#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬
ভালোবাসাকে ভালো রাখতে চাওয়ার যে প্রবণতা সেটাই হলো আসল ‘ভালোবাসা।’ রোজা যদি নিজে থেকে ভালো করে বুঝিয়ে আদ্রিশকে বলতো তাহলে হয়তো আদ্রিশ ওকে মুক্তি দিয়েই দিতো। ওর কাছে সবার আগে প্রিয় মানুষটির ভালো থাকাটা নির্ভর করে। আদ্রিশ জানতো, এত সহজে রোজার মনে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব নয়। তবুও সময় দিয়েছিলো, পাশাপাশি নিজে যতটা পারে রোজার খেয়াল রেখেছে। কিন্তু আজ যখন রোজা আদ্রিশের ভালোবাসাকে অপমান করেছে, ওর টুকরো টুকরো অনুভূতিকে ছোট করেছে তখন আর নিজেকে সামলাতে পারে নি৷ বেদনার্থ হৃদয়ে যখন বারান্দার জানালাটার কাচের টুকরো ওর হাতে ঢুকে কেটে গিয়েছিল, বেধড়ক শব্দে ঘুম থেকে জেগে গিয়েছিল রোজা। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ব্যলকনিতে ছুটে আসে রোজা৷ তখনি পাশের ব্যলকনিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় সে। রক্তাক্ত হাতটির দিকে তাকিয়ে আঁৎকে ওঠে। আদ্রিশ তখনো নির্বিকার, রক্ত চুইয়ে পড়ছিল। রোজার কাছে অভিনয়ই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ও ভুল ছিল। যখনি আসল ঘটনা ধরতে পারলো তখনি ছুটে গিয়েছিল আদ্রিশের ঘরে নিজে থেকে, প্রথমবারের মতো। যদিও খানিক আগের ঘটনা ওর মস্তিষ্কে ছিল, কিন্তু লোকটার বিপদে এগিয়ে যাওয়াটাই বেশি প্রয়োজন বলে মনে হলো ওর। একগাদা কথা শুনিয়ে আদ্রিশের হাতে ব্যান্ডেজও করে দিয়েছে রোজা। আদ্রিশ দ্বিরুক্তি করেনি, একটা শব্দব্যয় করে নি৷ ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুধু কম্পিত কন্ঠে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসোনি রোজানু?’
রোজার পা আটকে এসেছিল। মাথা নাড়িয়ে শুধু বলল, ‘ভালোবাসি নি।’
আদ্রিশের গম্ভীর কন্ঠ, ‘তবে এলে কেন?’
রোজা তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘আমি তো আপনাদের মতো নির্দয় নই। যাদের বাড়িতে থাকছি, পড়ছি, অন্ন ধ্বংস করছি তাঁদের বিপদে এগিয়ে আসবো না এতোটাও অকৃতজ্ঞ মনে করবেন না।’
আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘সবার প্রতি এত কৃতজ্ঞতা তোমার? আমার প্রতিও?’
‘না। বিবেচনাবোধ থেকেই ছুটে এসেছি। অন্যকিছু ভেবে নিবেন না।’
আদ্রিশ হেসে ওঠল, ‘তোমার কাছে আমার অপরাধটা ঠিক কী, জানা নেই৷ আমার জানামতে, সজ্ঞানে তোমার সাথে কোনো অন্যায় করি নি আমি। জানি না কে তোমাকে কি বলে কান ভাঙানি দিয়েছে। এতদিন আমাদের বাড়িতে থেকেও যখন আমার প্রতি সামান্য বিশ্বাস রাখতে পারলে না সেখানে ‘ভালোবাসা’ শব্দটিই তো বেমানান রোজানু।’
তারপর আদ্রিশ একটু থেমে হাত থেকে ব্যান্ডেজটা খুলে ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। রোজাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘কখনো আসবে না আমার কাছে। আমি তোমাকে ভুলতে চাই।’
প্রায় সবার জীবনেই কোনো না কোনো সময় ভালোবাসা এসে উঁকি দেয়। ভালোবাসার অনুভূতি চিরন্তন। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভালোবাসা শব্দটির অনুভূতি একইরকম হয়। হঠাৎ হঠাৎ মনে জেগে ওঠা এক টুকরো সুখানুভূতি, আনন্দ, অস্থিরতা। সময়ে-অসময়ে, রাত-বিরেতে প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়লেই নিজের অজান্তে মুখবিবরে ছলকে ওঠে একরাশ রক্তিম আভা। লজ্জা, ভয়, আনন্দ আর সুখ নিয়েই তো অনুভূতি। আর অনুভূতিরা যেখানে প্রগাঢ় হয় সেখানেই তো জন্ম নেয় ভালোবাসা নামক চার অক্ষরের একটি শব্দ। প্রেম হয়ে যায় মনের অগোচরে, অজান্তেই। রাগ-ঘৃণা, লজ্জা-অপমান থেকে প্রেমের অনুভূতি সজাগ হয়। প্রেমে সুখের সাথে সাথে বেদনাও থেকে যায়। আদ্রিশের ঘর থেকে ফিরে আসার পর বুকের মধ্যে চিনচিনে এক ধরণের ব্যথা অনুভূত হচ্ছিলো রোজার। সেটা কী বুঝতে পারছে না।
