#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৯
বাইরের কোলাহল ভেতরের রুম পর্যন্ত চলে এসেছে, ঝিঝি পোকার ডাকে কানে তালা লেগে আসার উপক্রম। তবে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মনির। সে আনমনে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এই ঘন কালো অন্ধকারে সে কি এতো দেখে তা ভাবায় নীলকে।
মনির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও বাইরে তাকায়। এক ফালি চাঁদ আর সেই চাঁদের ক্ষীণ আলোয় আবছা গাছ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। নীল প্রশ্ন করে মনিকে
-কি দেখো এত?
-অনেক কিছুই। আনমনে বললো মনি।
-আমিতো কিছু দেখতে পাচ্ছিনা।
-দেখার মতো চোখ লাগে।
নীল মুচকি হাসলো। বললো
-আমার বুঝি চোখ নেই?
-থাকবেনা কেন, তবে হয়তো দেখার মতো নেই।
নীল আর কিছু বললোনা। সেও বাইরে তাকালো। এভাবে কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর সে আবারও বললো
-একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
-হুম।
-বেবির নাম মুনিয়া কেন রাখলে?
মনি এইবার তাকালো নীলের দিকে। সে কপাল কুচকে শান্ত গলায় বললো
-এ নামে কি কোনো সমস্যা আছে?
নীল হালকা হেসে বললো
-এটা বলছি না। সাধারণত সকল মায়েরাই কোনো না কোনো একটা দিক চিন্তা করে অথবা কারো নামের সাথে মিলিয়ে বাচ্চার নাম রাখে। তুমিও কি সেটাই করেছো?
মনি অসহায় চোখে তাকালো নীলের দিকে। নীল প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। এই পর্যায়ে মনি একটা গরম নিশ্বাস ছেড়ে বললো
-হুম, মিলিয়েই রেখেছি।
-কার সাথে?
-আমার নাম থেকে ম নিয়ে ওর সাথে উ কার দিয়েছি, আর ওর বাবার নিয়ান নাম থেকে প্রথম দুইটা অক্ষর “নিয়া” নিয়েছি৷
নীল আবারও হাসলো।
-এতো ভালোবাসো ওর বাবাকে?
-কখনো ভালোবাসিনি। তবে বাচ্চার বাবাতো, একটা সুপ্ত বাসনা তো থেকেই থাকে।
নীল নিশ্বাস ছেড়ে বললো
-অভয় দিলে আরো একটা কথা বলি?
-কি?
-এরপর যদি কেউ কোনোদিন তোমার জীবনে আসতে চায়, তাহলে কি তুমি তাকে গ্রহণ করবেনা?
মনি চমকালো। হটাৎ এসব কথা কেন বলছেন উনি? শুধুই কি জানার আগ্রহ থেকে?
নীল আবারও তাড়া দিয়ে বললো
-কি হলো, বলছোনা যে? মানুষ যে বলে নিরবতা সম্মতির লক্ষন, আমিও কি সেটাই ধরে নিবো?
মনি মুখ খুলতে চাইলো। কিন্তু সেটা আর হলোনা। ফুটফুটে বাবুটা কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো আশা। মনির দিকে তাকিয়ে খুশিমনে বললো
-তোর বাবুটা তোর চাইতেও অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে মনি।
-তাই?
-সত্যিই তাই। কি বলিস ভাইয়া?
আশার কথায় নীল মনির দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ সেদিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থেকে বলল
-হয়তো।
আশা ভ্রু বাকালো। বিক্ষিপ্ত গলায় বললো
-এইটা কি ধরনের কথা বললি তুই?
-সত্যি বলতে, বেবি মানেই সুন্দর। সে ফর্সা হোক, কিংবা কালো। জানিস তো, কালোতেই আলো। তবে মুনিয়া সত্যিই অনেক সুন্দর হয়েছে।
-কে মুনিয়া? আশা বিস্ময় নিয়ে বললো।
-কে আবার। তোর বান্ধবীর মেয়ে।
আশা কপাল বাকিয়ে মনির দিকে তাকালো। ক্ষোভ নিয়ে বললো
-এর মাঝে তোরা দুইজনে মিলে বাবুনির নামও রেখে দিলি, আমাকে জানানোরও প্রয়োজন মনে করলিনা?
আশার চোখেমুখে স্পষ্ট অভিমান। মনি মুচকি হেসে বললো
-রাগ করোনা আশাপু। আমিই এই নামটা রেখেছি। অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম।
-তুই জানতি তোর মেয়ে হবে?
-নাহ।
-তাহলে কি করে ভেবে রাখলি?
-ভেবেছিলাম ছেলে হলে রাখবো আয়ান, আর মেয়ে হলে মুনিয়া।
-ওহ।
_____
ঘরের সমস্ত কাজকর্ম সেড়ে হাত মুখ ধুয়ে মুছে মনির রুমে এলো হিমা। মনি তখন বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। পাশেই রাবেয়া আর আশা বসে আছে। হিমা চটজলদি মনির পাশে বসে বললো
-বাবু কি করে মনি, ঘুমিয়ে গেছে?
-না, খাচ্ছে।
-খাওয়ানো হলে আমার কাছে দিও তো।
মনি হেসে বললো
-আচ্ছা।
রাবেয়া পান খেয়ে খেতে বললো
-নিলয় এসছে?
-না মা, এখনো আসেনি। বাবা চলে এসেছে।
-কখন এলো?
-মাত্রই।
-ওহ, আমি তাহলে গেলাম। দেখি লোকটার কিছু লাগে কিনা।
-কিছু লাগবেনা মা। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
এর মধ্যে মনি বললো
-বাবুকে নেন ভাবী।
হিমা খুশিমনে হাত বাড়িয়ে দিলো। মনি খুবই সাবধানে হিমার কোলে তুলে দিল বাবুকে। খুশিতে গদগদ হয়ে হিমা মায়াভরা কন্ঠে বাবুটার দিকে তাকিয়ে বললো
-লক্ষী সোনা, চাঁদের কণা।
মনি অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো হিমার দিকে। ভাবলো, আল্লাহর কি অপার লীলা। কেউ চেয়েও পায় না, আর কেউ না চাইতেও অনেক কিছু পেয়ে যায়।
এর মধ্যে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেছে। সেদিন সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছে আশা আর হিমা। রাবেয়ার শরীরটা হটাৎ করেই খারাপ হয়ে গেছে।
বিকেলের দিকে হটাৎ ফোন এলো রাবেয়ার মোবাইলে। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ফোনে আলাপ করলেন।। কথা বলা শেষ হলে ক্ষীণ কন্ঠে আশাকে ডাকলেন তিনি।
অসুস্থ মায়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আশা। যদিও এতো বেশিও অসুস্থ না মা। তারপরও সবাই খুব দেখভাল করছে উনার। আশা এসে রাবেয়াকে জিজ্ঞাসা করলো
-কিছু লাগবে মা?
-আমার কিছু লাগবে না, কিন্তু মেহমান আসবে বাসায়।
-কে আসবে?
-তোর ছোটখালা।
-কখন আসবে?
-আজই আসবে।।বিকেলের দিকে বোধহয়।
-ক্যাসেটটাকেও কি সাথে করে নিয়ে আসবে? আশার চোখেমুখে সামান্য বিরক্তি। রাবেয়া সেটা আঁচ করতে পেরে বললো
-আহ আশা, এভাবে কারো ব্যাপারে কিছু বলতে নেই। আমি এই শিক্ষা দেইনি তোমাদের।
-কি বলো মা, তোমার ছোটবোন যে পরিমানে প্যাঁচালো আর সাথের ক্যাসেটটাও যে পরিমানে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে, ওদের ব্যপারে এর চাইতে ভালো কিছু আমার মুখে আসেনা।
-সবকিছুর পরেও কিন্তু ও আমার ছোট বোন।
আশা খেয়াল করলো, বোনের নামে এসব বলায় মা কিছুটা রেগে যাচ্ছে। সে আর কথা বাড়ালোনা। যাওয়ার আগে শুধুমাত্র বলে গেলো
-ঠিক আছে, ক্যাসেট আর টেপরেকর্ডার যাই আসুক না কেন, আপ্যায়নে ঘাটতি রাখবোনা।
আশাকে দেখে কিছুটা ওর রেগে থাকাটা কিছুটা আঁচ করতে পারলো হিমা। রাগের কারণ জানতে চেয়ে সে বললো
-ব্যাপার কি, হটাৎ এতো রেগে আছে যে?
-আরশিয়া খালামনি আসবে আজ।
হিমা হেসে বললো
-সেতো খুব ভালো কথা। বাড়িতে এতোদিন পর মেহমান আসবে, ভালোই তো।
আশা চোখ বাকিয়ে তাকালো হিমার দিকে। ওর তাকানো দেখে হিমা শব্দ করে হেসে বলল
-কয়েক ঘন্টাই তো থাকবে। ওরা তো এসে আর থাকেনা তাইনা। এত টেনশন করোনা তো।
-ওকে, করলাম না টেনশন। কিন্তু এবার যে ওদের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে।
-করবো, এসো আমার সাথে।। পাশেই মনি বাবুকে কোলে নিয়ে বসেছিলো।
সে সামান্য বিস্ময় নিয়ে আশাকে বললো
-আশাপু একটা কথা বলবো?
