মন মুনিয়া পর্ব-৩৪

0
888

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৪

ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করলো মনি। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। কুরআন তেলাওয়াত শেষ করে যখন উঠে বসলো, তখন ভোরের আলো ফুটেছে মাত্র। মনি বিছানার এক পাশে গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসলো। মুনিয়া এখনো ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটা অন্যসব বাচ্চাদের মতো জ্বালাতন করেনা। পেটে খিদে এলে তখন একটু কান্না করে। তাই মুনিয়াকে নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা হয়না মনির।

মনি দরজা খুলে বাইরে বেরোয়। রাবেয়া ছাড়া আর কেউই এখনো উঠেনি এইসময়। তিনি হয়তো এখনো জায়নামাজ বিছিয়ে বসে আছেন। মনি ধীরে ধীরে ছাদে উঠে। ভোরের এই ফুরফুরে হাওয়ায় ছাদ বাগানের ফুলের সুঘ্রাণ মো মো করছে। এই মুহুর্তটা মনিকে খুব কাছে টানছে।

বাগানে উঠে বসার যায়গাটাতে গিয়ে বসলো মনি। কিছু ফুল ফুটে আছে, কলিগুলো মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জানান দিচ্ছে, এরাও শীঘ্রই বেরিয়ে আসবে। মনি অপলকভাবে তাকিয়ে রয়েছে সেগুলোর দিকে।

হটাৎ ই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে হয়ে যায় মনির। ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠে তৎক্ষনাৎ। মনি ভাবতে থাকে, “নীল কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে? নাকি নিয়ানের মতো শুধু ব্যবহারই করতে চায়?”
ওই নিয়ানকেও তো আমি অনেক বিশ্বাস করেছিলাম, যদিও সেটা ছিলো বন্ধুত্বের জন্য। কিন্তু বিশ্বাস ছিলো তো!

মনির চোখমুখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। সে আর বসে থাকতে পারছেনা এখানে। তাই চটজলদি উঠে নিচে চলে গেলো তৎক্ষনাৎ।

বেলা প্রায় ১০ টা,
মুনিয়াকে খাইয়ে দিতেই হিমা ওকে নিয়ে চলে গেলো। মনি তখন মুনিয়ার পরনের জামা কাপরগুলো ধোয়ার জন্য বন্দোবস্ত করছে। এমন সময় আশা এসে দাড়ালো ওর কাছে। মনি হাসিমুখে বললো
-কিছু বলবে আশাপু?
-হুম।
মনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো
-বলো আশাপু।
-তুই এখনো রেডি হোস নি কেন?
-রেডি হবো কিসের জন্য?
-তোর না ভাইয়ার সাথে কোথায় যাবার কথা?

হটাৎ মনির মুখের অবয়ব পালটে গেলো। সে থমথমে মুখে অন্যদিকে ফিরে বললো
-আমি যাবোনা আশাপু।।
-ওকে বলে দে আশা, যেতে ওকে হবেই। না গেলে বস্তায় ভরে হলেও নিয়ে যাবো।

নীলের কথায় চমকে তাকায় মনি। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নীল। আশা মুখ টিপে হাসছে। মনি সেটা খেয়াল করে ভ্রু বাকিয়ে বললো
-তুমি হাসছো কেন?
আশা হাসতে হাসতে বললো
-উপলব্ধি করছি মনি, যখন তোকে বস্তায় ভরবে আর তুই বস্তা থেকে বেরোবার জন্য ছটফট করবি।। কিন্তু বেরোতে পারবিনা। ভাইয়া সেইসব কিছুকে অগ্রাহ্য করে তোকে শুদ্ধ বস্তাটা কাধে ফেলে হাঁটতে শুরু করবে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না?
মনি মুখ বাকালো।

নীল দরজার সামনে দাড়িয়ে থেকেই বলল
-বাকিটাও বলে দে তোর বান্ধবীকে।
-বাকিটা আমি জানিনা। তুই বল..
-বস্তাটাকে নিয়ে কোনো ময়লার স্তুপে ফেলে দিয়ে আসবো।। ময়লাকর্মীরা বড় একটা ময়লার ট্রাকে করে বড় কোনো ময়লা ভেবে ওকেও নিয়ে যাবে।
নীলের কথায় চোখ বড় করে তাকালো মনি। আশার হাসির পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনি সামান্য রাগান্বিত গলায় বললো
-বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

নীল সে কথার উত্তর না দিয়ে আশার দিকে তাকালো। গম্ভীরমুখে বললো
-ওকে তারাতাড়ি বল রেডি হতে। আমি যেনো ফিরে এসে দেখি ও তৈরি।

নীল বেরিয়ে গেলে আশা একগাল হেসে মনির দিকে তাকাল। মনির কপালে সুক্ষ্ম ভাজ, চোখেমুখে দুঃশ্চিতার ছাপ। উনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবার জন্য এতো তাড়া দিচ্ছেন? কদিন পর উনি লন্ডন চলে যাবেন, নিজের কাজই জমা পরে আছে। সেগুলো ছেড়ে আমাকে নিয়ে পরেছেন কেন? গতরাতে যা হলো, তার পর তো এমনটা করার কথা ভাবাও উচিত ছিলোনা উনার। তাহলে?