আদ্রিশের প্রতিটি কথার গভীরে গিয়ে ভেবেছে রোজা। আদ্রিশ একটু ডেস্পারেট। কিন্তু একজন বিচক্ষণ ছেলে। সে নিজের ফুফুর কাছে গিয়ে রোজার নামে উলটাপালটা কথা বলেছে এটা অবাস্তব মনে হলো রোজার। তাহলে সত্যিই কী ও আদ্রিশকে ভুল ভেবেছে? অজান্তেই মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো রোজার।
————————————————————-
ঘটনাক্রমে সেদিন রাতে ইশা আর নেহাকে সুহানা শেখ নিজের সাথে নিয়ে দোতলার অন্য আরেকটি কামরাতে ঘুমান। ফিহা থাকে রোজার সঙ্গে। কিন্তু সে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় নি রোজার মনোভাব। রাতে অবশ্য খেয়াল করেছিল রোজার মন খারাপ, জিজ্ঞেস করলেও বেশিকিছু উত্তর দেয়নি রোজা। ফিহাও সেজন্য আর ওকে ঘাঁটায় নি। এনগেজমেন্টের আয়োজনে অধিক কাজ করতে হয়েছে ওকে। সেজন্য বিছানায় শুয়ে পরা মাত্রই গভীর ঘুমে ডুবে যায়।
রোজা এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ভোরের আলো ফোটামাত্রই। বাড়ির সবাই ঘুম থেকে জাগার আগেই। যাওয়ার আগে উৎস নিজের সাধ্যমতো বোনকে বুঝিয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। আদ্রিশের সাথে অনাকাঙ্খিত ওই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর রোজা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল। তাই আর এ বাড়িতে একটি মুহূর্ত কাটাতে ওর মন সায় দেয় নি। পাছে লোকটা যদি বাড়িতে অশান্তি করে বসে, তাহলে তো রোজা কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। তাই বাড়ির সদস্যরা ঘুমে বিভোর থাকা অবস্থায়ই সে উৎসকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায়। রোজা যে ভোরবেলা কখন বেরিয়ে গেল একটুও টের পায় নি ফিহা! সকালবেলা যখন নাস্তার টেবিলে কেউ রোজাকে দেখতে পেল না, সবাই খুব অবাক হলো। ঘরদোর, ছাদ, বাগান, বাড়ির বাইরে সব জায়গায় খোঁজ করেও রোজাকে পেলো না। ঘরে গিয়ে ফিহাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে নেহা জোর গলায় ডেকে ওঠলো ও। ঘুমঘুমু চোখ মেলতেই রোজার নিঁখোজ হওয়ার খবরটি শুনলো ও। পরক্ষণেই নিদ্রা কেটে গেল ওর। নিজেদের ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে রোজার জিনিসপত্র খুঁজলো, কিন্তু বইপত্র-পোশাক সবকিছুই উধাও দেখে সবাই ভড়কে গেল। ফিহা উৎকন্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাগানে, ছাদে দেখেছ? ভালো করে দেখেছ তো?’
নেহা হতাশ কন্ঠে বলল, ‘সব জায়গায় দেখেছি, কোথাও নেই।’
ফিহা চিন্তিতমুখে বলল, ‘বলো কী? গেল কোথায় তাহলে?’
নেহার হাত-পা টেনশনে কাঁপছে, ‘আমার কিন্তু অনেক চিন্তা হচ্ছে।’
ফিহা জবাবে বলল, ‘কাল আমরা কত আনন্দ করলাম, রোজা কিন্তু এটেন্ডই করেনি। ইনফেক্ট নিচে অবধি নামে নি। রাতে যখন ঘুমাতে এলাম তখন ওকে মনমরা দেখাচ্ছিলো। কারণ জিজ্ঞেস করার পরেও কিছু বলে নি। অগত্যা হাল ছেড়ে দিই। আমি অনেক ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছি। রোজা আমার পাশেই ঘুমিয়েছিল। কিন্তু কখন যে ওঠে বেরিয়ে গেল আমিতো টেরই পাই নি।’
ইশা গালে হাত দিয়ে বলল, ‘কোথায় খুঁজবো ওকে?’
ফিহা জিজ্ঞেস করল, ‘ফোন করেছিলে?’
