অনুভবে তুই পর্ব-৩৭

0
5444

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৭

একটি ভোর, নতুন এক জীবনে প্রবেশ করার প্রথম দিনের সূচনালগ্ন। সকালের নরম রোদের ঝিকিমিকি আর হিমেল হাওয়ায় আদ্রিশের ঘরের পর্দাগুলো ফরফর করে ওড়াওড়ি করছিলো। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেল রোজার। আধবোজা চোখজোড়া খুলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলো সে এখন কোথায় আছে। সেকেন্ডের মধ্যেই সচল মস্তিষ্ক জানান দিলো সে এখন তার শ্বশুরবাড়িতে আছে। কথাটা মনে হতেই সে কোনোমতে লাফ দিয়ে ওঠলো। গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করে এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা করে দু-হাতে মুখ ঢেকে খানিকক্ষণ বসে রইলো বিছানার ওপর, কোনোদিকে তাকালো না পর্যন্ত। গতরাতে রোজা এত ক্লান্ত ছিলো যে কখন তার চোখ দুটো লেগে এসেছিল বুঝতেও পারে নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই আদ্রিশকে দেখতে পেলো সে। আর তখনই ওর হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেল। আদ্রিশ নামক লোকটা ওর চির-জীবনের সঙ্গী, ওর বর। ব্যাপারটা স্বপ্নের চেয়েও বেশি চমকপ্রদ। কিন্তু কে ভেবেছিলো এই রাগী, উদ্ভট লোকের পাশেই শান্ত, নমনীয়, কঠোর রোজার নামটা জুড়ে যাবে? কেউ কি ভেবেছিল? উহু! রোজা নিজেই তো এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। আচ্ছা, গত রাতে আদ্রিশ আসার আগেই সে যে ঘুমিয়ে গেছে এজন্য কি লোকটা ওর প্রতি রাগ দেখাবে? অবশ্য রাগ দেখালেও সমস্যা নেই, রোজা ওর রাগকে পাত্তা দেবে না। বিয়ে বাড়িতে রাফিকে মারধর করায় সে নিজেই তো আদ্রিশের ওপর খেপে আছে, অবশ্য এখন আর রেগে নেই। কিন্তু সেটা আদ্রিশকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। রোজা দেয়াল ঘেঁষে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে আদ্রিশকে দেখতে লাগলো। কি এমন আছে যে, ও লোকটার ওপর রাগ দেখালেও মনে মনে ভীষণ ভাবে ওকে অনুভব করে? আদ্রিশের ভালোবাসা নাকি অভিমান দেখে? হয়তো দুটোই। রোজা ভাবনার গভীরে গিয়ে ঘুমন্ত আদ্রিশকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সাদা পোলো শার্টে আদ্রিশকে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিলো। কপালের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো তখনো বাতাসে ওড়ছে। কিন্তু আদ্রিশ বাঁকা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কুশনের ওপর পা তুলে দিয়েছে আর গায়ের কম্বল অর্ধেকটা বিছানায় অর্ধেকটা মেঝেতে পড়ে আছে। রোজা বরাবরই গোছানো মেয়ে, কিন্তু ওর কপালেই যে এমন অগোছালো লোক পড়বে কল্পনাতেও ভাবেনি সে। কোনো ছেলের ঘুম যে দু’বছর বয়সী চঞ্চল বাচ্চার মতো হয় এটা ভাবতেই ও বিরক্তিবোধ করলো। সে আস্তে করে ডাক দিলো আদ্রিশকে। নারী কন্ঠের ডাক শুনে আদ্রিশের পাতলা ঘুমটা ভেঙে গেল। ভ্রু কুঁচকে সে তাকালো রোজার দিকে। সবকিছু মনে পড়তেই ও শোয়া থেকে ওঠে বসলো। রোজার দিকে এগিয়ে যেতেই হতভম্ব হয়ে রোজা একটু দূরে সরে গেল। সেটা দেখে আদ্রিশ রেগে গিয়ে বলল, ‘সমস্যা কী তোমার?’

রোজা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আমার তো কোনো সমস্যা নেই। আপনারই সমস্যা।’

আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকালো। রোজা কী বলতে চাইছে? ওর আবার কীসের সমস্যা থাকতে পারে? ভ্রুকুটি করেই সে রোজার কথার মর্মোদঘাটন করলো এবং চওড়া হাসলো। ওর হাসি দেখে রোজা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাসছেন কেন? আমাকে দেখে কী হাসির পাত্রী মনে হচ্ছে?’

আদ্রিশ একটু থেমে বলল, ‘উহু, মোটেও না। তবে তুমি ভীষণ ইন্টিলিজেন্ট। ভাবনাচিন্তায় আমার থেকে বহুদূর এগিয়ে আছো। কিন্তু এটা নিয়ে আমি প্রাউড ফিল করছি না।’

রোজা প্রশ্ন করল, ‘মানে?’

আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘মানে আমি যে বিষয়ে এখনো কিছু ভাবিইনি; সে বিষয়টা নিয়ে তুমি অনেককিছুই ভেবে বসে আছো। রিল্যাক্স, এত হাইপার হওয়ার প্রয়োজন নেই। সবকিছুরই একটা সময় আছে, অসময়ে সেটার অভ্যাস করতে চাই না।’

রোজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই আদ্রিশ ওর খুব কাছে এসে কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভোরবেলার প্রেম অস্বাস্থ্যকর হয় প্রিয়। নিজের ভাবনাগুলো সামলে রাখো, নয়তো অঘটন ঘটে যেতে পারে। সব কথার বড় কথা, আমি একজন পুরুষ মানুষ এবং সম্পর্কে তোমার বর হই। তাই নয় কী?’

কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্রই রক্তিম আভায় লালায়িত হয়ে ওঠলো রোজার গাল। চারপাশের শব্দ যেন থেমে গেল। আসলেই তো, ও তো এক্ষুনি আদ্রিশকে নিয়ে উল্টাপাল্টা চিন্তা করে বসেছিলো। আর লোকটা তা বুঝেও গেলো। হায় ধরণী, দ্বিধা হও। রোজা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে নিলে আদ্রিশ ওর হাত টেনে ধরলো। ফলে ব্যালেন্স করতে না পেরে রোজা বিছানার ওপর পরে গেলো। আদ্রিশ খানিকটা রাগ নিয়ে ওকে হেডবোর্ডে চেপে ধরে বলল, ‘লাফাচ্ছো কেন তুমি? একটু রিল্যাক্স করতে পারছো না?’

রোজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। রাগী স্বরে বলল, ‘নিজেই তো বললেন সবকিছুরই একটা সময় আছে। এখন আপনিই এডভান্টেজ নিতে চাইছেন? দিস ইজ নট ফেয়ার। আমি রেডি নই। দয়া করে আমাকে যেতে দিন। এসব করা ভালো নয়।’

আদ্রিশ সন্দেহী চোখে রোজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মানে? তুমি এখনো ওসব-ই মিন করছো?’

‘তা নয়তো কী?’

আদ্রিশ হতাশ হয়ে ওর কপালে হাত রাখলো। কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করে হাতটা সরিয়ে রোজার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো। তারপর বলল, ‘তোমার যে গতরাতে জ্বর এসেছিলো জানো তুমি? সারারাত তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম। জ্বর নেমেছে কিনা সেটা চেক করতেই তোমাকে বসতে বলেছি। আর তুমি উল্টাপাল্টা ভেবে আমার মাথা খাচ্ছো। অসুস্থ রোগীর সাথে রোম্যান্স করার কোনো মুড আমার নেই। আমার বাসর রাতটাই নষ্ট করে দিয়েছো তুমি।’

প্রথম কথাগুলো শুনে গিলটি ফিল হলেও আদ্রিশের শেষের কথাটা শুনে রোজা রেগে গেল, ‘সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কী বলেছি আমার সেবা করতে? আর বাসর রাতটা আপনার একার নয়, আমারও ছিল। আপনি দেরি করে এসেছেন বলেই সেটা নষ্ট হয়েছে।’

আদ্রিশ সেটা মানতে নারাজ। রোজাও নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না। আদ্রিশ বলল, ‘তুমি ঘুমিয়ে পড়ায় সেটা নষ্ট হয়েছে, আমার জন্য না। সহজ কথাটা মেনে নিলে তোমার জন্যই ভালো।’

রোজা এবার বেশ রেগে গেলো। আদ্রিশ অহেতুক ওকে কথা শুনাচ্ছে যেন সবটা দোষ রোজার। আর ও নিজে কিছুই করেনি। রোজা রাগী কন্ঠে বলল, ‘বেশ হয়েছে। ভালো করেছি।’

আদ্রিশ ভীষণ রেগে গেল, ‘আস্ত একটা বজ্জাত মেয়ে কোথাকার।’

রোজা আগুনে ঘি ঢালতে ঢেলে বলল, ‘এই বজ্জাত মেয়েকে বিয়ে করতেই তো মরিয়া হয়ে ওঠেছেন। আঙ্কেলের পায়ে পর্যন্ত ধরেছেন। ভেবেছেন আমি কিছুই জানি না? আমি সব জানি। একটা ছ্যাঁ-ছ-ড়া লোক কোথাকার।’

আদ্রিশ মুখ কালো করে বলল, ‘বিয়েটা কী আমার একা হয়েছে? তুমি করো নি বিয়ে?’

রোজা বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দটি উচ্চারণ করে বলল, ‘আমি বাবা-মা’য়ের বাধ্য মেয়ে বলেই আপনার মতো ছ্যাঁ-ছ-ড়া লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।’

আদ্রিশ প্রতুত্তরে বলল, ‘তুমি যে মিচকা শ-য়-তা-ন্নী সেটা তো জানতাম না। তুমি নিজে থেকে ‘ভালোবাসি’ বলার পরই আমি আব্বুকে তোমার কথা জানাই। এখন সেসব অস্বীকার করছো?’

রোজা সেই মুহূর্তে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কখন আপনাকে ‘ভালোবাসি’ বলেছি?’

আদ্রিশ অধৈর্য নিয়ে রোজার মুখটা ওপরে তুলে রাগী স্বরে বলল, ‘কেন? নেহার বিয়ের দিন? ছাদে? বলো নি?’

