#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৮
ভোরের স্নিগ্ধ আলো চোখে পরতেই ঘুম ভাংলো মনির। সে ধীরে ধীরে উঠে বসলো বিছানায়। রিতা ওর কর্মক্ষেত্রে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মনিকে উঠতে দেখে সে বললো
-ঘুম ভেঙ্গেছে?
-হুম।
-আমি কাজে যাচ্ছি মনি। তুই খেয়ে নিস, রান্না করে রেখে গেলাম।
-তুই খেয়েছিস রিতা?
-খেয়েছি, বক্সে করে লাঞ্চের জন্য নিয়েছি।
-ওহ।
মনির মুখের মলিন ভাবটা আবারও ফুটে উঠলো। রিতা সেটা খেয়াল করে মুচকি হেসে ওর পাশে গিয়ে বসে ওর পিঠে হাত রেখে বললো
-এভাবে মুখ গোমড়া করে রাখিস না তো মনি। একটু হাসিখুশি থাকার চেষ্টা কর। দেখবি ভালো লাগবে৷
-পারি না, চেষ্টা করছি।
-পারবি পারবি। আচ্ছা আমি গেলাম। দেরি হয়ে যাবে পরে।
রিতা চলে যাবার পরপরই মনি একা হয়ে গেলো। আশা নামের মেয়েটাও বাসায় নেই। হয়তো সে আরো আগেই কাজে চলে গেছে। থাকলে গল্প করা যেতো। যদিও মেয়েটা অনেক বড়।
কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো এভাবেই। একটা সময় সে বারান্দায় গেলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের অপরুপ সৌন্দর্যটা চোখে পরছে। তবে মনির মনের ভেতরের মলিনতা দূর হলোনা। মায়ের জন্য খুব মন খারাপ করছে। কি করছে, ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার। ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে ফোন করে একটু কথা বলুক। কিন্তু এটা যে সম্ভব না।
মনি রুমে চলে এলো পরক্ষণেই। ঘরের চারপাশটা সে এবার দেখতে লাগলো। দেখে মনে হচ্ছে বাসাটার ভাড়া বোধহয় অনেক বেশি। তাছাড়া, বাসাতে অনেক কিছুই আছে, যা অনেক দামি দামি। রাতে আসায় সেগুলো খেয়াল করেনি মনি। তবে এখন বেশ অবাক লাগছে তার। রিতা গার্মেন্টসে চাকরি করে। ওর পক্ষে কিভাবে এতো ভালো একটা বাসায় থাকা সম্ভব? এতো দামি দামি জিনিসই বা সে কোথায় পেলো?
মনি যখন এসব আকাশ পাতাল ভাবনায় ব্যস্ত ছিলো, তখন আশা আসলো বাসায়। মনিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো সে। মিষ্টি কন্ঠে বললো
-গুড মর্নিং মনি।
মনি হাসলো। বিনিময়ে বললো
-আপনে এতো তারাতাড়ি চইলা আইলেন? আপনের কাজ নাই আইজ?
আশা হাসলো। হাতে থাকা সাইড ব্যাগটা ওয়ারড্রবের উপরে রাখতে রাখতে বললো
-তোমায় কে বলেছে আমি চাকরি করি?
-আপনে চাকরি করেন না?
আশা হাসতে হাসতে মনির পাশে এসে বসলো। বললো
-আমি লেখাপড়া করি, ভার্সিটিতে পড়ি আমি।
-ওহ।
মনি অবাক হলো। উনি ভার্সিটিতে পড়েন, আর রিতা গার্মেন্টসে চাকরি করে। তাহলে দুইজন কিভাবে একসাথে থাকে। মনিকে চিন্তিত দেখে আশা বললো
-কি ভাবছো মনি?
-আপনে ভার্সিটিতে পড়েন, তাইলে রিতারে কেমনে চিনলেন?
