অনুভবে তুই পর্ব-৪

0
2590

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

নেহা ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বলল, ‘আরে তুই নতুন তো, তাই ভাইয়া এমন করেছে। আমাদের ভাইয়া এতোটাও খারাপ নয়, যতটা তুই ভাবছিস।’

‘এত খিটমিটে কেউ হয়? যেভাবে কথা বলছিল যেন, এক্ষুনি থাপ্পড় মেরে দেবে আমাকে।’

‘আজব, তোকে কেন থাপ্পড় দিবে?’ ফিহা বললো।

‘তোমার ভাইয়ের চাহনি দেখলেই মনে হয় গলা টিপে ধরবে। উৎস ভাইয়া তো এমন নয়। ওনাকে কী ছোটবেলায় করল্লার রস খাইয়ে দিয়েছিল? মধু দেয় নি মুখে?’

রোজার কথা শুনে ফিহা হেসে বলল, ‘ভাইয়ের সামনে গিয়ে বল না, থাপ্পড় দিয়ে তোর গালের মাংস ফাটিয়ে দেবে।’

‘থাপ্পড় খাওয়ার শখ নেই ফিহা আপু।’

‘তাহলে এ বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা মুখেও আনবি না।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে বলল রোজা।

ফিহা হেলেদুলে ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলটাতে গিয়ে বসলো। খোপায় মোড়ানো চুলের ভাঁজ খুলে তাতে চিরুনি বুলাতে বুলাতে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘শোন রোজা, খালুজানকে অনেক রিকুয়েষ্ট করে মা রাজি করিয়েছে তোকে নিজের কাছে রাখবে বলে। কখনো তুই এসেছিস আমাদের বাসায়? আসিস নি। এখন তুই চলে গেলে মা কষ্ট পাবে। আর সামান্য একটা ব্যাপারে তুই এরকম রিয়েক্ট করছিস কেন আজব? আর একান্তই যদি তোর এখানে থাকতে মনে সায় না দেয় তাহলে, আমি ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলে দেব তুই ওকে কি বাজে বলেছিস, তারপর যখন ধরে দিবে না তখন বুঝবি আদ্রিশ ভাইয়া কী জিনিস।’

রোজা ফিহার কথা শুনলো মনোযোগ দিয়ে। ক্ষিপ্র কন্ঠে বলে ওঠলো, ‘আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো আপু?’

ফিহা গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিল, ‘মনে কর তাই।’

রোজা অনেকটা কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিতে নেহার দিকে তাকালো। অসহায় গলায় বলল, ‘ফিহা আপু কী বলে দেখেছো? আমাকে জোর করে আটকাতে চাইছে।’

ফিহার বুদ্ধিমত্তা দেখে মনে মনে প্রশংসা করে নেহা। ওর বোনের মাথায় যে কত রকমের কুটিল বুদ্ধি আছে সেটা দেখে মাঝেমধ্যে ও নিজেই অবাক বনে যায়। তবে রোজাকে আটকানোর জন্য যে ট্রিকস অবলম্বন করেছে সেটা খুবই প্রশংসার যোগ্য! নেহা রোজার কথা না শোনার ভঙ্গিতে বলল, ‘তো? কী করবে? তুই যদি আরেকবার প্যানপ্যান করিস আমি নিজেই গিয়ে ভাইয়াকে বলে দেব, তারপর দেখিস মজা।’

রোজা হতবিহ্বল হয়ে বলল, ‘আপু তুমিও!’

নেহা হাই তুলতে তুলতে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো। কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল, ‘কথা বাড়াস না। শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে।’

‘তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছো নেহা আপু। আমি তোমাদের বাসায় থাকতে চাই না।’

নেহা কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বললো না। পাশ ফিরে শুয়ে চক্ষুমুদিত করল। ততক্ষণে ফিহা চুল বাঁধা শেষ করে ওঠে দাঁড়ালো। বেড সাইডের বাতিটা নিভিয়ে দিতে দিতে খানিকটা রাগমিশ্রিত কন্ঠে রোজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুই এমন কান্ড করছিস যেন আদ্রিশ ভাইয়া বাঘ নয়তো ভাল্লুক। এই তোকে কিছু করেছে? জাস্ট রেগে একটু প্রশ্ন করেছে, তাতেই তুই এসব শুরু করেছিস রোজা। আমাদের তো মাঝেমধ্যে মাথায় চাটি মারে, তবুও তো এমন করি না। যত্তসব৷ তুই এখনি যদি ঘুমাতে না যাস, আমি সত্যিই ভাইয়ার কাছে উলটা পালটা কথা লাগিয়ে দেব। ভাইয়ের হাতে চড় খাইলে বুঝবি সে কী জিনিস! যা ঘুমা বলছি..’

