__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১৮___________
প্রকৃতিতে এখন বসন্তকাল। নতুন রূপে সাজছে প্রকৃতি। গাছেগাছে নতুন পাতা গজাচ্ছে। আর কোকিলের মধুর স্বর চারপাশটা মাতিয়ে তোলে। একটা কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙলো রাজের। দুপুরেই ঘুমিয়েছিল সে, এখন প্রায় সন্ধ্যা। রাজ বাসা থেকে বের হলো চোখ মুছতে মুছতে। উঠানে এসে দেখলো বাড়ির সবাই মিলে ছোট চাচুর সাথে ফোনে কথা বলছে। সবাই হাসিখুশি। কারণ ছোট চাচু দেশে ফিরবে কয়েকদিনের মধ্যে। ছোট চাচুর সাথে কথা বলার জন্য রাজও মোবাইলটা হাতে পেতে চাইলো। তখন দাদু কথা বলছিলো ফোনে। দাদু ওপাশের কথা শোনার জন্য মোবাইলটা একবার কানের পাশে নিয়ে যায়, আবার কথা বলার সময় মুখের কাছে নিয়ে আসে। মোবাইলে লাউডস্পিকার দেয়া ছিল, যাতে সবাই শুনতে পায়। রাজ দাদুর গা ঘেষে দাঁড়ালো। দাদু তখন গলার আওয়াজ বাড়িয়ে কথা বলছে। দাদু কথা বলার সময় কথাগুলো রাস্তায় শোনা যায়। দাদুর ধারণা ছোট করে কথা বললে ওপাশে শোনা যায় না। দাদু বলছে,
-হ্যাঁ রায়হান, এখানে সবাই খুশি তোর আসার খবর শুনে। তোর মা তো একেবারে কেঁদে দিয়েছে। দেখ এখনও তোর মায়ের চোখে পানি।’
বলেই দাদু তাকালেন দিদিমার দিকে। দিদিমা তখন শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছলেন। রাজ বললো,
-হয়ছে দাদু, এবার আমাকে একটু বলতে দাও…’
-এ্যা রায়হান? ধর, রাজ তোর সাথে কথা বলবে….’
বলেই মোবাইলটা রাজের হাতে দিলেন দাদু। রাজ তখন সালাম দিয়ে বললো,
-ছোট চাচ্চু, আসার সময় আমার জন্য একটা মোবাইল আনতে হবে।
-আচ্চা আনবো। তুই কেমন আছিস বল?
-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
-হ্যাঁ ভালো আছি। তোর পড়ালেখা কেমন হচ্ছে?
-হ্যাঁ ভালো। সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। দোয়া করো আমার জন্য।
-আচ্ছা করবো, ভালো করে পড়িস কিন্তু।
-আচ্ছা, আর আমার মোবাইলের কথা ভুলবে না কিন্তু।
-আচ্ছা।
-ছোট চাচ্চু… ছোট চাচ্চু…?
-হ্যাঁ বল…
-আমরা সবাই খুব খুশি তুমি আসবে তাই…’
-তাই…’ ওপাশে রায়হানের হাসি শোনা গেল।
-হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।
-আচ্ছা। ফোনটা তোর দিদিমণিকে দে একটু…’
-দিদিমণি, নাও কথা বলো…’ মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলো রাজ দিদিমার দিকে। দিদিমা তখন কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। রাজ ওখান থেকে সরে এসে টিউবওয়েল চেপে মুখ ধুতে লাগলো। টিউবওয়েলের শব্দের সাথে একটা কোকিলও মিষ্টি সুরে ডেকে উঠলো তখন।
.
.
