#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৫১
ঠিক কতোটা সময় পার হলো জানা নেই। যখন হুশ এলো, শ্রাবণ দেখতে পেলো আশাপাশের ছেলেমেয়েরা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চট করে সে আশাকে ছেড়ে দিলো। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। ওদিকে, হটাৎ করে এভাবে আশাকে ছেড়ে দেওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে সে ধপাস করে মাটিতে পরে গেলো। সাথে সাথেই মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো
-ওমাগো, ও বাবাগো…
একটু আগে সে ব্যাথা পাবার অভিনয় করলেও এবার সে একটুও অভিনয় করছেনা। ব্যাথাটা বোধহয় বেশিই পেয়েছে এবার। এতোক্ষণ মিথ্যা বলার পরিণাম এটা। শ্রাবণ তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো আশার দিকে। কন্ঠে সামান্য তেজ এনে বললো
-এই ম্যাডাম, আপনি বার বার পরে যাচ্ছেন কেন শুনি? মেরুদণ্ড কি আছে নাকি গেছে?
আশা অভিমানী চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে। নেকি গলায় বললো
-আপনার কারণেই আমি পরছি। বার বার পরছি। পিছলে গিয়ে পরছি, ধপাস করে পরছি, প্রেমে পরছি… আরো কতোভাবে যে পরছি।
শ্রাবণ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এ মেয়ে বলে কি। প্রেম পরছে মানে? আশার হটাৎ খেয়াল হলো সে কি বলেছে। সাথে সাথে দাতে জিভ কেটে শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণ এখনও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
আশা এবার আর শ্রাবণের আশায় না থেকে নিজে নিজেই উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু এবার সে বেশিই ব্যাথাটা পেয়েছে। নেহাত আগে অভিনয় করেছিলো, তার জন্য আর শ্রাবণকে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছেনা। যদি শ্রাবণ অভিনয়ের ব্যাপারটার কিছুই জানেনা।।
আশাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে মনের মধ্যে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করলো শ্রাবণ। এই মেয়েটার সাথে একসময় সে ঝগড়া করতো, একসময় ওকে পেত্নী, শাকচুন্নি বলে খেপাতো।।তবে এখন আর এইসব মনে হয় না। কেন জানি আশাকে ওর কাছে একটা পুতুলের মতো লাগে। রাজকন্যা পুতুল।
শ্রাবণ আশেপাশে ছাত্রছাত্রীদের পরোয়া না করে এবার নিজ দায়িত্বে আশাকে ধরলো। খুবই সন্তর্পণে ওর পিঠে হাত থেকে আলতো করে জরিয়ে ধরে উঠানোর চেষ্টা করলো। আশা থমকে গেলো এবার। নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। এতোটাও হয়তো আশা করেনি সে। এ যেনো মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি পাবার মতো। আশা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ দায়িত্ববান পুরুষের মতো আশাকে আগলে ধরে সামনের কমন রুমটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আশা নির্বাক। তবে চোখগুলো কথা বলছে।
কমনরুমের কাছাকাছি যেতেই উনার এক সহকর্মীর সাথে দেখা হয়ে গেলো হটাৎ। উনি আঁড়চোখে আশাকে ধরে রাখা হাতটার দিকে বার বার চোখ দিচ্ছেন। ব্যাপারটা প্রথমদিকে শ্রাবণ পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে বিরক্তির পর্যায়ে চলে গেলো। সে নিজে থেকে লোকটি কে উদ্দেশ্য করে বললো
-কিছু বলবেন?
-উনি কে? এভাবে ধরে রেখেছেন যে? আপনার কি হয়? প্রেমিকা???
আশা লজ্জা পায় লোকটির কথায়। আবার অবাকও হয়। কোনো কলেজের টিচার এভাবে প্রশ্ন করতে পারে? শ্রাবণ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো
-আমার ফিয়ন্সে। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো, ব্যাথা পেয়েছিলো। তাই টেইক কেয়ার করছি। আরো কিছু জানতে চান?