রোজা মুখ কালো করে বসে রইল। ফিহা আড়চোখে দেখল ওকে। যেন কৃষ্ণবর্ণের একরাশি মেঘ রোজার শুভ্রসুন্দর মুখখানি ঘিরে রেখেছে। খোলা জানালার কপাট দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়ায় কপালের কাছের ছোট চুলগুলো এদিকসেদিক ওড়ছে। ফিহা আড়ালে ঠোঁট চেপে হাসলো। গ্রামে বড় হওয়া তাঁর এই বোনটি যে ভীতুর ডিম সেটা ওরা খুব ভালো করেই জানে। তবুও শাখাওয়াতের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলেছে তাতে ওরা বেশ অবাকই হয়েছে বলা যায়। যে মেয়েকে ঠেলে-ধাক্কিয়েও কথা বলানো যায় না, সে আজ কীভাবে এত এত কথা বললো সেটা মেমোরিতে রেখে দিতেই নিজের ফোনে ভিডিও করেছিল ফিহা। খালুজান-আদ্রিশের ফোনে পাঠিয়েছিল সে। ফিহা মুচকি হেসে নেহার বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পড়লো। রোজা গুটিশুটি মেরে ওদের দু’বোনের মধ্যিখানে শুয়ে পড়তেই নেহা-ফিহা ওকে দু-দিক থেকে জাপ্টে ধরল। গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে রোজা মৃদুস্বরে বলল, ‘ফ্রি তে কোলবালিশ পেলে এমনই বুঝি হয়! তোমারা দুই বোন নির্ঘাত আমায় তুলো ভাবছো!’

‘বিড়বিড় করে এত কী কথা বলছিস রোজা? ঘুমিয়ে পড় না…’

রোজা ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বলে উঠলো, ‘নেহা আপু, তোমার বিয়েটা যে ভেঙ্গে গেল সেটা কী আমার জন্য?’

নেহা-ফিহা মাথা উঁচিয়ে তাকালো। রাগমিশ্রিত কন্ঠে নেহা জবাব দিল, ‘তোকে কে বলেছে?’

‘কেউ না। গ্রামে এরকম কান্ড হলে বলতো এক বোনের জন্য আরেক বোনের বিয়ে ভেঙ্গেছে। যার জন্য ভেঙেছে সেই মেয়েকে তখন অপয়া, অশুভ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। আচ্ছা এই ঘটনা যদি গ্রামে ঘটতো তাহলে আমাকেও সবাই এরকম বলতো, তাই না?’

ফিহা ধপ করে ওঠে বসলো। রোজা চমকালো। ফিহা কড়া কণ্ঠে বলল, ‘আসলেই কী তোর জন্য বিয়ে ভেঙ্গেছে না-কি? ওই ছেলে নিজেই তো নেহা আপুকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। সেজন্য আপুকে সবার সামনে অপমান করেছে। আরে ও তো একটা ছ্যাছড়া, অশিক্ষিত লোক। তুই যখন প্রতিবাদ করতে গেলি দেখলি না কেমন অসভ্যতামি করলো? দরকার হলে আমার বোনকে কখনোই বিয়ে দেব না। এর সাথে সংসার করার চেয়ে আইবুড়ো হয়ে জীবন কাটানো অনেক ভালো।’

‘না মানে আমি ভাবছিলাম..’

নেহা বিরক্ত হয়ে ধমকে বলল, ‘এই তুই চুপ করবি? এই লোকটাকে প্রথম থেকেই আমার সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। তার মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে যা গুণগান গাইতো সবকিছু অতিরিক্ত লাগতো আমার। ওই যে বলে না, ফাঁকা কলসি বাজে বেশি, তেমনই। বিয়েটা ভেঙ্গেছে একদম ঠিক হয়েছে। তাছাড়া দেশে কী ছেলের আকাল পরেছে যে আমার বিয়ে হবে না? তুই এত ভাবছিস কেন! আর একটা কথাও বলবি না। চুপচাপ ঘুমা রোজা…’