সন্ধ্যায় রাজ পড়তে বসলো। ইদানীং সে একটু পড়াতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। মনির বিয়ের পর থেকে আগের মতো নেই আর সে। কোনো মেয়ের পিছু ঘুরে না সে আর। স্কুলের ম্যাডামটাও এখন পছন্দ করে রাজকে। মনির বিয়ের পর রাজ যখন মন খারাপ করে ক্লাসে বসে থাকতো, তখন ম্যাডামই তাকে পরম স্নেহে জিজ্ঞেস করতো,
-কীরে তোমার মন খারাপ কেন? কয়েকদিন ধরেই দেখছি ক্লাসে দুষ্টামি করো না, চুপচাপ বসে থাকো।’
-কিছু না ম্যাম। এমনি।’ রাজ মাথা নিচু করে জবাব দিতো।
-এভাবে মন খারাপ করে থেকো না, সবার সাথে হাসিখুশি থাকো, কথা বলো। দেখবে মন ভালো হয়ে গেছে।’ বলেই ম্যাডাম হাত বুলিয়ে দিতো ওর মাথায়। আগের মতো আর বকা দিতো না। স্কুলে তবুও একটু ভালো লাগতো তার। কিন্তু বাসায় এলে তার মনটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় পৃথিবীতে সে বড় একা। কেউ নেই তার। চারপাশে খালি শূন্যতা। তখন সে ঘর থেকে বের হয়ে খালের ধারে চলে যেতো। আর নৌকার ছঁইয়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে মনির কথা ভাবতো শুধু। তবে মনিকে নিয়ে কেন ভাবতো তা সে জানে না। শুধু কষ্ট কমাতে মনির কথা ভাবতো, তখন কষ্ট কমার বদলে আরও বেড়ে যেতো। ছঁইয়ের উপর শুয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতো। স্বাভাবিক হতে তার অনেকদিন কেটে যায়।
.
.
জোরে জোরে পড়ছে রাজ। পাশে বসে বীথিও পড়ছে, তবে মনে মনে। পাশের রুম থেকে তখন ইয়াসমিনের ছেলেটার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। তার মা তাকে মারছে। প্রতিদিন এই সময়ে ছেলেটা মার খায় মায়ের হাতে। কারণ এই বয়সেই সে বেশি দুষ্ট হয়ে গেছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে, খোঁজ পাওয়া যায় না। আঁধার হয়ে গেলেই ঘরে ফিরে। মা একটু আরবি পড়াতে চাইলেও পড়ে না। এজন্যই মার খায় সে। ওর কান্নার কারণে রাজ ও বীথি ঠিকমতো পড়তেও পারছে না। পড়া থামিয়ে বসে থাকলো তারা। তখন রাজের মা নিজে নিজেই চিৎকার করে বলে উঠলো,
-প্রতিদিন ছেলেমেয়ে দুজন পড়তে বসলে ওদের মা ছেলের কাণ্ড বেড়ে যায়। সামনে ছেলেটার পরীক্ষা। প্রতিদিন এভাবে নাটক করলে আমার ছেলেটা পড়বে কী করে?’
ও ঘর থেকে ইয়াসমিন বলে উঠলো,
-আমার ছেলেকে আমি মারছি আরেকজনের জ্বলে কেন?’ বলেই ছেলেকে আবার মারতে শুরু করে ইয়াসমিন। ওর ছেলে তখন আরও জোরে কেঁদে উঠে। আয়েশা বেগম আবার বলে,
-ছেলে শাসন করে রাখতে না জানলে জন্ম দিতে কে বলছে? কই আমার ছেলে মেয়ে তো এমন না। কখনও এমন ছিল না।’
-হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার ছেলে মেয়ে দুটো অমূল্য সম্পদ। জাদুঘরে রেখে আসো যাও।’
-ইয়াসমিন, বেশি বাড়াবাড়ি করবি না বলে দিলাম। তোরা মা ছেলে মিলে এসব আমার ছেলেটার পরীক্ষা খারাপ করে দিস না।
-এ্যাহ! উনার ছেলের আবার পড়া। পড়ে একেবারে উড়ায় দিচ্ছে।’ খোঁচা মেরে বললো ইয়াসমিন। আয়েশা বেগমের রাগ বেড়ে গেল। চিৎকার করে বললো,
-তোরা প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে নাটক করবি, আবার বড় বড় কথা বলিস কেন? আজকে রাজের বাবা আসুক, এর একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বো।
-যা পারো করো।’
ঝগড়ার মাঝখানে এবার পদ্মাবতী ঢুকলেন। তিনি ইয়াসমিনের ঘর থেকেই বলে উঠলেন,
-বড় বউমা, এসব কী হয় প্রতিদিন? এভাবে ঝগড়া করে কী পাও তোমরা?
