মন মুনিয়া পর্ব-২৬

0
898

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৬

গুটিকয়েক পা ফেলে রুমে এসে আশা দেখলো জানলার গ্রিল ধরে মনি দাঁড়িয়ে আছে। সে মনির কাছে গিয়ে বললো
-মন খারাপ হয়েছে?
-নাহ।
-মন খারাপ করিস না প্লিজ, ভাইয়া তো তোর ব্যাপারে জানেনা বল।
মনি আশার দিকে ফিরে তাকালো। ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বললো
-আমি মন খারাপ করিনি আশাপু। শুধু ভাবছিলাম, আজ আমিতো বিবাহিত হলে তোমার ভাইয়ের সামনে মাথা উঁচু করে বলতে পারতাম, “আমিও সংসার করছি, আমিও মা হতে যাচ্ছি।

কিন্তু এই কথাটা বলার মতো মুখতো আমার নেই।

আশা মনিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো
-মনকে শক্ত রাখ মনি, একদিন তোরও দিন আসবে।
-চেষ্টা করছি আশাপু।

রাতে নিলয় আর ওর বাবা বাসায় ফিরলে নীলকে নিয়ে আরেক দফা আড্ডা বসে। উনারা নীল আসামাত্রই ফোনে খবর পেয়েছেন, তবে উনাদের ভাষ্যমতে, ব্যস্ত থাকার দরুন আসতে পারেন নি। নীলকে নিয়ে কথাবার্তা চলার এক পর্যায়ে হিমা আশার দিকে তাকিয়ে বললো
-মনিকেও ডেকে নিয়ে আয় আশা। মেয়েটা আর কতো একা একা থাকবে। আমাদের সকলের সাথে থাকলে ওর হয়তো একটু ভালো লাগবে।

আশা হিমার কথার বিপরীতে কিছু বলবে তার আগেই ওর বাবা বললো
-নিয়ে আয় মেয়েটাকে। আসুক এখানে, আমাদের একটু যদি সঙ্গ পায় তাহলে দোষ কি।
আশা উঠে চলে গেলে নীল হিমার দিকে তাকিয়ে বলে
-এই মনি রহস্যটা কি ভাবী?
-জানতে চাও?
-অবশ্যই।

হিমা বলতে লাগলো এক এক করে ঘটে যাওয়া মনির সাথের ঘটনাগুলো। এর মধ্যে আশাও চলে এলো সেখানে, সবাইকে জানান দিলো এতো মানুষের মাঝে মনি আসবেনা।

সবকিছু শোনার পর নীল বললো
-ওকে, সব বুঝতে পেরেছি। এবার আমি ট্রাই করি।
-তুই কি ট্রাই করবি? ভ্রু বাকিয়ে আশা বললো।
-তুই বান্ধবী হয়েও একটা পুচকে মেয়েকে আনতে পারলি না, কিন্তু আমি ওকে এখানে এনে দেখাবো।
-এখন?
-হুম।
-সম্ভব না।
-বাজি?
-ওকে।

নীল ধীরে ধীরে আশার রুমের কাছে গেলো। দরজা থেকে আগে উঁকি দিয়ে দেখলো মনির অবস্থানটা। মনি বিছানায় হাটু ভাজ করে তার উপর মাথা রেখে বসে আছে। নীল খুবই সন্তর্পণে রুমে ঢুকলো। এরপর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে রুমের লাইটটা এমনভাবে অফ করলো যেনো মনির মনে হয় এটা কোনো মানুষের কাজ না।

লাইট অফ হওয়ার সাথে সাথে মাথা উঁচু করে তাকায় মনি। অবাক হয় সে, রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে থাকলেও দরজার ফাক দিয়ে বাইরের আলো ঘরে প্রবেশ করছে। মনি উঠে দাঁড়ায়। হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা খুজে পাবার চেষ্টা করে সে। আশার রুমে আগে কখনো থাকেনি মনি, তাই জানেনা বোর্ডটা কোথায় আছে।

একটা সময় সে যেই বোর্ডটাকে ছুতে যায় তার আগেই ওর হাতের উপর কিছু একটা ছিটকে পরে, বেশ ভয় পেয়ে যায় মনি। জিনিসটা খুব নরম আর ঠান্ডা। মনি আবারও বোর্ডটাকে হাত দিতে যায়। আবারও ওর উপর আক্রমণ হয়, একটা ঠান্ডা হাত ওর ঘাড়ে স্পর্শ করে। আঁতকে উঠে মনি, ভয় পেয়ে যায় এবার অতিরিক্ত। মনি আশাপু বলে চিৎকার করে উঠে।। এবার একটা হরর সাউন্ড কানে আসে মনির। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় ওর। এই মুহূর্তে তার সেন্সলেস হয়ে যাবার মতো অবস্থা।

