মন মুনিয়া পর্ব-৪

0
1207

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -০৪

-হো খাওয়ামু তো, আমার মাইয়ার চল্লিশা খাওয়ামু।
মনির মা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন মনি রান্নাঘরের এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। মনিকে দেখে ওর মা আবারও চেচিয়ে বলতে লাগলো
-আমি না কওয়া পর্যন্ত যদি এক পাও ওই ঘরে বাড়াবি, তাইলে কিন্তু তোর খবর আছে মনি।
কথাটা শুনে একেবারে চুপসে গেলো মনি। ও ঘরে থাকা রহিম মিয়া আর জয়নালের কানেও কথাটা গিয়ে ঠেকলো। বিশেষত মনির মা তাদেরকে শোনানোর জন্যই কথাটা বলেছে।

জয়নাল চিন্তিত গলায় রহিম মিয়াকে বললো
-চাচীর কি হইছে, অতো চেইতা রইছে কেন?
-আর কইয়ো না বাপ, তোমার চাচীর আইজ সকাল থেইকাই মাথা গরম আছে। পরের বাড়ির কাম করে তো, আইজ বোধহয় কামডা একটু বেশিই করছে।
-ওও, জয়নাল রান্নাঘরের দিকে দৃষ্টি ফিরালো এবার। ও চোখ শুধু মনিকে খোজছে। রহিম মিয়া সেটা লক্ষ্য করে বললেন
-কিছু লাগবো তোমার?
-মনি রে দেখতাছিনা। একটু কন এইহানে আইতে।

রহিম মিয়া আবারও হাঁক ছাড়লেন
-মনি, মা মনি একটু আয় তো এদিকে। দেখ জয়নাল তোরে কেন জানি ডাকতাছে। পোলাডার মনে হয় কিছু লাগবো।
কিছুক্ষণ কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা। কয়েক মুহূর্ত পর মনির মা ছুটে এলো রান্নাঘর থেকে। তিরিক্ষি মেজাজে রহিম মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো
-কেন ডাকেন মনিরে?
-আমি ডাকছি চাচী। এক গাল হেসে বললো জয়নাল। সে হাসি দেখে জ্বালায় ফেটে যাচ্ছে মনির মা।

রাগটাকে অনেক কষ্টে চাপা দিয়ে রুক্ষ গলায় বললো
-কি দরকার মনিরে?
আচমকা এমন প্রশ্নে হটাৎ ভড়কে গেলো জয়নাল। সে ভালোকরেই বুঝতে পারছে, মনির মা ওকে সহ্য করতে পারছেনা। তাতে অবশ্য জয়নালের কিছু যায় আসেনা। সে আবারও তার সেই বিষাদময় হাসিটা হেসে বললো
-দরকার মনিরে, আপনারে না চাচী। একজনের কথা কি আরেকজনরে বলা যায়।
মনির মা চাপা আক্রোশ নিয়েও নিজেকে দমিয়ে নিলো। রহিন মিয়া পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্য বললো
-ওই মনির মা, ভাত বাড় গিয়া। খিদা লাগছে পোলাডার।

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে মনির মা জয়নালকে মনির বাবার পাশে শুতে দিয়ে নিজে গিয়ে মনির পাশে শুয়ে পরলো। এতে কিছুটা আশাহত হলো জয়নাল। ও ভেবেছিলো মনি একা থাকবে, আর সেই সুযোগে রাতের আধারে সে মনির কাছে যাবে। লোকলজ্জার ভয়ে হয়তো মনি কাউকে কিছু বলতো না। তবে সে সমস্ত চিন্তাভাবনায় পানি ঢেলে দিলেন মনির মা।

পরের দিন সকালে আবার স্কুলের দিকে রওনা করলো মনি। কিছুটা দূর যেতেই কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো জয়নাল ওর পিছু পিছু আসছে। মনিকে তাকাতে দেখেই পান খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া কুৎসিত দাঁতগুলো বের করে ফিক করে হেসে ফেললো সে। মনি কপাল কুচকে আবারও সামনে হাটা শুরু করে দিয়েছে। এই লোকটাকে প্রথম থেকেই তার সুবিধার ঠেকছেনা। আবার রাতেও মা এই লোকটার খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে ওকে জানিয়ে দিয়েছে।

মনি এক পা এগোচ্ছে তো সেই জয়নাল নামের ছেলেটা তিন পা বেগে এগিয়ে চলেছে। একটা সময় সে মনির একদম কাছাকাছি চলে আসলে মনি পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে পরলো। জয়নাল ওর সামনে এসে দাড়িয়ে আবারও সেই বিভৎস হাসিটা হাসলো। মনি কিছুটা কাঁপা গলায় বললো
-আপনে আমার পিছন পিছন আইতাছেন কেন?
-তোমার লগে কথা কইতে আইছি। তুমি এমনে দৌড়াইয়া হাটতাছো কেন?
-আমার ইস্কুলের দেরি হইয়া যাইতাছে। আপনে আমার সাথে যাইয়েন না, মাইনষে আমারে বদনাম দিবো।
-দিলে দিবো, দুইদিন পর তো আমিই তোমারে বিয়া করমু।

