মন মুনিয়া পর্ব-৩৩

0
905

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৩

দিগন্ত বিস্তৃত এক মরুভূমি, চারিদিকে খাঁ খাঁ করছে শূন্যতায়। এরই মাঝে ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে মনি। হাত বাড়িয়ে আকুতি মিনতি করে ডাকছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে।

ওর এই আকুতি মিনতি দেখে অট্রহাসিতে মেতে উঠেছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ব্যক্তিটা। মনি হতাশায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো তার এইরুপ আচরণে। এই ধু ধু মরুভূমির মাঝে এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে সে কিভাবে কি করবে? মাথায় আসছে না কিছু। তাহলে কি এখানেই সব শেষ?

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি মনির দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলে যেতে থাকে। মনি গগনবিদারী চিৎকারে ছুটে যেতে চায় তার দিকে। তবে এর আগেই চোরাবালির গর্তে সে পা দিয়ে ফেলে। মনি বাচ্চাটাকে চেপে ধরে আতংকে লোকটিকে আবারও ডাকে। লোকটি ফিরে তাকায় একবার। তবে এগিয়ে আসেনা সাহায্যের জন্য। ঠোঁটের কোনে এক বিস্তৃত হাসি টেনে সে এগিয়ে যেতে থাকে সামনে।।

মনি চিৎকার করে, এই চিৎকারে যেনো আকাশ পাতাল কেঁপে উঠে। এই কি তার শেষ গন্তব্য?
মনি আস্তে আস্তে চোরাবালির অতলে নিমজ্জিত হতে থাকে। শেষ পর্যায়েও এসেও মনি চোখদুটো বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে।

হটাৎ ই সে কারো স্পর্শ পায়। মনি চোখ মেলে তাকায় মুহূর্তে। বুকে প্রাণ আসে তার। কোনো এক মহান মানব তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। প্রসস্থ হাতখানা মনির দিকে এগিয়ে দিয়েছে উঠে আসার জন্য। মনি অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো সে মানবটির দিকে। মুখখানা অস্পষ্ট, ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা।

মনি হাত বাড়িয়ে দিলো সে মানুষটির দিকে। লোকটি খুবই সন্তর্পণে মনি আর ওর বাচ্চাকে টেনে তুলে আনলো চোরাবালির অতল গহ্বর থেকে।

প্রচন্ডরকম নিশ্বাস নিতে নিতে ঘুম ভাংগে মনির। মাথার উপর অবিরাম ভাবে পাখা ঘুরছে, তবুও ঘামছে মনি। এই মাঝরাতে এ কি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেংগে গেলো তার? এই স্বপ্নের মানেটাই বা কি? মনি পাশ ফিরে মুনিয়ার দিকে তাকায়। মেয়েটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। মনি লম্বা একটা শ্বাস টেনে বিছানা থেকে নামে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার।

মনি ধীরপায়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে নিরাশ হয় সে। জগটা একদমই খালি পরে আছে। সে রান্নাঘরের দিকে হাটা শুরু করে। রান্নাঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে সে গ্লাস ভর্তি করে পানি নেয়। ঢকঢক করে পুরো পানিটা শেষ করে সে আবারও ফিরে আসে।

নীলের রুমের সামনে দিয়ে ওদের রুমে যেতে হয়। যাওয়ার সময় সে খেয়াল করেছিলো নীলের রুমের লাইট জ্বালানো। তবুও সে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গিয়েছিলো।

এখন ইচ্ছে করছে একবার দেখুক, এতো রাতে নীল কি করছে? মনের ভিতর থেকে কেউ একজন তাড়া দিচ্ছে দরজায় টুকা দেওয়ার জন্য। মনি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ একভাবেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটার পর দোনোমনা করে দরজায় টুকা দিতে গিয়েও দিলোনা। এতো রাতে একজনকে এভাবে জ্বালানো ঠিক হবেনা। তাছাড়া উনিই বা কি ভাববেন?

মনি নিজের রুমের দিকে হাটা দেয়। এরই মধ্যে পিছন থেকে ওর ডাক আসে।
-মনি!
মনি থমকে দাঁড়ায়। নীল দরজা খুলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনি পেছনে ফিরে তাকায়। নীল হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে
-এতো রাতে কি করছো এখানে?
মনি অবাক হয়। সে থতমত খেয়ে বললো
-পা পানি খেতে গিয়েছিলাম।
-পিপাসা পেয়েছিলো?
-হুম।

নীল কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মনির দিকে। মনি বললো
-আমি গেলাম।
-আমার দরজার সামনে এসেছিলে তুমি?
মনির ভেতর এবার জড়তা কাজ করতে থাকে। সামান্য লজ্জায় শঙ্কিত হয় সে। নীল কি দেখে ফেলেছে ওকে?