এর মধ্যে সে অন্ধকারে আবছা আলোয় দেখতে পায়, একটা অবয়ব চলে গেছে তার সামনে দিয়ে। সে আর কিছু দেখতে পারেন, তাই আগেই ভয়ে কুকড়ে যায়। মনির চিৎকারে আশা আর হিমা এগিয়ে আসে। দরজাটা খোলাই আছে, তবে লাইট অফ দেখে অবাক হয়ে। রুমে গিয়ে আগে লাইট জ্বালায় তারা। দেখে বিছানার এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে মনি, পুরো শরীর তার কাপছে।।

ওরা দুজনই মনির কাছে আসতেই মনি শক্ত করে আশাকে জরিয়ে ধরে বলে
-আমি অনেক ভয় পেয়েছি আশাপু। এখানে কিছু ছিলো।
আশার রাগ হয় খুব নীলের উপর। তবে সে কিছু বলেনা তৎক্ষনাৎ। নীল রুমে প্রবেশ করে বলে
-এই রুমে তুমি থাকো মনি?
মনি ভয়ার্ত চোখে তাকায় নীলের দিকে। নীল আবারও বলে
-এই রুমে একটা খারাপ আত্মা থাকে তুমি কি জানোনা? যদিও একসাথে দুজন কিংবা অনেক জন থাকলে সেই খারাপ আত্মা কিছু করে না, তবে কেউ যদি এই রুমে একা থাকে তাহলে….

আশা চিৎকার করে বলে উঠে
-তুই থামবি ভাইয়া?
মনি আশাকে বলে
-আমি এখানে থাকবোনা আশাপু।
-এখানে কিছু নেই মনি। ভাইয়া মজা করছে।
-আমি একটুও মজা করছিনা মনি। তুমি এক কাজ করো, রুম ছাড়তে হবেনা তোমাকে। বরং যখন সবাই একসাথে গল্পের আসরে থাকে,তুমিও তাদের সাথেই থেকো, তাহলে কিচ্ছু হবেনা।
মনি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ায়। সে আশাকে তাড়া দিয়ে বলে
-আশাপু, চলো। আমিও তোমাদের সাথে বসবো।

হিমার পিছুপিছু মনি গল্পের আসরে যায়। মনি যাবার পর নীল আশার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে
-দেখলি আশু। বাজি জিতে গেলাম কিন্তু।
আশা রেগে বললো
-তোর কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি ভাইয়া।
-আমি কি করলাম?
-তুই মেয়েটাকে এভাবে ভয় দেখালি কেন?
-তা নাহলে কি ও যেতো?
-হয়তো যেতোনা। তাই বলে এমন করবি? মেয়েটার বয়সই বা কতো হবে, তারউপর ওর উপর দিয়ে যা ঝর বেয়ে গেছে তা তো শুনলিই। এখন পর্যন্ত মেয়েটা বাড়িছাড়া। আর মেয়েটা এখন কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা। যদি ভয়ের চোটে এমন কিছু করে ফেলতো, যা করা মেয়েটার জন্য মোটেই ঠিক ছিলোনা? তখন কি হতো ভেবে দেখেছিস?

নীল একটু গম্ভীরমুখে বললো
-খুব বেশি করে ফেলেছি তাইনা?
-হুম।
-স্যরি রে।
-আমাকে স্যরি বললে কি হবে?
আশা চলে গেলো সেখান থেকে। নীল নিজের মাথায় নিজেই টুকা দিয়ে বললো
-আসলেই আমি ননসেন্স।

ড্রয়িং রুমে গিয়ে নীল দেখলো মনি এখনো জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ এখনো স্পষ্ট। নীলের খুব মায়া হলো এবার। অনুধাবন করতে পারলো সে আসলেই বেশি বেশি করে ফেলেছে।