-আমাকে বলছেন কেন শুধু? আপনার পাশে যে আছে, তাকে চোখে পড়ে না আপনার?’ আয়েশা বেগমের রাগ আরও বেড়ে গেল। পদ্মাবতী বললেন,
-তুমি বড় বউ, তোমাকে বুঝতে হবে এসব। তোমরা আলাদা হয়েছে ঝগড়ার কারণে। কিন্তু আলাদা হয়েও তোমাদের ঝগড়া থামলো কই। রোজ রোজ এসব ঝগড়া ভালো লাগে না।
-আমারও আর এসব ভালো লাগে না। আপনারা বুড়া বুড়া দুইজন, সবসময় ওদের পক্ষে কথা বলেন। আমার ছেলেটার কয়েকদিন পর পরীক্ষা, ও যে পড়তে পারছে না, ওসব তো আপনাদের চোখে পড়ে না।’
আরেকটা রুম থেকে আশরাফ সাহেব চিৎকার করে বললেন,
-ও মা রে মা, কী অসভ্যজাত নিয়ে পড়লাম রে মা। তোরা যে যেদিকে পারিস চলে যাস না কেন? আমার ঘরে পড়ে আছিস কেন? সন্ধ্যার সময় কোথায় একটু আল্লাহর ইবাদত করবা তা না, দুজন মিলে শুরু করে দিবে ঝগড়া।’
আশরাফ সাহেবের কথা শুনে দুই বউয়ের ঝগড়া থামলো। ইয়াসমিনের ছেলেটার কান্নার শব্দও আর শোনা গেল না।
.
.
রাতে স্বামী বাসায় ফিরলে আয়েশা বেগম কেঁদে কেঁদে সব বলে। তখন আমান ইয়াসমিনকে ডেকে কথা বলে। আমান তাকে কিছু বলতে গেলেই সে বেয়াদবি করে বসে আমানের সাথে। চেঁচিয়ে বলে উঠে,
-আপনার বউকে সামলান। ঠিকমতো শাসন করেন না বলে এমন বাড় বেড়েছে। সবমসময় ঝগড়া করতে মন চায় উনার।’
স্বামী কিছু বলার আগেই আয়েশা বেগম বললো,
-ঐ বেয়াদব মেয়ে, কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না? আমার স্বামী আমাকে কী সামলাবে রে? তোর স্বামীই তো তোকে সামলাতে পারে না।’
বাহির থেকে ঘরে ফিরলো তখন জামাল। ইয়াসমিন যে কথাটা বলেছে সে আসার সময় শুনতে পেয়েছে। তাই ঘরে ঢুকার আগে একটা মেহেদি গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এসেছে সাথে। ঘরে ঢুকেই ইয়াসমিনকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। তারপর মেহেদি গাছের ডালটা দিয়ে মারতে লাগলো। ভেতর থেকে ইয়াসমিনের কান্নার শব্দ ভেসে এলো। জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে সে। উপর থেকে জামাল আরও বেশি মেরে যাচ্ছে তাকে। রাগ বেড়ে গেছে তার। মারতে মারতে বললো,
-আমরা কোনোদিন বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনি, আর তুই মুখের উপর এতবড় কথা বলে দিলি? প্রতিদিন ঝগড়া করিস না? আজ তোর ঝগড়া বের করবো।’ বলেই মারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো সে। দরজার বাইরে থেকে পদ্মাবতী চিৎকার করে উঠলো,
-ওরে মেরে ফেলবি নাকি বউটাকে? দরজা খুল, জামাল দরজা খুল…’
কিন্তু দরজা খুলে না জামাল। আরও বেশি মারতে থাকে সে। পদ্মাবতী এবার আমানের উদ্দেশ্যে বললেন,
-আমান ওকে থামা। মেরে ফেলবে ও বউটাকে।’
আমান এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো,
-জামাল দরজা খুল, খুল বলছি…’
একটুপর জামাল দরজা খুলে দিলো। পদ্মাবতী তখন ইয়াসমিনকে ধরে অন্যরুমে নিয়ে গেলেন….
.
.
(চলবে….)