লোকটি দাঁতকপাটি বের করে হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো
-আরে না না, যা জানার জেনে গেছি। ভাবিকে ভালো করে কেয়ার করুন। আজকাল কার মেয়ে। কোনো গ্যারান্টি নেই। কেয়ারিং এ একটু খামতি হলেই অন্য কারোর সঙ্গ নিবে।।
শ্রাবণ বিরক্ত হলো উনার কথায়। তবে, উত্তর দিলোনা। ক্লাস টাইম থাকায় কমনরুমে কেউ ছিলোনা সেই মুহূর্তে। আশাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে মাথার উপর ফ্যানটা ছেড়ে দিলো শ্রাবণ।। এরপর একটা বোতলে করে পানি এসে আশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
-পানিটা দিয়ে চোখমুখ টা একটু ধুয়ে নাও। দুই ঢোক পানি খেয়ে নিও। ভালো লাগবে।
আশা অবাক হয়। শ্রাবণকে সে যতোটা ভালো ভেবেছিলো, বাস্তবে সে তার চাইতেও অধিক পরিমাণে ভালো।
আশাকে চিন্তারত অবস্থায় দেখে শ্রাবণ আবারও তাড়া দিয়ে বললো
-কি হলো, বসে আছো কেন। যেটা করতে বলেছি সেটা কর।
আশা শ্রাবনের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে বললো
-ও হ্যাঁ, করছি।
আশা চোখমুখ ধুয়ে বোতলটা শ্রাবণের দিকে এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ গম্ভীরমুখে বললো
-পানি খাও।
আশা বাধ্য মেয়ের মতো পানি খেলো। এরপর শ্রাবণ একটা চেয়ার টেনে আশার পাশে বসলো। শান্ত গলায় বললো
-এখানে কেন এসেছিলে?
শ্রাবণের প্রতিটা কথা আশা গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের মধ্যে সে আছে কি নেই তাও হয়তো তার জানা নেই। শ্রাবণের মায়ায় সে ডুবে আছে। ঘোরের মধ্যে থেকেই আশা উত্তর করলো
-আপনাকে দেখতে।
-কেন?
-ভালোবাসি তাই।
-দেখা হয়েছে।
-নাহ।
-দেখলে তো।
-আরো দেখতে চাই। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা দেখতে চাই। ঘুম থেকে উঠে দেখতে চাই, ঘুমাতে যাবার আগে দেখতে চাই। অলটাইম দেখতে চাই।
আশার কথায় শ্রাবণ হাসলো।ওর হাসি থেকে আশা আরো গভীরে হারিয়ে যেতে চাইলো। এক পর্যায়ে শ্রাবণের গালে হাত ছোয়ালো আশা। ছোট্র বাচ্চাদের গাল টেপার মতো শ্রাবণের গালদুটো টিপে বললো
-আপনার গালগুলো খুব নরম, একদম মুনিয়ার মতো।
-মুনিয়া কে?
-আমার আম্মু।
শ্রাবণ বুঝলো, আশা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে আজ। সে বোতল থেকে হাতে পানি নিয়ে আশার মুখে ছিটিয়ে দিলো। আশার হুশ এলো। পুর্বে কি বলেছে সব মাথাতে এলো, কিন্তু তাতে কোনো পরিবর্তন এলোনা তার মাঝে। সেতো মিথ্যে কিছু বলেনি, সত্যিই বলেছে।।
শ্রাবণ তাকিয়ে আছে আশার দিকে। আশা এবার স্বাভাবিক গলায় বললো
-উনাকে আমার পরিচয় টা মিথ্যে কেন দিলেন?
-আমাদের কলেজের সবচেয়ে জটিল মনের লোক উনি। যদি সত্যটা বলতাম, এতোক্ষনে বাজে কথা ছড়িয়ে পরতো সবার কানে কানে।
-তবুও তো উনি শিক্ষক মানুষ।
-শিক্ষক হলেই যে সাধু মনের অধিকারী, কথাটা কোথাও লেখা পেয়েছো?
-নাহ।
-তাহলে.?
আশা উত্তর দিলোনা। শ্রাবণ বললো
-বাসায় যেতে পারবে?
-নাহ।
-তাহলে বসে থাকো। ক্লাস শেষ হলে তোমার ওই ভাবীর সাথে একসাথে যেও।
আশার মুখটা চুপসে গেলো হটাৎ। সে ভেবেছিলো শ্রাবণ হয়তো নিন দায়িত্বে আশাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। শ্রাবণ চলে যেতে চাইলে আশা উনাকে পিছন থেকে বললো
-লেডিস কমনরুমে এতোটা সময় আমার সাথে ছিলেন, বদনাম রটবে না?