গল্পের আসর শেষ হলে সকলে যার যার রুমে চলে যেতে লাগলো। রাবেয়া অনেক আগেই চলে গেছে। এবার নীলের বাবাও চলে গেলো। উনি চলে যাবার পর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হিমা আর নিলয়ও উঠে পরলো। আশা মনিকে রুমে যেতে বলে সেও পানি খেতে কিচেনে গেলো।

মনি ধীরপায়ে এগিয়ে চললো রুমের দিকে। যদিও সে শুনেছে এটা নীলের কাজ, তবুও একটা ভয় কাজ করছে মনে। দরজার কাছে গিয়ে রুমে ঢুকার আগ মুহুর্তে ওর এক হাত ধরে টান দেয় নীল। আবারও ভয় পেয়ে যায় সে। ভয়ের চোটে মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে আসতে পারে সেই ভয়ে আগেবাগেই ওর মুখে হাত চেপে ধরে নীল।

মনি ভয়ার্ত চোখে তাকায় নীলের দিকে। নীলকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেও অবাক হয় সে। নীল এখনো ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। মনি ইশারায় হাত সরাতে বললে নীল হাত সরিয়ে নেয়। মনি নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে
-কেন এমন করছেন আমার সাথে?
-আমি স্যরি।
মনি অবাক হয়। বিস্ময়ে বলে
-কিহ?
-মানে আমি দুঃখিত।
মনি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো
-কেন?

নীল ইতস্তত করে বললো
-আসলে, তুমি নাকি কখনোই গল্পের আসরে যাও না, তাই ভাবলাম….
-কি?
-আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতোটা ভয় পাবে।
-ঠিক আছে।
নীল ঘাড় বাকা করে মনির দিকে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করলো ওর মনের মধ্যে কি চলছে।

মনি অবাক হয়ে বললো
-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
-মাফ করেছো তো?
মনি হাসলো। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো
-আপনিতো আমার ক্ষতি চান নি। বরং সকলের সাথে থাকার একটা চেষ্টা করেছেন মাত্র। এতে ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?
নীল উপরের দিকে তাকিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বললো
-আলহামদুলিল্লাহ। তুমি মানুষটা পুচকে হলেও বুদ্ধিতে কিন্তু আশার চাইতেও এগিয়ে। ওর মাথায় তো গোবরে ভরা। আমাকে কি ধমকানোটাই না দিলো।

আশা কিচেন থেকে সবেমাত্র ফিরে এসেছে। এসেই ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে রেগে গেলো সে। এমনিতেই আগে থেকেই নীলের উপর সে রেগে আছে, তার উপর বললো ওর মাথায় নাকি গোবরে ভরে। আশা চেচিয়ে বললো
-তুই এখানে কি করছিস?
-ডিস্টার্ব করিস না। মাফ চাইছি।
-পেয়েছিস?
-হুম। ও তোর মতো নাকি, যে কথায় কথায় রেগে যাবে।
-ঠিক আছে। মাফ চাওয়া চাওয়ি শেষ হলে এবার বিদায় হো। ঘুমাবো।
নীল আশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো
-এবার তোকে বিয়ে দিয়ে তারপর যাবো, এর আগে না।
-যা খুশি তা কর। যা তো এখন।

পরের দিন ভোরে ঘুম ভাংলে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে মনি। ওয়াশরুম থেকে অযু করে এসে নামাজ আদায় করে কিছুক্ষন কুরআন তেলাওয়াত করে সে। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। আশার পাশের রুমটায় নীলের রুম। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো এতাক্ষন। তবে এতো সকাল সকাল সুমিষ্ট কুরআন তেলাওয়াত শুনে ঘুম ভেংগে গেলো তার।

সে ঘুমঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে বুঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে। তেলাওয়াতের উৎস খুজে পেয়ে সে এগিয়ে যেতে থাকে সেখানে। এতো মধুর সুর তাকে কেন যেনো খুব টানছে।

আশার রুমের দরজাটা খোলাই ছিলো। নীল দরজার পাশে এসে দেওয়ালের সাথে হেলান দয়ে দাঁড়ায়। মনি অনবরত তেলাওয়াত করেই যাচ্ছে। নীল একভাবে তাকিয়ে আছে সেদিকে। খুব ভালো লাগছে তার।

এক পর্যায়ে নীলের মুখে হাসি ফুটলো। না চাইতেও সে হাসলো। তৃপ্তির হাসি হেসে সে মনে মনে ভাবলো
“পুচকে মেয়ের কন্ঠস্বরটা তো দারুণ”.

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here