আশা মিষ্টি করে হেসে বললো
-রিতাকে আমি চিনতাম না। আমি আমার ভার্সিটির হোস্টেলেই থাকতাম আগে। কিন্তু কেন জানিনা হোস্টেলে আমার ভালো লাগছিলোনা। আমি নিজের মতো করে থাকতে পারছিলাম না সেখানে। মনে হচ্ছিলো নিজের মধ্যে থেকেও নিজেকে হারিয়ে ফেলছি।
তাই এ বাসাটা ভাড়া নেই। কিন্তু একদম একাও থাকতে ভালো লাগছিলোনা। তাই সাবলেটের জন্য বিজ্ঞাপন দেই। রিতাও মেস খুজছিলো। তখন আমার বিজ্ঞাপন দেখে আমার সাথে যোগাযোগ করে। ব্যস, এভাবেই পরিচয়।
মনির মনের খচখচানিটা এখনো দূর হচ্ছেনা। সেই খচখচানি থেকেই সে আবারও বললো
-কিন্তু ও তো গার্মেন্টসে চাকরি করে। আর এই বাসার ভাড়া তো মনে হয় অনেক বেশি। জিনিসও অনেক দামি দামি।
বাকি কথা আর বলতে হলোনা মনিকে। আশা বুঝতে পেরে সেই নিজে থেকে বললো
-তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে মনি, এটা মানতে হবে। তা নাহলে এতো প্রশ্ন তোমার মাথায় আসতোনা।
মনি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আশার দিকে। আশা বললো
-এই বাসাতে যা যা জিনিস দেখছো সব আমার। আর এই বাসার ভাড়াটা একটু বেশিই। এরচেয়ে লো লেভেলের বাসায় আমি থেকে অভ্যস্ত না মনি। তবে রিতা যখন ভাড়ার ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হয়েছিলো তখন সে এখানে থাকতে চায়নি। ভাড়াটা তার জন্য আসলেই বেশি। আমি বুঝতে পেরেছি সেটা। কিন্তু এখন মিটমাট হয়েছে বিষয়টা। আমি ভাড়ার তিন ভাগের দুই ভাগ দেই, আর রিতা এক ভাগ দেয়।
আশার কথা শুনে অবাক হলো মনি। সে হতবাক হয়ে বললো
-তাতে তো আপনের বেশি টেকা খরচ হয়।
-হোক। আমিতো এমনিতেও একা থাকার জন্যই বাসাটা নিয়েছিলাম। একা থাকলে তো পুরোটাই আমাকে দিতে হতো। নেহাৎ একদম একা থাকতে ভালো লাগছিলোনা তাই।
মনি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আশার দিকে। এইরকম মানুষও দুনিয়াতে আছে। মনির ভাবনা ছেদ করে আশা বললো
-খেয়েছো?
-নাহ।
-এখনো খাওনি কেন? অনেক বেলা হয়ে গেছে তো।
-আপনে খাইছেন?
-আমিতো বাসায় ছিলাম না এতোক্ষণ। এখন খাবো, এসো একসাথে খাই।
মনি হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
ভাত খাওয়ার এক পর্যায়ে মনির মাথা ঘুরানো শুরু হলো, বমি বমিও লাগলো বেশ। এমন একটা অবস্থা হয়েছে যেনো এখন প্লেটেই বমি হয়ে যাবে তার। মনি অস্থির হয়ে গেলো। তারাহুরো করে উঠে পরলো সে। আশা বিস্ময়ে বললো
-কি হয়েছে মনি? তুমি ঠিক আছো তো?
মনি কিছু বলতে পারলোনা। সে তারাহুরো করে বাথরুমে চলে গেলো। আশাও এলো পিছন পিছনে। বাথরুমে এসে গড়গড় করে পেটের সব বের করে দিলো মনি। এরপর কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইলো মাথায় হাত দিয়ে।
আশা এগিয়ে গিয়ে মনির মাথায় হাত রাখলো। নরম স্বরে বললো
-তুমি কি অসুস্থ?
মনি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। আশা আবারও বললো
-তাহলে হয়তো বদহজম হয়েছে। আমার কাছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ আছে। হাত মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নাও।
মনি কোনো উত্তর দিলোনা। সে ধীরে ধীরে উঠে ট্যাবটা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। হাতমুখ ধোয়া হলে সে আস্তে আস্তে রুমে এলো। শরীরটা বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে ওর। ক্লান্তি দূর করতে হেলান দিয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়।
আশা ওর ব্যাগ থেকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বের করে এগিয়ে এলো মনির কাছে। এক হাতে পানিভর্তি গ্লাস আর আরেক হাতে ওষুধ নিয়ে মনিকে বললো
-ওষুধটা খেয়ে নাও মনি।
মনি শান্ত গলায় বললো
-খামুনা।
-খেয়ে নাও। ভালো লাগবে। তোমার তো এসিডিটির সমস্যা হচ্ছে। বমিও হলো সে জন্যই।
মনির চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে এলো। হতবাক হলো আশা। বিস্ময়ে বললো
-কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে? এটা কাঁদার মতো কোনো বড় অসুখ না।
-আমার কোনো অসুখ হয় নাই আশাপু।
-তাহলে কাঁদছো কেন?