মনির বেশ রাগ হলো এবার। ইচ্ছে করলো কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এই মাঝরাস্তায় এইরকম একটা বখাটে ছেলের সাথে ঝাঝালো উত্তর দেওয়ার সাহস তার হয়ে উঠলো না।

কিছুটা পথ এভাবে হাটার পর একপর্যায়ে জয়নাল এসে মনির পথ আগলে দাড়ালো। মনি বেশ ভয় পেয়ে গেলো এবার। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
-আমার রাস্তার মাঝখানে আইসা দাড়াইলেন কেন?
-তোমারে লইয়া এক জায়গায় যামু। আহো আমার লগে।
-আমি কুত্থাও যামুনা।
জয়নাল চোখ রাঙিয়ে বললো
-শোন মাইয়া, কাইল রাইত থেইক্কা তোগো মা মাইয়ার অনেক তেজ সহ্য করতাছি। আর আমার লগে তেজ দেখাইস না। ফল ভালা হইবো না কইলাম। ভালা মুখে কইতাছি, আমার লগে আয়।।
-আপনে এমন করতাছে কেন? আমি কিন্তু আব্বারে কইয়া দিমু।
জয়নাল হটাৎ ফিক করে হেসে দিলো। সে হাসিটা খুবই বাজেভাবে ঠেকলো মনির কানে।

জয়নাল মনির মুখের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো
-কোনো লাভ নাই। তোর বাপেরে পুরা পাঁচ হাজার টাকা দিয়া আইছি। তোর বাপেই কইছে তোরে যেহানে খুশি সেহানেই নিতে পারমু। তার কোনো আপত্তি নাই।
কথাটা শুনে নিজের বাবার প্রতি এক অজানা ঘৃণার জন্ম হলো মনির মনে।

এই মুহূর্তে নিজেকে ওর হাত থেকে বাঁচানো দরকার। সেই ভাবনা থেকেই একটা দৌড়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগলো মনি। কিন্তু তেমন কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি সে। দৌড়ে কয়েক পা সামনে এগোতেই ওকে ধরে ফেললো জয়নাল৷ আবারও ওর চোখেমুখে সেই পৈশাচিক হাসি। মনিকে একমত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা সে।

জয়নাল টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মনিকে। মনি চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছে তখনো। একটা সময় মনির মনে হলো জয়নাল থেমে গেছে। আগের মতো নিজের গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ওকে টানছেনা। তাহলে কি জয়নাল ওকে ওর গন্তব্যে নিয়ে চলে গেছে? ভেবেই সারা শরীর কেপে উঠলো মনির। সে আতংকে তাকালো সামনে।

স্যারের সেই নিয়ান নামের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে জয়নালের সামনে। জয়নাল রক্তবর্ণ চক্ষু নিয়ে সেই নিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে নিয়ান স্বাভাবিক। ওর মাঝে না আছে রাগ, আর না আছে কোনো ক্ষোভ। জয়নাল তীব্র মেজাজে নিয়ান কে বললো
-ওই মিয়া, পথের মাঝখানে আইয়া দাড়াইলেন কেন?
-সার্কাস দেখতে দাঁড়িয়েছি।
-মুখ সামলাইয়া কথা কন মিয়া। এইখানে কে সার্কাস দেখাইতাছে শুনি?
-আপনি।

জয়নাল রাগে ফুসে উঠলো। সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো
-বাজে কথা ছাড়েন। আমারে যাইতে দেন।
-আগে এই মেয়েটার হাত ছাড়ুন, আমিও পথ ছেড়ে দিবো।
-আপনের কথায় আমি ওর হাত ছাড়মু কেন? জানেন আমি ওর কি হই?
-জানি না। কি হন আপনি?
-ওর হবু স্বামী।
-ওকে, যখন প্রেজেন্ট স্বামী হবেন তখন নিয়ে যাবেন। আজকাল হবু কথার ন্যুনতম ভ্যালু নেই।
-আপনে কিন্তু বাড়াবাড়ি করতাছেন।
-আমার কাছে থানার ওসি, এস আই, এস পি সকলের নাম্বার আছে। সেগুলো কি কাজে লাগাতে হবে?