নীল আবারও প্রশ্ন করলো
-বললেনা যে?
-আমিতো পানি খেতে গিয়েছিলাম। এতো রাতে আপনার দরজার সামনে গিয়ে কি করবো আমি?
নীল কি যেনো ভেবে বললো
-হবে হয়তো আমারই মনের ভুল। কেন যেনো মনে হলো, আমার দরজার সামনে তুমি এসেছিলে।
মনি মনে মনে ভাবলো, “উনি কিভাবে জানলেন এটা?”

মনি জড়তা নিয়ে বললো
-এতো রাতে আপনার রুমের লাইট জ্বালানো কেন?
-কাজ করছিলাম একটু?
মনি ভ্রু বাকিয়ে বললো
-এতো রাতে কাজ!!
-বিশ্বাস হচ্ছেনা? না হলে এসে দেখে যাও, আমি সত্যিই কাজ করছিলাম। উল্টাপাল্টা কোনো নেশা আমার নেই।

মনি হাসলো। নরম গলায় বললো
-আমি সেটা বলিনি। কি কাজ করছিলেন?
হটাৎ নীলের চোখেমুখে সামান্য বিষন্নতা দেখা দিলো। সে হতাশ গলায় বললো
-আমার ফিরে যাবার সময় হয়ে গেছে মনি। তাই সেখানকান কিছু কাজ সেড়ে নিচ্ছি।

নীলের বলা কথাটা মনির মনের মধ্যে একটা জোরেশোরে ধাক্কা দিলো। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তার, এটা কি বললো নীল। মনের মধ্যে থাকা এই অস্পষ্ট প্রশ্নকে জানার চেষ্টায় মনি বললো
-কোথায় যাবার সময় হয়েছে আপনার?
নীল হাসলো। তবে সে হাসি জোরপূর্বক হাসি সেটা বুঝে গেছে মনি।।
-আমার লন্ডন যাবার সময় হয়ে গেছে। স্টাডি শেষ হয়নি তো।। আরো দুইবছর বাকি আছে।

মনি কিছু বলতে পারলোনা আর। কেন জানি মুখ দিয়ে কোনো কথায় তার বের হচ্ছেনা। সে ফিরে যেতে চাইলো নিজের রুমে।

নীল পিছন থেকে ডাকলো মনিকে। মনি দাঁড়িয়ে পরলো নিজ যায়গায়। তবে নড়াচড়া করলোনা। নীল ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো
-তুমি কিছু বলবেনা?
-আমি কি বলবো?
-আমি চলে যাচ্ছি মনি। কিছু বলার নেই তোমার?
মনি নিরব। সে কি বলবে, কি করবে? কিছুই করার যে নেই তার।

ইদানীং নীলের প্রতি একটা টান অনুভব করে সে। কিন্তু এটা কিসের টান? এই টানের মানেই বা কি? ও এক ধর্ষিতা মেয়ে, তার উপর একটা মেয়েও আছে। ওর কি কারো প্রতি এইসব টান থাকা মানায়?

নীল দুইহাতে মনিকে নিজের দিকে ফেরায়। মনি নিশ্চুপ, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নীল উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
-কিছু বলো প্লিজ। তুমি বললে আমি থেকে যাবো বাংলাদেশে, কোথাও যাবোনা।

মনি অবাক হয়। সে চমকে তাকায় নীলের দিকে। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে
-কেন, কেন আপনি আমার কথায় থেকে যাবেন? কি হই আমি আপনার?
নীল মনির দুপাশ থেকে হাতদুটো ছেড়ে দেয়। অসহায় কন্ঠে বলে
-আমি জানিনা মনি, তুমি আমার কি হও, আমিই বা তোমার কি হই, আমি কিচ্ছু জানিনা। তবে কেন জানি মানতে পারছিনা আমি চলে যাচ্ছি।

-তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা মনি, আমিতো নিজের বাবা মা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে এর আগেও গিয়েছি, তখন কিন্তু আমার এমন অনুভুতি হয়নি। এবারেও তাদের প্রতি এমন অনুভূতি হচ্ছেনা মনি। কষ্ট হচ্ছে নিজের ফ্যামিলি ছেড়ে যেতে, তবে মনের মধ্যে বার বার তোমার মুখটা ভেসে আসছে। বার বার মনে হচ্ছে, চলে গেলে তোমার ওই মায়াবী মুখটা আমি মিস করবো। তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো, মুনিয়াকে দেওয়া সময়টুকু, তোমার ওই অদ্ভুত চাহনি, সবকিছুই মিস করবো।

মনি অদ্ভুতভাবে তাকালো নীলের দিকে। মনির প্রতি এইরূপ অনুভূতি নীলের মধ্যে বিদ্যমান, সেটাতো আগে টের পায়নি? এ অস্তিত্বের নাম কি?