রোজা স্বীকার করতে পারলো না। প্রসঙ্গটা এড়াতে বলল, ‘মনে নেই আমার। কিন্তু আপনিও সুবিধের লোক নন। নেহা আপুর এনগেজমেন্টের রাতে আমার সাথে যে ব্যবহার করেছেন, দিস ইজ নট ফেয়ার।’

বলেই থেমে গেল রোজা। সেনসেটিভ টপিক এড়াতে গিয়ে আবার এসব প্রসঙ্গেই অনিচ্ছাকৃতভাবে ঢুকে গেছে সে। কিন্তু এবার আর আদ্রিশ রেগে থাকলো না, বরংচ শান্ত হয়ে গেলো সে। এরপর রোজাকে বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তারপর স্বপ্নালু চোখে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে তাকালো। ঘন নীলের সমাহারে অজানার উদ্দেশ্যে ওড়তে থাকা মেঘকুঞ্জের ধীরগতিতে ছুটে চলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার জীবনের প্রথম চু’মু ছিলো। অনিচ্ছাবশত, কিন্তু মধুর।’

রোজা আদ্রিশের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলো। কিন্তু ওর মুখ থেকে এ কথাটা শুনে অস্বস্তি নিয়ে বলে ওঠল, ‘এটা আমারও প্রথম চু’মু ছিলো। অনিচ্ছাবশত এবং জঘন্য।’

এই একটা কথাই আদ্রিশের প্রেমিক মনের ইতি টানার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সে রোজাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে ওঠে পড়লো। দেয়াল ঘড়িটা জানান দিলো এখন সকাল সাড়ে ছ’টা। টি-শার্টের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে আদ্রিশ ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। আর রোজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। আদ্রিশের না থাকার সুযোগে বিছানা, বালিশ, কম্বলগুলো ভাঁজ করে রাখলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলো। একটু পর আদ্রিশ বেরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। এরপর রোজা নিজেও ফ্রেশ হতে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে রুমে আসতেই আদ্রিশকে দেখলো একটা কালো রঙের প্রস্ফুটিত গোলাপ হাতে আদ্রিশ ঘরে ঢুকছে। ফুলটা এতটাই আকর্ষণীয় যে ওটা ছুঁয়ে দেখতে রোজার খুব লো’ভ লাগলো। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। আড়চোখে ফুলটা দেখতে লাগলো। আচমকা আদ্রিশ এসে ওর দিকে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার জীবনে আসার জন্য অনেক ভালোবাসা তোমাকে। আজকের মতো প্রতিটি সকাল যেন তোমার সাথেই উপভোগ করতে পারি। তুমিই যেন সূর্যের প্রথম কিরণের মতো আমার জীবনে উজ্জ্বল আলো ছড়াও। তুমিই যেন আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা হও। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ভালোবাসো; এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই যেন জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি থাকতে পারি।’

রোজা ফুলটা হাতে নিয়ে ভাবুক কন্ঠে বলল, ‘কিন্তু আমাদের জীবনের প্রথম সকাল তো ঝ’গড়া দিয়ে শুরু হলো।’

আদ্রিশের প্রেমিক মনটা আবারও আ’হত হলো। অসহায় দৃষ্টিতে রোজার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা ওর অনুভূতির সাথে ভালোই খেলা করতে পারে; ভেবেই আদ্রিশ গম্ভীর হয়ে ওকে জ’ড়িয়ে ধরে কপালে চু’মু খেয়ে বলল, ‘ঝ’গড়ার পর তো আরও বেশি করে ভালোবাসবো। তখন প্রতিটি সকালই আজকের মতো নতুন আর প্রেমময় হবে।’

এবার রোজা নিশ্চুপ রইলো। মুহূর্তটা উপভোগ করতে লাগলো সে, আদ্রিশের হৃদপিন্ডের মৃদু শব্দটা ওর বেশ ভালো লাগছে। এই শব্দগুলো নিশ্চয়ই মানুষের মনের অনেক অজানা কথাগুলো জানিয়ে দেয়। প্রকৃতির নীরবতা আর ওদের দু’জনের নিস্তব্ধতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু ঠিক তার পরেই দরজায় কে যেন ক্রমাগত আঘাত করতে লাগলো। রোজাকে ছেড়ে আদ্রিশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে ফিহার গলা শোনা গেল, ‘তোমরা উঠেছ ভাইয়া? তাহলে ব্রেকফাস্ট করতে এসো। সবাই তোমাদের অপেক্ষা করছে।’

আদ্রিশ ‘আসছি’ বলে যে-ই না ফিরতে যাবে তখনি ফিহার পেছন থেকে উৎস জিজ্ঞেস করল, ‘জীবনে প্রথমবার বাসর রাত পালন করেছ। কী’রকম অনুভূতি হচ্ছে তোমার ভাই?’

—————————————————————————–

[নোট: গল্পের কাহিনী প্রায় শেষই। এগুলো এক্সট্রা পর্ব হিসেবে পড়ে নিন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ও মন্তব্য জানাবেন আশা করি।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here