সকালে নাস্তার টেবিলে নেহার পাশে কাচুমাচু হয়ে বসে খাচ্ছিলো রোজা। পরোটার সাথে দেওয়া হয়েছে হাঁসের ডিম। যেটাতে ওর এলার্জি আছে আর পরোটা ওর মোটেও পছন্দ না। কিন্তু এই কথাটাই সে মুখফুটে খালা বা নেহাকে বলতে পারছে না সে। কারণ টেবিলের একপ্রান্তে বসে নাস্তা খাচ্ছে আদ্রিশ, ওর বাবা, উৎস, ফিহা, ওদের বাবা। সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করছে নেহার মা নিশিতা, আদ্রিশের মা মিতালি। খেতে খেতে আদ্রিশ পর্যবেক্ষণ করছিল সবাইকে। যখন দেখলো রোজা কিছু খাচ্ছে না, আনমনা হয়ে বসে আছে তখন ধমকের সুরেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মেয়ে? খাচ্ছো না কেন? কখন থেকে এভাবে বসে আছ? সমস্যা কী?’

আদ্রিশের কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই একপলক ওকে দেখে নিয়ে রোজার দিকে তাকালো। এতগুলো মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে আছে ভাবতেই অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল রোজা। তাড়াহুড়ো করে পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরলো। সবাই আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। ওর খাওয়া দেখে নেহা অদ্ভুতচোখে তাকিয়ে রইল। জিজ্ঞেস করল, ‘ডিম নিলি না যে? শুকনো পরোটা কেউ খায় নাকি? পানি খা, নয়তো গলায় আটকে যাবে।’

রোজা বিড়বিড় করে বলল, ‘পরোটা খাই না আপু, হাঁসের ডিমে এলার্জি আছে আমার।’

সবাই খাওয়ায় মনোযোগী। আদ্রিশ কুটিল চোখে বসে দেখছিল রোজার কান্ডকারখানা। ওর মৃদুকন্ঠে বলা কথাটি অন্যরা না শুনতে পেলেও, আদ্রিশ ঠিকই শুনতে পেল। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল রোজার দিকে। জোর গলায় বলল, ‘ডিম-পরোটা খাও না, এটা বলতে তোমার প্রবলেমটা কোথায়?’

আবারও সবাই ওদের দিকে তাকাল। আদ্রিশের বাবা ইনায়াত সাহেব ওকে বললেন, ‘তুমি মাথা ঘামিও না। মিতালি-নিশিতা যাও তো, রোজার জন্য কিছু একটা করে নিয়ে আসো। আমি লক্ষ্য করেছি, মেয়েটা অনেকক্ষণ খাবার নিয়ে বসে আছে, খেতে পারছে না।’

আদ্রিশ বাবার কথা শুনে বলল, ‘এজন্য চুপ করে বসে থাকবে? যেটায় ওর সমস্যা সেটা বলে দিলেই তো হয়। আমাদের বাড়িতে কি খাবারদাবার নেই নাকি? রিডিকিউলাস!’

রোজা লজ্জিত। আদ্রিশের কথাগুলো ওর ভালো লাগছে না। সবার সামনে এভাবে কথা শুনানোর মানে কী! লোকটা কী চিরকালই এমন? খ্যাটখ্যাট করে কথা বলে? আদ্রিশের মা মিতালি এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কয়টা স্যান্ডউইচ করে দিই? ডিম ছাড়া?’

ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে রোজা বলল, ‘না না দরকার নেই।’

নেহা ধমক দিয়ে বলল, ‘বড়চাচী ওর কথা শুনো না। স্যান্ডউইচ খাবে ও।’

নিশিতা কফির মগ এগিয়ে দিলো রোজার দিকে। বলল, ‘কফিটা খা৷ ততক্ষণে স্যান্ডউইচ করে দিচ্ছি!’

রোজা মাথা নুইয়ে বলল, ‘কফি খাই না আমি। চা খাই।’

আদ্রিশ এবার চেঁচিয়ে ওঠল, ‘এসব কী শুরু করেছ তুমি? এটা খাবে না, ওটা খাবে না তো খাবেটা কী? আমাকে খাবে?’

সবাই অবাক হয়ে তাকালো। ইনায়াত সাহেব কড়া গলায় বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে? তোমাকে খাবে কেন? ও কী খাবে না খাবে সেটা তো তোমার মা-চাচীই দেখে নিচ্ছে। তুমি নিজের খাওয়া রেখে এরকম করছো কেন?’

[নোট: সবাই কষ্ট করে রিয়েক্ট, কমেন্ট করে যাবেন, আর ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্প সম্পর্কে কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন, হার্ট করে কমেন্ট করবেন না প্লিজ।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here