‘ফোন সুইচড অফ। আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘উৎস ভাইয়াকে জানিয়েছো? ভাইয়া কিছু তো করতে পারতো।’
নেহা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ভাইয়া বাসায় নেই, জানেও না৷ বোধহয় জগিং করতে বেরিয়েছে। ফোন নট রিচেবল।’
এমন সময় সুহানা শেখ ঘরে ঢুকলেন। ওদের শেষ কথাবার্তা কিছু তাঁর কানে যেতেই ফোড়ন কেটে তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘গিয়ে দেখ কোনো ছেলেপুলের সঙ্গে পালিয়ে গেল নাকি! গ্রামের মেয়েরা হঠাৎ শহরে আসলে যা হয় আরকি! চাকচিক্যময় শহরে বাস করতে করতে ওদের নজরে পড়ে বড়লোকের ছেলেপেলে। আর একটু রূপ-যৌবন থাকলে তো কথাই নেই৷ সবাইকে রুপে মুগ্ধ করে কথার জাদুতে মন গলিয়ে ফেলে। ওই মেয়ের তো পরীর রুপ। চরিত্র কেমন হবে তা আন্দাজ করাই যায়।’
ফুফুর মুখে রোজার সম্বন্ধে কটু কথা শুনে ফিহার মাথায় রক্ত টগবগ করতে লাগলো। চড়া গলায় বলে ওঠলো, ‘হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনই সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে যেও না ফুপি। রোজার মতো ভালো, ভদ্র মেয়েকে নিয়ে এসব লাগামহীন কথা বললে আমি কিন্তু চুপ করে থাকব না। তোমার কিন্তু সেসব শুনতে ভালো লাগবে না। ঠোঁটকাঁটা হিসেবে আমার কিন্তু বদনামই আছে। তাছাড়া গ্রামের মেয়েদের নিয়ে যে পিএইচডি করে বসে আছো, তা তুমি শহরে বসবাস করেও এমন নিচু চিন্তাধারা কীভাবে নিজের মনের মধ্যে পোষণ করো?’
ফিহা ছোটবেলা থেকেই একটু প্রতিবাদী মনোভাব পোষণ করে। সেজন্য অন্যদের যেমন তিনি খুব ভালোবাসেন, ঠিক ততোটাই অপছন্দ করেন ফিহাকে। মেয়েদের এতো ঠোঁটকাঁটা হলে চলে নাকি? বেয়াদব, অসভ্য কোথাকার। সুহানা শেখ গর্জে ওঠে বললেন, ‘ভুলে যাস না, সম্পর্কে আমি তোর গুরুজন। তোর ফুফু হই। যার জন্য এত সাফাই গাইছিস গিয়ে দেখ কোন কীর্তি ঘটিয়ে বসে আছে।’
ফিহা নিজের রাগ সামলালো। এখন মাথা গরম করা ঠিক হবে না। আগে রোজার খোঁজ চাই। নিজের চোখদুটো বন্ধ করে বড় করে দম নিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘সে তো দেখবোই। তবে তুমি এত ভবিষ্যৎ বাণী করছো কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। তোমার কী পছন্দ নয় রোজাকে?’
সুহানা শেখ কথাটা অতি সন্তপর্ণে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার পছন্দে-অপছন্দে কার কী এসে যায়? তবে তোর বোনটাকে আমার তেমন সুবিধের মনে হয় নি। লোভ…’
ইশা মায়ের কথাবার্তায় বেশ লজ্জিত বোধ করলো। রোজা যে খুব ভালো একটা মেয়ে বোঝাই যায়। মায়ের কাছ থেকে এরকম লাগামহীন কটুক্তি সে আশা করে নি। একেতো বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির, তার মধ্যে সুহানা শেখের অবান্তর কথায় সে বিরক্ত। মায়ের দিকে কড়া, সূক্ষ্ম চাহনি নিক্ষেপ করলো ইশা। সুহানা শেখ চুপ হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। রোষাগ্নি দৃষ্টিতে ফিহাকে একপলক দেখে নিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে নেহার মাথা কাজ করছে না। তার মধ্যে ফিহা আর ফুফুর ঝামেলাটা অসহ্য লাগছে৷ ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে সে বলল, ‘ফিহা দয়া করে তোরা চুপ কর। বাড়ি থেকে একটা মেয়ে উধাও আর তোরা এখানে কথা কাটাকাটি করছিস? এবার খালামণিকে কি জবাব দেব? নিচে তো আম্মু রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।’
ফিহা বিষন্ন মুখে বলল, ‘চলো নিচে যাই।’
হঠাৎই ইশা বলে ওঠলো, ‘আদ্রিশ ভাইয়াকে একবার জানালে হতো না? খোঁজটোজ নিয়ে দেখতো?’
ফিহা চট করে ওর দিকে ফিরে তাকালো। বলল, ‘ঠিক বলেছিস তো৷ উৎস ভাইয়া কখন ফিরবে কে জানে। আদ্রিশ ভাইয়াকেই দেখছি জানাতে হবে ব্যাপারটা। ভাইয়া কোথায়?’
‘এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।’
ফিহা গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে ঘর থেকে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আমি আদ্রিশ ভাইয়াকে বলে কিছু একটা করছি। তোমরা নিচে যাও।’
————————————————–
Group – Israt’s Typescripts
[নোট: খাপছাড়া হওয়ার জন্য দুঃখিত৷ কষ্ট করে মন্তব্য জানাবেন। আর দেরি হওয়ার কারণটা আপনাদের প্রায় সবারই জানা। অবশেষে দুঃখিত।]
চলবে…