__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-৩১___________
একটা ৭/৮ বছরের মেয়ে এসে চেয়ে থাকলো দুজনের দিকে। রাজ মেয়েটাকে ডাকলে আবার দৌড়ে চলে গেল মেয়েটা। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একটা মহিলা উঁকি দিলো। ঘোমটাটা ভালো করে টেনে দিয়ে মহিলাটা বের হয়ে এলো। অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর চোখ দুটো তার জ্বলজ্বল করে উঠলো। কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলো,
-রাজ? বীথি?’
-হ্যাঁ মেজো আম্মু…’ বলেই পা ছুঁয়ে সালাম করলো দুজন। দুজনকে জড়িয়ে ধরে মেজো আম্মু কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-এতদিন আসিসনি কেন তোরা? মনে পড়েনি একটুও আমাদের কথা?’
-খুব মনে পড়েছে।’ বলেই কান্না কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো রাজ। কিন্তু বীথি পারলো না। ওর চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়াতে লাগলো মেজো আম্মুর মতো।
চোখ মুছে মেজো আম্মু বললো,
-এখন তোদের কোথায় বসতে দিই? ঘর দুয়ার সব ভেজা।’
-অসুবিধে নেই, আমরা সব জেনেই এসেছি। দাদু, দিদিমণি আর বাকি সবাই কোথায়?’
-ওরা ও বাড়িতে থাকে। তোর ছোট চাচ্চু করেছে বাড়িটা।
-আর মেজো আব্বু কোথায়?’
-তোর মেজো আব্বু বাইরে। চল তোদের দিদিমণির সাথে দেখা করবি…’ বলেই আগে আগে বের হলো ইয়াসমিন। উঠোন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজিত হয়ে ডাক দিলো,
-খালাম্মা, খালাম্মা দেখেন কারা এসেছে।’
পদ্মাবতী বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। সাথে আরও কয়েকজন বের হয়ে এলো। দাদিকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো রাজ আর বীথি।
-দিদিমণি, কেমন আছো দিদিমণি?’ বলেই কাঁদতে শুরু করলো রাজ আর বীথি। পদ্মাবতী মুখ তুলে ভালো করে দেখলেন দুজনকে তারপর আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন বিলাপ ধরে,
-আমার ভাই, আমার রাজ, বীথি… কোথায় ছিলি এতদিন তোরা? আমাদের ছেড়ে এতদিন কী করে ছিলি দূরে?’ কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেল পদ্মাবতীর। হঠাৎ দুজনকে পেয়ে আর ছাড়তে চাইছেন না তিনি। তখন বড় ফুফি দুজনকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। কান্নার একটা বড়সড় পর্ব চলতে লাগলো উঠোন জুড়ে। আবার আরও দুইটা মেয়ে বের হলো ঘর থেকে। একজনকে চিনতে পারলো না রাজ ও বীথি। অন্যজনকে দেখেই চিনতে পারলো। মনি। কিন্তু ওর গায়ে সাদা শাড়ি কেন? হাজারো প্রশ্ন নিয়ে তাকালো ওর দিকে রাজ। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো মনি। রাজের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো তার। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে বুক চিরে। তারপর কোনো কথা না। রাজের নাম ধরে চিৎকার করে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সম্পূর্ণ আবেগে কাঁদতে লাগলো। কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ বেয়ে, শুধু কান্নার শব্দ ছাড়া। রাজ নিজের চোখের জল মুছার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। মনির মতো জোরে জোরে কাঁদতে পারছে না সে। বীথি মনির পিঠে হাত রাখলো। মনি এবার বীথির নাম ধরে চিল্লায় উঠে জড়িয়ে ধরলো বীথিকে। কান্না থামছে না কোনোমতে তার। যেন অনেক বছরের জমানো কান্না। সব চোখের জল আজ শেষ করবে কেঁদে।
মনির সাথে যে মেয়েটি বের হয়ে এলো, ওর দিকে ইশারা করে রাজ দাদিকে জিজ্ঞেস করলো,
-ইনি কি ছোট আব্বুর বউ?’
-হ্যাঁ, ও তোর ছোট আম্মু।’
রাজ সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কেমন আছেন ছোট আম্মু?’
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা কেমন আছো?’ হাসিমুখে বললো ছোট আম্মু।
-জ্বী, আমরাও ভালো আছি।’
-এভাবে উঠোনে আর কতক্ষণ কান্নাকাটি চলবে, খালাম্মা ওদেরকে ভেতরে নিয়ে যায়।’
ছোট বউয়ের কথায় পদ্মাবতী জবাব দিলেন,
-হ্যাঁ, রাজের হাত থেকে ব্যাগটা নাও। চল দাদুভাই, চল দিদিভাই…’ বলেই পদ্মাবতী রাজ ও বীথিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পেছন পেছন সবাই ঢুকলো। তখন বাহির থেকে এলো ছোট চাচ্চু। সেই কত বছর আগে দেখেছিলো, চাচ্চুকে দেখে চেনার উপায় নেই। রায়হানও চিনতে পারলো না রাজ ও বীথিকে। পরে রাজ ও বীথি নিজেদের পরিচয় দিলে রায়হান দুজনকে বুকে টেনে নেই। বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকে ওভাবে। তারপর দুজনকে ছেড়ে দিয়ে রায়হান তার স্ত্রীকে বললো,
-রেশমা, বাসায় কিছু রান্না হয়নি না এখনও? তুমি ভাত বসাও, আমি বাজার করে নিয়ে আসছি, এদের দুইজনের মনে হয় খিদে পেয়েছে।’ বলেই বের হয়ে গেল রায়হান হনহন করে। রাজ এবার দাদুর কথা জিজ্ঞেস করলো,
-দাদু কোথায় দিদিমণি? দাদুকে দেখছি না যে?’