নীল আবারও মনির দিকে তাকায়। শান্ত গলায় বলে
-আমার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে মনি, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মুনিয়াকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কেমন যেনো এক অনুভূতি হচ্ছে আমার। এ অনুভূতির নাম কি?
-আমি জানিনা। নিচের দিকে তাকিয়ে বললো মনি।

নীল আবার দুইহাতে মনির দুপাশ চেপে ধরলো। জোরালো গলায় বললো
-জানিনা বললে হবেনা। বলো, আমার কেন এমন হচ্ছে? বার বার কেন মনে হচ্ছে, তোমাকে ছেড়ে গিয়ে আমি থাকতে পারবোনা?
-বললাম তো আমি জানিনা।
-আমি জানি।

নীলের কথায় চমকে ওর চোখের দিকে তাকালো মনি। নীল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনির দিকে। দৃষ্টিতে তার প্রচন্ড আকাঙ্খা, চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুরে পিপাসার্ত মানুষের মধ্যে যে তৃষ্ণা বিদ্যমান, তার চাইতে হাজারগুণ বেশি তৃষ্ণা নীলের চোখের সে দৃষ্টিতে। মনি চোখ নামিয়ে নিলো। আমতাআমতা করে বললো
-কিহ, কি জানেন?
-এই অনুভূতির নাম।
-তাই?
-হুম।
-কি নাম?
-ভালোবাসা। আমি তোমাকে ভালোবাসি মনি, বিশ্বাস করো।

মনির মনের ভিতর হটাৎ ই ঝর বেয়ে গেলো। সে ঝরে ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে তার। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছেনা। সে নীলের কাছ থেকে নিজেকে চটজলদি ছাড়িয়ে নিলো।। বললো
-আপনি পাগল হয়ে গেছেন। মাঝরাতে আপনার মাথায় ভীমরতি ধরেছে।
-আমার মোটেও ভীমরতি ধরেনি। আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই আছি। অনেক ভেবেই তোমাকে এ কথাগুলো বলছি মনি।

-আপনার মধ্যে যদি এমন কোনো অনুভূতি হয়ে থাকে, তাহলে বলবো, এটা ভালোবাসা নয়। এটা মোহ। কিছুদিন পরই এই মোহ কেটে যাবে।

নীল মনিকে আচমকা নিজের দিকে টেনে নেয়। দুহাতে শক্ত করে মনিকে বুকের সাথে চেপে ধরে। আবেশে বলে
-আমি মোটেও মোহের মধ্যে নেই মনি। আমি ইন্টার পড়ুয়া কোনো ছাত্র নয় যে এখনো মোহতেই ডুবে থাকবো। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাস করো…

মনি নিজেকে নীলের হাতের বন্দী থেকে আবারও ছাড়িয়ে নেয়। শক্ত গলায় বলে
-বিশ্বাস করিনা আমি, কিছুতেই বিশ্বাস করিনা। জীবনে প্রথমবার কাউকে বিশ্বাস করে ঠকেছিলাম। আর কাউকে বিশ্বাস করতে চাইনা আমি।

মনি দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে। আর এক মুহুর্ত সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। নীলের মুখে মুখে এতো শক্ত কথা বলতেও ইচ্ছে করছেনা তার। এ মায়াময় মুখাবয়বের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকা সম্ভব না। পাছে, মুখ ফসকে যদি বেরিয়ে আসে, সেও নীলকে অসম্ভব রকমের ভালোবেসে ফেলেছে। মনি চায় না এটা বলতে, নীলকে জানতে দেওয়া যাবেনা এটা। সামনে দারুণ এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে নীলের জন্য। ওর এই অভিশপ্ত জীবনে নীলের মতো একজনকে সে জড়াতে চায় না কখনোই।

নীল এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে আগের যায়গায়। বুকফাটা আর্তনাদ করতে ইচ্ছে করছে খুব। বার বার বলতে ইচ্ছে করছে,
“তুমি মানো কিংবা না মানো, আমি তোমাকেই ভালোবাসি মনি”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here