কোনো বাজে মতলব নেই তো? নিয়ানের মতো উনিও কি ভালো মানুষ সেজে ধোঁকা দিচ্ছেন আমায়?

মনির মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। আশা সামান্য কেশে বললো
-চিন্তা করা হয়ে গেছে মনি?
মনি আশ্চর্য ভাবে তাকালো আশার দিকে। চিন্তিত গলায় বললো
-আমাকে উনি কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন আশাপু?
-আমি কি করে জানবো।
-তাহলে তুমিও আমাকে এতো তাড়া দিচ্ছো কেন?
-ভাইয়া যেহেতু নিজে থেকে তোকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে, তাহলে নিশ্চিত থাক, কোনো বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছেনা। তোর ভালোই হবে আশা করি। বাজে কোনো উদ্দেশ্য থাকলে এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে তোকে নিয়ে যাবার নামও নিত না।

মনি আবারও চিন্তার সাথে বললো
-সেটা বলছিনা আশাপু। যদি আমার কোনো উপকার করার উদ্দেশ্যেই উনি আমাকে নিয়ে যাবে, তাহলে বলতে অসুবিধা কোথায়?
-সেটা আমি জানিনা। এতো প্রশ্ন করিস না তো। রেডি হয়ে নে তারাতাড়ি।

মনি আর কোনো কথা বাড়ালোনা।

নীলের সাথে মনি এক অজানা গন্তব্যে পা দিয়েছে প্রায় আধঘন্টা হয়েছে। এর মধ্যে নীল কয়েক দফা এটা ওটা নিয়ে মনিকে প্রশ্ন করেছে, কিন্তু মনি নির্বাক। সে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে আনমনে বসে আছে। নীল এবার এক ধ্যানে তাকালো মনির দিকে। মনির কোনো হেলদোল নেই। নীল প্রশ্ন করলো,
-কথা বলবে না আমার সাথে?
মনি এবার তাকালো নীলের দিকে। নীলের চোখের দৃষ্টি খুবই গভীর।
-কি হবে কথা বলে?
-হতেও তো পারে কিছু।
-আমি চাইনা কিছু হোক।

নীল সামান্য ঢোক গিললো। ধীর গলায় বললো
-রেগে আছো?
-নাহ।
-তাহলে সুন্দর করে কথা বলো।
-পারিনা।
নীল হাসলো এবার। পরম আবেশে বললো
-আমাকে কি একটুও ভালো বাসা যায়না?
মনি নীলের কথায় কোনো নড়াচড়া করলো না। শুধু ছোট্র করে বলল
-সম্ভব না।

নীল আর কথা বাড়ালোনা।
কয়েক ঘন্টার জার্নি সেড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে গাড়ি থামলো। এর মধ্যে সিটে হেলাম দিয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলো মনি। বাস এসে স্টপেজে থামলে নীল ডাকলো মনিকে। একটা ডাক দিতেই মনি চোখ মেলে তাকালো।। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো সে নীলের দিকে।
নীল হেসে বললো
-গাড়ি থেকে নামতে হবে যে এবার।

মনি নীলের পিছু পিছু বাস থেকে নামলো। বাস থেকে নামার পথে নীলকে প্রশ্ন করলো,
-এখানে আমরা কেন এসেছি?
-নামলেই জানতে পারবে।

নীলের হেয়ালি কথা মনির মাথায় ঢুকেনা। নীল নেমে গেলে মনিও নেমে এলো বাস থেকে। চারপাশটায় তাকাতেই চমকে উঠলো সে। এটা তো তার নিজের এলাকা। মনি অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকালো। বলল
-আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?
নীল হাসলো। চোখের ইশারায় সে মনিকে সামনে তাকাতে বললো। মনি নীলের দৃশ্য অনুসরণ করে সামনে তাকালো।

একজোড়া চোখ তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো অশ্রুসিক্ত। মনির চোখের বাধও আর মানলোনা। মুহুর্তেই চোখ বেয়ে তার অশ্রুধারা বেরিয়ে এলো। একবার সে হতবাক হয়ে নীলের দিকে তাকালো। নীল সামনের দিকে তাকিয়েই বললো
-যাও মনি, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন উনি।