-তোর দাদু মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছে সেই কবে। এখনও ফিরেনি। হয়তো মসজিদেই আছে।’
-আচ্ছা, আমি বের হয়ে দেখি।’ রাজ বের হলো। ভেজা উঠোনে পা ফেলতে ফেলতে চলে এলো রাস্তায়। তারপর মসজিদের দিকে হাঁটলো। দাদু হয়তো মসজিদের ভেতরে। নয়তো আসার সময় দেখা হতো। মসজিদের পাশে একটা দোকান দেয়া হয়েছে। ঐ দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো রাজ। তখন মসজিদের ভেতর থেকে লাঠিতে ভর দিয়ে বের হলো দাদু। রাজ এগিয়ে গেলো দাদুর দিকে। দাদু ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। রাজ নরমকণ্ঠে ডাক দিলো,
-দাদু…’
আশরাফ সাহেব থামলেন। রাজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কে?’
-দাদু আমি… চিনতে পারছো না?’
আশরাফ সাহেব রাজের মুখে হাত বুলালেন। তারপর বললেন,
-না, চোখে ভালো করে ঠাহর করতে পারি না আগের মতো। অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। কে দাদুভাই তুমি?’
দাদুর কথা শুনে আবারও কান্না চলে এলো রাজের। কোনোমতে কান্না কন্ট্রোল করে সে বললো,
-দাদু, আমি রাজ। তোমার আদরের নাতি রাজ।’
কথাটি শুনেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন আশরাফ সাহেব। রাজের মুখে বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-রাজ? আমার রাজ? আমার আদরের নাতি রাজ?’ বলতে বলতে জড়িয়ে ধরলেন তিনি রাজকে। হাত থেকে লাঠিটা পড়ে গেল তার। রাজের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদতে লাগলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-এতো বছর পর বুঝি তোর এই বুড়ো দাদুটাকে মনে পড়লো?’
-মনে সবসময় পড়েছে দাদু। প্রতিমুহূর্তে তোমাদের সবাইকে মনে করেছি।
-আর কে এসেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন দাদু।
-বীথি এসেছে।
-তোর বাবা-মা আসেনি?’
-না…’
আশরাফ সাহেবের মুখটা কিছুক্ষণ মলিন হয়ে রইলো বড় ছেলে আর ছেলের বউ আসেনি শুনে। পরক্ষণে তিনি খুশিতে চিল্লায় উঠলেন,
-এই কে কোথায় আছো দেখো, দেখো আমার নাতি এসেছে।’
রাজ নিচ থেকে লাঠিটা তুলে দাদুর হাতে দিলো। একহাতে লাঠিতে ভর দিয়ে, অন্য হাতে নাতির মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন আশরাফ সাহেব। তারপর কান্নার সাথে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
-ইশ! দাদুভাই তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস।’ বলেই খুশিতে প্রাণ খুলে হাসলেন তিনি। আশেপাশে বাচ্চাকাচ্চা ও আরও অনেকে এসে দাদা নাতির পুনর্মিলন দেখতে লাগলো। আবুল চাচাকে চিনতে পেরে রাজ উত্তেজিত হয়ে বললো,
-আবুল চাচা? কেমন আছো?’
-এই তো ভালা আছি বাবাজি। আসো, দোকান থেইকা ঠাণ্ডা কিছু খাইয়া যাও।’ বলেই আবুল চাচা দোকানদারের উদ্দেশ্যে ডাক দিয়ে বললেন,
-মন্টু, ফ্রিজ থেইকা একটা ঠান্ডা সেভেন আপ লইয়া আয় তো…’
একটুপর মন্টু সেভেন আপ নিয়ে এসে রাজের হাতে দিলো। রাজ সেভেন আপের ছিপি খুলতে খুলতে বললো,
-এটা মন্টু? বাহ্। কত বড় হয়ে গেছে। কেমন আছিস মন্টু? চিনতে পারছিস আমাকে?’
-হ্যাঁ রাজ ভাই…’ হাসলো মন্টু।
-এইতো চিনতে পেরেছিস। তো দোকান দিছিস নাকি?’
রাজের প্রশ্নের জবাবে আবুল চাচা হেসে জবাব দিলো,
-হ্যাঁ, দোকানটা ওরে কইরা দিছি।
-তো আবুল চাচা, এখন আর মাছ ধরো না?’
-তা তো ধরি। বাপ দাদার পেশা, যাইবো কই?’ আবারও হাসলো আবুল চাচা।
-আচ্ছা, পরে সময় করে সবার সাথে ভালো করে কথা হবে। এখন দাদুকে নিয়ে যাই আমি।’
-আচ্ছা।’
রাজ দাদুকে ধরে হাঁটতে লাগলো ঘরের দিকে। দাদু আর আগের মতো পা ফেলে হাঁটতে পারে না। ধীরে ধীরে পা ফেলে লাঠিতে ভর দিয়ে। হয়তো পথও ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না দাদু।
.
.
(চলবে….)