জয়নাল অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো নিয়ানের দিকে। চাপা আক্রোশে বললো
-আমি আপনেরে দেইখা নিমু।
-এখনই দেখুন। আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমাকে কেউ দেখলে আমার ভালোই লাগে। সেই মুহূর্তটা খুবই স্পেশাল মনে হয়। নিজেকে সেলিব্রিটি সেলিব্রিটি লাগে। জয়নাল মনির হাত ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে তাকালো। এরপর তিক্ত গলায় বললো
-তোর যে নাগর আছে আমারে তো সেই কথা তোর বাপে কয় নাই।
-কি উল্টাপাল্টা কথা কইতাছেন আপনে? বিস্ময় নিয়ে বললো মনি।
-কি কইতাছি সেইডা তোর বাপেরে বুঝামু। তবে মনে রাখিস, আমি কিন্তু তোরে এতো সহজে ছাড়তেছি না।

জয়নাল চলে গেলে মনি ভয়ে ভয়ে তাকালো নিয়ানের দিকে। নিয়ান সে দৃষ্টিকে ইগ্নোর করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মনি সামান্য অবাক হলো এতে। নিয়ান কে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ডাকতে গিয়ে ডাকতে পারলোনা। একটা সময় নিয়ান মনির থেকে অনেকটা দূরে এগিয়ে গেলে মনির মনে হলো, সামান্য একটা ধন্যবাদ যদি উনাকে না দেয়, তাহলে ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে। এইটুকু ধন্যবাদও উনার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে এরচেয়ে বেশি কিছু করাও তো মনির পক্ষে অসম্ভব।

মনি আর কিছু না ভেবেই এক দৌড়ে নিয়ানের কাছে চলে গেলো। মনিকে নিজের দিকে ছুটে আসতে দেখে সামান্য ভ্রু বাকালো নিয়ান। হাঁটা থামিয়ে মনির দিকে ফিরে ইশারায় উনাকে
-কি ব্যপার?
-আপনারে অনেক ধন্যবাদ।
-হোয়াই?
মনি কিছুক্ষণ হতবাকের মতো তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। নিয়ান কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললো
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, আমার কথার মানেটা বুঝোনি?

মনি হাসলো। কিছুটা লজ্জিত কন্ঠে বললো
-এইটুকুর অর্থ আমি জানি।
-তাহলে?
-নাহ মানে, আপনে আমারে কালকেও সাহায্য করলেন, আইজ আবার আমারে ওই ভন্ডডার হাত থেইকা বাঁচাইলেন তাই।
নিয়ান এবার তাকালো মনির দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার ভালোকরে পরখ করে বললো
-আমি কি তোমাকে চিনি?

নিয়ানের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো মনি। আমতাআমতা করে বললো
-মম মানে?
-তোমাকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি? পরিচিত মনে হচ্ছে খুব।
মনি অন্যদিকে ফিরে মুখ কালো করে বললো
-জানিনা।
সে আর সেখানে দাড়ালো না। এক দৌড়ে ছুটলো স্কুলের দিকে।

নিয়ান সেদিকে এক পলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একা একা বিড়বিড় করে বলল
-Oh, I see. This is the girl who ran yesterday.
নিয়ান আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো না। হাঁটা শুরু করলো নিজের গন্তব্যে।

আজ স্কুলেও বিশেষ মনোযোগ দিতে পারছেনা মনি। বারবার শুধু জয়নালের বলা কথাটা তার মাথায় ঘুরছে। মনি এটা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা, একজন বাবা কিভাবে নিজের মেয়েকে সামান্য কটা টাকার জন্য বখাটের হাতে তুলে দিতে পারে। মনির যখন এইসব নিয়ে চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিলো, ঠিক তখনই ওর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো ইতি। ইতি মনির ঠিক পাশে বসেই ওর ঘারে হাত দিয়ে বললো
-কিরে মনি, আজ সকালে স্কুলে আসার পথে দেখলাম স্যারের সেই কিউট ছেলেটা তোর সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে। কি বলেছে সে? আমার ব্যপারে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে নাকি?
-তোমার কথা কেন আমারে জিগাইতে যাইবো? মনি ভ্রু বাকিয়ে বললো।

ইতির কপালে ভাজ পরলো। সে সামান্য ক্ষোভ নিয়ে বললো
-তো তোর সাথে আর কিবা নিয়ে কথা বলবে সে। গতকাল প্রাইভেটে তোর পাশেই আমি বসেছিলাম। আমার মত সুন্দরী একটা মেয়েকে রেখে নিশ্চয়ই ওর তোর দিকে নজর যাবেনা। নিশ্চয়ই সে আমার ব্যপারেই তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে। তুই বলতে চাইছিস না তাইতো? হিংসে করছিস আমায়?
মনি হতবাকের মতো তাকিয়ে রইলো ইতির দিকে। মেয়েটার মাথাটা কি পুরোপুরি গেছে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here