মনি আর অপেক্ষা করলোনা। এক দৌড়ে চলে গেলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটির দিকে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে এক পর্যায়ে জরিয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো
-মা, ও মা!
মনির মাও কেঁদে চলেছে অবিরাম ভাবে। এতোটা দিন পর মেয়েকে দেখে তিনিও আর নিজের দমাতে পারছেন না।

দুই মা মেয়ের মধ্যে এক অমলিন অস্তিত্ব জেগে উঠেছে আজ।। মনি কাঁদতে কাঁদতে বললো
-কেমন আছো মা?
-ভালো নারে মা। তুই নাই, কেমনে ভালা থাকি। তুই কেন চইলা গেছিলি আমাগো ছাইড়া? তোরে ছাইড়া কেমনে থাকমু আমরা একবারও কেন ভাবলিনা?

মনি এবার এবার সোজা হয়ে দাড়ালো। চোখের পানিগুলো হাতের তালু দিয়ে মুছতে মুছতে বললো
-আসলে আমি..
মনির মা বললো
-আমি সব জানি মনি।
মনি অবাক হয়ে বললো
-তুমি জানো মা? কি জানো, কিভাবে জানো?
-আমি বলেছি মনি।।
মনি নীলের দিকে তাকালো। নীল এগিয়ে এসে বললো
-আমি তোমায় সেদিন বলেছিলাম তোমাদের এলাকায় এসেছি। সেদিন শুধু এলাকাতেই না, তোমাদের বাড়িতেও গিয়েছিলাম।
মনি অবাক হলো। বিস্ময়ে বললো
-আমাকে তো বলেন নি।
-বললে কি হতো? বাবা মায়ের কথা মনে করে আবারও কাঁদতে তাইতো। আমি দিনের পর দিন দেখে এসেছি, তুমি তোমার পরিবার ছেড়ে কতোটা অসহায়ের মতো করে দিন কাটিয়েছো মনি।

মনি কিছু বললোনা আর। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-আব্বা কেমন আছে মা?
-ভালো না রে মা। মানুষটা কেমন জানি হইয়া গেছে। তুই চইলা আওনের পর থেইকা উনি ঠিকমতো খায় না, ঠিকমতো গোসল করেনা। মাঝে মাঝে রাইতে ঘুমের মইধ্যে তোর নাম কইরা ডাকে। অসুখে ভুগতাছে মানুষটা।
বাবার অবস্থা শুনে মনির খুব কান্না পেলো। কতোটা কষ্ট দিয়েছে সে বাবা মাকে। কিন্তু সেদিন না গিয়েও তো কোনো উপায় ছিলোনা। জয়নালের মতো একটা বদমাইশের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যেতো।

নীল এবার বললো
-তুমি কি বাড়িতে যাবেনা মনি? আংকেল অসুস্থ, উনাকে দেখে আসবেনা?
-কেমনে যামু? কোন মুখে আব্বারে আমি এই মুখ দেখামু। যদিও জয়নাল বদমাইশ ছিলো, কিন্তু আমার কারণে তো আব্বার মুখ পুড়ছে, মানুষে হয়তো আব্বারে নানান কথা শুনাইছে।
-এইসব কিচ্ছু হই নাই মনি।
-হয়নি? অবাক হয়ে বললো মনি।
-না, জয়নাল সেদিন আয় নাই বিয়া করতে, আইবো কেমনে, আমাগো বাড়ি আওনের আগেই পুলিশ ওরে ধইরা নিয়া গেছিলো। অহনো হে জেলেই আছে।
মনি একটা লম্বা শ্বাস টানলো।

মনির মা বললো
-মুনিয়া রে আনোস নাই মনি?
মনি চমকে তাকালো মায়ের দিকে। অস্পষ্ট গলায় বললো
-মুনিয়ার কথা তুমি জানো মা?
-আমারে সবই কইছে নীল বাবাজি।
মনির মা হটাৎ ই কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো
-তুই আমারে আগে কেন কস নাই মা, তোর উপর দিয়া এতো তুফান গেছে, আর আমি টেরই পাইলাম না। আমারে একবার কইতি, দেখতি আমি কি করি।। মায়েরে তুই বিশ্বাস কইরা একবার কথাটা কইলি না মনি।
মনিও কাদঁলো, অশ্রু ভেজা কন্ঠে বললো
-আমারে মাফ করে দিও মা।

চলবে….

যারা যারা এখনো গ্রুপে জয়েন করোনি, তাদের কাছে অনুরোধ,,, তোমরা গ্রুপে জয়েন করে পাশে থাকো🙂
গ্রুপ লিংকঃ https://facebook.com/groups/599171584476188/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here