-বল!
-আন্টির নাম রাবেয়া, আর উনার বোনের নাম আরশিয়া। দুজনের নামের তফাৎ টা আকাশ পাতাল না?
আশা একটা অট্রহাসি দিয়ে বললো
-আর বলিস না, আমার নানুমনি খালামণির নাম রেখেছিলো আছিয়া। কিন্তু খালামনি ছিলো খুব মডার্ণ, সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে স্টাইলিশ। তার একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে নিজের নামটাকে প্লাস মাইনাস করে আছিয়া থেকে আরশিয়া তে কনভার্ট করেছেন তিনি।
মনি হতবাক হলো। বললো
-বলো কি, নিজের নাম নিজেই রেখেছে?
-হুম।
বিকাল নাগাদ আশাদের বাড়ির সামনে একটা প্রাইভেট কার এসে দাড়ালো। গাড়ি থেকে একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এসে নামলো। রাবেয়া উঠোনেই ছিলো। গেইটের সামনে নিজের বোনকে দেখে উনি খুশিতে বিগলিত হলেন। মুখের মধ্যে হাসি টেনে উনি ছুটে গেলেন গেইটের সামনে।
আরশিয়ার কাছাকাছি গিয়ে উনাকে জরিয়ে ধরলো রাবেয়া। এতোদিন পর বোনে বোনে দেখা হয়েছে সেই খুশিতে দুইজনই বিগলিত। বোনকে কুশল বিনিময় করতে করতে রাবেয়া বললো
-তোর মেয়ে কোথায়?
-গাড়িতেই আছে বুবু।
-নামছে না কেন এখনো?
-গরম লাগছিলো গাড়িতে, তাই জুতা মোজা খুলে রেখেছিলো। এগুলো পরতেই একটু সময় নিচ্ছে হয়তো।
-ওহ।
-দুলাভাই কোথায় বুবু?
-বাইরে কোথাও আছে।
ওদের কথাবার্তার এক পর্যায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো এক মেয়ে। রাবেয়াকে দেখে মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো
-কেমন আছো খালামনি?
রাবেয়া কোনো জবাব না দিয়ে মেয়েটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো। পায়ে হাই হিল, পরণে জিন্স আর টপস। রাবেয়া তীব্র কন্ঠে বললো
-এইসব কি পরেছিস ছোকরী?
-ওহ খালামনি, বোকার মতো কথা বলোনা তো। এগুলোই তো ফ্যাশন।
-আমার সামনে মায়ের মতো ফ্যাশন ফ্যাশন করবিনা তো। কি হয় এতো ফ্যাশন করে?
মেয়েটি হাসলো। রাবেয়াকে এক হাতে জরিয়ে ধরে বললো
-এইসব তুমি বুঝবেনা। রুমে চলো।
রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম হিমার সাথে দেখা করলো মেয়েটি। ওর সাথে আলাপচারিতা শেষ করে আশার রুমে গেলো সে। আশাকে দেখে মেয়েটি বললো
-কেমন আছো আশা?
আশা ভ্রু বাকালো। ছোট থেকেই এই মেয়েটিকে সে পছন্দ করেনা। তবুও সামনে যেহেতু এসেছে মানবতার খাতিরে বলতে হলো
-ভালো আছি, তুমি ভালো আছো আরিশা?
-হুম ভালো আছি।
আরিশার চোখ গেলো এবার বিছানায় বসে থাকা মনির দিকে। সে আঁড়চোখে ওকে একনজর দেখে আশাকে বললো
-এই মেয়েটা কে?
-মনি, এই বাড়িতেই থাকে।
আরিশা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো
-ওহ, এখানেই থাকে। আই মীন আশ্রিতা?
মনি চমকে উঠলো। আশা বিরক্ত হয়ে বললো
-ওহ আশ্রিতা নয় আরিশা, ও এখানকার কোচিং টিচার। নিজের খরচেই চলে, নিজের টাকাতেই খায়।
আরিশা মুখ বাকিয়ে বললো
-ওও।
আশা মনির কাছে গিয়ে ওর কানে কানে বললো
-এই টেপরেকর্ডার এর কথায় কিছু মনে করিস না মনি, এইটা এসেছে তো, দেখবি সারাক্ষণ ক্যাসেটের মতো বেজেই যাবে।
চলবে….