মনি বলতে গিয়েও বললোনা। সে কি বলবে? এটা কি কোনো বলার মতো কথা।
মনি চুপচাপ শুয়ে রইলো আর নিশ্বব্দে চোখের পানি ছাড়লো। আশার নজরে সবটাই এলো৷ তবে সে আর কথা বাড়াবে না। সে বুঝে গেছে মনির ভেতর কিছু চলছে। কান্না করুক বরং, মনে কোনো কষ্ট থাকলে সেটা কান্নার সাথে বেরিয়ে আসবে।।
সন্ধ্যায় রিতা বাসায় ফিরলে আশা রিতাকে মনির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। মনি তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো।
রিতা কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে পরবর্তীতে আশাকে মনির সাথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাটা জানালো। আশা হতবাক হলো। সেই সাথে মনির সাথে সে ছেলেটা এমন করেছে তার উপর বেশ রাগ হলো তার।
মনি এখনো ঘুমাচ্ছে। আশা একনজরে তাকিয়ে রইলো মনির দিকে। আহ কি নিষ্পাপ একটা মেয়ে, চেহারায় কতো মায়া। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ওই অমানুষটা কিভাবে পারলো ওর সাথে এমন করতে?
মনির যখন ঘুম ভাংলো তখন দেখলো রিতা আর আশা মিলে রান্না করছে। সে চটপট বিছানা ছেড়ে উঠে ওদের কাছে চলে এলো। আশা আর রিতা দুজনেই হাসিমুখে বললো
-ঘুম ভাংলো?
মনি হেসে বললো
-ভেঙ্গেছে।
-দুপুরে খেয়েছিলি মনি?
-হুম। আশাপুর জন্য খাইতে হইছে, আমারে একমত ধমক দিয়া খাওয়াইছে।
আশা হাসলো মনির কথায়। রিতা বললো
-দেখিস আর অনিয়ম করিস না। আশা আপু অনিয়ম মানতে পারেনা। আরেক বার অনিয়ম করবি তখন আশা আপুর হাতে মাইর খাইবি।
মনি মুচকি হেসে আশার দিকে তাকালো। মেয়েটা আসলেই অনেক ভালো। কথাবার্তা, চালচলন, ব্যবহার, শাসন সবকিছুতে একদম বড়বোন বড়বোন লাগে।
ওদের রান্নবান্না শেষ হলে আশা গিয়ে পড়তে বসে। রিতা একটু বিশ্রাম করার জন্য বিছানায় হেলান দেয়। মনি ওর পাশেই বসে থাকে কিছুক্ষণ। কাচুমাচু করতে থাকে। ব্যাপারটা রিতার নজরে আসে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে মনিকে প্রশ্ন করে
-বলবি কিছু?
-হুম।
-বল।
-ইয়ে মানে, আমারে একটা কাজের ব্যবস্থা কইরা দিবি রিতা?
মনির কথায় তৎক্ষনাৎ রিতা কিছু বললোনা। তবে কথাটা আশার কানে গেলো। সে পড়া ছেড়ে উঠে আসলো মনির কাছে। ওর পাশে বসে মিষ্টি করে বললো
-তুমি কি কাজ করবে মনি?
-যাই একটা হোক। একটা কাজ লাগবো আমার। এইভাবে কয়দিন থাকমু।
-কিন্তু তোমার শরীরের কন্ডিশন তো ভালোনা। এই অবস্থায় যদি কাজ করো, তাহলে কিন্তু ক্ষতি হতে পারে।
মনি বিস্ময়ে তাকালো রিতার দিকে। ওর শরীরের কথা আশা কিভাবে জানলো। রিতা শান্ত গলায় বললো
-রাগ করিস না মনি। আশা আপু খুবই ভালো মেয়ে। তাই সে জানলেও কোনো সমস্যা নেই।
মনি আবার চোখ ফিরিয়ে আশার দিকে তাকালো। আশা ওকে আস্বস্ত করে বললো
-ভয় পেয়োনা মনি। আমি তোমাকে বাজে মেয়ে ভাবছিনা। বরং তোমার সাথে যা ঘটেছে সেটা খুবই খারাপ হয়েছে। যে তোমার সাথে এমন করেছে, তাকে যদি পেতাম হয়তো খুন করতাম।
মনি নিচের দিকে তাকালো। চোখদুটো ছলছল করছে ওর। আশা সেটা খেয়াল করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল
-তুমি চাইলে আমি তোমাকে একটা কাজ দিতেই পারি।।
মনি চমকে তাকালো আশার দিকে। হন্তদন্ত হয়ে বললো
-সত্যিই আশাপু। কি কাজ, আমি করমু।
-কাজ একটা আছে। তবে সেটা করতে হলে তোমাকে আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। তুমি পারবে সেখানে গিয়ে থাকতে?
চলবে….
#বিঃদ্রঃ সন্ধ্যার আগে যদি ১৫০+ লাইক প্লাস গঠনমূলক মন্তব্য বেশি বেশি পাই, তাহলে সন্ধ্যায় একটা বোনাস পার্ট দিবো🙂