড়িতে। গাড়িতে উঠার আগে মনি সাবার দিকে আরেকবার তাকালো। অসহ্য কষ্ট হচ্ছে তার। বুকটা কেউ যেন ছিড়েছিড়ে খাচ্ছে। তবুও উঠে গেল সে গাড়িতে। একটুপর গাড়ি ছেড়ে দিলো বরের। রাজ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো মনির চলে যাওয়া। যতদূরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি, বুকের ভেতরের ব্যথাটাও যেন ততো বেড়ে যাচ্ছে। কখনও ভাবেনি সে মনির বিয়েতে এতটা কষ্ট হবে তার, মনিকে এতবেশি মিস করবে সে….
.
.
(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here