-বদনাম রটুক। তাতে কাজটা দ্রুত সেড়ে ফেলা যাবে।
আশার মাথার উপর দিয়ে গেলো কথাটা। উনি এই কথার মাধ্যমে কি বুঝাতে চাইছেন?
কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো কিভাবে যেনো। আশা এখনো আগের যায়গাতেই বসে আছে। মাঝে মাঝে দুই একজন মেয়ে কমনরুমে আসা যাওয়া করছে। ফাঁকে ফাঁকে আশাকে আঁড়চোখে দেখছেও। আশা ব্যাপারটা পাত্তা দেয় নি। যদিও সে বাসায় যেতে পারার মতো অবস্থায় আছে। কিন্তু সে ভাবলো, এতোটা সময় যেহেতু এখানে আছেই তাহলে আর কিছুটা সময় থেকে একবারে মনিকে সাথে করে নিয়েই যাবে।
এভাবে আরো কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো। এক যায়গায় বসে থাকতে থাকতে আশার ঝিমুনি এসে গেছে হটাৎ। চোখটা বুঝে আসতেই কেউ ভাঙ্গা গলায় ডাকলো আশাকে।৷ আশা ধরফরিয়ে তাকালো সামনের দিকে। একটা অল্প বসয়ের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। হাতে একটা ট্রেন। তাতে একটা চিকেন বার্গার আর মগ ভর্তি ব্ল্যাক কফি। আশা কিছুটা অবাকই হলো। সে পশ্ন করলো
-কে তুমি?
-আমি রিপন। এই কলেজের ক্যান্টিনে কাম করি।
-ওগুলো এখানে নিয়ে এসেছো কেন?
-আপনের লাগি।
-আমার জন্য? অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো আশা।
-হো।
-আমি তো এসব আনতে বলিনি।
-শ্রাবণ স্যার আমারে দিয়া পাঠাইলো। আপনেরে দেখাইয়া কইলো, আপনের কাছে দিয়া যাইতে।
আশার মনের মধ্যে লাড্ডু ফুটছে মনে মনে। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে খুব। আশা ট্রে থেকে খাবারগুলো হাতে নিয়ে সামনের একটা চেয়ারে রাখলো। ছেলেটি চলে গেলে আশা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বাইরে ক্যান্টিনের দিকে তাকালো, শ্রাবণকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আশা হতাশ হল। তবে কি লোকটা সাথে সাথেও উধাও হয়ে গেলো?
আশা বার্গারে কামড় বসালো। পাশে কফির মগটা থেকে ধোঁয়া উড়ছে অবিরত ভাবে।
____________
বিকেলে ছুটির পর আশার সাথে একসাথে কলেজ থেকে বেরোনার প্রস্তুতি নিলো মনি। যদিও আশার পা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, গায়েও কোনো ব্যাথা নেই। তবে, গেইটের সামনেই শ্রাবণ দাঁড়ানো আছে দেখে আশার পায়ের ব্যাথাটা বেড়ে গেলো হটাৎ। সে মনিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে লাগলো। হটাৎ এমন করায় কিছুটা হতবাক হয়ে গেলো মনি। বিস্ময়ে বললো
-এই তো ভালো ছিলে, এখন আবার কি হয়ে গেলো তোমার?
-যা দেখছিস দেখে যা। এতো কথা বলিস না তো।
মনি কপাল বাকিয়ে বললো
-আচ্ছা।
শ্রাবণ আড়চোখে তাকিয়ে আছে আশার দিকে। আশা নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মনি একবার শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আশার দিকে। পরক্ষণে সবটা বুঝতে পেরে হেসে বললো
-ডাল মে কুচ কালা হে!
আশা মনির দিকে তাকিয়ে বললো
-তুই হিন্দি বলা শুরু করলি কেন আবার।
-টিভি দেখে শিখছি, এই একটা কথায়।
কথাটা বলে হেসে ফেললো সে। আশাও হাসলো৷
চলবে…..
[রিচেক দিয়ে এডিট করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন]