ফেরা পর্ব-৩

0
746

#ফেরা

৩.

হাত পা কাঁপছে রাগে ইচ্ছে করছে সাব্বিরকে চড় মেরে সবগুলো দাঁত ফেলে দিতে।
মেয়েটা ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। রাগ কমানোর জন্য মুক্তা বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেঁড়ে দিলেন। রাগ পানি হয়ে ঝড়তে লাগলো!

শাজু জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের উপর বই খোলা, বাতাসে বইয়ের পাতা গুলো উল্টিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের শব্দের সাথে এই পাতা উল্টানোর শব্দ মিলে দারুণ একটা টিউন হয়েছে। টিউন টা যদি রেকর্ড করা যেতো! তাহলে সঞ্চয় ভাইকে শুনিয়ে বলতো
– আপনার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই সারাক্ষণ এমন একটা টিউন কানের কাছে বাজছে। আপনারও কি এমন হচ্ছে?
সঞ্চয় ভাইয়া কী বলতে পারে? শাজুর ধারণা নেই। নিধির প্রতিবেশী সঞ্চয় ভাইয়া। বয়সে নিধির থেকে বড় এমনকি এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন। নিধি এমনভাবে সঞ্চয় ভাইয়ার সাথে মেলামেশা করে যেন সঞ্চয় আর ও একই বয়সের।
যদিও তার বয়স বোঝা মুশকিল। শাজুর নানী বলেন – বয়সচোরা!
যাদের দেখে প্রকৃত বয়স বোঝা যায়না তাদেরকে বয়সচোরা বলা হয়।

নিধি শাজুর দেয়া কাগজটা সঞ্চয়ের হাতে দেয়ার আগে মজা করে বললো
– তো আমাকে ট্রিট দিবি কবে?
সঞ্চয় মুচকি হেসে বললো
– আমি বেঁচে থাকলে সেনা তোকে ট্রিট দিবো?
– মানে?
– এইযে এতো অপেক্ষা করাচ্ছিস। আমার তো জান বের হয়ে আসতেছে রে!
– আগে বল কী ট্রিট দিবি?
– বিরিয়ানি খাওয়াবো। হবে?
নিধি কাগজটা সঞ্চয়ের হাতে দিয়ে বললো
– যাই করিস, আমার বেস্টু যেন কষ্ট না পায়।
– তোর বেস্টু আমার জান। মনে রাখিস।

সঞ্চয় তার ছোট্ট বারান্দার ফ্লোরে কাগজটা হাতে নিয়ে বসে আছে। কাগজটা খুলতে ভয় লাগছে। যদিও নিধির হাসি ঠাট্টাতে মনে হয়েছিলো উত্তর হ্যাঁ- ই হবে।
কাগজটা খুলে দেখলো মাত্র একটি লাইন লিখা। মুচকি হেসে কাগজটা ভাজ করে পকেটে রেখে দিলো সঞ্চয়।
অনেক বড় একটা দায়িত্ব তার ঘাড়ে এসেছে। ভালোবাসা বলতে শুধু একে অপরকে নিজের করে পাওয়া নয়। একে অপরকে ভালো রাখার দায়িত্ব। মানুষটাকে ভালো রাখার দায়িত্ব। কখনো চোখের কোণায় অশ্রু জমা না হওয়ার দায়িত্ব।
নিধির সাথে কথা বলতে হবে তা নাহলে প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিবে সে?

নিধিকে ম্যাসেজ করে জানালো সবটা সঞ্চয়। প্ল্যান করে নিলো দুজনে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সঞ্চয় পড়াশোনায় মন দিলো। আগামী বছর তার এএইচএসসি এক্সাম।
শাহাজাদী কেবল ক্লাস নাইনে। যদিও বার্ষিক পরীক্ষা সামনে। ক্লাস টেনে উঠে যাবে। বয়সের পার্থক্য কতো হবে? ৩ বছর নাকি কম?
মেয়েটাকে তার প্রথম দেখাতে তেমন একটা ভালো লাগেনি। একটু বেশিই চুপচাপ। হাসে কম আর অচেনা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
নিধির বার্থডে পার্টি থেকে শুরু করে কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে ও আসবেই। নিধি পারলে প্রতি শুক্রবারেই ওকে নিয়ে আসে। এভাবে টুকটাক কথা আর দেখা হতে হতে সঞ্চয়ের ভালো লেগে গেলো।
কিছু মানুষ থাকে যাদের প্রথম দেখাতে ভালো না লাগলেও মিশতে মিশতে ভালো লেগে যায়। কিছু চেহারাও থাকে এমন। প্রথম দেখাতে ভালো না লাগলেও কিছুক্ষণ দেখার পরে ভালো লেগে যায়। শাহাজাদী ঠিক ওইরকম চেহারার মানুষ।
সঞ্চয়ের যে এমন চুপচাপ মেয়েকে ভালো লাগবে কখনো ভাবতেও পারেনি।

আমরা যেটা ভাবতে পারিনা সেটাই আমাদের সাথে ঘটে বেশি। – একটি লাইন ডায়েরির পাতায় লিখে রাখলো।

*****

মুক্তা সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে মেয়ের রুমে গেলেন। শাজু কেবলই হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসেছে। মেয়েটা কতটা লক্ষী ভাবতেও অবাক হন মুক্তা। তাকে পড়তে বসা থেকে শুরু করে কোনোকিছুই তেমন বলতে হয়না। ও ওর নিজের রুটিন অনুযায়ী কাজ করে। একদিনের রুটিন তার আগের রাতে খাতায় লিখে রাখে। সময় মেপে সেই রুটিন ফলো করে। হঠাৎ রুটিনের বাইরে চলে যায় তবে পুরোপুরি অনিচ্ছাকৃতভাবে।
মুক্তা মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো
– কী খাবে সকালে বলো?
শাজু আদুরে সুরে বললো
– আলু পরোটা খাবো। ওইযে সেদিন যেভাবে বানিয়েছিলে ওইভাবে।
মুক্তা চলে যাওয়ার পর শাজু পড়ায় মন দিলো।
নাস্তা করার সময় মুক্তা মেয়েকে চড়া গলায় বললেন
– আজকে তোমার বাবার আসার কথা। সেটা জানো তো?
– হ্যাঁ জানি।
– সে কিন্তু তোমাকে বিভিন্নভাবে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তুমি সেসব কথা কানে নিবে না মনে থাকবে?
– হ্যাঁ, থাকবে।
– বিকালে আসবে। চা, নাস্তা পারলে রাতে খাইয়ে পাঠাবে। সে যাওয়ার পর আমাকে ফোন করবে। মনে থাকবে?
– থাকবে।
– দুপুরে কী খাবে?
– তোমার যেটা ইচ্ছা করে সেটা।
– আচ্ছা।
মুক্তা এঁটো থালাবাসন নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
প্রতি মাসে দুইবার শাজুর বাবা মাহমুদ সাহেব মেয়েকে দেখতে আসেন।
শাজুর যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে তখন মুক্তা আর মাহমুদ সাহেবের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়।
মেয়েকে পারলে তিনি নিতে পারতেন কিন্তু মুক্তার জন্য তিনি পারেননি।
আবার মেয়েটারও মায়ের প্রতি বেশি টান।
প্রথম দিকে বাড়ি ফিরে মেয়েকে না দেখতে বেশ কষ্ট হতো। ফ্রেন্ডরা মিলে বিয়ে করায় দিলো। সংসার হলো নতুন করে। দেড় বছরের মাথায় দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের বাবা হলেন কিন্তু প্রথম কন্যার কথা ভুলতে পারলেন না।
দ্বিতীয় কন্যা যেন তার মনে বিদ্যুতের মতো প্রথম কন্যাকে মনে করিয়ে দিতো। মনের অবস্থা এমন খারাপ হলো যে বাধ্য হয়ে মুক্তার কাছে গেলেন।
মুক্তা মাহমুদ সাহেবকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আগের মাহমুদ আর এই মাহমুদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।
মাহমুদ সাহেব মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলেছিলেন
– মুক্তা সুমিকে যদি মাসে দুই একবার দেখার সুযোগ দিতে তাহলে আমি একটু শান্তি পেতাম।
মুক্তা কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে পারলো মেয়েটার জন্যই মনে হয় এই হাল।
মুক্তা চড়া গলায় বলেছিলেন
– ঠিক আছে। মাসে দুইবার মেয়েকে দেখতে পারবে কিন্তু তাকে ফুসলিয়ে আবার নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করবেনা।
– না কখনোই না।

তারপর থেকে প্রতিমাসে দুদিন মেয়েকে দেখতে আসেন। সকাল থেকে প্ল্যান করেন কী কী গল্প করবেন এমনকি খাতায় লিখে রাখেন। মেয়ের জন্য খাবার কিনে আনেন।

ইদের দিনে ১ ঘণ্টার জন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বের হন।

এই শুক্রবারে নিধির বাসায় শাজুকে যেতে হবে। নিধির গণিতের পুরো একটা অধ্যায় নাকি কোনোভাবেই মাথায় ঢুকছে না।
শাজু ওকে বাসায় আসতে বলেছে কিন্তু নিধি রাজি না। বাধ্য হয়ে শাজুকেই যেতে হবে। শাজুর অবশ্য এতে লাভই হবে। সেই চিঠি দেয়ার পর থেকে আর কোনো রেসপন্স সে পায়নি। না নিধি তাকে কিছু বলেছে না সঞ্চয় দেখা দিয়েছে। ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে গিয়ে দেখা হয়েছিলো কিন্তু সঞ্চয় তাকে দেখে আড়ালে থাকার চেষ্টা করেছে।
সঞ্চয় পাশের একটা কোচিং সেন্টারে ম্যাথ পড়তে আসে আর শাজু ইংরেজি। এভাবেও তাদের মধ্যে দেখা হয়।
শাজু বিভিন্ন ইঙ্গিতে নিধিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, সঞ্চয় কোনো কিছু বলেছে কিনা কিন্তু নিধি বুঝতেই পারছেনা। নাকি না বোঝার ভান করে আছে।
শাজুর মনে হচ্ছে, সঞ্চয় তার সাথে মজা করেছে। তার মতো মেয়েকে ওই ছেলে কোনোদিনও পছন্দ করতে পারেনা। ইশ! এতোদিন এই মজাটাকে সে সিরিয়াস ভেবে আসছে। লজ্জায় মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিকাল ৪ টা ৩০ মিনিটে মাহমুদ সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। শাজু চা আর নুডুলস রান্না করে মাহমুদ সাহেবের সামনে ছোটো টেবিলে রাখলো। মাহমুদ সাহেব হাসার চেষ্টা করলেন কিন্তু হাসতে পারলেননা। সবকিছু ঠিক থাকলে এই বাড়িতে তাকে মেহমান হয়ে আসতে হতো না। মেয়েটাকে দেখার জন্য এভাবে ঝোলাঝুলি করতে হতোনা।
– বাবা চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– তুমি খাবেনা।
– আমি সন্ধ্যার পরে খাবো।
– তোমার পড়াশোনা কেমন চলে?
– ভালো।
– বাবা তুমি কি অসুস্থ?
– না।
– বাবা তুমি মিথ্যা বলছো কেনো? তুমি সবসময় হাসিমুখে থাকো আজকে তোমার মুখে হাসি উধাও হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তোমার শরীর খারাপ?

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here